মে দিবস ও আজকের লড়াই

পুঁজিপতিদের বিশ্বাস শ্রমিকশ্রেণীর বিজয় হলে সূর্যোদয়‌ই হবে না । অথচ সেই শ্রমিকশ্রেণীর সূর্যোদয়ের ইতিহাস রচিত হলো ১৮৮৬ সালে। আত্মাহুতি, আত্মবলিদান‌ই জন্ম দিল  কঠিন সংগ্ৰামের ইতিহাসকে। অনিশ্চিত মজুরী, বেলাগাম শ্রমঘন্টা। এর‌ই বিরুদ্ধে রচিত হয়েছিল হে- মার্কেটের ইতিহাস। রক্তে ভেজা শ্রমিকের পোষাক উর্ধ্বে তুলে তৈরী হয়েছিল লাল ঝান্ডার কাহিনী। পুঁজিপতিরা ভাবে শ্রমিকদের খাটিয়ে নেব। তাদের রক্ত ও ঘামে গড়ে উঠবে পুঁজির পাহাড়। মার্কস্ বলেছিলেন, "এখানে‌ই একটা দ্বন্দ রয়েছে। অধিকারের বিরুদ্ধে অধিকার, উভয়‌ই বিনিময়ের নিয়মে আইনসম্মত। সমানে সমানে লড়াই চলে তখন। শক্তি বা বল‌ই নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে। এই লড়াই হলো যৌথ পুঁজি এবং যৌথ শ্রম অর্থাৎ পুঁজিপতি ও শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যেকার সংগ্ৰাম।"

শ্রমক্ষমতার ব্যবহারিক মূল্য হলো শ্রম আর এই শ্রম‌ই পণ্যের বিনিময়ে মূল্য সৃষ্টি করে। সেইজন্যই মালিক শ্রমক্ষমতাকে ব্যবহার করতে চায়। শ্রমক্ষমতা তার নিজের মূল্যের থেকে যে বেশি মূল্য সৃষ্টি করে, সেটাই হলো উদ্বৃত্ত মূল্য। আর এখানেই লুকিয়ে আছে পুঁজির পাহাড় বানানোর কৌশল। মে দিবসের ঘটনায় যেমন খুশি কাজের ঘন্টা কমাতে বাধ্য হলো পুঁজিপতিরা। কিন্তু তৈরী হতে লাগলো যান্ত্রিক কৌশলের বৈপ্লবিক পরিবর্তন। শিল্পবিপ্লবে ক্রমশ বদলাচ্ছে পৃথিবী। আমরা মনে করি বস্তু কখন‌ও গতিহীন হতে পারে না। মানুষের শরীরে কয়েক মূহুর্ত আগে যে কোষ ছিল, এক মূহুর্ত বাদে দেখা যাবে মানব শরীরে সেই কোষ নেই। কোষের মৃত্যু হয়েছে কিন্তু জন্ম দিয়েছে নতুন কোষ। এই নিয়ত পরিবর্তনশীলতার মধ্য দিয়েই সব কিছু । ফলত প্রযুক্তির জগতেও আজ 'রোবোটিক' পরিবর্তন শুরু হয়েছে। জন্ হেনরি’র যুগের শিল্পের সঙ্গে আজকে মঙ্গলগ্ৰহে মানুষের পৌঁছে যাওয়ার এক বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। আজ আর কেউ কম্পিউটারের পরিবর্তে টাইপরাইটার  ব্যবহার করেন না। প্রশ্ন এটা‌ই, তাহলে কি অনিবার্যভাবে শ্রমিকের স্বার্থ ব্যহত হচ্ছে না? প্রসঙ্গক্রমে একটি আলোচনা করা যেতে পারে। সাল ১৯৯৫। বর্ধমান থেকে রামপুরহাট বামদেব লোকাল ট্রেনটি টেনে নিয়ে যেত পুরনো রেল‌ইঞ্জিন যেখানে কয়লার গনগনে আঁচে ইঞ্জিন এগিয়ে যেত। পরবর্তীতে সেই ইঞ্জিনের পরিবর্তে এলো DMU।

প্রশ্ন এলো,'Coal Ash Worker'-দের মধ্যে। আমাদের চাকরী কি তাহলে আর থাকবে না? এই নিয়ে শুরু হয় বিরাট আন্দোলন। ঠিক এক‌ই সময়ে দৈনিক নিত্যযাত্রীরা (Daily Passenger) প্রায় ৩০,০০০ হাজার স্বাক্ষর সংগ্ৰহ করে DMU ইঞ্জিনের পক্ষে মত দিলেন। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় পুরো দুনিয়া যখন এগোচ্ছে নিশ্চয়ই গৃহীত হবে নতুন প্রযুক্তি। এই প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) অষ্টাদশ পার্টি কংগ্ৰেসের দলিলের কথা তোলা যেতে পারে। যে কোন পরিস্থিতিতেই শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা করতে হবে। যেখানে বিক্রি বা সংস্থা বন্ধের সময় শর্ত শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। সেখানে আরো উন্নত প্রস্তাবের জন্য শ্রমিকদের সংগ্ৰামে আমরা নেতৃত্ব  দেব বা সমর্থন করবো। প্রয়োজনে প্যাকেজের জন্য শ্রমিকদের জন্য লড়াই করা যেতে পারে। স্পষ্টতই আধুনিক তথাকথিত সভ্য সমাজে দাঁড়িয়ে একথা জোরের সঙ্গে বলতে হবে এবং শ্রমিকশ্রেণীকে বোঝাতে হবে মৌল বা স্ট্র্যাটেজিক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় বিলগ্নীকরণ করা যাবে না। একথা বামফ্রন্ট সরকার পরিচালনা করার সময় যখন আমরা বলেছি তখন বৃহৎ  শিল্পের সঙ্গে বাংলায় কেন হোটেল বিলগ্নীকরণ করা হচ্ছে এ প্রশ্ন উঠেছে আবার বিস্কুট কারখানার সঙ্গে" ভেল"এর তুলনা করা হয়েছে। এইসব আজগুবি ভাবনার উপর দাঁড়িয়ে মানুষের মগজে এক বিপুল ভুল বার্তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

Capitalism is the crisis

বর্তমান যুগকে বলা হচ্ছে 'রেভোলিউশন ইন টাইম'; বলা হচ্ছে ডেথ অফ ডিস্ট্যান্স' অর্থাৎ দূরত্বের মৃত্যুযুগ। সময়ের মধ্যে খোদ সময়‌ই ঢুকে পড়ছে। আগে একটা আবিষ্কার, একটা উদ্ভাবন, একটা প্রযুক্তি এলে সেটা তার নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই থাকত। আজ আর তা আটকে নেই। তথ্য প্রযুক্তির এ এক বিপুল প্রসঙ্গ। যে নীতি শ্রমিকশ্রেণীকে amput করছে, সেই নীতি‌ই মানুষ অনেক সময় অম্লান বদনে গ্ৰহণ করছে। এ এক সূক্ষ জটিল ও প্রহেলিকাময় ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। শৈল্পিক মোড়কে মানুষকে ধ্বংস সাধন করা। আগে বলা হোত ভূমি, পুঁজি ও শ্রম তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে IT , মানুষের জায়গায় যন্ত্র এক স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। চারপাশে তাকালে ভাবখানা এমন যেন সব‌ই তো ঠিক আছে। মনে রাখতে হবে When you go beyond your capacity, you go beyond your class। শ্রমিক সংঘ শ্রমিকের প্রয়োজনে ধর্মঘট ডাকে উল্টোদিকে আর একদল শ্রমিককে প্রলুব্ধ করে জনগণের অংশকে যুক্ত করে সেই ধর্মঘটকে ভাঙতে উল্লাসে মেতে ওঠে। এখানেই আমাদের কাজ।

মে দিবস শুধু একটি ঘটনা নয়, ভবিষ্যতের দিক নির্দেশক। আন্দোলন এক‌ই পদ্ধতিতে চলবে মনে করার কোন কারণ নেই। সব লড়াইয়ে শ্রমিক শ্রেণী জিতবে এটাও ভাবার কোন কারণ নেই। মানুষ তৈরির প্রতিষ্ঠান ট্রেড ইউনিয়ন। সেই ট্রেড ইউনিয়নের কাজ‌ই হবে শ্রমিককে তার নির্দিষ্ট শ্রেণীতে প্রতিষ্ঠা করা ও যোগ্যতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হ‌ওয়া।

যত‌ই আমরা রক্তাক্ত হ‌ই, যত‌ই ব্যথা লাগুক আমরা বিশ্বাস করি,

"সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে গো ফূল ফুটবে

সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে"।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন