চোর কখনও চোর ধরে? চন্দন দাস

প্রথম পর্ব

‘ঈশ্বরের বরপুত্র’র শাসনে
রাম, শিবের ঘরেও চুরি

সেদিন ছিল ১৬ মে। ২০১৯। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের শেষদিন।
সেদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভাষণ দিয়েছিলেন মথুরাপুরে, দমদমে। তিনি বলেছিলেন,‘‘মোদী সরকার শপথ নেওয়ার পরই দুর্নীতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করা, শাস্তি দেওয়ার কাজ শুরু হবে। আমাদের সরকার হলে দুর্নীতিগ্রস্তরা জেলে যাবে।’’
তৃণমূলের চুরি, কমিশন, কাটমানির রাজত্বে ক্রুদ্ধ রাজ্যবাসী আশা দেখেছিলেন। ‘পারলে বিজেপি-ই পারবে তৃণমূলকে টাইট দিতে’ — প্রচার হয়েছিল পাড়ায় পাড়ায়।
তারপর?
শাস্তি দূরের কথা, তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রী, সাংসদদের বিরুদ্ধে তদন্তই শেষ করতে পারেনি ইডি, সিবিআই। কেন? এই প্রশ্নের একাধিক উত্তর। তার একটি — যাদের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ তারা অন্য চোরকে ধরবে কী করে? তা সম্ভব নয়। হয়ওনি। অন্তত ‘মোক্ষধাম’ তাই বলছে।
‘মোক্ষধাম’-এ সোনার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এই ছিল পুরোহিতদের বড় অংশের নিদান। হিমালয়ের কোলে কেদারনাথ মন্দির — তাই হলো ‘মোক্ষধাম’।
কিন্তু ‘ঈশ্বরের বরপুত্র’-র সামনে পুরোহিতদের ঈশ্বরজ্ঞান? তুচ্ছ।
তাই সেই প্রাচীন মন্দিরে ৫৫০টি সোনার পাত লাগানো হয়েছিল। যেগুলির সম্মিলিত ওজন ছিল ছিল প্রায় ২৩ কেজি ৭৭৭ গ্রাম। রীতিমত ড্রিল করে সোনার পাত লাগানো হয়েছিল সেই মন্দিরে গত অক্টোবরের আগে।
তার আগে দেশ দেখেছিল ‘ভগবানের দূত’ নরেন্দ্র মোদীকে সেই কেদারের একটি গুহায় ধ্যান করতে। দুনিয়াকে সচকিত করে সেই মন্দির চত্বরে আমরা পেয়েছিলাম সেই অবতারকে — রোদ চশমা এবং চমকদারী পোষাকে।
এই পর্যন্ত ঘটনার বিবরণ মূলত ‘গর্বিত হিন্দু’-র অহঙ্কারের আখ্যান। কিন্তু তারপর? মন্দির খোলার পর জানা গেল, ১২৫ কোটি সোনার পাত চুরি হয়ে গেছে! গত জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এই অভিযোগ সেই মন্দিরের পুরোহিত আচার্য সন্তোষ ত্রিবেদীর। রাত নামলে, হিমালয়ের জীবন যখন আরও নিঃসাড় হয়ে পড়ে, তখন সেই পড়ে থাকা পিতলের পাতে সোনার জলের পালিশ করা হয়েছিল।


সেই অভিযোগের উচ্চপর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিতে বাধ্য হয় উত্তরাখন্ডের সরকার — বিজেপি-র সরকার। যে দপ্তরের তত্বাবধানে এই তদন্ত হওয়ার কথা, সেই দপ্তরের নাম ‘পর্যটন, ধর্ম এবং সংস্কৃতি’।
কেদারনাথই শুধু চোরদের খপ্পরে? মোটেই তা নয়। রাম, হনুমান সহ পুরো রামায়নের মাহাত্ম্যই সঙ্কটে। তা জানতে হিমালয় ছেড়ে অযোধ্যায় পৌঁছোতে হবে।
অযোধ্যায় ‘রামায়ন সার্কিট’ একটি দৃষ্টান্ত। রাম, হনুমানের মাহাত্ম্য তুলে ধরার জন্য সেই পর্যটন প্রকল্প। নাম ‘রামায়ন সার্কিট’। অযোধ্যায় সেই প্রকল্পে দেদার টাকা নয়ছয় হয়েছে।
কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল(সিএজি) গত ১২আগস্ট এই সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে হেনরি দ্বীপ এবং উপকূল এলাকায় পর্যটনের উন্নয়নে বরাদ্দের থেকেও অতিরিক্ত প্রায় ৪ কোটি টাকা তৃণমূল সরকারকে কেন পাইয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার? এই প্রশ্নও তুলেছে সিএজি — সেই একই রিপোর্টে।
নরেন্দ্র মোদীর এই বহুঘোষিত প্রকল্পের নাম ‘স্বদেশ দর্শন প্রকল্প’। ২০১৫-র জানুয়ারিতে প্রকল্পটি ঘোষিত হয়। প্রথমে প্রকল্পটির জন্য ৫০০কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু মোদী সরকার ২০২১-২২ পর্যন্ত এই পর্যটন প্রকল্পে বাজেটে বরাদ্দ করেছে ৬৮০২কোটি টাকা। এখনও পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৪৭৩৪ কোটি টাকা। প্রকল্পটির লক্ষ্য হিসাবে বলা হয়েছিল দেশে ১৫টি বিশ্বমানের ট্যুরিস্ট সার্কিট গড়ে তোলা। সেগুলির মধ্যে আছে হিমালয়ান সার্কিট, উত্তর পূর্ব সার্কিট, কৃষ্ণা সার্কিট, বৌদ্ধ সার্কিট, উপকূল সার্কিট, মরুভূমি সার্কিট, আদিবাসী সার্কিট, বন্যপ্রাণী সার্কিট, গ্রামীণ সার্কিট, আধ্যাত্মিক সার্কিট, রামায়ন সার্কিট, ঐতিহ্যশালী এলাকা সার্কিট, তীর্থঙ্কর সার্কিট এবং সুফি সার্কিট প্রভৃতি।
‘স্বদেশ দর্শন’-র অনেকগুলি প্রকল্পের খরচ, পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সিএজি। তবে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন ‘রামায়ন সার্কিট’ নিয়ে। এই সার্কিটের দুটি পর্ব। সিএজি প্রশ্ন তুলেছে মূলত ‘রামায়ন সার্কিট’-র দ্বিতীয় পর্বের কাজ নিয়ে। যে কাজ প্রধানত অযোধ্যা কেন্দ্রিক। ২০১৮-র এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে এই সার্কিটের দ্বিতীয় অংশের কাজ। মূলত অযোধ্যাকে কেন্দ্র করে এই অংশের উদ্যোগ। এখনও পর্যন্ত এই প্রকল্পে ১১৫কোটি ৪৬লক্ষ টাকা উত্তরপ্রদেশ সরকারকে দিয়েছে কেন্দ্র। কিন্তু ধরা পড়েছে অনেক অসঙ্গতি।


যেমন, অযোধ্যাকে কেন্দ্র করে এই প্রকল্পের কোনও ‘ফিসিবিলিটি সার্ভে’-র হদিশ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ যা একটি প্রকল্পের পরিকল্পনার প্রাথমিক কাজ, তাই হয়নি। কোনও ট্রাস্টের থেকে জমি নেওয়া যাবে না, এই ছিল শর্ত। কিন্তু সেই শর্তও মানা হয়নি। দীগম্বর আখড়া ট্রাস্ট থেকে ৩কোটি ৬লক্ষ টাকা দিয়ে জমি নেওয়া হয়েছে।
জমির কোনও বন্দোবস্ত না করে পাটেশ্বরী মন্দির সংলগ্ন এলাকার উন্নয়নের কাজ শুরু হয়ে যায়। পরে তা বন্ধ তা করতে। তার জন্য টাকা নষ্ট হয়। এই প্রকল্পে ঠিকাদারদের অন্যায় সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে গুপ্তার ঘাটের উন্নয়নের কাজে। গুপ্তার ঘাটের উন্নয়নের কাজকে ১৪টি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। আলাদা আলাদা ঠিকাদরাদের বরাত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একই কাজের জন্য ঠিকাদারদের আলাদা আলাদা রেটে বরাত দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই প্রকল্পে ঠিকাদরাদের সুবিধা মত কাজ করিয়েছে রাজ্য সরকার। এতে প্রায় ২০লক্ষ টাকা বাড়তি পেয়েছে ঠিকাদার।
তারপরেও আছে। ৫% বিভাগীয় ডিসকাউন্ট দেওয়ার শর্ত ছিল। যোগী আদিত্যনাথের সরকার সেই শর্ত মানেনি। ফলে প্রায় ৩কোটি ৮৬লক্ষ টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে। ঠিক মত পরিকল্পনা না করার কারনে জিএসটি, লেবার সেসসহ নানা ক্ষেত্রে এই প্রকল্পে আরও ৬কোটি ৭লক্ষ টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে। শর্ত ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের টাকা ব্যাঙ্কে রাখার কারনে যে সুদ জমবে তা কেন্দ্রীয় সরকারকে ফেরত দিতে হবে। দেখা যাচ্ছে, সেই সুদ উত্তর প্রদেশ স্টেট ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড এবং উত্তর প্রদেশ রাজকীয় নির্মাণ নিগম ফেরত দেয়নি। তার পরিমাণ প্রায় ১কোটি ২৮লক্ষ টাকা।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করছিল উত্তর প্রদেশ রাজকীয় নির্মাণ নিগম। সেই নিগম এবং রাজ্যের সেচ দপ্তর তাদের কাজ বরাদ্দ টাকার চেয়ে প্রায় ৮কোটি ২০লক্ষ টাকা কমে বাস্তবায়িত করে। কিন্তু সেই টাকা তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে ফেরত দেয়নি। ওই টাকা অন্য প্রকল্পে খরচ হতে পারত বলে সিএজি মন্তব্য করেছে।


আরও আছে। প্রকল্পটির কনসালটেন্সি বাবদ এবং কনটিনজেন্সির জন্য যথাক্রমে ১কোটি ২৯লক্ষ এবং ১কোটি ৯৪ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে বলে হিসাব দেখানো হয়েছে। কিন্তু এমন কোনও টাকাই রাজ্য সরকার কোনও সংস্থাকে দেয়নি। টাকা তবে গেল কোথায়? তাছাড়া প্রকল্প বর্ণনায় এমন অনেক কিছু দেখানো ছিল তা প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন, তুলসি উদ্যানে ২টি পাথরের বেঞ্চ। রাম কী পাইরি এবং তুলসি উদ্যানে পানীয় জলের কিয়স্ক আছে। কিন্তু তা কাজ করে না। সেগুলির ট্যাপই উধাও। সোলার লাইটের ব্যাটারি চুরি হয়ে গেছে। সিএজি লিখছে, এই প্রকল্পের জন্য তৈরি করার কথা ছিল স্টেট লেবেল মনিটরিং কমিটি। তা প্রকল্প অনুমোদিত হওয়ার ২বছর পরে তৈরি হয়েছে। প্রকল্পের অগ্রগতির কোনও কেন্দ্রীয় সরকারকে নিয়মিত পাঠানো হয়নি।
কে খেলো রামের মাহাত্ম্য প্রচারে সরকারি উদ্যোগের টাকা? জবাব নেই ‘ঈশ্বরের বরপুত্র’-র কিংবা তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের।

ক্রমশ...


শেয়ার করুন

উত্তর দিন