মার্কিন কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটলে বেপরোয়া হামলা - ফ্যাসিস্ত অভ্যুত্থানের চেষ্টা

ব্যর্থ ট্রাম্পের ফ্যাসিস্ত অভ্যুত্থান

Shantanu Dey

শান্তনু দে

মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। আভাস ছিলই।

শেষে বুধবার মার্কিন কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটলে-ই বেপরোয়া হামলা চালালেন ট্রাম্পের সমর্থকরা। ক্যাপিটল ভবন, কংগ্রেস এবং ‘গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানের’ উপর যখন এই তুমুল তাণ্ডব, ভিতরে তখন নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের জয়কে আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের লক্ষ্যে চলছে সংসদের দুই কক্ষের যৌথ অধিবেশন। বন্দুক উঁচিয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা। যে কোনও সময় দরজা ভেঙে ঢুকে পড়তে পারেন উগ্র সমর্থকরা। এক নজিরবিহীন রুদ্ধশ্বাস নাটকীয় পরিস্থিতি। শেষমেশ গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে ঘরে ফিরেছেন মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন মহিলাসহ চারজন মারা গিয়েছেন। আহত হয়েছেন একাধিক পুলিশকর্মীও। পাওয়া গিয়েছে বিস্ফোরক।

শেষে হিংসার আবহেই মার্কিন কংগ্রেসের দুই কক্ষের যৌথ অধিবেশনে নির্বাচনী জয়ের শংসাপত্র পেয়েছেন ‘প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট’ বাইডেন। উপরাষ্ট্রপতি পদে কমলা হ্যারিসের জয়কেও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে মার্কিন আইনসভা। ট্রাম্পও কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন। বলেছেন, ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আগামী ২০ জানুয়ারি নিয়ম মেনেই তা শেষ হবে।’

পুরোপুরি বেআব্রু মার্কিন গণতন্ত্র। এখানে ফ্যাসিস্ত অভ্যুত্থান ঘটানো যেতে পারে না, বুধবার বিকেলে তা ঘটানো হয়েছে। প্রাথমিক চেষ্টা ব্যর্থ হলেও, ঘটতে পারে ভবিষ্যতেও।

এই ঘটনা মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। দু’মাস আগে দ্য ডেইলি পোস্টার ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছেপে সতর্ক করে অভ্যুত্থানের হুমকি বাড়ছে। ডেমোক্র্যাট, বা কর্পোরেট মিডিয়া কেউই একে গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। অথচ, এটি একটি সযত্নে লালিত পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফসল। নির্বাচনের আগে থেকেই ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি ছিল ফল যাই হোক রাষ্ট্রপতি তিনিই হচ্ছেন। নির্বাচনের দু'মাস পরেও তাঁর সমর্থকেরা এই পরাজয় মেনে নিতে পারেননি। ট্রাম্প নিজেও না। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলার পাশাপাশি একাধিক মামলাও করেছেন। দাবি করেছেন, তিনিই ‘প্রকৃত বিজয়ী’। ভোটে কারচুপি না হলে, তিনিই জিততেন। বুধবারও তিনি বাইডেনের জয়ের বিরোধিতা করে ফের বলেন, 'আমরা পিছু হটব না।' তারপরেই এই হিংসার ঘটনা। ‘আমেরিকা বাঁচাও' ব্যানারে গণজমায়েতে অংশ নিতে ওয়াশিংটনে জড়ো হন হাজারে হাজারে ট্রাম্প সমর্থক। সেখান থেকেই তাঁর অনুগামীরা ক্যাপিটলে চড়াও হন। কয়েক ঘণ্টা কংগ্রেস ভবন অবরুদ্ধ করে রাখেন। বিপুল সংখ্যক বিক্ষোভকারীকে রোখার ক্ষমতা ছিল না পুলিশের। পরিস্থিতি সামাল দিতে ওয়াশিংটনে জারি করতে হয় কারফিউ। দেখে মনে হচ্ছিল লাতিন আমেরিকা, কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশ। মার্কিনমুলুকের গণতন্ত্র রক্ষার জন্য হয়তো সেনা পাঠাতে হবে কিউবা, ভেনেজুয়েলা, কিংবা বলিভিয়াকে!

অশান্তিতে ইন্ধন জোগানোর অভিযোগে ১২-ঘণ্টার জন্য ট্রাম্পের টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সংযত না হলে, ভবিষ্যতে তাঁর অ্যাকাউন্ট পাকাপাকি ভাবে ব্লক করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি পর্যন্ত দেয় টুইটার।

এই উগ্র শ্বেতাঙ্গ বাহিনীর লক্ষ্য মেহনতি মানুষ। এবং যাঁরা সবচেয়ে বেশি শোষিত। ভিন্নমত, অধিকার রক্ষার প্রতিটি প্রকাশকে গলা টিপে হত্যা করাই এদের একমাত্র রাজনৈতিক লক্ষ্য। বিশেষ করে শ্রমিকদের অধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের অধিকারের লড়াই ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারকে খতম করতে এরা মরিয়া।

ঘটনার সময় ওবামা থেকে ক্লিন্টন— ডেমোক্র্যাট নেতারা প্রতিরোধের ডাক না দিয়ে নীরব থাকলেও, পরে প্রধান দুই দলের রাজনীতিবিদরাই এই ফ্যাসিস্ত অভ্যুত্থানের চেষ্টা ও তাঁর মূল প্ররোচক ট্রাম্পের থেকে নিজেদেরকে দূরত্বে রাখতে চাইছেন। যদিও, স্বল্পায়ু। তবু এই একতরফা হামলা মোকাবিলায় রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন ফ্যাসিস্ত হুমকি মোকাবিলায় আদৌ বিশ্বস্ত নয়। একেবারেই অযোগ্য। এই ঘটনা কেবল ট্রাম্পের ফ্যাসিস্ত অভ্যুত্থান নয়, এই ঘটনা মার্কিন সমাজ কতটা ভঙ্গুর, তার আয়না। যাঁরা মার্কিন গণতন্ত্রের দেউলিয়াপনা দেখে আজ বিস্মিত, তাঁরা ভুলেই গিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোটেই পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের দেশ নয়। আসলে মার্কিন গণতন্ত্রের ভিত্তি বরাবরই ত্রুটিপূর্ণ। বলেছেন জোশেফ স্টিগলিৎজ।

সেই কবে লেনিন বলেছেন, ‘তথাকথিত ডেমোক্র্যাটিক পার্টি হলো, এক সময়ের দাস-প্রভুদের দল। আর পুঁজিপতিদের দল, যারা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের দাসত্ব থেকে মুক্তির পক্ষে ছিল, তাদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল রিপাবলিকান পার্টি।
কৃষ্ণাঙ্গ মানুষরা দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে এই দুই দলের মধ্যে ফারাক কমে গিয়েছে। এখন মূলত আমদানি রপ্তানি শুল্ক নিয়ে এই দুই দলের লড়াই। সাধারণ জনগণের জন্য তাদের এই লড়াইয়ের বিশেষ কোনও গুরুত্ব নেই। দুই বুর্জোয়া দলের জমকালো এবং অর্থহীন দ্বৈরথের মধ্যে দিয়ে মানুষকে তাদের অপরিহার্য স্বার্থগুলির থেকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে।
আমেরিকা এবং ব্রিটেনে তথাকথিত যে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা বজায় রয়েছে, তা স্বাধীন শ্রমিক শ্রেণির উত্থান, অর্থাৎ প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক পার্টির উত্থানকে বাধা দেওয়ার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী একটি ব্যবস্থা।’ (মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল ও তাৎপর্য: প্রাভদা, ৯ নভেম্বর, ১৯১২)।

আজ একুশ শতকে, আবারও সেই জরুরি প্রশ্নের মুখোমুখি মার্কিন জনগণ। ‘হুইচ সাইড আর ইউ অন?’ গত শতকের তিরিশের দশকের গোড়ায় কেন্টাকির খাদান শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ে লেখা ফ্লোরেন্স রিসের লেখা গান, পরে যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় পিট সিগারের গলায়। আজ ‘কোন দিকে সাথী তুই, কোন দিক বেছে নিবি বল?’

রাস্তায় এবং উৎপাদন ক্ষেত্রে শ্রমজীবী জনগণের ক্রমবর্ধমান শক্তিই একমাত্র পারে ধারাবাহিক বর্ধমান এই ফ্যাসিস্ত আন্দোলনকে পরাস্ত করতে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন