রবিকর গুপ্ত
১৯১৭-এর নভেম্বরের দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন ও তার পরবর্তী বলশেভিক বিপ্লবের গতি-প্রকৃতি যখন আলোচনা করা হয়, তখন আমাদের নজর সাধারণতঃ থাকে বিপ্লবের প্রধান কেন্দ্র মস্কো বা পেট্রোগ্রাদের দিকে। আরেকটু বিস্তারিত আলোচনার সময় উঠে আসে ইউক্রেন এবং ককেশাসে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কাহিনী। আলোচনায় আসে ইউক্রেনে দেনিকিনের শ্বেত বাহিনীর সঙ্গে লাল ফৌজের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম বা ককেশাসে বাকু সোভিয়েতে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ২৬ জন কমিসারের দুঃসাহসের কথা। অবশ্যই এই ইতিহাস স্মরণীয়। কিন্তু এই সব বিপ্লবী কর্মকান্ডের কাহিনী-তে জোর দিতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই, সোভিয়েত বিপ্লবের মূল কেন্দ্র ইউরোপীয় রাশিয়া হলেও বিপ্লবের অগ্নিশিখা শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মধ্য এশিয়ায় ও দূর প্রাচ্যে – প্রশান্ত সাগর তীরে প্রাইমোরিয়ার শেষ দুর্গ পর্যন্ত উড্ডীন হয়েছিল রক্তে রাঙা শ্রমিক পতাকা। এই কাহিনীগুলি বর্তমানে অনেকটাই তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। এই বিস্মৃতির ধোঁয়াশায় কিছু আলোকপাত করার উদ্দেশ্যেই এই লেখার অবতারণা।
১৯১৭ সাল নাগাদ রুশ সাম্রাজ্য অধিকৃত মধ্য এশিয়া তিনটি রাজনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল – তুর্কিস্তান, বোখারা ও খিভা। এর মধ্যে তুর্কিস্তানের তাশখন্দে নভেম্বর বিপ্লবের ঠিক পরেই ১৯১৭ সালের ১৫-ই নভেম্বর শ্রমিক, কৃষক, সৈনিকদের নিয়ে বসে সোভিয়েতের অধিবেশন। এই সভায় বলশেভিকরা সব ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি পেশ করে। অপরদিকে ১৭-ই নভেম্বর তাশখন্দেই অনুষ্ঠিত হয় তথাকথিত ‘মুসলিম সম্মেলন’ – যা প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় অভিজাত ও উলেমাদের সম্মেলন ছিল। সেখানে উলেমাদের নেতা শের আলি সব ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব বর্জন করেন এবং ধর্ম ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার জিগির তোলেন। শের আলির ‘মুসলিম’ ঐক্য ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল প্রস্তাবের প্রকাশ্য উত্তর দেন খোজান্ত থেকে আগত এক শ্রমিক প্রতিনিধি – রহিমবায়েভ। তিনি বলেন শের আলি যে মুসলিম সম্মেলন ও মুসলিম স্বার্থের কথা বলছেন – তা আসলে উলেমাদের সংগঠন আর উলেমাদের স্বার্থ। মুসলিম মেহনতি জনতার স্বার্থ সোভিয়েতই রক্ষা করেছে আর সোভিয়েতই করবে। এই বাদানুবাদের মধ্যে দিয়েই স্পষ্ট হয়ে যায় আলোচনায় আর কাজ হবে না। একদিকে মেহনতি জনতার স্বার্থ আর অন্যদিকে বেগ আর উলেমাদের স্বার্থ। এই দুই স্বার্থে মিলমিশ হওয়া ছিল অসম্ভব। স্পষ্ট হয়ে যায়, ফয়সালা হবে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মাধ্যমেই।
‘সব ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে দিতে হবে’ - এই প্রস্তাব গ্রহণের পর পর-ই তাশখন্দ, ফার্গানা ও সমরখন্দ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় সোভিয়েত শাসন। কিন্তু সেমিরেচিয়ে অঞ্চল এবং ট্রান্স-কাস্পিয়ানের একটি বিশাল এলাকা সোভিয়েত শাসনের বাইরে ছিল। মধ্য এশিয়াতে সোভিয়েত শাসন প্রতিষ্ঠা ও নির্বাচিত গণ-কমিশারদের কার্যাবলী শুরু হতে না হতেই তাঁদের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু হয় – এবং এতে অগ্রণী ভূমিকা নেয় ‘সভবদনি সমরকন্দ’-এর মতো পত্রিকা। তাদের প্রাথমিক অভিযোগ কী ছিল, তা থেকেই শ্রেণি বিভাজনের প্রশ্নটি স্পষ্ট বোঝা যায়। এই পত্রিকায় রীতিমত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে লেখা হয় সোভিয়েত শাসন ও বলশেভিকরা এতই অশিক্ষিত যে তাঁদের বিভিন্ন ডিক্রি ও বিজ্ঞপ্তিও ভুল বানানে ভরা। এই ছোটলোক এবং অশিক্ষিত শ্রমিকদের হাতে ক্ষমতা থাকলে কী বিপদ হতে পারে – তা নিয়েও এই পত্রিকা তার পাঠকদের বার বার সচেতন করে। কিন্তু ইতিহাসের গতি স্তব্ধ করার ক্ষমতা প্রতিক্রিয়াশীলদের ছিল না। সোভিয়েত যে নিম্নবর্গের মানুষরা চালাচ্ছিলেন – প্রথাগত শিক্ষা তাঁদের না থাকতে পারে, বিজ্ঞপ্তি ও প্রস্তাবের বানান তাঁদের ভুল হতে পারে – কিন্তু তাঁদের শ্রেণি স্বার্থ সম্পর্কে গভীর সচেতনতা ছিল। সোভিয়েতের তৃতীয় অধিবেশনেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন সব ক্ষমতা শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকের হাতে তুলে দেওয়ার। এর প্রত্যুত্তরে ২৭-শে নভেম্বর কোখন্দে শুরো-ই-ইসলামিয়া এবং আলাশ ওর্দা-র মতো সংগঠনগুলি মিলিত হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের গঠন করেন। শুরো-ই-ইসলামিয়ার মুস্তাফা চোকায়েভ এই সরকারের প্রধান হন। প্রাথমিক ভাবে এই সরকারে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী থেকে সর্ব-তুর্কিবাদী - অনেক মতের মানুষ-ই ছিলেন। কিন্তু ক্রমে এটি মুস্তাফা চোকায়েভের হাত ধরে মোল্লাতন্ত্রের অভিমুখে ধাবিত হয়। সেপ্টেম্বরেই ঘোষণা করা হয় এই নতুন সরকার শুধু মোল্লাদের নিয়ে গঠিত একটি সভা-কে সর্বোচ্চ বিচার সভা হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। মোহম্মদজান তিনিশবায়েভের মতো সর্ব-তুর্কিবাদীদের কোনঠাঁসা করে ফেলেন চোকায়েভ। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে চোকায়েভ শ্বেত সেনাপতি দুতভকে প্রেরণ করেন কাশগড়ে, উদ্দেশ্য ব্রিটিশ কন্সালের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নতুন করে যে ‘ইতিহাস’ লেখা হচ্ছে, তাতে এই কালপর্বে মুস্তাফা চোকায়েভের মত চরিত্র-কে মধ্য এশিয়ার সত্যিকারের জাতীয়তাবাদী বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। বলা হয়, ‘বহিরাগত’ বলশেভিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ‘স্থানীয়’ ও ‘জাতীয়তাবাদী’ শক্তি ছিলেন তাদের মত মানুষেরা। আদতে এদের প্রকৃত স্বরূপ ছিল শ্রেণি স্বার্থ রক্ষা করতে আগ্রহী সুবিধাবাদীর, যারা বলশেভিকদের ঠেকাতে ব্রিটিশদেরও ডেকে আনতে রাজি ছিল। স্থানীয় স্বাধীনতা, সর্ব-ইসলামবাদ বা সর্ব-তুর্কিবাদ ছিল এই স্বার্থপর সুবিধাবাদের আবরণ মাত্র। আদত লড়াই ছিল বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আগ্রহী শাসক গোষ্ঠীর এবং স্থানীয় মেহনতি জনতা নিয়ে গঠিত সোভিয়েত শক্তির মধ্যে। প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ ও. লাটিমোর, যাঁকে কোনোভাবেই কমিউনিস্ট (এমনকি বামপন্থীও) বলা চলে না, তিনি এই সময়ে মধ্য এশিয়ার সামাজিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কী লক্ষ্য করেছিলেন তা একবার এই সূত্রে ঝালিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘বিপ্লব যতই রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে শ্রেণিযুদ্ধের দিকে এগিয়েছে, ফাটলের রেখা তত বেশি ব্যবধান সৃষ্টি করেছে দু’পক্ষর মধ্যে – এক পক্ষে, যারা বিত্তশালী (রুশ ও অ-রুশ নির্বিশেষে), প্রাচীন নিয়মকানুন যতটুকু সাধ্য সংরক্ষণ করতে যুদ্ধরত ; আর অন্যপক্ষে রুশ-অ-রুশ নির্বিশেষে সর্বহারার দল যারা সম্পূর্ণভাবে নতুন এক জীবনধারা নির্মাণ করতে চায়।’ বর্তমানে এইরকমও প্রচার করা হয়ে থাকে, সোভিয়েত সরকার জাতীয় স্বশাসনের একেবারেই সপক্ষে ছিল না। এও একেবারেই ভিত্তিহীন বক্তব্য। লেনিন বহুবার বহুরকম ভাবে এই প্রসঙ্গে সোভিয়েত সরকার ও বলশেভিক পার্টির অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন। তাঁর কথা বাদ দিলেও ১৯১৮ সালেই সোভিয়েতের কংগ্রেসে কমিউনিস্ট নেতা তবলিন ঘোষণা করেন যে বলশেভিকরা শুধু জনজাতির স্বশাসন নয়, ইচ্ছানুসারে প্রজতান্ত্র থেকে তাদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অধিকারের পক্ষেও বটে। তবে এর পাশাপাশি এই প্রশ্নও উত্থাপন করা হয়, এই স্বশাসন ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার জনজাতির কোন অংশের জন্য ? তবলিনের ভাষণের এই অংশটি এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, ‘যাদের স্বায়াত্তশাসনের কথা আমরা বলছি তারা, আমাদের মতে, হল দেশের সত্যিকারের মালিক – মেহনতি জনগণ। আমরা শুধু এই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা মুখেই বলছি না, সমস্ত সম্ভাব্য উপায়ে তাকে কার্যক্ষেত্রে রূপান্তরিত করার চেষ্টাও করছি…স্থানীয় বা রুশ বুর্জোয়া যাদের কাছ থেকেই প্রতিবিপ্লব আসুক না কেন, আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে তার মোকাবিলা করছি।’ অর্থাৎ তবলিন স্পষ্ট করে দেন, এখানে জাতিগত স্বশাসনের অধিকারের ক্ষেত্রেও শ্রেণি প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে না। জনজাতিগুলির মেহনতি অংশেরই স্বশাসনের অধিকার রয়েছে এবং সেই অংশ থেকে উঠে আসা নেতৃত্বেরই একমাত্র প্রয়োজন মনে হলে প্রজাতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার রয়েছে। এই সকল জনজাতি সমূহের ‘জোঁক’ (রাহুল সাংকৃত্যায়নের থেকে ধার করে বললে) বা শোষক শ্রেণির কোনো স্বশাসনের দাবিকে বা বিচ্ছন্নতাবাদকে সোভিয়েত সরকার মেনে নেবে না এবং উল্টো দিকে মেহনতি অংশের স্বশাসন প্রতিষ্ঠার লড়াইকে সোভিয়েত সরকার শুধু মৌখিক ভাবেই না কার্যক্ষেত্রেও সকল প্রকার ভাবে সমর্থন করবে।
এ শুধু ফাঁকা কথা ছিল না। ১৯১৮ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে জাইৎসেভের শ্বেত কসাক বাহিনী কোখন্দের উগ্র ইসলামপন্থী সরকার ও দুতভের সঙ্গে সহযোগিতা শুরু করে। ১৯১৮ সালে কোখন্দের ‘জাতীয়তাবাদী’ (পশ্চিমের ভাষ্য অনুসারে)-দের ডেকে নিয়ে আসা এই কসাক বাহিনীকে স্থানীয় লাল ফৌজ সমরখন্দের নিকট পরাজিত করে। ফর্গানা, সমরখন্দ, আন্দিজান সর্বত্র গ্রামে গ্রামে লাল পতাকা উড্ডীন হতে থাকে। ভূমি সংস্কারের কাজ কর্ম শুরু হলে সোভিয়েতের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন এক ধাক্কায় বহুগুণ বেড়ে যায়। এরপর সোভিয়েত শক্তি কোখন্দের প্রতিবিপ্লবীদের মূল ঘাঁটিতে শেষ আঘাত করতে প্রয়াসী হয়। ফার্গানা, সমরখন্দ, আন্দিজান সর্বত্র থেকে স্থানীয় মানুষ দলে দলে লাল ফৌজে যোগদান করেন। ২২-শে ফেব্রুয়ারি কোখন্দের সরকারের পতন হয়। স্থানীয় কৃষকরা সংগ্রামে লাল ফৌজেরই পক্ষ অবলম্বন করেছিল। কোনো ধর্মীয় জিগিরই তাঁদেরকে সোভিয়েত বিরোধী করতে পারেনি। স্থানীয় লাল ফৌজের সঙ্গে লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে ছত্রভঙ্গ প্রতিবিপ্লবী শক্তির এক অংশ বোখরার আমিরের দলে যোগদান করে, অপর অংশ ফার্গানা উপত্যকায় ‘বাসমাচি’ দল গঠন করে সোভিয়েত বিরোধী গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। এরপর ১৯১৮ সালের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে তুর্কিস্তানের সোভিয়েত সরকার রাশিয়ার কেন্দ্রীয় সোভিয়েত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলে। ১৯১৮-এর ৩০-শে এপ্রিল নতুন তুর্কিস্তান সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের সংবিধি সোভিয়েতের পঞ্চম কংগ্রেসে অনুমোদিত হয়। এর মাধ্যমে স্থানীয় সোভিয়েত তুর্কিস্তানের স্বায়াত্তশাসনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল – তা পূর্ণ হয়। স্বয়ং লেনিন নতুন প্রজাতন্ত্রকে শুভেচ্ছাবার্তা ও সহযোগিতার আশ্বাস প্রেরণ করেন। অক্টোবর মাসের মধ্যে প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। লড়াই অবশ্য এতেই শেষ হল, এমন মনে করা ভুল। তখনও মধ্য এশিয়ার একটা বড়ো অংশে শ্বেত বাহিনী ও স্থানীয় অভিজাতদের সৈন্য উপস্থিত এবং গৃহযুদ্ধ জনিত কারণে এইসময় রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে তুর্কিস্তান সোভিয়েতের সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তাই চাইলেও লেনিন মধ্য এশিয়ার প্রথম প্রতিষ্ঠিত এই শিশু সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রকে তেমন সাহায্য করতে পারেননি। কিন্তু বিপ্লবের কাজ তাতে থেমে থাকেনি। যে সময়ে খিভায় জুনাইদ খানের বাহিনী তুর্কিস্তান সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই তুর্কিস্তান সোভিয়েত প্রতিষ্ঠা করেছিল মধ্য এশিয়ার প্রথম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় – তাশখন্দের তুর্কিস্তান গণ বিশ্ববিদ্যালয়। পুরাতনের ধ্বংস ও নতুনের সৃষ্টি – এই দুই কাজেই মধ্য এশিয়ার প্রথম সোভিয়েত শক্তি পরিচয় দেয় অসামান্য দক্ষতার।
১৯১৮ থেকে ১৯২০-এর মধ্যে খিভায় জুনাইদ খানে শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। অত্যন্ত অত্যাচারী শাসক জুনাইদকে কেন্দ্র করে মধ্য এশিয়ায় সোভিয়েত বিরোধী অক্ষ গড়ে উঠতে থাকে। তাঁকে কেন্দ্র করে সংহত হয় তুর্কিস্তান থেকে বিতাড়িত জাইৎসেভের বাহিনী, কোখন্দ সরকারের লোক-লস্কর আর ওরেনবুর্গের কুখ্যাত লুটেরা কসাক বাহিনী। স্থানীয় মার্কিন কনসাল, ফরাসী এজেন্ট কাস্তান ও ব্রিটিশ কর্নেল বেইলী অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে জুনাইদকে সহায়তা করতে থাকেন। এর বিরুদ্ধে খিভার কমিউনিস্টরা সংহত করে স্থানীয় কৃষক ও কারিগরদের। চাল আর আটার গুদামের দখল নিতে থাকে তারা। পাল্টা প্রত্যাঘাতে বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া থেকে গরিব কৃষকদের শেষ সম্বল গবাদি পশু হত্যা – জুনাইদ খান সবরকম দমন পীড়নই চালাতে লাগলেন। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত ফল হল। পেটানো ইস্পাতের মতো খিভার বিপ্লবী বাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল। কুনা-উর্গঞ্জের কৃষকরা বলশেভিকদের নেতৃত্বে শুরু করলেন সশস্ত্র সংগ্রামের। এদিকে জুনাইদ এঁদের ও নবপ্রতিষ্ঠিত তুর্কিস্তান সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে জোরালো সংগ্রাম শুরু করলেন। তাঁর পেছনে ছিল ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য ও শ্বেত সেনাপতি কোলচাকের মদত। কিন্তু সোভিয়েত বিপ্লবীরা সংখ্যায় ও অস্ত্রে খাটো হয়েও প্রমাণ করলেন চকমকে নতুন রাইফেল কোন বিষয়ই না, যদি সঙ্গে জনগণ ও জনগণের থেকে উঠে আসা নেতারা থাকেন। নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন রহমান প্রিমবেতভ, আহমদজান ইব্রাহিমভ, কুরবান বেকনিয়াজভ, আব্দুল্লায়েভ, ন. সলাপভ ও অন্যান্য কমিউনিস্ট ব্যক্তিত্ব। স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে তাঁদের তৈরি গেরিলা বাহিনী মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় ভিয়েতনামের পাঁচ দশক আগে ভিয়েতনাম নির্মাণ করল। মোটামুটি পুরো প্রচেষ্টাই গড়ে উঠেছিল স্থানীয় উদ্যোগে ও স্থানীয় নেতৃত্বের পরিচালনায়। তবে এঁরা পরামর্শ ও সাহায্য পেয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম লাল সেনাপতি মিখাইল ফ্রুঞ্জে ও কুইবিশভের থেকে।
খিভার মেহনতি জনতাদের নিয়ে তৈরি এই গণ-বাহিনীর সামনে জুনাইদের ভাড়াটে সেনা বেশিদিন টিকতে পারল না। ১৯২০-এর ২-রা ফেব্রুয়ারি কমিউনিস্ট পার্টিজানরা খিভা শহর দখল করল। জুনাইদ খানের শাসনের অবসান ঘটিয়ে খিভা বিপ্লব জয়যুক্ত হয়েছে বলে ঘোষণা করা হল। খিভা বিপ্লবের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল, এই বিপ্লবের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল দরিদ্র কৃষকরা। এমনকি তুর্কিস্তানের বিপ্লবেও দেখা গেছে কৃষকদের অংশগ্রহণ থাকলেও চালিকা শক্তি ও নেতৃত্ব এসেছিল শ্রমিক শ্রেণির পক্ষ থেকে। এই প্রেক্ষিতে এই ঘটনা ভবিষ্যৎ চীনের বিপ্লবের সম্ভবনার দিকে ইঙ্গিত করেছিল – একথা বললে বোধ হয় খুব ভুল বলা হবে না। খিভার বিপ্লবী সরকার আরেক বিষয়েও ভীষণ উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়। মধ্য এশিয়ায় তাঁরাই প্রথম সরকারী নীতি হিসেবে অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্থ উলেমাদের দ্বারা পরিচালিত ওয়াকফের অবসান ঘটায়। ওয়াকফের জমি নতুন সরকার সাধারণ মানুষের মধ্যে বন্টনের নীতিকে গ্রহণ করে ও তা যুদ্ধপরিস্থিতির মধ্যেই প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হয়। যে খিভা একসময় ইসলামিক মৌলবি-দের আখড়া ছিল, সেখানে এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে ছিল একটি ভীষণ বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। এই সরকার তুর্কিস্তান সোভিয়েতের অনুকরণে ও স্ব-শাসনের নীতির উপর ভিত্তি করে খোরজম সোভিয়েত গণ-প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
তুর্কিস্তান এবং খিভার পর মধ্য এশিয়ায় প্রতিবিপ্লবীদের হাতে আর একটি রাজ্যই রইল – বোখরা। বোখারা ছিল মধ্য এশিয়ায় মোল্লাতন্ত্রের কেন্দ্র। এখানকার আমির সৈয়দ ওলীমখান সোভিয়েতদের বাধা দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। ব্রিটিশরা তুর্কিস্তান আর খিভার পর বোখরায় – ভারতের একেবারে দ্বারপ্রান্তে বিপ্লব এসে পৌঁছক, তাতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। ১৯১৯ নাগাদ প্রায় তিনশো উঁট বোঝাই ব্রিটিশ হাতিয়ার বোখরায় আফগানিস্তানের মধ্যে দিয়ে প্রেরিত হয়। আমিরের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে আসে প্রায় তিনশো ব্রিটিশ অফিসার। এঁদের মধ্যে কর্নেল পদের দুজন অভিজ্ঞ সামরিক অফিসারও ছিলেন – কর্নেল ল্যাম্বার্ট ও কর্নেল বেইলি। আমির এই অস্ত্রবলে বলীয়ান হয়ে জেহাদের ডাক দিলেন। তাঁর পতাকা তলে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ব্রিটিশ প্রশিক্ষিত উগ্র-ইসলামপন্থী সেনা এসে যোগ দিলেন। বোখরার কমিউনিস্ট পার্টিও হাত গুটিয়ে বসে ছিল না। ১৯১৯-এর মধ্যে স্থানীয় চাষি ও কারিগরদের মধ্যে ২৮-টি ও সেনাবাহিনীতে ১৩-টি পার্টি শাখা সক্রিয় ছিল। শহরীসব্জ, কারাকুল ও ওয়াবখন্দ এবং পুরনো বোখরায় পরপর পার্টির নেতৃত্বে গণবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। শুধু পুরনো বোখরার অভ্যুত্থানেই পাঁচশ লোককে বন্দি ও ঊনসত্তর জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। কিন্তু পার্টি এতে দমে যায়নি। ইস্পাতের মতো আগুনে পুড়ে আরও দৃঢ় হয়েছিল। এই সংগ্রামগুলির মধ্যে দিয়েই উঠে এসেছিল ইর্গিশ মুসাবায়েভের মতো নেতৃত্ব। এইখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়। বোখরায় কমরেডদের উপর এই ব্যপক অত্যাচারের সময়েও সোভিয়েত সরকার হস্তক্ষেপের ব্যাপারে ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। ফ্রুঞ্জে ও লেনিনের মধ্যে এই বিষয়ে যে চিঠি বিনিময় হয়েছিল তা লক্ষণীয়। ফ্রুঞ্জে লেনিনকে লেখেন বোখরায় কবে অভ্যন্তরীণ বিপ্লব হবে তার জন্য বসে না থেকে অনেক সহজ কাজ তুর্কিস্তান ও খোরজম সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের শক্তি এক করে আমিরকে উৎখাত করা। এই বিষয়ে রুশ সোভিয়েত সরকারের লাল ফৌজও বাইরে থেকে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এই বিষয়ে লেনিন যে উত্তর দিয়েছিলেন, তা উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন বোখরায় কোন স্থানীয় বিপ্লবের কেন্দ্র গড়ে উঠলে ও তারা সহায়তা চাইলে তখন-ই সোভিয়েত হস্তক্ষেপ করা যেতে পারে। নচেত বেয়োনেটের ডগায় বাইরে থেকে সমাজতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা কার্যত লাল ফৌজকে মুক্তিবাহিনী থেকে ভিনদেশী দখলদারে পরিণত করবে। তুর্কিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্থ কংগ্রেসে এই মতই গৃহীত হয়। বলা হয় – ‘…বোখরার নিজের জনসাধারণের ভিতর থেকেই জেগে-ওঠা বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হবার সেই স্বাভাবিক মুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করে থাকতেই হবে…’। অবশেষে সেই কাঙ্খিত অভ্যুত্থান ঘটে ১৯২০ সালের ২৮-শে আগস্ট বোখরা কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক চারজৌ দখলের মধ্য দিয়ে। ফ্রুঞ্জের বাহিনী বিপ্লবীদের আহ্বানে সাহায্য করতে ছুটে আসে। তুমুল যুদ্ধের পর অবশেষে ১৯২০ সালের ৬-ই সেপ্টেম্বর বোখরার পতন হয়। অক্টোবরে নতুন গণপরিষদ গঠিত হয় এবং বোখরা একটি সোভিয়েত গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
বোখরার বিজয়ের মধ্যে দিয়েই মধ্য এশিয়ায় সোভিয়েত শক্তির প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শেষ হয়। এরপরেও ১৯২৩-২৪ পর্যন্ত সর্ব-ইসলামবাদী ও সর্ব-তুর্কিবাদী বাহিনী মধ্য এশিয়ায় সক্রিয় ছিল, বাসমাচি আন্দোলনের বিরুদ্ধেও সোভিয়েত শক্তিকে সব সময় সতর্কতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হত। কিন্তু মোটের উপর সোভিয়েত ব্যবস্থা টলানোর মতো পরিস্থিতিতে আর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো আসেনি। বিপ্লবের বিজয়ের পর সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ, জাতি প্রশ্নের বিতর্ক এবং অবশেষে বৃহত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগদান একটি পৃথক কাহিনী – তার আলোচনা এই লেখায় সংক্ষেপে শুধু ছুঁয়ে গেলে তার প্রতি সুবিচার হবে না। তাই মূল উপসংহারে আসা যাক। রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ পূর্ণ হল গত ২০১৭-তে, কিন্তু তখনও বিভিন্ন আলোচনায় লক্ষণীয় ভাবে অনুপস্থিত ছিল মধ্য এশিয়া ও সুদূর প্রাচ্যের বলশেভিক বিপ্লবের কাহিনী। সূচনায় লিখেছিলাম এই বিস্মৃতির ধোঁয়াশায় আলোকপাত-ই এই লেখার উদ্দেশ্য। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, শুধু ম্লান বা ধোঁয়াশাপূর্ণ স্মৃতির প্রশ্ন এটা নয়, ভাষ্যের প্রশ্নও বটে। আসলে সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকাকালীনই পশ্চিম থেকে এই বক্তব্য বারবার পেশ করা হত, মধ্য এশিয়া বা দূর প্রাচ্যে আলাদা করে কোনও বিপ্লব হয় নি, বরং তা ছিল রুশ বলশেভিকদের মস্কো-পেট্রোগ্রাদ অঞ্চলের বিপ্লবের কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটি ব্যবস্থা – বস্তুত জারের আমলের রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদেরই নামান্তর। বর্তমানে এমনকি বহু বামপন্থী লেখকের তরফ থেকেও শুনতে পাওয়া যায় মধ্য এশিয়ায় নাকি সমাজতান্ত্রিক কোন বিপ্লবের পূর্বশর্তই ছিল না এবং সেখানে সোভিয়েত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাইরের ক্ষমতা বলে – স্থানীয় জনতার সমর্থনে নয়। এখানে কোন শ্রেণি দ্বন্দ্ব থেকে বিপ্লব উদ্ভূত-ই হয় নি। একটু বিচার করে দেখলে বোঝা যাবে বিষয়টি আদৌ তা নয়। মধ্য এশিয়ায় রুশ সাম্রাজ্যের শাসন সেখানে মূলতঃ স্থানীয় অভিজাত ও মোল্লাতন্ত্রের সহযোগিতায় পরিচালিত হত। প্রকৃতপক্ষে শ্রেণি সংগ্রামের সূত্রে আমরা যদি মধ্য এশিয়ায় সোভিয়েত বিপ্লবকে ব্যাখ্যা করতে চাই, তাহলে আমরা একদিকে পাব – এই রুশ শাসকশ্রেণি, স্থানীয় অভিজাত ও মোল্লাতন্ত্র আর অন্যদিকে পাব রুশ ও মধ্য এশিয় সাধারণ শ্রমিক, ভূমিহীন চাষী ভাগ চাষী ও গ্রামীণ কারিগর। বিশেষ করে চারিককার ও মরদিককার নামক ভূমিহীন কৃষকশ্রেণি, যাঁদের আমরা গ্রামীণ সর্বহারা বলতে পারি – তাঁরা এই বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এছাড়াও বিপ্লবে বলশেভিকদের আরও এক গুরুত্বপূর্ণ সহায় ছিল দরিদ্র কারিগর শ্রেণি। জমির প্রশ্ন মধ্য এশিয়ায় অতি গুরতর প্রশ্ন ছিল, অধিকাংশ জমিই ছিল অভিজাত বেগ ও ইসলামী ধর্মগুরুদের পরিচালিত ওয়াকফগুলির হাতে। এই জমির প্রশ্নেই বারংবার ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মধ্য এশিয়ার শ্রেণি বিভাজন সুস্পষ্ট ভাবে দেখা দিয়েছিল। এই বিভাজিত শ্রেণি স্বার্থের সংঘাতে শোষিত শ্রেণির স্বার্থের পক্ষে দৃঢ় ভাবে দাঁড়িয়েই মধ্য এশিয়ায় সোভিয়েত শক্তি তৃণমূল স্তরে জনসমর্থন লাভ করে। গৃহযুদ্ধের সময় একদা এমন পরিস্থিতিও হয়েছিল, যে মধ্য এশিয়ায় সোভিয়েত শাসন ইউরোপীয় রাশিয়ার বিপ্লবের কেন্দ্র থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই পরিস্থিতিতেও তা সম্পূর্ণ নিজের জোরে বহুমুখী আক্রমণ প্রতিহত করে বিপ্লবের শিখা অনির্বাণ রাখে। যদি মধ্য এশিয়ায় সোভিয়েত শাসন নিছক বাইরে থাকে চাপানো একটি ঘটনা হত, এ কাজ করা কখনই তাদের পক্ষে সম্ভবপর হত ন। এই বাইরে থেকে আগত বিপ্লবের তত্ত্ব সোভিয়েতের পতনের পর খণ্ডনের অভাবে এমন ভাবে এমনকি বামপন্থীদের অনেকের মননেও স্থান করে নিয়েছে - যে এখন এটাকেই সত্য বলে ধরা হয়। আশা রাখলাম, সংক্ষিপ্ত ভাবে হলেও মধ্য এশিয়ার চুড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কিভাবে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল, তার কাহিনী সেই এই ‘ নয়া সত্য’ কে খন্ডন করার সহায়ক হবে।