Site icon CPI(M)

The Road Ahead

মহম্মদ সেলিম

নয়া ফ্যাসিবাদের উত্থান হচ্ছে দেশ জুড়ে। চরম দক্ষিণপন্থীরা সারা পৃথিবী জুড়ে জার্মানের নাৎসিদের মত বা ইতালির মুসোলিনির মত করায়ত্ব করতে চাইছে বিশ্বজুড়ে। ফ্যাসিবাদীদের দখল করার পদ্ধতি আলাদা, তারা সংসদীয় ব্যবস্থার পদ্ধতিকে জারি রেখেই ক্ষমতা দখল করতে চায়। আমাদের দেশে ও রাজ্যে বিজেপি ও তৃণমূল নয়া ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটাচ্ছে নিজ নিজ ভঙ্গিমায়। দুনিয়া জুড়ে যে দক্ষিণপন্থার উত্থান ট্রাম্প থেকে শুরু করে মোদী করছে, এদের অ্যাপেন্ডিক্স হল তৃণমূল। হিন্দুত্ববাদী নয়া ফ্যাসিবাদী প্রবণতা আসলে যমজ। এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সুদৃঢ় রণকৌশল তৈরী করতে হবে। এ লড়াইয়ে নিজস্ব শক্তি বাড়াতে হবে। ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে নয়া উদারবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সমস্ত অংশের বিরোধীদের নিয়ে জোট হবার কারণেই বিজেপি একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার তৈরী করতে পারেনি।

বর্তমান সময়ের রাজনীতি দাবি রাখে আমাদের রাজ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ার লক্ষ্য নিয়েই আমাদের সংবদ্ধ হতে হবে। আমাদের মতাদর্শগত চর্চায় জোর দিতে হবে। দরকার আত্ম অনুশীলন। দক্ষিণপন্থীরা রাজনীতি করে অতীতের দিকে তাকিয়ে, আর বামপন্থীরা রাজনীতি করে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। সামনের দিনে আমাদের পুরানো পন্থাকে শানিত করতে হবে ও আয়ত্ব করতে হবে নতুন পন্থা। বামপন্থীদের প্রতিরোধের স্পৃহাকে দক্ষিণ পন্থীরা ভয় পায়। বিগত পার্টি কংগ্রেসে আমাদের লাইন ছিল বিজেপি -বিরোধী সব শক্তিকে এক জায়গায় করতে হবে। আমাদের রাজ্যে তৃণমূল – বিজেপির বিরুদ্ধে বৃহত্তর ঐক্য গড়াই আমাদের লক্ষ্য।  নয়া ফ্যাসিবাদী প্রবনতার বিরুদ্ধে যেমন দেশ জুড়ে বৃহত্তর জোট হবে তেমনই আমাদের রাজ্যে, রাজ্যের পরিপেক্ষিতে সম্ভাব্য বৃহত্তর ঐক্য। তৃণমূল কংগ্রেসের যা ভূমিকা রাজ্য জুড়ে, যা তার শ্রেণীচরিত্র গত বিন্যাস, দুর্নীতির ও সন্ত্রাস, থ্রেট কালচার, তাঁদের যা রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাতে তাকে নিয়ে বৃহত্তর জোট সম্ভব নয়। তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়াই নয়, ওদের নীতির বিরুদ্ধে লড়াই। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে এই দুই দল একই ভাবে মানুষে মানুষে বিভেদের রাজনীতি করে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি নষ্ট করতে চাইছে। আমাদের লড়াই নীতির প্রশ্নে, শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে শ্রেণী বৈষম্যর বিরুদ্ধে। সেটাই মানুষকে বোঝাতে হবে।

রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার চলে যাবার পর থেকে কৃষিক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। খেতমজুররা সঠিকভাবে কাজ পান না। সারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, ফসলের ন্যায্য মূল্য কৃষকরা পান না। ধান ও আলু চাষীরা সমস্যায় আছেন। গ্রামে শহরে একই ভাবে কাজের অভাব, নির্দিষ্ট জীবিকা নেই। ভিনরাজ্যে পারি দিচ্ছেন মানুষ। কাজের সন্ধানে কৃষক,ক্ষেত্র মজুরা অন্যান্য কাজে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছেন। শ্রমজীবী মহিলাদের সমস্যা অনেক।

পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে গরিব মানুষ, খেতমজুর, কৃষক, শ্রমজীবী ও ট্রেড ইউনিয়নের কর্মীরা গ্রামে গ্রামে পদযাত্রা করেছিলেন। মানুষের কাছে বারে বারে গিয়ে তাঁদের না পাওয়ার কথা তুলে ধরেছিলেন, তুলে ধরেছিলেন অধিকার না পাবার কথা। সন্ত্রাস কবলিত এলাকায় মানুষ বেড়িয়ে এসেছিল নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল, শ্রমজীবী মানুষ আস্তা রেখেছিলেন আমাদের ওপর। জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন অনেক মানুষ। শহীদ হয়েছেন পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়াই করতে গিয়ে। মানুষ লড়াই করে মনোনয়ন পেশ করেছিলেন, শুধু ভোট লুট নয়, লুট আটকানোর চেষ্টা ও প্রতিরোধ হল। হেরে যাবার ভয়ে ব্যালট বক্স জলে ভাসানো হল। গরিব মানুষের প্রতি আস্তা না রেখে লুটেরা রাজনীতিকে আশ্রয় করলো শাসক দল।  গরিব মানুষের প্রতি দিনের পর দিন ঘটে চলা নি:ষ্পেশনের বিরুদ্ধে গরিব মানুষের প্ররিশোধস্পৃহা পরিলক্ষিত হল। যারা প্রতিরোধ করলেন, প্রতিশোধস্পৃহা দেখালেন তারা সবাই আমাদের শ্রেণীর মানুষ। তৃণমূল ও বিজেপির যে বাইনারি তা কিছুটা ভেঙে আমরা এগোতে পারলাম।

লোকসভা নির্বাচনের আগেও আহ্বান জানানো হয়েছিল, শ্রেণীর মানুষকে একত্রিত করার কথা। আগামীদিনেও তাই শ্রেণীর মানুষকে আরো ঐক্যবদ্ধ করার প্রশ্নে মানুষের ন্যায্য দাবি নিয়ে লড়াই আন্দোলনে অগ্রসর হতে হবে।

এবছর উচ্চ মাধ্যমিকে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ব্যাপক ভাবে কমেছে। ড্রপ আউটের বিচারে আমাদের রাজ্য দেশে প্রথম। এই ছাত্রদের ভবিষ্যতের কথা আমাদের ভাবতে হবে, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর পন্থা ঠিক করতে হবে। বিভিন্ন ঘটনায় আমরা মানুষের পাশে যাচ্ছি, এটা ভালো লক্ষণ কিন্তু সব ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা থাকছে না। নতুন ঘটনা, নতুন দিকে ধাবিত করছে, ফোকাস ঠিক করতে হবে, কোথায় কি হচ্ছে তা আগে থেকে উপলব্ধির মধ্যে আনতে হবে। বামেরাই যে বিকল্প রাজনীতির কথা বলে, মানুষের প্রকৃতি অধিকারের কথা বলে তা মানুষকে বোঝাতে হবে।

সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সময়ে আমরা দেখেছি, বিদেশী টাকার অনুপ্রবেশ, ধারাবাহিক ভাবে নির্বাচনগুলির সময়ও এই বিদেশী টাকা আসতে থাকে। এর উৎস খুঁজে বার করতে হবে। আমাদের মগজকে রক্ষা করতে হবে।

ফ্যাসিবাদী শক্তি উগ্র-দক্ষিণপন্থার চাষ আমাদের সকলের মধ্যে বপন করতে চাইছে। আমাদের মগজ কে রক্ষা করতে হবে, সাম্রাজ্যবাদ তথা কর্পোরেট চক্রের বিরুদ্ধে তৃণমূল-বিজেপির ঐক্যবদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে জনমতে মাধ্যমে জনগণের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে, যার নেতৃত্বে থাকবে শ্রমিকশ্রেণী, খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ  শক্তি। আমাদের মতাদর্শগত চর্চা, আন্তর্জাতিক বোধ ও পার্টি কর্মসূচির সম্মিলিত ভিত্তিতে লড়াই করতে হবে আমাদের। আমাদের নাছোড়বান্দা হতে হবে, আপোসহীন লড়াই করে উপযোগী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।

জমির লড়াই হোক বা সংস্কৃতি চর্চা, শিক্ষার পরিবেশ হোক বা শ্রমিকের  শ্রমের মূল্যের ন্যায্য দাবি, বেকারের কাজের দাবি হোক বা নারীদের প্রতি নির্যাতন, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বেহাল দশা হোক বা পরিবেশ রক্ষার লড়াই, সমাজে মানুষের সমস্যাগুলির সব ক্ষেত্রে আমাদের ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে।

আরএসএস অলক্ষ্যে থেকে তাদের জাত পাতের রাজনীতি, মানুষে মানুষে বিভেদের রাজনীতিকে মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। তৃণমূল নানান ধর্মীয় উস্কানি মূলক কথা দিয়ে আরএসএস’র কাজে শিলমোহর বসাচ্ছে। আখেরে ক্ষতি হচ্ছে মানুষের। তৃণমূল প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকে মানুষের প্রকৃতি পাওনা, অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে, ক্ষুদ্র ক্ষমতা লাভের প্রয়াসে।

মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রমান করতে হবে আমরা আছি, আমরা থাকবো। শ্রেণী সংগঠনগুলির মাধ্যমে, শ্রেণীশক্তির ভারসাম্যর পরিবর্তন শ্রেণী আন্দোলনের মাধ্যমে শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে।

কমিউনিস্টরা অতীতে বন্দী থাকে না, তারা অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে পাথেয় করে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলে। মানুষের ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর শক্তি গড়তে গেলে চেনা বৃত্ত, চেনা পথ, চেনা গন্ডি, চেনা পরিসর, কমফর্ট জোনের বাইরে বেড়িয়ে মানুষের একদম কাছের বন্ধু হয়ে উঠতে হবে। এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের আমাদের সঙ্গে থাকার কথা, কিন্তু নেই, দূরে আছেন, নানান কারণে আছেন। তাঁদের ও আমাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য লক্ষণরেখা টানা আছে, সেই লক্ষণরেখা মুছে আমাদের এক সাথে হতে হবে। যারা ওদের প্রতি আস্তা রেখে ছিলেন, ভরসা করেছিলেন, কিন্তু ঠকে গেছেন, যাদের বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে, তাদের কাছেও আমাদের যেতে হবে, ভরসা দিতে হবে। আমরাই পারি, আমরাই পেরেছি, আমরাই পারবো এই ভরসা দিতে হবে।

নদীমাতৃক দেশ আমাদের, আমাদের সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে ঘিরে। জীবন জীবিকা সব কিছু নদীকে ঘিরে, সেই নদীকে ঘিরেও এরা ধর্মীয় বিষ বপন করছে। নদীর কথা ধরেই দুজনের কথা বলা দরকার, ওস্তাদ বিসমিল্লা খান, তার আমেরিকায় যাবার আমন্ত্রণ এসেছিল, তাকে বলা হয়েছিল সবকিছু দেব, আপনি একবার আসুন। বিসমিল্লা খান প্রতুত্তরে বলেছিলেন, সব দিতে পারলেও তোমরা গঙ্গা এনে দিতে পারবে না আমেরিকায়। আর একজন হলেন মহাভারত সিরিয়ালের ডায়ালগ রচয়িতা রাহী মাসরুম রেজা। তিনি নিজেকে গঙ্গা পুত্র বলতেন। তিনি তার একটি কবিতায় বলেছিলেন, মৃত্যুর পরে আমার দেহ যে কোনো নদীর তীরে যেন কবর দেওয়া হয়, আর যেন বলা হয় গঙ্গার পুত্র এখানে দিয়ে গেলাম। কারণ সব নদী গিয়ে মেলে মহাসাগরে।

কবি রামপ্রসাদ সেন লিখেছেন, এমন মানব জমিন রইল পতিত/ আবাদ করলে ফলত সোনা। মানব জমিন অনাবাদী পরে থাকে না, সমস্ত মানব জমিন জুড়ে আমরাই ছিলাম, আবার আমাদেরই ফিরতে হবে। যারা মানুষের শান্তি কেড়েছে, তাদেরকে আমরা শান্তিতে ঘুমাতে দেব না। বাংলাকে বাঁচানোর স্বার্থে একজোট হতেই হবে। সমাজতন্ত্রই ভবিষ্যৎ, ভবিষৎমুখি সমাজতন্ত্রের স্বপ্নের কথা আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, ও মানুষের কাছে বারে বারে বলতে হবে। কঠিন কঠোর সময়ে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে কমিউনিস্টদের একত্রিত হবার কথা বলতে হয়। বুঝতে কারুর কম কারুর বেশি সময় লাগবে, কথা বলা বন্ধ করলে হবে না। মানুষের মধ্যে বিশ্বাস আনতে হবে আমরা এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য লড়তে  নেমেছি এলাকা, জেলা, রাজ্য সহ সমগ্র বিশ্বের স্বার্থে এই লড়াই।

স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে নেমেছি আমরা।

আরামদায়ক বোঝাপড়া ছেড়ে বিপরীতে দাঁড়িয়ে লড়াই করছি আমরা।

বিকল্প নীতির প্রশ্নে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

ভবিষ্যত আমাদের হবেই।

২৭তম রাজ্য সম্মেলনে জবাবী ভাষণের অংশবিশেষ

সম্পাদনা- ওয়েবডেস্ক

শেয়ার করুন