'দেশপ্রেমিক' নাথুরাম, বিক্ষুব্ধ সময়, এবং গান্ধীহত্যা - চন্দন দাস....

৩১ জানুয়ারি ২০২২

২য় পর্ব

গান্ধীকে হত্যার কী ‘অ্যালিবাই’ খাড়া করেছিলেন নাথুরাম এবং হিন্দুত্ববাদীরা?
প্রথমত, গান্ধীই দেশভাগের জন্য প্রধানত দায়ী।

দ্বিতীয়ত, গান্ধী ভারতে বরাবর মুসলমানদের তোষণ করে এসেছেন। তিনিই মুসলিম লীগের বাড়বাড়ন্তের জন্য দায়ী।

তৃতীয়ত, তাঁর অহিংসার ভাবধারা হিন্দুদের নিরস্ত্র করেছে।

চতুর্থত, কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র বসু ছাড়াও ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, ভগৎ সিংসহ সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তিনি বিরোধিতা করেছেন।

পঞ্চমত, তেলেঙ্গানার নিজাম শাসনের বিরুদ্ধে কোনও কড়া পদক্ষেপ গান্ধী বেঁচে থাকলে নেওয়া যেত না। নিজাম মুসলমান। প্রজারা হিন্দু। সেখানে হিন্দুদের উপর প্রবল অত্যাচার চালায় মুসলমানরা।

ষষ্ঠত, গান্ধীর চাপের জন্য পাকিস্তানকে ৫৫ কোটি দিতে ভারত সরকার বাধ্য হয়েছে।
নাথুরামের দীর্ঘ জবানবন্দীতে আরও নানা প্রসঙ্গ আছে। কিন্তু মোদ্দা ‘অভিযোগ’ এই কয়েকটি। যার জন্য ‘গান্ধীর মৃত্যুদন্ড।’

গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল আলোচনা মগ্ন।


শেষ দুটি প্রসঙ্গ ১৯৪৭-র ১৫ আগস্ট পরবর্তী। তার আগের চারটির সঙ্গে দীর্ঘ সময়কাল জড়িত। এবং নাথুরামের মত হিন্দুত্ববাদীদের ক্ষেত্রে সেগুলিই প্রধান হওয়ার কথা — বিশেষত, দেশভাগ এবং মুসলমান তোষণের ইস্যু।
নাথুরাম, সাভারকারসহ সাম্প্রদায়িক শক্তি দেশভাগের পক্ষে ছিলেন। হিন্দু মহাসভায় সাভারকারের উত্তরসূরী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বাংলাভাগে নিজের 'কৃতিত্ব' জাহিরও করতেন। ফলে দেশভাগ যখন অবধারিত হয়ে উঠছিল, হিন্দুত্ববাদীরা পুলকিত হচ্ছিলেন। দেশভাগের জন্য গান্ধীকেই দায়ী করা এবং তাঁকে খুন করা নিয়ে নাথুরামের বক্তব্য আসলে কুমিরের কান্না — শয়তানের অজুহাত।
গান্ধীর 'মুসলমান-তোষণ' আটকানোর জন্য খুনের সিদ্ধান্ত? তার জন্য ১৯৪৮ পর্যন্ত অপেক্ষা কেন?
বরাবর নিজের পথ অনুসারে ঐক্যের কথা বলা গান্ধী এই প্রশ্নে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিতে পেরেছেন আগে — দেশভাগের আলোচনা জনমানসে ওঠার পর। বিশেষত ১৯৪৪-১৯৪৬-এ।
উদাহরণ? আমরা ১৯৪৪-এ গান্ধী-জিন্না পত্রালাপের দিকে তাকাতে পারি। প্রতিটি চিঠিতেই গান্ধীর বিভাজনবিরোধী মনোভাব, অখন্ড ভারতের প্রতি প্রত্যাশা, ঐক্যের আকাঙ্খা প্রবল।


১৯৪৪-র ১০ সেপ্টেম্বর মহম্মদ আলি জিন্না লিখলেন,‘‘আমার মনে হয় আপনি উপলব্ধি করিবেন যে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান করাই সর্বপ্রথম কথা ও প্রধান বাধাও বটে। যতদিন না এই দুই জাতির(হিন্দু ও মুসলমান) প্রতিনিধিরা বসিয়া আলোচনা করেন,ততদিন অগ্রসর হওয়া কেমন করিয়া সম্ভব? পরের দিন, ১১ সেপ্টেম্বর গান্ধী এর জবাবে লিখলেন,‘‘হিন্দু-মুসলিম একতাই আমার জীবনের লক্ষ্য। একতার প্রয়োজনেই আমি ইহা চাই। কিন্তু বিদেশী শাসকশক্তিকে হটাইয়া না দেওয়া পর্যন্ত একতা গঠবন করা যাইবে না। সুতরাং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার খাটাইবার প্রথম শর্তই হইল ভারতের সমস্ত দল ও পার্টির মিলিত প্রচেষ্টায় স্বাধীনতা লাভ করা।’’
গান্ধীর বক্তব্য স্পষ্ট। জিন্নারও। জিন্নার দুই জাতির ধারনা বেশকিছুটা সাভারকারের হিন্দুত্বের ধারনার অনুসারি।
ওই বছরেই ১৭ সেপ্টেম্বর জিন্না লিখলেন,‘‘আমরা মনে করি যে, জাতির যে কোন সংজ্ঞায় ও পরীক্ষায় দেখা যাইবে যে হিন্দু ও মুসলমান দুইটি প্রধান জাতি। আমরা ১০ কোটি মানুষের একটি জাতি। শুধু তাই নয়, জাতি হিসাবে আমাদের নিজেদের সুস্পষ্ট কৃষ্টি ও সভ্যতা, ভাষা ও সাহিত্য, কারুশিল্প ও স্থপতিশিল্প, নাম ও পদবী, মূল্য ও সামঞ্জস্যের জ্ঞান, আচার-ব্যবহার ও পঞ্জিকা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, দক্ষতা ও আশা আকাঙ্খা — এক কথায়, জীবন সম্বন্ধে ও জীবনের প্রতি আমাদের নিজস্ব এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী আছে।’’

গান্ধী জিন্নার আলোচনার পর।


গান্ধীর জবাব? তিনি জিন্নাকে লিখলেন,‘‘আপনি জাতিত্বের এক অভিনব সংজ্ঞা উপস্থিত করিয়াছেন। আমি যদি ইহা গ্রহণ করি, তাহা হইলে আমাকে আরও অনেক দাবিই স্বীকার করিয়া লইতে হয় এবং এমন সমস্যার সম্মুখিন হইতে হয় যাহার সমাধান অসম্ভব। আমাদের জাতিত্বের প্রকৃত ভিত্তি আসিয়াছে আমাদের সম-রাজনীতিক দাসত্ব হইতে। আমাদের মিলিত প্রচেষ্টায় আপনি এবং আমি যদি দাসত্বের উচ্ছেদ করি, তাহা হইলে ফলস্বরূপ আমরা রাজনীতিক স্বাধীন জাতি হিসাবে জন্ম লইব।’’
অর্থাৎ আগে স্বাধীনতা। হিন্দু-মুলমান ঐক্যের ভিত্তিতে স্বাধীনতা এবং স্বাধীন জাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ — গান্ধী এটাই বোঝাতে চেয়েছেন।
সাভারকারের মত কী? ‘‘আমি এই বলে হিন্দুদের সতর্ক করছি, এমনকি ইংল্যান্ড যদি কখনও এদেশ থেকে চলেও যায়, তখনও মহম্মদীয়রা আমাদের হিন্দুরাষ্ট্র এবং একটি সাধারন ভারতীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক প্রমাণিত হবে।…আমরা হিন্দু, এই সৌরজগতে আমাদের একটি পৃথক দেশ থাকতেই হবে। সেখানে আমরা হিন্দু হিসাবে — একদল শক্তিবান মানবগোষ্ঠীর উত্তরাধিকারী হিসাবে নিজেদের অবশ্যই বিকশিত করব।’’
সেই দুই জাতির ধারনা — প্রবল সাম্প্রদায়িকতা। বহুত্ববাদকে অস্বীকার।
এই দুই সাম্প্রদায়িকতা, দেশের উদীয়মান পুঁজিপতিদের দেশভাগ, ব্রিটিশের সঙ্গে গাঁটছড়া দরকার ছিল।
হত্যাকান্ডটি ১৯৪৮-র জানুয়ারিতে। দেশভাগ তখন সুনিশ্চিত। একটি বিশেষ পরিস্থিতি তখন ভারতে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু দেশজুড়ে বিক্ষোভ। একের পর এক শ্রমিক আন্দোলন। ধর্মঘট। লড়াইয়ের ময়দানে মানুষের ঐক্য গড়ে উঠছে। আবার চলছে মালিকদের অত্যাচারও।


উদাহরণ? ১৯৪৭-র ১৫ আগস্ট, স্বাধীনতার দিনই শ্রীদূর্গা কটন মিলের ৪জনকে ছাঁটাই করা হল। এমন ছাঁটাই লেগেই ছিল। অন্যদিকে চলছিল কৃষকদের লড়াই — তেভাগা, তেলেঙ্গানাসহ আরও নানা প্রান্তে। লেখক, বুদ্ধিজীবীরাএ প্রতিবাদে মুখর হচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে, গান্ধীহত্যার একমাস আগে, ১৯৪৭-র ৩১ ডিসেম্বর মুম্বাইয়ে কামগড় ময়দানে ছাত্র ফেডারেশনের এক বিরাট মিছিলে পুলিশ গুলি চালাচ্ছে। সেই মিছিল সম্মেলন মঞ্চে পুলিশী বাধা ভেঙে ঢুকে পড়ছে। ছাত্র নেত্রী সুশীলা মনিবেন ‘সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে’ প্রস্তাব উত্থাপন করছেন। এবং তা গৃহীত হচ্ছে। ভারত তখন তপ্ত — সংগ্রামের মেজাজে।
গান্ধীহত্যা তখন।

বিধানসভায় ১৯৪৯-র ২০ ফেব্রুয়ারি গান্ধীজীর স্মরণে শোক প্রস্তাবের উপর আলোচনা করেন কমরেড জ্যোতি বসু।


এই পরিস্থিতির ছবি উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা, গান্ধীহত্যার ২০ দিন পর।
দিনটি ছিল ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮। গান্ধীজী সম্পর্কে শোক প্রস্তাব উত্থাপিত হয় বিধানসভায়। স্পিকার ছিলেন ঈশ্বরদাস জালান। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন স্বাধীনতাপূর্ব কংগ্রেসে কট্টর সুভাষচন্দ্র বসু-বিরোধী বিধানচন্দ্র রায়। শোক প্রস্তাবের উপর আলোচনা করেন তৎকালীন সিপিআই-র সদস্য কমরেড জ্যোতি বসু।
কী বলেছিলেন? ‘‘মিস্টার স্পিকার, সারা দেশের সঙ্গেই আমার পার্টি গান্ধীজীর হত্যায় শোকাহত। …তাঁর ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে আমরাও এসেছিলাম। গভীর দূরদৃষ্টিতে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, সাম্প্রদায়িক হানাহানি আবার একবার পরাধীনতার নয়া সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল আমাদের পায়ে পরিয়ে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করবে।…সাম্প্রদায়িকতার অসূয়াপরায়ণ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় আমরা দায়বদ্ধ; সাধারন মানুষকে নিষ্পেশনের চেষ্টা করছে যারা তাদের বিরুদ্ধে সরকারের ভিতরে কিংবা বাইরে মানুষের পবিত্র ক্রোধ জাগিয়ে তুলতে আমরা দায়বদ্ধ; তাদের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করব। সত্যিকারের মুক্ত ও গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় আমরা সকলেই সামনের দিকে এগিয়ে যাব। আমরা অপেক্ষা করব। লক্ষ্য রাখব, এই চূড়ান্ত ট্র্যাজেডির পরে আজ পর্যন্ত সব কাজেই অকৃতকার্য কংগ্রেস সরকারের মনোভাবে কোনও পরিবর্তন আসে কিনা। নিছক প্রার্থনায় নয়, এমন ভাবে তারা কাজ করে কিনা যা হবে গান্ধীজীর স্মৃতির উপযুক্ত স্মারক।’’
আজও এই কথা প্রাসঙ্গিক। আজকের মন্দা,বেকারি বিধ্বস্ত দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিপদকে প্রতিহত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেটিই হবে গান্ধীর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।


গান্ধীর হত্যাকারীরা দীর্ঘদিন ধরে একাধিক শিল্পপতির সহায়তাপুষ্ট। জমিদারদের সমর্থনপুষ্ট, দেশভাগের আগে থেকে। যার ফলে ১৯৪২-র আগস্ট পরবর্তী সময়ে দ্রুত ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে আরএসএস, হিন্দু মহাসভা। স্বাধীনতার কিছুদিন আগে থেকে জমিদার, শিল্পপতিদের কাছে তাদের ‘প্রয়োজন’ অনেকটা কমেছিল। নির্বাচনী ফলাফলগুলিই তার প্রমাণ। ১৯৪৬, ১৯৪৮-র নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যাচ্ছে হিন্দু মহাসভা ক্রমশঃ শক্তিহীন হয়ে পড়ছে। দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রীদের প্রভাব আগের তুলনায় বাড়ছে। তাৎপর্যপূর্ণ হল গান্ধীহত্যার পর, ১৯৪৮-র ২৬ মার্চ পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করছে সরকার।
গান্ধীহত্যার এই হল পরিপ্রেক্ষিত। এক উত্তেজক, বিক্ষুব্ধ সময়ে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, সুগভীর চক্রান্তের এক বাস্তবায়নই ঘটেছিল ১৯৪৮-র ৩০ জানুয়ারি।

গান্ধী হত্যা


বাকি থাকে অহিংসার ভাবধারা এবং সশস্ত্র সংগ্রামীদের কাজের প্রতি গান্ধীর মনোভাব। অহিংসার ভাবধারা গান্ধীর দর্শন। ভারতে ১৯১৪-তে পা রাখারা আগে থেকেই তিনি এই ভাবধারা অনুশীলন করছিলেন। সবাই সেই দর্শনে অনুপ্রাণিত হবে, তার কোনও দাবি কোথাও ছিল না। সে জন্য ১৯৪৮-এ তাঁকে হত্যা করা কোনও যুক্তিই নয়।
আর সংগ্রামীদের প্রতি মনোভাব? নাথুরামসহ হিন্দুত্ববাদীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা কী ছিল? আন্দামানের সেলুলার জেলে সাভারকারের মুচলেকার কথা বহুজনবিদিত। আরএসএস কখনও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি। বরং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে তাড়ানোর থেকেও মুসলমানদের বহিষ্কার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলেই গোলওয়ালকারের মত সঙ্ঘের নেতারা প্রচার করে এসেছেন।
অতঃপর প্রসঙ্গ নিজাম শাসন। তেলেঙ্গানা। নাথুরাম এবং হিন্দুত্ববাদীরা নিজামের শাসন সম্পর্কে যে সময়ের কথা বলছিলেন, তার আগেই সেখানে কৃষকরা আন্দোলন শুরু করে দিয়েছেন। ১৯৪৮-এ তা সশস্ত্র প্রতিরোধের পর্যায়ে উন্নীত হয়। নিজামের ভূমিব্যবস্থা, শোষণ, কৃষকদের দুদর্শা এবং তাঁদের সংগ্রাম নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না।
গান্ধীহত্যা আসলে ভারতের রাজনীতি এবং অর্থনীতির সঙ্কটের সঙ্গে যুক্ত। যুক্ত মানুষের সংগ্রামকে প্রতিহত করার জন্য শাসকের চক্রান্তের সঙ্গে।


শেয়ার করুন