অ্যান্টি ড্যুরিং কেন পড়তে হয়?

সৌভিক ঘোষ

১৮৬৫ থেকে ১৮৭৮। এই পর্বে জার্মানির এক অধ্যাপক ইউজিন ড্যুরিং এমন এক 'সিস্টেম' গড়ে তোলার দাবী জানান যা একইসাথে পুঁজিবাদ এবং মার্কসীয় প্রজ্ঞানুবর্তী সাম্যবাদের বিরুদ্ধে এক প্রকৃত বিজ্ঞানসম্মত বিশ্ব সমাজব্যাবস্থা! ইউজিন ড্যুরিং জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন – তার কৃতিত্ব সম্পর্কে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকমন্ডলী এমনই অভিভূত ছিলেন যে তাকে বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং রাজনৈতিক অর্থনীতি- তিন বিষয়েই অধ্যাপনার সুযোগ দেওয়া হয়।

ইউজিন ড্যুরিং

ইউজিন ড্যুরিং জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একজন উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব হয়ে বসেন। শুরুর দিকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির পত্রিকা ভরোয়ার্টস-এ তার প্রতিভাস্ফুরিত ধারাবাহিক নানা লেখার ভক্ত হয়ে ওঠেন এডুয়ার্ড বার্নস্টেইন, অগাস্ট বেবেল এমনকি উইলহেলম লিবনেখটও। অবশ্য কয়েকবছরেই লিবনেখট’র মোহমুক্তি ঘটে। তিনি উপলব্ধি করেন সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাসি না, ড্যুরিং আসলে নিজেকেই নরশ্রেষ্ঠ প্রমাণে সচেষ্ট।

দার্শনিক কান্ট এবং ফ্যুরিয়ের-কে শিশুসুলভ, হেগেল-কে বড় বেশি বুনিয়াদি, ডারউইনের আবিষ্কারকে 'মানবতার বিরুদ্ধে এক বর্বরোচিত আঘাত' বলে তার ঢাকপেটানো শুরু হয়। এখানেই না থেমে ড্যুরিং সাহেব আরও বিশেষ মর্যাদা পেতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন। শেষ অবধি পালের গোদা হিসাবে কার্ল মার্কস প্রসঙ্গে 'অত্যন্ত সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সম্বলিত, দুর্বল যুক্তি ও অভাবি মনোনিবেশের সমাহারে বিশিষ্ট এমন একজন- আড়বোঝা তর্কের ভারে যিনি ন্যুব্জ। জঘন্য সব লেখার ধরন, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক মতবাদের দিক থেকে পশ্চাদপদও তিনি' গোছের কথাবার্তা বলে ফেলেন। স্বাভাবিকভাবেই ততদিনে ড্যুরিং বুদ্ধিজীবী বলে চিহ্নিত ও বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছেন। তার লেখা বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে। যেমন-

Kapital und Arbeit (Germ) – Capital and Labour (1865)

Der Wert des Lebens (Germ) – The Value of Life (1865)

Natürliche Dialektik (Germ) – The Natural Dialectic (1865)

Kritische Geschichte der Philosophie (von ihren Anfängen bis zur Gegenwart) Germ – The Critique to Philosophy (From its beginning to the present day) (1869)

Kritische Geschichte der allgemeinen Principien der Mechanik (Germ) – Critical History of the General Principles of Mechanics (1872)

Kursus der National und Sozialokonomie (Germ) – The Course of the National and Socail Economy (1873)

Kursus der Philosophie (Germ) – Course of the Philospohy (1875)

Wirklichkeitsphilosophie; Logik und Wissenschaftstheorie (Germ) – Theory of Philospohy, Logic and of Science (1878)

ইটালিকসে মূল নামগুলি জার্মান ভাষায়, হাইফেনের পাশে উল্লিখিত ইংরেজি নাম বর্তমান লেখকের নিজস্ব অনুবাদ।

জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সিদ্ধান্ত নেয় ড্যুরিং-এর এইসব কথাবার্তার একটা 'উপযুক্ত জবাব' দিতে হবে। সেই মুসাবিদাটি লেখার দায়িত্ব নেবেন ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস! ১৮৭৫ সালে লিবনেখট সেই উদ্দেশ্যেই দুবার হাজির হন এঙ্গেলসের সামনে, একবার ১লা ফেব্রুয়ারি, আরেকবার ২১শে এপ্রিল।

'সেই যুগের জার্মানিতে নিস্কর্মা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একজন যথাযথ প্রতিনিধি হিসাবে বিজ্ঞানের নামে ড্যুরিং’র আবিষ্কার আসলে এক মহোত্তম ছাইপাঁশ ছাড়া আর বিশেষ কিছু নয়' - ড্যুরিং-এর সেই বিখ্যাত 'সিস্টেম' সংক্রান্ত তত্ত্বটি অধ্যয়নের শেষে এঙ্গেলসের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ছিল এটুকুই।

কম বয়স থেকেই একটি চোখের সমস্যায় জর্জরিত ইউজিন ড্যুরিং সত্যিই উনবিংশ শতাব্দীর জার্মানিতে সর্বজ্ঞ, আত্মকেন্দ্রিক অহংকারে বুঁদ হয়ে থাকা একচোখা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের এক উজ্জ্বল প্রতিনিধি ছিলেন। পুঁজিবাদ এবং ধর্মের শাসনের বিরুদ্ধে কলম ধরে কাজ শুরু করেন। পরে নিজের নামেই একটা উপযুক্ত 'বিশ্বতত্ত্ব' প্রচারে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন। ইতিহাসের শিক্ষাও এমনই, মেধাবৃত্তির আড়ালে মানুষের মুক্তির দিশা খোঁজার পথে অনেকেই শুরুটা করেন বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে, শেষ করেন নির্লজ্জের মতো নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার আরও বড় এক প্রহসনে অভিনয় করে!

ড্যুরিং-এর লেখার 'জবাব' লিখতে বসে এঙ্গেলস আরেকবার উচ্চতর গনিত, আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, অর্থশাস্ত্রতত্ত্ব, দর্শন এবং সমসাময়িক জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা সম্পর্কে নিজেকে ঝালিয়ে নেন। অর্থশাস্ত্র সম্পর্কে 'জবাব' লেখার কাজে মার্কস নিজেই অংশগ্রহন করেছিলেন। ১৮৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভল্কস্ট্যাট পত্রিকায় 'জার্মান রাইখস্ট্যাগে প্রুশিয়ান ভদকা' শিরোনামে ড্যুরিং-প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ঐ বছরের মে মাস থেকে শুরু করে পরের বছর (১৮৭৭)-র জুলাই অবধি সময় লাগে সেই 'জবাব' লেখার সম্পূর্ণ খসড়াটি প্রস্তুত করতে। ১৮৭৭ সাল থেকে ভরোয়ার্টস পত্রিকায় এঙ্গেলসের লেখা ধারাবাহিক হিসাবে প্রকাশিত হতে শুরু হয়। 'বিজ্ঞানে বিপ্লবের রচনাকার হের ড্যুরিং প্রসঙ্গে' শিরোনাম সহ জার্মান ভাষায় সেই লেখা পূর্ণাঙ্গ বই হিসাবে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৮ সালের ৮ই জুলাই। ইংরেজিতে 'এফ এঙ্গেলস, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্টসমূহ, অ্যান্টি ড্যুরিং'। এই বই প্রকাশিত হয়েছিল শিকাগো থেকে, ১৯০৭ সালে। পরবর্তীকালে 'অ্যান্টি ড্যুরিং' নামটিই বহুল প্রচারিত ও সমাদৃত হয়। ঐ নামেই গোটা পৃথিবীতে প্রচারিত হতে থাকে মার্কসবাদ শিক্ষার সবচেয়ে সুসংহত, এমনকি অতি প্রয়োজনীয় বাহুল্যতাটুকুও বর্জিত, ঠাস বুনোটের এক বুনিয়াদি পাঠ্যপুস্তক। ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসের এক তারিখ অবধি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বইটির মোট ৬৯ টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ২১টি বিভিন্ন ভাষায় সেই বই ছাপা হয় মোট ২,৬০,৯০০০টি। আজকের পৃথিবীতে ইউজিন ড্যুরিং-এর নামটুকু যে কারনে মানুষ মনে রাখে তা এঙ্গেলসের লেখা 'অ্যান্টি ড্যুরিং' এর জন্যই, তার নিজের সেইসব ছাইপাঁশ তত্ত্বের জন্য আদৌ নয়!

মার্কসবাদ শিক্ষার পাঠ্যক্রম বুনিয়াদি স্তরে মূলত তিনটি বিষয় কেন্দ্রিক। লেনিন সেই কারনেই মার্কসবাদের তিনটি উৎস এবং তিনটি অঙ্গ নামে বইটি লিখেছিলেন – ১. মার্কসীয় দর্শন, ২. মার্কসীয় অর্থনীতি এবং ৩. সমাজতন্ত্রের ধারণা। তিনটি বিষয়েই মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও সে তুং রচিত অনেকগুলি পাঠ্যবই রয়েছে। এঙ্গেলসের নিজেরই লেখা কয়েকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ রচনার মধ্যে দুটির শিরোনাম হল প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা (Dialectics of Nature), পরিবার, ব্যাক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি ( Origin of Family, Private property and The State)। এইসব থাকা স্বত্বেও 'অ্যান্টি ড্যুরিং' – মার্কসীয় সাহিত্যে এক অনন্য জায়গা করে নিয়েছে।

এই বইতে এঙ্গেলস-কে অত্যন্ত সতর্ক থেকে বারে বারে ড্যুরিং-এর লেখাজোখা থেকে বিভিন্ন প্রলম্বিত উক্তিসমূহের উল্লেখ করতে বাধ্য হতে হয়। এঙ্গেলসের লেখার বাঁধুনি এমনই যে পাঠক বই-এর পাতা উল্টানোর সাথে সাথেই একটি প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে স্বচ্ছন্দেই চলে যাওয়া যায়। আসলে ড্যুরিং যা করেছিলেন বা বলা ভাল করতে চেষ্টা করেছিলেন তা হল কিছুটা খামচে তোলা মার্কসবাদ (ঋণস্বীকার না করেই!), তার সাথে বেশ খানিকটা একক ব্যাক্তিত্বের বিষাক্ত, অহমিকাময় দিবাস্বপ্ন যেগুলি তিনি দর্শন এবং অর্থনীতির নামে চালিয়ে দিয়েছেন এবং যখন-যেমন সুবিধা তখন-তেমন ভাষায় (তবে ভাষার ব্যাঞ্জনায় ড্যুরিং-এর দখল ছিল একথা পাঠককে স্বীকার করতেই হবে, এমনকি বই পড়ার শুরু থেকেই!) গনিত এবং বিজ্ঞানের প্রাচীন থেকে আধুনিক সমস্ত সূত্রাবলীর এবড়ো-খেবড়ো উপস্থাপনার এক দুর্দান্ত খিচুড়ি।

এরকম একটা জগাখিচুড়িতে জনমানসে আগ্রহ তৈরি করা যায় অনেক সহজেই। একে তো ভাষার ঝনঝনায় মানুষের কানে তালা লাগিয়ে দেওয়া যায়। দ্বিতীয়ত সহজ, অকাট্য যুক্তির বদলে অনর্থক কঠিন সুত্রের প্রয়োগপাঠের সময় সাধারন মানুষ নিজেকে অতি সাধারন, যৎকিঞ্চিত তুচ্ছ অনুভব করেন। ফলে বেশি সময় লাগে না লেখককে মহান এক ব্যাক্তিত্ব বলে মেনে নিতে। বলা ভালো তারা ওরকম মেনে নিতে বাধ্যই হন কারন সেই লেখা ও লেখক দুইই দুর্বোধ্য! সবশেষে পাঠক সিদ্ধান্তে আসেন পিসার হেলানো মন্দিরে গ্যালিলিওর পরীক্ষা দেখার পরেও 'শাস্ত্রবাক্য অমান্য করা যায় না' বলা লোকজনের আর এমন কি দোষ, তারাও তো সেবার কিছুই বোঝেনি!

এরকম বুদ্ধিজীব অনুকূল পরিবেশেই তো ড্যুরিং-রা নিজেদের মতামতকে 'জ্ঞানের জগতে শেষ কথা' বলে চালিয়ে দেন– আর তিনি সেই কাজে অনেকটা সফলও হয়েছিলেন। তার একটাই দুর্ভাগ্য, চড়চড় করে উন্নতির পথে বাধ সাধলেন ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস।

'অ্যান্টি ড্যুরিং' বইতে তিনটি অংশ (Part) রয়েছে –

প্রথম অংশ 'দর্শন' (Philosophy)- এর বিষয়বস্তু বহুবিধ। সময় ও স্থান সম্পর্কিত পদার্থবিদ্যা (Mechanics / Mechanical Science), বস্তুর রুপান্তর সম্পর্কিত রসায়নের উদাহরণসমূহ, পৃথিবীতে জৈবজগতের সাধারন নিয়মাবলী সম্পর্কিত জীববিদ্যার বিবিধ উপাদান সম্বন্ধে আলোচনা, চিরায়ত সত্য, সাম্য এবং মুক্তির তত্ত্ব সম্পর্কিত আলোচনায় বিভিন্ন গাণিতিক তত্ত্ব এবং তথ্যকে উদাহরণ হিসাবে ব্যাবহার। সবশেষে প্রকৃতির দ্বান্দিকতার পুনর্পাঠ হিসাবে পরিমাণ এবং গুণের আন্তঃসম্পর্ক ও নেতির নেতিকরনের দ্বারা বহুযুগ ধরে ব্যখ্যা–প্রতিব্যখ্যার দারিদ্রজর্জর দর্শনশাস্ত্রের কবরে যাওয়া নিশ্চিত করতে সাম্যবাদী দর্শনের আবির্ভাব সম্পর্কে এঙ্গেলসের নিজস্ব ব্যাখা।

দ্বিতীয় অংশ 'রাজনৈতিক অর্থনীতি' (Political Economy)- এতে রয়েছে অর্থনীতিকে বিষয়বস্তু হিসাবে বিবেচনা করে তার ব্যাপ্তি (Scope) এবং প্রকরণের (Method) আলোচনা। পণ্যের মূল্যমান, শ্রমের সরল ও জটিল রুপভেদ, পুঁজি এবং উদ্বৃত্ত মূল্যসহ অর্থশাস্ত্রের স্বাভাবিক নিয়মাবলী সম্পর্কিত নাতিদীর্ঘ ও যথাযথ পর্যালোচনা।

তৃতীয় অংশ 'সমাজতন্ত্র' (Socialism)- ১৮৮০ সালে পল লাফার্গের অনুরোধে এঙ্গেলস এই অংশটি লেখেন। পরে সেই লেখাটি মূল বইয়ের সাথে যুক্ত করা হয়। 'অ্যান্টি ড্যুরিং' ছাড়াও লেখার নির্দিষ্ট এই অংশটিই 'ইউটোপিয় এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র' শিরোনামে একটি আলাদা বই হিসাবে পরিচিত। এতে রয়েছে ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা, সমাজতন্ত্রের বুনিয়াদি তত্ত্ব, উৎপাদন এবং বণ্টনের উপায়সমূহ এবং রাষ্ট্র, পরিবার ও শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা।

'অ্যান্টি ড্যুরিং' প্রকাশিত হলে ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস সম্পর্কে দুই তরফ থেকে অভিযোগ ওঠে।

প্রথমটি আসে জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভিতর থেকেই। ড্যুরিং’র ভক্তবৃন্দেরা এমন সমালোচনায় প্রবল আপত্তি জানান। তাদের যুক্তি ছিল, এতে পার্টির অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নষ্ট হবে। নিজেদের মধ্যেকার কলহ প্রকাশ্যে জনগণের খোরাকে পরিণত হবে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন ডিজরাপশন দেখেও নিশ্চুপ থেকে ভালো সেজে নিজেদের মধ্যে চুপিচুপি মিটমাট করে নেওয়া আসলে দুর্বল চিত্তের এক মানসিক ব্যাধি- লেনিন পরবর্তীকালে রাশিয়ায় বলশেভিক পার্টি গড়ে তোলার সময় এমন মনোভাবকে দুরমুশ করে দিয়েছিলেন। এধরণের মতবাদকে কনশিলিয়েশনিজম (যেমন করেই হোক মিটমাট করে নিতে হবে গোছের তত্ত্ব) বলে চিহ্নিত করেছিলেন।

দ্বিতীয় অভিযোগের বিবরণ অতি কম কথায় বইয়ের মুখবন্ধে (প্রথম প্রকাশের মুখবন্ধ) এঙ্গেলস নিজেই উল্লেখ করেছেন – এক অজ্ঞাতপরিচয় প্রতিভাধর গনিতশাস্ত্রী মার্কসের কাছে চিঠি লিখে অভিযোগ জানান যে এঙ্গেলস অহেতুক √(-১) [Complex Number বা জটিল রাশির তত্ত্বে একক হিসাবে যা ব্যবহৃত হয়] - এর মর্যাদাহানি করেছেন। অ্যান্টি ড্যুরিং- বইটির যে নির্দিষ্ট জায়গায় এঙ্গেলস ঐ সংক্রান্ত আলোচনা করেছেন সেটুকু পড়লেই বোঝা যায় সেই অজ্ঞাতপরিচয় প্রতিভাধর ব্যক্তিটি হয়ত এঙ্গেলসের ব্যাজস্তুতি সম্পূর্ণ পড়ার আগেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিলেন, আর তাই মজাটা ধরতে পারেন নি – 'It is a contradiction that a negative quantity should be a square of anything, for every negative quantity multiplied by itself gives a positive square. The square root of minus one is therefore not only a contradiction, but even an absurd contradiction, a real absurdity. And yet is in many cases a necessary result of correct mathematical operations. Furthermore where would mathematics – lower or higher – be, if it were prohibited from operation with?'

ড্যুরিং'কে এঙ্গেলস ব্যাক্তিগত শত্রু মনে করেননি কখনো। তিনি লিখছেন, 'অ্যান্টি ড্যুরিং' কখনোই মনের গহীন কোন থেকে বেরিয়ে আসা ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ (inner urge) নয়। তাঁকে এই বই লিখতে হয়েছিল এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে। এহেন দায়িত্ববোধও কমিউনিস্টদের জন্য এক চিরায়ত শিক্ষা বিশেষ। মার্কসবাদ চর্চার পাঠ্যক্রমে এই বইটি সকলের জন্য এক অমোঘ হাতিয়ার সেই কারনেও। মার্কসবাদ কোন আপ্তবাক্য নয়, মার্কসবাদীদের আচরণ কখনোই কোন মৌলবাদীদের মতো নয়। প্রতিটি ঐতিহাসিক সময়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে, সাহিত্য-শিল্পকর্মের আধুনিকতম অভ্যাসের সাথে এবং সর্বোপরি মানবিক সংস্কৃতির যাবতীয় বহিঃপ্রকাশের সাথে মার্কসবাদকে সম্পৃক্ত করে নিতে হয়। দুতরফেই যাচাই করে নিতে হয় তত্ত্ব ও প্রয়োগ কতদূর যথাযথ। এমনটা করা হয় বলেই, করা যায় বলেই মার্কসবাদ হয়ে ওঠে বিজ্ঞান, হয়ে ওঠে সর্বশক্তিমান। কোনো ভাড়া করা মেধার ভরসায় নয়, এই কাজ মার্কসবাদীদের নিজেদের চেতনায় পরিশ্রমসাধ্য শান দিয়েই করতে হয়। আর তাই মেধার চর্চা মার্কসবাদীদেরই অন্যতম এক অভ্যাস।

এই লেখা শেষ করার আগে একটি ছোট্ট বিষয় উল্লেখ করার ইচ্ছা কিছুতেই অবদমন করা যাচ্ছেনা। ড্যুরিং-এর বিশ্বজয়ের নামে কিম্ভূতকিমাকার তত্ত্ব প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের অসামান্য উক্তিটি। শেষ পাতে মিষ্টান্ন সাজিয়ে দেওয়ার রুচি মাথায় রেখেই সেকথার উল্লেখ করতে হবে- 'When a man is in possession of the final and ultimate truth and of the strictly scientific approach’ it is only natural that he should have a certain contempt for the rest of erring and unscientific humanity.'

আজকের পৃথিবীতেও মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে চেতনার জগতে একের পরে এক আক্রমন নামিয়ে আনা হচ্ছে। এমন কর্মসূচির বেশিরভাগই হচ্ছে বৃহৎ পূঁজির প্রত্যক্ষ সহায়তায় ভাড়াটে মেধার হাত ধরে (End Of History and The Last Man– মাথায় রাখতে হবে)। এসব আক্রমনের বিরুদ্ধে আমাদের, পার্টি কর্মীদের মগজে শান দিতেই হবে। এও পার্টিরই কাজ। দৈনন্দিন অন্যান্য কাজের মধ্যেই সময় বার করে নিয়ম মেনেই (আত্মনির্ধারিত শৃঙ্খলার প্রয়োগ করেই) প্রয়োজনীয় যে সব বই আমাদের সবার বারে বারে পড়া উচিত 'অ্যান্টি ড্যুরিং'- থাকুক সেই তালিকার উপরের দিকেই।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন