জিডিপি’র দ্বিতীয় ভাগের খতিয়ান এবং সম্ভাব্য ফলাফল – একটি পর্যালোচনা
প্রভাত পট্টনায়েক
মূল নিবন্ধটি পিপলস ডেমোক্র্যাসি পত্রিকার ৬ই ডিসেম্বর,২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত
সরকারি মুখপাত্রেরা চলতি বছরের দ্বিতীয় পর্বে (প্রতি তিন মাসে একটি পর্ব হয়) জিডিপি’র স্বাস্থ্যোদ্ধার সম্পর্কে যতই আগাম উচ্ছাস প্রকাশ করছেন বিড়ম্বনা ততই বাড়ছে। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের দ্বিতীয় পর্বের সাথে তুলনায় এবছরে জুলাই – সেপ্টেম্বর পর্বে জিডিপি’র অধোগতির চেহারা ভালো দেখাতে তারা বলেছেন অবনমনের সূচক হবে মাত্র ৭.৫ শতাংশ। যদিও এই অধোগতি সম্পর্কে ধারণা করা হয়েছিল প্রায় ৮ থেকে ৯ শতাংশের। যেহেতু এবছর প্রথম পর্বের অবনমন ছিল ২৩.৯ শতাংশ, তাই “শক্তসমর্থ স্বাস্থ্যোদ্ধার” সম্পর্কেও সেই ধারনার তুলনায় উন্নতির কথা বলা হচ্ছিল। বাস্তবিক বিড়ম্বনা হল একদিকে সেই স্বাস্থ্যোদ্ধার যেমন দ্বিধাগ্রস্থ তেমনি আরেকদিকে অবনমন ক্রমশ স্থায়ী হবার সম্ভাব্যতায় উন্নতির চেহারা যথেষ্টই পলকা।
এই স্বাস্থ্যোদ্ধার দ্বিধাগ্রস্থ কারন জিডিপি ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে অসামঞ্জস্যতাসহ যাতে ভ্রান্তি এবং ফাঁক দুইই পরিপূর্ণ। যদি ধরেও নেওয়া যায় ২০১৯-২০ সালের দ্বিতীয় পর্বের জিডিপি’র হিসাবে যে সকল ভ্রান্তি এবং ফাঁকফোকর রয়ে গেছিল ঠিক সেগুলিই আবার ২০২০-২১ সালের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য তাহলেও এই দুই পর্বের মধ্যেকার অবনমনের সূচক দাঁড়াবে ৮.৭ শতাংশে, যেমনটা ধারণা করা হয়েছিল। অথচ জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর এই হিসাবকেই ৭.৫ শতাংশ বলছে। সুতরাং “শক্তসমর্থ স্বাস্থ্যোদ্ধার” সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে পরিসংখ্যানবিজ্ঞানের যুক্তিতেই তা আগাগোড়া দ্বিধাময়।
ধরে নেওয়া যাক আপাতত জিডিপি’র চিত্রটি সঠিক এবং তাকে যাচাই করা যাক। লকডাউনের কারনে উৎপাদনে যেমন বড় ধরনের ঘাটতি ছিল তার কিছুটা উন্নতি করা সম্ভব হতোই একথা নিশ্চিত, গুরুত্বপুর্ন প্রশ্ন হল সেই পুনরুদ্ধারের কারনসমূহ।
জিডিপি’র পরিসংখ্যানের দিকে খেয়াল রেখে আলোচনা এগোনো জরুরী কারন কর্মসংস্থানের প্রশ্নটি এর সাথে জড়িত। ভারতের অর্থনীতি যেখানে কাজে যুক্ত হবার অর্থ সরাসরি স্থায়ী চাকরি নয়, এর মধ্যে অনিয়মিত চাকরি, অস্থায়ী চাকরি, আংশিক সময়ের কাজ এসবকিছুই সম্মিলিত সেখানে জিডিপি অধোগতিপ্রাপ্ত কিনা তা বুঝতে গেলে কর্মীদের আয়ের চিত্রটি বুঝতেই হবে। কর্মীদের কিংবা সাধারনভাবে শ্রমজীবী জনগণের আয়ের বদলী হিসাবে ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে তাদের খরচের হিসাবকেও আলোচনায় রাখা যেতে পারে। শ্রমজীবী জনগণের ভোগ্যপণ্য কেনার ক্ষমতা না বাড়া কিংবা অতি তুচ্ছ পরিমানে বৃদ্ধি সত্বেও জিডিপি বৃদ্ধি হলে, তাকে অর্থনীতির প্রথাসম্মত নিশ্চিত উন্নতি বলা যায় না।
একথা মাথায় রেখেই বর্তমান অবস্থার পর্যালোচনা করা যাক। শ্রমজীবী জনগণের ক্রয়ক্ষমতা সম্পর্কে যথাযথ কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই, কিন্তু বাজারে ভোগ্যপণ্যের মোট বিক্রয়ের যে তথ্য রয়েছে তার থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে একটা অনুমান করে নেওয়া চলে। আগের বছরের তুলনায় এবার দ্বিতীয় পর্বের জিডিপি’র অবনমন ৭.৫ শতাংশ, ফলতঃ ব্যাক্তিগত চাহিদার কারনে ভোগ্যপণ্য কেনায় খরচের পরিমান আরও কম, ১১.৩২ শতাংশ। এর অর্থ ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ দুবছরেই জিডিপিতে ব্যাক্তিগত চাহিদায় ভোগ্যপণ্যের খরচ কমেছে। সংশ্লিষ্ট তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০১৯-২০ সালের দ্বিতীয় পর্বে জিডিপিতে এই খরচের অংশীদারি ছিল ৫৬.৫ শতাংশ, ২০২০-২১ সালের দ্বিতীয় পর্বে তা নেমেছে ৫৪.২ শতাংশে।
লকডাউন প্রত্যাহার হবার পরে জনগণের অপেক্ষাকৃত ভালো থাকা অংশের মানুষজনেদের ক্রয়ক্ষমতা খুব সহজেই পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। এমন হবে কারন খুবই কম সময়ের জন্য তাদের ক্রয়ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হলেও তাদের হাতে যথেষ্ট নগদ টাকাপয়সা রয়েছে যার ফলে চাহিদার কোনোরকম পরিবর্তন আপেক্ষিক থাকবে। লকডাউনের বিধিনিষেধ শিথিল হলেই বাজারে চাহিদা বাড়তে থাকবে, জিডিপি বৃদ্ধিতে তার অংশীদারি বাড়বে – যদি এই বৃদ্ধি বাড়তি উৎপাদনের দ্বারা না করা যায় তবে শেয়ার বাজারে স্টকের যোগান বাড়িয়ে দিয়ে সেই সমস্যার সমাধান হবে। জিডিপি বৃদ্ধিতে ব্যাক্তিগত চাহিদায় ভোগ্যপণ্য খরচের অংশীদারিত্ব যদি ১১.৩২ শতাংশ কমে যায় তাহলে শ্রমজীবী জনতার ভোগ্যপণ্য কেনায় খরচের পরিমান নেমে যাওয়ার হার ১১.৩২ শতাংশের তুলনায় আরও বাড়বে। এমনটা হবে কারন শ্রমজীবীদের ক্রয়ক্ষমতা কমবে।
জিডিপি’তে ব্যক্তিগত চাহিদায় ভোগ্যপণ্যে খরচের অংশীদারিত্বের পরিমান কমলে ধারণা করা সম্ভব যে এরই অনুসারি হয়ে জিডিপি’তে শ্রমিক জনতার আয়ের অংশিদারিত্বও কমে যাবে অথবা সরাসরি জিডিপি’তে উদ্বৃত্তের অংশীদারি বৃদ্ধি পাবে।
স্থায়িকরনের দুটি ভিন্ন পদ্ধতি বর্তমানে ক্রিয়াশীল রয়েছে। মহামারি এবং সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক লকডাউনের কারনে একটি পদ্ধতির সূচনা হয়েছে। মাথাপিছু আয়, মাথাপিছু ভোগ্যপন্য ক্রয় এবং সামগ্রিক বিচারে বেঁচে থাকার মান, সবকিছুই এর ফলে নিম্নগামী হয়েছে। মাথাপিছু আয় কমে যাবার পরিব্যাপ্ত অবস্থার মধ্যেই অবনমন স্থায়ী হবার দ্বিতীয় কারণটির উদ্ভব – সাধারনভাবে শ্রমজীবী জনতার ক্রয়ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুতরভাবে জখম হয়েছে, সেই অবস্থাই লকডাউন শিথিল হবার পরেও জারি রয়েছে। আয় কমে যাওয়ার পরেও উদ্বৃত্তের পরিমানে বৃদ্ধি হবার ফলেই এমন ঘটে।
তথাকথিত স্বাস্থ্যোদ্ধার সম্পর্কে আরও একটি কথাও মনে রাখতে হবে। সেটি হল জিডিপি’তে সরকারি ব্যায়বরাদ্দের পরিমান কমে যাওয়া। ২০১৯-২০ সালে দ্বিতীয় পর্বের জিডিপি’তে সরকারি ব্যায়বরাদ্দের অংশ ছিল ১৩ শতাংশ, এবছর দ্বিতীয় পর্বে তা কমে হয়েছে ১০.৯ শতাংশ। আপাতবিচারে এই অবনমন কম মনে হলেও গতবছরের দ্বিতীয় পর্ব থেকে এবছর জুলাই-সেপ্টেম্বর অবধি সময়কালে এই অবনমনের প্রকৃত পরিমান ২২.২ শতাংশ যা সামগ্রিক বিচারে জিডিপি’র ৭.৫ শতাংশ অধোগতির তুলনায় অনেকটাই বেশী।
সাধারণ সময়ে জিডিপি পতনের সময় সরকারি আয় (রেভিন্যু) কমলেও সরকারি ব্যায়সমূহ যার একটি বড় অংশই হল বেতন (চরিত্রগত ভাবে এটি উপরি) – কমে না। ফলে জিডিপি’তে ব্যায়বরাদ্দের অনুপাত বাড়ে। এই অভিমুখে কোনোরকম সচেতন পদক্ষেপ না নিলেও সরকারি ব্যায়বরাদ্দ ক্রমশ চক্রাবর্তি ঝোঁকের বিপরীত প্রবনতার দিকে এগোচ্ছে। এই হিসাব স্পষ্ট করে দেয় কীভাবে মোদী সরকার বিশ্বায়িত ফিন্যান্স পুঁজির সমীপে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম জানাচ্ছে এবং তারই ফলে রেভিন্যুতে সরকারি ব্যায়বরাদ্দ ক্রমশ ছেঁটে ফেলা হচ্ছে , এমনকি রেভিন্যু আয় কমার হারের থেকেও বেশী হারে। মহামারির সময়ে লকডাউন চলাকালিন স্বাস্থ্যপরিষেবা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যায়বরাদ্দ না বাড়িয়ে সরকার যেমন কার্পণ্য দেখিয়েছে সেই চিত্র যথেষ্ট আপত্তিকর।
জিডিপি’তে অংশিদারির পরিমানে বেসরকারি এবং সরকারি দুক্ষেত্রেই ব্যায়বরাদ্দ কমে যাওয়ার কারনে তথাকথিত স্বাস্থ্যোদ্ধার বিনিয়োগ বৃদ্ধির সাথে সংযুক্ত হয়ে থাকে, বিশেষভাবে স্থায়ী পুঁজি গড়ে ওঠার মোট পরিমানের সাথে। এমনকি মোট অর্থের তুল্য পরিমানেও এখনকার অবস্থা গতবছরের দ্বিতীয় পর্বের তুলনায় অনেকটাই নিচে। যদিও সেই ডোবা থেকে অনেকটাই উপরে ওঠা গেছে। এই উদ্ধার সম্পর্কে খেয়াল করলে দেখা যাবে দ্বিতীয় পর্বের সাথে প্রথম পর্বের তুলনায় জিডিপি’র বৃদ্ধি ৫৮ শতাংশ যা এই পর্বের স্থায়ী পুঁজির মোট পরিমানে (সরকারি এবং বেসরকারি দুয়েরই মোট বিনিয়োগ) বৃদ্ধির কারন।
স্থায়ী পুঁজির মোট পরিমানে এই বৃদ্ধি স্পষ্টই অস্থায়ী চরিত্রের। এমনকি সরকারি বিনিয়োগের উপরে এধরনের কর্তৃত্ব যদি আরও কিছুদিন বজায় থাকে তাহলেও সেই অস্থায়ী চরিত্র পাল্টায় না। বিশ্বায়িত পুঁজিকে কোনভাবেই না চটানোয় সরকারের যে আসক্তি অক্টোবরের শেষ অবধি রাজকোষ ঘাটতি ইতিমধ্যেই গোটা বছরের ঘাটতির সীমা পেরিয়ে গেছে। সরকারি ব্যায়বরাদ্দে যথেচ্ছ কাটছাঁটের পরে অবশ্যই সরকার নিজস্ব বিনিয়োগে লাগাম পরাতে বাধ্য হবে। এধরনের লাগাম দেবার বাধ্যবাধকতা যাবতীয় বেসরকারি বিনিয়োগের যতই বৃদ্ধি হোক না কেন কাটবে না, কারন বেসরকারি বিনিয়োগের বৃদ্ধি নির্ভর করে বাজারে ভোগ্যপণ্যের বেচাকেনা বৃদ্ধি পাওয়ার উপরে।
একটা সময় অবধি বেসরকারি বিনিয়োগের বৃদ্ধিতে রপ্তানি বাড়ানোর কারনে তেজি অবস্থা জারি থাকলেও, জিডিপি’তে যেহেতু রপ্তানির অংশিদারিত্ব খুবই কম মহামারির কবলে থাকাকালিন পৃথিবীতে বিনিয়োগের চিত্রটি যেমনটি ধারণা করা হচ্ছে সেই অনুপাতে ভরসাযোগ্য নয়। তাই বেসরকারি বিনিয়োগে তেজি আনতে পারবে একমাত্র যদি অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা এবং বেচাকেনা বাড়ে, তবেই।
যতদিন না বাজারে চাহিদা এবং বেচাকেনা মহামারী-পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসে, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যেসকল ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে সেইসবই অব্যবহৃত রয়ে যাবে এবং সেইসব ব্যাবস্থার সংস্থানে অল্পস্বল্প বৃদ্ধি করা হলেও তা কার্যকরী হবে না। সুতরাং বেসরকারি বিনিয়োগে উল্লেখযোগ্য চেহারায় পৌঁছাতে পারে একমাত্র যদি বেচাকেনার হাল মহামারি-পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারে। কিন্তু যদি ভোগ্যপণ্যের কেনাবেচা এখনকার মতোই নিস্তেজ হয়ে থাকে তবে স্বাস্থ্যোদ্ধার চিরকালই সম্ভাব্য সুদিন হয়েই থেকে যাবে।
লকডাউনের ফলে কায়েম হওয়া মন্দার খাদ থেকে উদ্ধারের পথ আরও একটি কারনে বিরক্তিকর। ভোগ্যপণ্যের ক্রয়ক্ষমতা পড়ে যাওয়া এক্ষেত্রে অবশ্যই অন্যতম একটি কারন। ২০২০-২১ সালের প্রথমার্ধের (এপ্রিল – জুন) পুরোটাকেই যদি আলোচনার বিষয়বস্তু হয় তবে গতবছরের তুলনায় বাস্তবিক বেসরকারি কেনাবেচা প্রায় ২০ শতাংশ নিচে নেমেছে। যে দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ আর্থিক সঙ্গতির কিনারায় বেঁচে থাকেন সেখানে এই অবস্থা গুরুতর সংকটের পরিচয় দেয়। এই অবস্থা থেকে একথাও বোঝা যায় মন্দার খাদ থেকে উঠে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও একই অনুপাতে কঠিন হবে।
সুতরাং এবছরের দ্বিতীয়ার্ধে জিডিপি’র সম্ভাব্য স্বাস্থ্য সম্পর্কে সরকারের তরফে যা বলা হচ্ছে তাতে খুব উচ্ছাসের কিছুই নেই, কারন দেশের অর্থনীতি ধীরে হলেও কাদায় আটকে পড়ার দিকে এগোচ্ছে। এই বদ্ধাবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হল আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির কথামতো না চলে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু মোদী সরকারের এমন পদক্ষেপ নেবার মতো সাহসিকতার অভাব রয়েছে।
মূল লেখার অনুবাদ - ওয়েবডেস্কের পক্ষে সৌভিক ঘোষ