তৃণমূল ও দুর্নীতি - সুদীপ্ত বোস...

১৯ সেপ্তেম্বর ২০২২

দ্বিতীয় পর্ব

দুর্নীতির এপিসেন্টার হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট-ই

রেলে চাকরি পাবার আশায় টাকা ঢেলেছিলেন ৩৪ বছর বয়সি হুগলির বাঁশবেড়িয়ার তৃণমূল কর্মী প্রসূন দত্ত। দলনেত্রী মমতা ব্যানার্জি তখন রেলমন্ত্রী। টাকা ঢালা মানে তাঁর দলের নেতাদের কাছে কয়েক লক্ষ টাকা ধার করে তুলে দিয়েছিলেন। সেই নেতা মমতা ব্যানার্জির ‘ঘনিষ্ঠ’- এটাই ছিল তোলবাজির রক্ষাকবচ!
যদিও মেলেনি চাকরি। হতাশ, তবুও আশা নিয়েই প্রসুন দত্ত এসেছিলেন হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে, দলনেত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন বলে। দেখা হয়নি, চাকরি পাওয়ার আশাও নেই, বুঝে গেছেন- দলকে টাকা দিয়ে বেবাক প্রতারিত হয়েছেন।
মমতা ব্যানার্জির বাড়ির পিছনের খালের ধার বরাবর থাকা একটি জেনারেটরের পাশে রাখা ছিল এক ড্রাম ভর্তি তেল। সেই তেল গায়ে ঢেলে আগুন জ্বেলে দেন তিনি।
দলনেত্রীর কাছে প্রতারণার বিহিত না পেয়ে চাকরির মিথ্যা আশায় স্বপ্ন দেখা এক যুবক সেদিন হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে এসেই গায়ে আগুন দিয়েছিলেন। আগুনে পুড়ে মরছে এক বেকার যুবক, চাকরি পাওয়া স্বপ্ন তছনছ হওয়ার পরে, মুখ্যমন্রীবার চৌকাঠেই।
প্রতিবাদে পথে নেমেছিল বামপন্থী যুবরা। ঘৃণার স্লোগান উঠেছিল- ‘হাওয়াই চটির মানে/ প্রসূন দত্ত জানে’।
তাঁর দপ্তরে চাকরি পাবার আশায় কাকে কাটমানি দিতে হয়েছিল? মমতা ব্যানার্জি আলবাৎ জানতেন তা।


জেলায় জেলায় ছোট-বড়-মাঝারি তৃণমূল নেতাদের বাড়ি, অফিসে বিক্ষোভ আছড়ে পড়েছে। বীরভূমের ইলমাবাজারে এক প্রতিবন্ধী বাবার মেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা থেকে পাওয়া টাকাও লুট করেছে তৃণমূল।কোথাও আবার শ্মশানযাত্রীদের কাছ থেকেও তোলার টাকা আদায়, রেগা, মিড ডে মিল থেকে লুট— সব হিসাব কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিতে স্থানীয় বাসিন্দারা জড়ো হচ্ছে তৃণমূল নেতাদের বাড়ি,অফিসের সামনে। কারণ যেখান থেকে লুট হয়েছে সেখানেই তো টাকা ফেরতের জন্য যাবেন মানুষ, স্বাভাবিক। নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডেও মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে জড়ো হয়েই লাঠিপেটা জুটেছিল বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের।
এই স্বাভাবিক নিয়মেই বাঁশবেড়িয়ার তৃণমূল কর্মী বছর তেরো আগে দলনেত্রীর কালীঘাটের বাড়ির সামনেই গিয়েছিলেন, আত্মঘাতী হতে বাধ্য হয়েছিলেন।
চিট ফান্ডের গ্রাসে জমানো সব টাকা, স্বপ্ন হারিয়ে সর্বস্বান্ত, অসহায়, বিপন্ন প্রতারিতরাও নয় বছর আগে জড়ো হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনেই। কেন? এর জবাব দেওয়ার দায় তো এখন মুখ্যমন্ত্রীরই।
রাজ্যে এমন কোন দুর্নীতি আছে যার সঙ্গে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের যোগ নেই? মুখ্যমন্রীার জানেননা অথচ অনুব্রত ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা হাজার কোটি সম্পত্তি,১৬২টি জমির মালিকা, পার্থ চ্যাটার্জি ২০১টা ভুয়ো সংস্থার মালিক বনে গেলেন? কট্টর তৃণমূলীদেরও বোঝানো কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

         

যাদু আছে এই হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে! এখানেই মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি। ‘বিশ্ব বাংলা’ লোগোর আবেদন আসে এই ঠিকানা থেকেই। এই হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটেই সেই প্রভাবশালী ব্যানার্জি পরিবারের লাগোয়া বাড়িতে বসেই রমরমিয়ে চলত চিট ফান্ড। এই হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ঠিকানাতেই চলে অবিশ্বাস্য রকমের দ্রত গতিতে উত্থানের সেই সংস্থা ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’।
আবার গত বিধানসভা নির্বাচনে নির্বাচনে ঢাকে কাঠি পড়ার মুহুর্তেই কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের অদূরের মুখার্জি ঘাট থেকে উদ্ধার হয়েছিল বস্তায় ভর্তি ছেঁড়া নোট যার অধিকাংশ পোড়া অবস্থায় মিলেছিল। ঘটনাস্থল থেকে আটটি বাড়ির পরেই শুরু হচ্ছে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট। ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির বাড়ি। বস্তায় ছিল মূলত ২০,৫০,১০০,৫০০ টাকার নোট , অধিকাংশ নোট সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে বলে মোট টাকার পরিমাণ জানানো যাচ্ছে না। না হলে সেই গার্ডেনরিচের আমির খান নতুবা অর্পিতা মুখার্জির বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া টাকার মতই দেখাতো তা! এক বছর আগেই। উল্লেখ্য, কয়লা ও গোরু পাচারের তদন্ত চলাকালীনই জানা গিয়েছিল এভাবে ছেঁড়া নোটের কাহিনি।আসানসোল শিল্পাঞ্চলের মানুষ জানে সেই ছেঁড়া টাকার গল্প!
গত ৩১ আগস্ট গণ-আন্দোলনৃর শহীদ দিবসের দিনই বর্ধমানে কার্জন গেটের সামনে থেকে বিশ্ব-বাংলা ‘ব’ উপড়ে দিয়েছিল ক্ষুব্ধ মানুষজনই। এই ‘ব’ তেও কেলেঙ্কারি এবং সেই হরিশ চ্যাটার্জি স্রিতেট।
মুখ্যমন্ত্রী ‘ব’ শব্দ দিয়ে ছবি আঁকলেন, সেই ছবিকে ট্রেড মার্ক হিসাবে ব্যবহার করার জন্য ট্রেড মার্কস রেজিস্ট্রির কাছে আবেদন জানালেন তাঁর ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি। তাঁর নামেই তা বরাদ্দ হলো। তার অনেক পরে তৈরি হলো ‘বিশ্ব বাংলা মার্কেটিং কর্পোরেশন লিমিটেড’ নামক সরকারি সংস্থা। সরকারই সেখানে বিনিয়োগ করলো, আর সেই সংস্থা অভিষেক ব্যানার্জির ‘বিশ্ব বাংলা’ লোগোই ব্যবহার করলো। সরকারি সংস্থা বেসরকারিভাবে এক ব্যক্তির আবেদন করে পাওয়া লোগোকে ব্যবহার করলো। আইনত তার জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা রয়্যালটি হিসাবে পাওয়ার কথা ওই ব্যক্তির। অর্থাৎ সরকারের বিনিয়োগে ‘বিশ্ব বাংলা’ ব্র্যান্ডের যে প্রচার, প্রোমোশনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লোগোটি ব্যবহার করা হয়েছে, তার জন্য মোট আয়ের একটি অংশ রয়্যালটি হিসাবেই যাওয়ার কথা ভাইপোর ঘরে। অর্থাৎ ৩০বি, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে!
নয় বছর আগে বিশ্ব-বাংলা ট্রেড মার্কের জন্য আবেদন এসেছিল খাস ৩০/বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কালীঘাট, কলকাতা-৭০০০২৬ ঠিকানা থেকে। ট্রেডমার্কের জন্য আবেদন করা হয়েছে ২০১৩ সালের ২৬শে নভেম্বর। ঐ দিন তিনটি আবেদন করা হয়েছিল। তার মধ্যে একটি আবেদনের (২৬৩৩৫৩৫) পরিপ্রেক্ষিতেই এখনও পর্যন্ত ট্রেড মার্কস রেজিস্ট্রির খাতায় বিশ্ব বাংলা লোগো ও ট্রেড মার্কের মালিক অভিষেক ব্যানার্জি। তাহলে কি খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই তাঁর ‘ব’ আঁকা বিশ্ব বাংলার লোগো অভিষেকের নামে বরাদ্দ করে তা রাজ্য সরকারকে ব্যবহার করতে দিয়ে সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ রয়্যালটি পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল? উঠছে প্রশ্ন।


‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’। মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহের ভাইপোর সংস্থার নাম। সাংসদ হওয়ার আগে পর্যন্ত অভিষেক ব্যানার্জি’ই ছিলেন ‘‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’র কর্ণধার।অফিসের ঠিকানা বাসভবন চত্বরেই, ২৯/সি, হরিশ চ্যাপটার্জি স্ট্রিট। অভিষেকের স্ত্রী রুজিরা ব্যানার্জিও ছিলেন এই সংস্থায়। কয়লা পাচার তদন্তে কেন্রীেকয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’ এবং ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ড ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস এলএলপি’- এই সংস্থায় সন্দেহজনক লেনদেনের হদিশ মিলেছে। একটি নির্মাণকারী সংস্থার মাধ্যমে ঢূকেছে টাকা। সেই সংস্থার সঙ্গে আবার সরাসরি যোগ কয়লা মাফিয়া অনুপ মাঝি ওরফে লালার।অর্থাৎ কয়লা পাচারের কারবারের টাকাই ঢুকেছিল ঘুরপথে!
২০০৯ সালে বেদিক ভিলেজকাণ্ডে যে ব্যক্তি( রাজকিশোর মোদী)’র বিরুদ্ধে রাস্তায় নামলেন মমতা ব্যানার্জি মাত্র তিন বছর পরেই জামিনে মুক্ত সেই রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১কোটির ১৫ লক্ষ টাকা ‘কমিশন মানি’ ঢুকে গেলে তাঁর ভাইপোর এই সংস্থায়! অভিষেক ব্যানার্জির সংস্থার অডিটর যিনি তিনিই আবার রাজকিশোর মোদীর গ্রিন টেক সংস্থারও অন্যতম ডিরেক্টর!
এ’এক গোলক ধাঁধাই বটে।
আবার কয়লা পাচার কাণ্ডে ফেরার হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্র্া ভানুতুয়ার নাগরিকত্ব নিয়ে ফেলা অভিষেক ঘনিষ্ঠ বিনয় মিশ্রের বাড়িও হরিশ চ্যাটার্জি স্রি ্ট লাগোয়া ধর্মদার রো’তে! এখানেই দুটি শিখন্ডী সংস্থা চলছে যেখানে কয়লার পাশাপাশি গোরু পাচারের কিংপিন এনামুলের টাকাও ঢুকেছে।
দুর্নীতির ভরকেন্দ্র হরিশ চ্যাটার্জি স্রিট-ই। যাবতীয় চুরি, জোচ্চুরি, দুর্নীতির রক্ষাকবচ এই ঠিকানার মালকিন-ই।

চলবে...

'তৃণমূলের দুর্নীতি'র সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি আগামী পর্বগুলিতে প্রকাশিত হবে......।।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন