রুখে দাঁড়িয়েছে দেউচা পাঁচামী (২য় পর্ব)

কোল ইন্ডিয়া বাতিল করে, মমতা তখন কেন্দ্রের শরিক!

মমতা ব্যানার্জির দাবি পাঁচামীতে হবে ‘শিল্প।’ কিন্তু উচ্ছেদ হওয়া পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়া হবে পুলিশে! পুলিশে কেন? তাহলে কী এই ‘শিল্পে’ কাজ হবে না? রাজ্য সরকারের কয়েক লক্ষ শূণ্য পদ, সেখানে চাকরি কেন হবে না? ‘শিল্প’-র অনুসারী শিল্প থাকে। সেখানেও অনেকের কাজ হয়। অনেকে স্বনির্ভর হন। সিঙ্গুর, শালবনীতে তা স্পষ্ট জানিয়েছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। হলদিয়ায় তা প্রমাণ হয়েছিল। এবারে পাঁচামীর অনুসারী শিল্পের চেহারা কেমন হবে? কতজনের কাজ হতে পারে? সরকার চুপ। কেন? খোলা মুখ কয়লা খনির কোনও অনুসারী শিল্প হয় না। হবেও না। সবদিক থেকেই লোকসান। ২য় ইউপিএ সরকারের শরিক ছিলেন মমতা ব্যানার্জি। সেই সরকারই জানিয়েছিল যে, মহম্মদবাজারের এই কয়লা ব্লক থেকে কয়লা উত্তোলনে তারা আগ্রহী নয়। মমতা ব্যানার্জি নিশ্চই জানতেন। তাহলে সেই ‘প্রকল্প’ নিয়ে প্রায় এক যুগ পরে তিনি তেড়েফুঁড়ে উঠলেন কেন? কোনও শিল্পগোষ্ঠীকে পাঁচামী ধ্বংস করে মুনাফার সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া আছে তাঁর? এমন অনেক প্রশ্ন রয়েছে দেউচা পাঁচামীর প্রকল্পকে ঘিরে। যার উত্তর রাজ্য সরকারের দেওয়ার কথা। কিন্তু কোনও আলোচনা ছাড়াই ঝাঁপিয়ে পড়েছে পুলিশ, প্রশাসন, তৃণমূল — গ্রামগুলি থেকে উচ্ছেদে তারা মরীয়া। আশ্চর্যের হল — যে গ্রামগুলির অস্তিত্বই রাখতে চাইছে না তৃণমূলের সরকার, সেখানে এখন রাস্তা, আলো, পানীয় জলের বন্দোবস্তের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন বীরভূমের জেলা শাসক।

সরকার, তৃণমূল তাঁদের ঠকাতে নেমেছে — পাঁচামীর গ্রামবাসীদের এই সন্দেহ এখন দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। ২০১১-র ৯ই মার্চ ছিল দিনটি। লোকসভা বসেছিল। সাংসদ নৃপেন্দ্রনাথ রায়ের একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন প্রতীকপ্রকাশ বাবু পাতিল। কেন্দ্রীয় কয়লা দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন পাতিল। কেন্দ্রে ২য় ইউপিএ সরকার। মমতা ব্যানার্জি সেই সরকারের শরিক। নৃপেন্দ্র নাথ রায়ের প্রশ্নটির নং ছিল ২০৭৮। প্রশ্নটিতে সাতটি ভাগ ছিল। মোদ্দা বিষয় ছিল একটিই — বীরভূমের দেউচা পাঁচামির কোল ব্লক থেকে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে তৃণমূল সমর্থিত কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা কী?

কয়লা মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী জবাব দিয়েছিলেন। লিখিত। সেই জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন —প্রথমত, ওই প্রকল্পে কোল ইন্ডিয়া যুক্ত থাকবে না। দ্বিতীয়ত, দেউচা পাঁচামি এলাকায় মাটির তলায় যে কয়লা মজুত আছে, তা বেশ নিম্ন মানের। গ্রেড সি এবং গ্রেড জি পর্যায়ের। তৃতীয়ত, রাজ্য সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান এবং ন্যাশনাল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন একটি জেভি(জয়েন্ট ভেনচার) গড়ে তুলেছে, এমন কিছু কেন্দ্রীয় সরকার জানে না। তবে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে দেউচা পাঁচামির জন্য কোল ইন্ডিয়া, ন্যাশনাল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন, ওয়েস্টবেঙ্গল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট এবং ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের মধ্যে একটি যৌথ উদ্যোগের প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাতে থাকবে না।

প্রশ্ন হলো — যদি দেউচা পাঁচামি খুবই ‘সম্ভাবনাময়’ হয়, তবে তৃণমূল সেদিন রাজ্যের স্বার্থের কথা ভেবে কেন্দ্রীয় সরকারকে কেন চাপ দেয়নি? কেন মমতা ব্যানার্জি সেদিন চুপ করেছিলেন?

দেউচা পাঁচামির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারই জানিয়েছিল — তারা আগ্রহী নয়। কারন — সেখানে কয়লার মান ভালো নয়। কোল ইন্ডিয়ার বিশেষজ্ঞরা এই মত দিয়েছিলেন। মমতা ব্যানার্জি তা জানতেন। তবু এবার তিনি এগিয়েছেন। বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষকে উচ্ছেদ করে খোলা মুখ কয়লা খনি করতে চাইছেন। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ওয়েস্টবেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন(পিডিসিএল)কে। যাদের এমন কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। নেই বিশেষজ্ঞ। নেই কারিগরি সামর্থ্যও।

এখন প্রশ্ন হল — তাহলে কাদের জন্য মহম্মদবাজারের এই গ্রামগুলি উজাড় করে মুনাফার রাস্তা খুলে দিতে চাইছেন তৃণমূল নেত্রী?

সম্প্রতি মুম্বাইয়ে গিয়ে মমতা ব্যানার্জি বলেছেন যে, ‘পশ্চিমবঙ্গে আদানি, আম্বানিরা স্বাগত।’ শিল্পে বেসরকারি পুঁজি লাগে। কিন্তু সেই শিল্পে তা স্বাগত, যা কাজের সুযোগ সৃষ্টি করবে। অনুসারী শিল্পের জন্ম দেবে। যেমনটা সিঙ্গুর, শালবনীতে বামফ্রন্ট সরকার করতে চেয়েছিল। কিন্তু খোলা মুখ কয়লাখনিতে কতজনের কাজ হবে? যদি কাজ হত, তাহলে পাঁচামীতে পুলিশে চাকরি দেওয়ার ‘প্যাকেজ’ মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করতেন না। খোলা মুখ কয়লা খনি কোনও অনুসারী শিল্পেরও সৃষ্টি করে না। অর্থাৎ এই প্রকল্পে রাজ্যের মানুষের লাভ নেই। বিশেষ কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করছে না। শুধু তাই নয়, খোলা মুখ কয়লা খনি পরিবেশের বিপুল ক্ষতি করবে।

এখানেই শেষ নয়। তারপরের ঘটনাবলীও প্রমাণ করেছে দেউচা পাঁচামি আদৌ ‘উৎসাহজনক’ কোল ব্লক নয়।

নরেন্দ্র মোদী ২০১৪-র মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী হন। তার দু’ বছর পর ২০১৬-তে কেন্দ্রীয় সরকার বীরভূমের এই কয়লা ব্লকটি থেকে কয়লা তোলার জন্য প্রস্তাব দেয় ৬টি রাজ্যকে — পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ এবং কর্ণাটক। কিন্তু বিহার, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, কর্ণাটক এবং তামিলনাডু এই প্রকল্প থেকে পিছিয়ে যায়। অবশেষে পশ্চিমবঙ্গের পিডিসিএল এখানে কয়লা তোলার বরাত পায় ২০১৮-তে।

সবাই পিছিয়ে গেল কেন? বিস্তর খরচের আশঙ্কায়। দেউচা পাঁচামি থেকে কয়লা তোলার জন্য খুঁড়তে হবে খুব শক্ত মাটি। প্রায় ২২৫-২৪৫ মিটার। তা মূলত আগ্নেয়শিলা। এরজন্য প্রচুর খরচ হয়

মমতা ব্যানার্জির সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বীরভূমের মহম্মদবাজারের দেউচা পাঁচামী এলাকায় অন্তত ৩৪০০ একর জমিতে খোলামুখ কয়লা খাদান হবে। তার জন্য আশেপাশের আরও জমি ধ্বংস হবে। এই এলাকার গ্রাম সব নিশ্চিহ্ন হবে। জঙ্গল সব সাফ হবে। পুকুর, মাজার, গোরস্থান, আদিবাসীদের পূজার থান, স্কুল যে কটি আছে — সব মিশিয়ে দেওয়া হবে মাটিতে। তৃণমূলের সরকার কী মারাত্মক পথে চলেছে তা বোঝা যায় হরিণশিঙা আর শালুকার তফাৎ দেখে। প্রশাসনের চালাকি ধরা পড়ে গেছে।

প্রশাসন প্রায় একবছর আগে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল কয়েকটি এলাকায়। যেমন শালুকা। সেখানে প্রথমে কয়েকটি বাড়িতে সমীক্ষা করে সরকার রিপোর্ট তৈরি করার পরিকল্পনা করেছিল। বিষয়টি বুঝে চেপে ধরেন রতন সিংহরা। ‘শালুকা-কবিলনগর-মকদমপুর ভূমি রক্ষা কমিটি’-র সভাপতি, তৃণমূল নেতা রতন সিংহ বলেন,‘‘আমরা দেখলাম কোনোরকমে জোড়াতালি সমীক্ষা হচ্ছে। আমরা দাবি করলাম সব বাড়িতে সমীক্ষা করতে হবে। কার কী আছে সব লিখতে হবে। কে ভাগচাষি, কে পাট্টাদার, কার কত জমি— সব দেখতে হবে। সেটা হলো। আমরা প্রত্যেকে তার কপি চাইলাম। তারপর সমীক্ষা হলো।’’

শালুকা, কবিলনগর, মকদমপুরে সম্পন্ন লোক আছেন। কিন্তু সাগরবাথান, হাবড়াপাহাড়ি, হরিণশিঙা, কেন্দপাহাড়ি, মথুরাপাহাড়ি, দেওয়ানগঞ্জে কী হয়েছে? সেখানে বেশিরভাগ মানুষ গরিব। পাথর ভাঙা, ক্রাশার আর ছোট জমিতে চাষ— এই তাঁদের জীবনযাপনের পাথেয়। সেখানে আদিবাসীরা বেশি। আছেন তফসিলিরাও। সেখানে সমীক্ষা হয়েছে? হরিণশিঙার সুনীল মার্ডির কথায়,‘‘কোথায় প্রশাসন? আমাদের সঙ্গে কেউ কথা কয়নি। বাড়ি বাড়ি এসে জিজ্ঞেস? প্রশাসনের কোনও লোককে গত কয়েকবছর গ্রামে দেখা যায়নি।’’ হরিণশিঙার ভাগচাষি রামযতন মির্ধা খেতে ছিলেন। সপরিবারে— স্ত্রী বিলাসী মির্ধা, ছেলের স্ত্রী ললিতা মির্ধা, মেয়ে অঞ্জলি মির্ধা একসঙ্গে ধান কাটছিলেন। আমরা ‘কয়লার পক্ষে কথা বলতে আসিনি’ জেনে এগিয়ে এলেন। বললেন,‘‘সরকার কী করে জানল আমরা এই প্যাকেজে রাজি? কোথায় জমি দেবে? কোথায় কাজ পাবো, এত ছোট ৬৫০ বর্গমিটার ঘরে আমরা থাকতে পারব কিনা — সরকার জানতে চেয়েছে। ইচ্ছা হলো আর ঘোষণা? এখানে সবাই অনিচ্ছুক। গাঁ ঘুরে কয়লার পক্ষে লোক পাবেন না।’’

সরকারের কোনও প্রতিনিধি বিস্তীর্ণ এই এলাকায় সমীক্ষাই করেনি। জানতেই চায়নি কার কী আছে!

প্রথম পর্ব পড়তে এই লিংকে প্রবেশ করুন।


শেয়ার করুন