চাচা হো, ভিয়েতনামের জনমুখী জনস্বাস্থ্য : শান্তনু দে

১৯ মে,২০২০ মঙ্গলবার

শেষ ৩২-দিনে ভিয়েতনামের সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রে নতুন করে একজনের শরীরেও করোনাভাইরাস ধরা পড়েনি।

এই বিশ্বে ‘সবচেয়ে নিরাপদ’ দেশ ভিয়েতনাম। দশ কোটির দেশে এক তাক লাগিয়ে দেওয়া সাফল্য। যেখানে করোনার সংক্রমণে একজনেরও মৃত্যু নেই। আক্রান্তের সংখ্যা সাকুল্যে ৩১৪। এর মধ্যে ১৪৮ জন সংক্রমাতি হয়েছেন দেশের বাইরে থেকে। ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক নান দাঙ পত্রিকা শনিবার জানিয়েছে, আক্রান্তদের মধ্যে ২৬০ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। ৫৪ জন এখনও চিকিৎসাধীন। রয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছ’টি হাসপাতালে।

এই সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে জনমুখী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও সরকারি তৎপরতা। ১৯৮৫ পর্যন্ত ভিয়েতনামে স্বাস্থ্য পরিষেবা মিলত পুরোপুরি বিনামূল্যে। সরকারি ভরতুকিতে। ১৯৮৬, দইমই সংস্কার চালু করে ভিয়েতনাম। তুলে দেওয়া হয় নিখরচায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা। এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে শুরু হয় নানা পরীক্ষানিরীক্ষা। সংস্কারের প্রথমদিকের ভুলত্রুটি পরে শুধরে নেওয়া হয়।

২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৫। দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা কর্মীদের সম্মেলনে কমরেড হো চি মিন বলেছিলেন: থাকতে হবে সৎ এবং ঐক্যবদ্ধ। ভালোবাসতে হবে রোগীদের। এবং উন্নত করতে হবে দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রকে। কমরেড হো চি মিনের পাঠানো ৩৬৮-শব্দের সেই চিঠি এখনও ভিয়েতনামের মূল মন্ত্র। ২৭ ফেব্রুয়ারি ভিয়েতনামে চিকিৎসক দিবস।

এখন দেশের জনসংখ্যার ৮৭.৭ শতাংশই, দশ কোটির দেশে ৮ কোটি ৩৬ লক্ষ মানুষই সরকারি স্বাস্থ্যবিমার আওতায়। গরিবদের জন্য এই বিমার প্রিমিয়ামের ১০০ শতাংশই দেয় সরকার। প্রায় গরিবদের ক্ষেত্রে এই হার ৭০ শতাংশ।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এবং বিশ্বব্যাঙ্কের যৌথভাবে প্রকাশিত গ্লোবাল মনিটারিং রিপোর্টের সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদন জানাচ্ছে: ৬-বছরের কম বয়েসি শিশু আর গরিবদের চিকিৎসার জন্য কোনও পয়সাই লাগে না। দেশের ৯৭ শতাংশ শিশুই টিকাকরণের আওতায়। যেখানে মার্কিনমুলুকে এই হার ৯৫ শতাংশ। ১৯৯৫-২০১৫, গড় আয়ু ৭১ থেকে বেডে হয়েছে ৭৬। পাঁচ-বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি ১ হাজারে ৫৮ থেকে কমে হয়েছে ১৮। একই সময়ে প্রসূতিকালীন মৃত্যুর হার কমেছে ৭৫ শতাংশ। ২০০০-১৮, এই সময়ে পাঁচবছরের কম বয়েসিদের অপুষ্টির হার ৩০.১ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১৩ শতাংশ।

২০১৭তে, জনস্বাস্থ্যে ভিয়েতনাম খরচ করেছে জিডিপি’র সাড়ে ৭ শতাংশ। ১৬১০ কোটি ডলার। এবছর তা ২০০০ কোটি ডলারে পৌঁছনোর কথা। ২০১২ থেকে স্বাস্থ্যখাতে বেসরকারি খরচকে ছাপিয়ে গিয়েছে সরকারি খরচ। এর মূল কারণ স্বাস্থ্যবিমায় জোর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে, ভিয়েতনামে স্বাস্থ্যখাতে মাথাপিছু খরচ ১৪২ ডলার। এতে সরকারের খরচের সঙ্গেই আছে মানুষের পকেট থেকে দেওয়া অর্থ। ২০১৪’র হিসেব অনুযায়ী, তাতে সরকারি খরচের হার ৫৪ শতাংশ, বাকি ৪৬ শতাংশ মানুষের পকেট থেকে।

ভিয়েতনামে হাসপাতালের সংখ্যা ১৩৪৬। এর মধ্যে সরকারি ১১৬১। বেসরকারি ১৮৫। আছে জেলা-স্তরে ৭০০টির বেশি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এছাড়াও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার দায়িত্বে রয়েছে ১১,০০০ কমিউন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একটি নেটওয়ার্ক। এইসব কেন্দ্রে থাকেন ডাক্তার, নার্স, প্রশিক্ষিত ধাত্রী।

তবে ভিয়েতনামের স্বাস্থ্যব্যবস্থা একেবারে ত্রুটিমুক্ত, এমন দাবি কেউ করে না। বিদেশী পুঁজি আছে। বেসরকারি হাসপাতাল আছে। ধরেই নিতে হবে সম্পদশালীরা বাড়তি সুবিধা পান। গ্রাম-শহরের মধ্যে পরিষেবা পাওয়ার ফারাক থাকার কথা। তবে এও ঠিক, বিনা চিকিৎসায় মানুষ মরেন না।

এবছরের মধ্যে জনসংখ্যার ৯০ শতাংশকেই স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা সরকারের লক্ষ্য।

৫০ বছর আগে এই বসন্তেই মার্কিনমুলুকে শয়ে শয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও হাইস্কুলে লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী শামিল হয়েছিল ধর্মঘটে। চেয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান। মে, ১৯৭০। সেদিন দেশজুড়ে ৪০ লক্ষ ছাত্রছাত্রী শামিল হয়েছিল সেই ধর্মঘটে। গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ২ হাজার ছাত্রকে। কলকাতাসহ বাংলা উত্তাল। তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম। উত্তাল দেশ-দুনিয়া। পঞ্চাশ বছর পর সেই প্রতিবাদ আজও অনুপ্রেরণা।

৪৫ বছর আগে এই সময়ই ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্ণায়ক পরাজয়। ৩০ এপ্রিল, ১৯৭৫। সায়গনের পতন। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের অবসান। উত্তর ভিয়েতনামের সেনারা সাঁজোয়া গাড়িতে চেপে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গনের দিকে। অন্যদিকে সায়গনে মার্কিন দূতাবাসের ছাদে মার্কিন হেলিকপ্টার। তাতে ওঠার জন্য মার্কিন নাগরিকদের তৎপরতা। দক্ষিণ ভিয়েতনামে পুতুল সরকারকে রক্ষা করার মার্কিন মরিয়া প্রচেষ্টা পরাস্ত হয়েছিল সেদিন। ৪০ লক্ষ ভিয়েনামবাসীর মৃত্যু ও মরণপণ লড়াইয়ে পরাস্ত হয়েছিল মহাশক্তিধর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।

পঞ্চাশ এবং ৪৫-বছর পর সেই সায়গন আজ হো চিন মিন সিটি।

আজ, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদী নেতা কমরেড হো চি মিনের ১৩০-তম জন্মবার্ষিকী। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জনগণের দীর্ঘ বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। মানবমুক্তির লড়াইয়ে যা হয়ে রয়েছে চিরস্মরণীয়।

কমরেড হো চি মিন থেকে আজকের ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক, রাষ্ট্রপতি নগুয়েন ফু ত্রঙ। আরও একটি যুদ্ধে নির্ণায়ক জয়। এবারে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে।

একদিন যারা ইতিহাসের বর্বরতম সামরিক আগ্রাসনের অন্যতম চাপিয়ে দিয়েছিল, যে আগ্রাসনে ব্যবহৃত রাসায়নিক অস্ত্রের প্রভাব এখনও রয়ে গিয়েছে, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সাড়ে ৪ লক্ষ মাস্ক, সুরক্ষা পোশাক পাঠিয়েছে ভিয়েতনাম। এবং, শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়। এমনকি ফ্রান্সকেও।

৫,৫০,০০০ ব্যাক্টেরিয়া-প্রতিরোধক মাস্ক তুলে দিয়েছে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন এবং ব্রিটেনকে। উপহার হিসেবে। মেডিক্যাল সামগ্রী পাঠিয়েছে লাওস ও কাম্বোডিয়াকে। ফেব্রুয়ারিতে, ভিয়েতনাম ৫ লক্ষ ডলার মূল্যের চিকিৎসা সামগ্রী পাঠিয়েছে চীনে।

মে ২০২০। বিশ্বের একটাই নাম ভিয়েতনাম।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন