sandeshkhali Cover

এখন আর কে নিরাপদ?

সৌভিক ঘোষ

প্রাককথন

২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সন্দেশখালি আসনে সিপিআই(এম) জয়ী হয়। তারপর থেকেই শুরু হয় এলাকা দখলে আনতে দন্ড (পড়ুন ঘর ভেঙ্গে দেওয়া, জ্বালিয়ে দেওয়া, এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা) ও ভেদের (জাত-পাত, পদবী, আরও যা কিছুতে মানুষকে ভাগ করে দেওয়া যায়) কৌশল। বাকি দুটি ইচ্ছা করেই বলছি না। মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে নিজেদের রাজনীতির আসল কথাটুকু বলার মত, সেই রাজনীতির স্বপক্ষে জনসমর্থন আদায় করতে সাম (পড়ুন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ) আর দাম (পড়ুন ন্যায্য অধিকার) কোনটাই দেওয়ার মতো অওকাত তৃনমূল কংগ্রেসের নেই, তাই বলছি না। যে দুটি বলা হল বিজেপি’র দীর্ঘ সাহচর্যে থাকায় ওরা ভালোমতই শিখে নিয়েছে। ২০১৬ অবধি ঐ আসনে বিধায়ক ছিলেন নিরাপদ সর্দার। বিধানসভাতে বিধিসম্মত আলোচনার সময় দিয়েও কথা শুরুর পরেই আচমকা তার মাইক অফ করে দেওয়া হয়েছিল, সেসবের প্রসিডিংস পাওয়া যায়। মাইক অফ হওয়ার ঠিক আগে বলা কথাগুলির দিকে বারে বারে কিছুটা বাড়তি মনোযোগ দেওয়া যায়- ‘...আমরা দেখতে পাচ্ছি আজকে পঞ্চায়েতে যারা মহিলারা দাঁড়ানোর জন্য উৎসাহিত তাদেরকে বলা হচ্ছে গ্যাং রেপ করা হবে...’।

আজকের সন্দেশখালি

যে পরিস্থিতি তার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উপরে বলা শেষ কথাগুলিই। প্রথমে যেন-তেন-প্রকারেণ ক্ষমতা দখল, পরে সেই ক্ষমতার পরিধি বাড়াতে বাড়াতে এমন একটা অবস্থা তৈরি করে ফেলা যখন মিডিয়া অথবা নিজেই নিজেকে দেওয়া উপাধিতে (দুটো অবশ্য প্রায় একই ব্যাপার) খুঁটির জোরে লড়া ইয়ে না কি যেন বলে শেষ পঞ্চাশ (আজ থেকে একান্ন) দিন ধরে নিখোঁজ রয়েছে। সেই ব্যক্তি ও তার সাগরেদদের বিরুদ্ধে এলাকার মহিলারা সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা, মাইক ইত্যাদির সামনে যে সকল অভিযোগ করেছেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে না গেলে কেউ ওভাবে ওকথা উচ্চারণ করে না। তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখলে গ্রামীণ এলাকায় রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্তৃত্বের পরিচিতি সূচক বিশেষ কিছু অভিধা চোখে পড়ত। সেসব প্রথাসম্মত ভাষাবিজ্ঞানের ডিকশনারিতে পাওয়া যায় না। উৎপাদনের হাতিয়ার ও তার ফলাফলের উপরে দখল কায়েম করার একেক ঐতিহাসিক পর্যায়েই এসব নির্মিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে নতুন করে ‘লুটেরা বদবাবু’দের আবির্ভাব ঘটিয়ে দিয়েছে তৃণমূল জমানা। এ রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস লিখতে গেলে আর কিছু না হোক এটুকু কৃতিত্ব তাদেরই রইল।

গণশক্তি আর পার্টি পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের হ্যান্ডলগুলি ব্যতীত বাদবাকি মূল ধারার মিডিয়ার প্রচারে মোটের উপরে ব্যাপারটাকে তৃনমূলের ম্যানেজ করে মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বনাম বিজেপি’র পায়ের তলায় মাটি ছোঁয়ার সাফল্য এই দুয়ের মধ্যেই ছকে ফেলার চেষ্টা ছিল, আছে, আর হয়ত শেষ অবধি থাকবেও। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এক্সাম সেন্টারে পৌঁছাতে না পারায় তার মা’কে পুলিশের সামনে মাথা উঁচু রেখে প্রতিবাদ করতে দেখার আগে-পরেই রাজ্যেরই এক মন্ত্রীকে কীর্তনের আখড়ায় উপস্থিত হয়ে মুখে হাসি আর গলায় খোল বেঁধে হরিনামের সাথে নৃত্যরত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। একই জায়গা থেকে এমন দুটি খবর একইসাথে টিভির পর্দায় চলে, ঘুরে ফিরে আসে। তাই সকলেই যে টিভিতে দেখতে পাওয়া খবরে আশা-ভরসা করেন এমনটা আর হয় না। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ছবি, ভিডিও, লেখা ইত্যাদি স্ক্রল করে উপর-নিচ ঠেলে দেওয়ার রুচিতে আটকে থাকতে চাওয়ার ইচ্ছা যতই প্রবল হোক না কেন, পরিস্থিতি যত এগোয় যেকোনো ধোঁকার প্রভাবও ততটাই কমে আসে। সাময়িক উত্তেজনার ক্ষণস্থায়ী পরশ কাটিয়ে ওঠার, অনেক কিছু থেকে শাঁসটুকু চিনে নেওয়ার মনোভাব দানা বাঁধে। এমন সময়কে মনে রাখতেই এই প্রতিবেদন।

আসল কথাটা কি?

দখল বলুন, নির্যাতন বলুন, ভয় দেখানো, মারধর থেকে সন্ত্রাস ইত্যাদি পেরিয়ে শেষ অবধি মহিলাদের উপরে অকথ্য জুলুম সবকিছুরই একটা গোড়া থাকে। আজকের দুনিয়ায় সেই গোড়ার কথাটি হল সম্পদ, সম্পত্তির মালিকানা। নোনা জলের ভেড়ি আর অল্প স্বপ্ল চাষ-আবাদ করার এলাকা এই দ্বীপাঞ্চলে সম্পদ বলতে ওগুলোকেই বুঝতে হয়, উপলব্ধি করতে হয়। ছোট বড় গরীব পরিবারগুলির দুবেলা বেঁচে থাকার উপায় বলতে হয় চাষের জমিতে কাজ, না হলে ভেড়িতে কাজ। আরও একটি কাজ অবশ্য ছিল, তাকে একশো দিনের কাজ বলা হত। সেই কাজ শুরু হলে গ্রামের মানুষ বিশেষত মহিলারা প্রকৃত অর্থে স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। পরিবারের মাথা দুজন (নর-নারী বা স্বামী-স্ত্রী দুটোই বলতে পারেন) উপযুক্ত কাজ পেলে পরবর্তী প্রজন্ম সবার আগে যেটা করে সেটা হল দুমুঠো ভাত খেয়ে কাছেপিঠের ইশকুলে যাওয়া। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ধীরে ধীরে একটা বিস্তীর্ণ এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটতে থাকে, শক্তিশালী বাজার গড়ে ওঠে কেননা ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য চাহিদা বাড়তে থাকে। সামাজিক সম্পদের সমাজতান্ত্রিক না হোক অন্তত সমানুপাতিক বণ্টনই হল সেই গোটা নির্মাণ পর্বের পূর্বশর্ত। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে অবধি নানা ঐতিহাসিক বাঁক-মোড়, বাধা-সংশয় পেরিয়েও মোটের উপরে সেটাই ঘটছিল। এই প্রক্রিয়ায় যেটুকু সমৃদ্ধি গড়ে ওঠে তাতেই উঠতি লুটেরার দল জিভ দিয়ে লালা ঝরা আটকে রাখতে পারেনি। পঞ্চায়েত হোক কিংবা বিধানসভা, লোকসভা যাই হোক না কেন সেই বাহিনীই আজকের শাসকের ‘ভালো ছেলে’দের দল। ওরা জানতো একটিও আসনে যদি বামেরা জিতে যায় তবে ঐ লুঠের খবর সঙ্গে সঙ্গে বাইরে চলে আসবে, তাই সবকটি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে আসাটা একান্ত প্রয়োজন ছিল।

এ রাজ্যের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের তথ্য ইত্যাদি নিয়ে যারা একটু হলেও নাড়াচাড়া করেন তারা জানেন শেষ এক দশকে সন্দেশখালিতে যাই নির্বাচন হোক সবকটি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তৃণমূল কংগ্রেসই। এ কোনও ম্যাজিক না, ওটা ওদের রাজনৈতিক লাইনের কম্পালশন, বাধ্যবাধকতা। যত দ্রুত সম্ভব যাবতীয় সম্পদের দখল নিতে ও’ছাড়া অন্য উপায় ভেবে পায়নি আর কি। অমন রাজনীতির অভিঘাতেই জব কার্ড, রেশন কার্ড, কয়লা থেকে চাকরি সংক্রান্ত যাবতীয় দুর্নীতি, আসলে কনসেন্ট্রেশন অফ সোশ্যাল ক্যাপিটাল। আর কে না জানে জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি পুঁজি এমন কোনও কায়দায় জমা হয় না যা লোকসমক্ষে বলা যায়! সন্দেশখালির এক ফসলি কৃষিজমিতে জোর করে নোনাজল ঢুকিয়ে ভেড়ি তৈরির অভিযোগ উঠেছে, বসতবাড়ি, দোকানপাট এমনকি ছোটদের খেলার মাঠও পুলিশ দিয়ে দখলমুক্ত করা হল বলে প্রচার করতে হচ্ছে। এসবের উদ্দেশ্য বুঝতে খুব বেশি ভাবতে হয় না, নোনাজলে যা কিছু জন্মায়, তার যা কিছু বিক্রয়যোগ্য, রপ্তানিযোগ্য সেসবের উপরে একচেটিয়া দখল কায়েম করাই ছিল বাঘারু বন্দোবস্তের আসল কথা। এমন লুঠ প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় পৌঁছে যাওয়ায় এখন সে আঁস্তাকুড় থেকে এমন গন্ধ বেরোচ্ছে যে একদিকে চাপা দিতে গেলে আরেকদিকে ঢাকা সরে যায়। তাই মুখপাত্র না কিসব যেন’রা যখন গলা কাঁপিয়ে বলেন ‘কেন এতদিন এসব সামনে আসে নি’, তখন প্রতিক্রিয়ায় মুচকি হাসি ফিরিয়ে দেওয়ার রুচিটুকুও হয় না। গায়ে মানুষের চামড়া থাকলে কার্যত বিবমিষাই আসে।

যে জায়গায় রয়েছি সবাই

গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দা বিশেষত মহিলাদের রোজকার স্বাভাবিক অভ্যাসের আবডাল ছেড়ে ক্রমশ বাইরে আসতে দেখা যাচ্ছে। তারা সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খুলেছেন, রাজ্য প্রশাসনের বিভিন্ন কর্তা-ব্যক্তিদের সাথে কথা বলার সময় মাথার উপর ফেলে রাখা কাপড়ের অংশটুকু সেভাবে ঠিকঠাক করার দিকে বিশেষ মন দিচ্ছেন না, বরং মানুষের উপযুক্ত সম্মানের সাথেই মাথা তুলে বাঁচতে চাইছেন একথাটাই বারে বারে স্পষ্ট করে দিচ্ছেন। নিঃসন্দেহে এমন পরিস্থিতি সকলের জন্য উদ্বেগের। কিন্তু সে উদ্বেগ আর শুধুই নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাসটুকুর জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে থাকছে না, নিপীড়কদের জন্যও ক্রমশ অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হচ্ছে। ছোটখাটো কৃষিকাজ কিংবা মাছ চাষের জিবিকায় অভ্যস্ত সহজ, সরল গরীব মানুষ একটু ধীরে চলো, সামলে চলো’র নীতিকে আঁকড়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হন, গ্রামীণ উৎপাদনের রীতিই তাদের অমন করে তোলে। যে হাতে তারা বেঁচে থাকার রসদ ফলান, সেই দুহাত যে আগাছা উপড়ে ফেলতেও সমর্থ একথাটা শাসক বারে বারে ভুলে যায়। সন্দেশখালির মানুষ সেটুকুই তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ঘুরে-ফিরে খবর খোঁজা ক্যামেরার সামনে দিয়েই পালিয়ে বেড়ানো পুঙ্গবদের মুখ দেখলেই সেটুকু বোঝা যায়।

এখন প্রথম কাজ আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। দ্বিতীয় কাজ নির্যাতিতদের বিচার সুনিশ্চিত করতে যথাযথ আইনি সহায়তার ব্যবস্থা করা। মজার বিষয় যদি কিছু থাকে তবে সে হল এদুটি কাজই যাতে সুষ্ঠুভাবে না করা যায় রাজ্য সরকারের পুলিশবাহিনী সম্ভবত সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছেন। তাই প্রথমে গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সর্বভারতীয় ও রাজ্য নেতৃত্ব, পরে গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের অন্যতম নেতৃত্ব সহ প্রতিনিধিদের হাস্যকর কায়দায় ‘এখান থেকে কোথাও যেতে পারবেন না’ শুনতে হয়েছে। তারা কাউকেই ঢুকতে দিতে চান না, আবার বাধা পেরিয়ে ঢুকে গেলে আইনি অধিকার সম্মত উপায়ে কোথাও যেতে এমনকি বেরিয়ে যেতেও দিতে চান না! সারা ভারত কৃষকসভা, খেতমজুর সংগঠনের নেতৃত্বও পৌঁছেছেন, আক্রান্ত পরিবারের কথা শুনেছেন। ছাত্র, যুব, মহিলা ফ্রন্টের প্রতিনিধিরা মহিলা কমিশনে গেছেন, দোষীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবী সহ ছাত্র-ছাত্রীদের নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য নাগরিক পরিষেবা অব্যাহত রাখার দাবী জানিয়ে এসেছেন। জনজীবনে জরুরী ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে রেখে প্রশাসনের তরফে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রচেষ্টা দেখা গেছে। যেটুকু যা গ্রেফতার ইত্যাদি হয়েছে সেসবই হাল-ফিলের ঘটনা। সাংবাদিক সম্মলেনে ইতিমধ্যেই পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম স্পষ্ট বাংলায় জানিয়েছেন আগামী ২৯শে ফেব্রুয়ারি সন্দেশখালি যাওয়া হবে।

এই জমানায় যে কেউই আর নিরাপদ না, সন্দেশখালি দেখিয়ে দিয়েছে।

গরীব মানুষ থেকে সংবাদমাধ্যম অবধি সবাইকে কখনো নোটিশ, কখনো হুমকি আর নয়তো মামলার ভয় দেখিয়ে দিয়ে ঠাণ্ডা করতে চাইছে রাজ্য সরকার।

আমরা নির্যাতিত মানুষকে ভরসা দিতে চাইছি। আর কেউই যখন নিরাপদ নন, তখনও নির্যাতিতদের পাশে থাকার লড়াইতে নিরলস এক সর্দারের জেল হেফাজত চলছে। কিছুটা অভিনব হলেও একথা তো ভোলার নয় সেই সর্দারের নাম আর আজকের পশ্চিমবঙ্গে জনসাধারণের অন্যতম একটি দাবী দুইই প্রায় এক।

এই পরিস্থিতিতে কেউ কেউ ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছেন। এসব নতুন কিছু না। নোনাজলের অজুহাতে বিষয়টি খুব সহজ বলে ভাবলে হয়ত একটু ভুলই হবে। অনেকেই ভুলে যান, তবু একটি চিরায়ত সহজ কথা তো এই– ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ নট সাচ অ্যান ইনোসেন্ট প্লেস অ্যাজ উই ইউজড টু থিঙ্ক, পেটকফ!’

তথ্যসুত্রঃ

১) গণশক্তি

২) সংবাদমাধ্যমের টেলিভিশন চ্যানেলে প্রকাশিত প্রতিবেদন

৩) সোশ্যাল মিডিয়া


শেয়ার করুন

উত্তর দিন