কুৎসার আড়ালে,প্রকৃত সত্য - অর্ণব ভট্টাচার্য

১১ জানুয়ারি ২০২১,সোমবার
প্রসঙ্গ: মরিচঝাঁপি, পর্ব ১

মরিচঝাঁপি নিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে  বিগত চার দশকে একের পর এক অভিযোগ করা হয়েছে। যুক্তিতর্কের তোয়াক্কা না করে,অসমর্থিত তথ্যসূত্র ব্যবহার করে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণিয়েছে বামবিরোধী শক্তি। অপপ্রচারের এই ঘূর্ণাবর্তের মাঝে উঠে এসেছে অনেক প্রশ্ন যার উত্তর খোঁজা বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার স্বার্থে ভীষণ জরুরি।

দণ্ডকারণ্য থেকে এ রাজ্যে চলে আসা উদ্বাস্তুদের প্রতি বামফ্রন্ট সরকার কি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল? সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ বলেই কি তাদের অবহেলা করে বামফ্রন্ট সরকার? দণ্ডকারণ্য ফেরত উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের কি বোঝানো হয় নি যে সুন্দরবনে বা রাজ্যের কোথাও তাদের পুনর্বাসনের কোন সম্ভাবনা নেই?
মরিচঝাঁপি কি আদর্শ উদ্বাস্তু কলোনি হয়ে উঠেছিল? পুলিশের সাথে সংঘর্ষে আসলে কতজন মারা গিয়েছিলেন?
এমন নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে 'প্রসঙ্গ: মরিচঝাঁপি'র কয়েকটি পর্বে।


স্বাধীনতার সময় হাজারো প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তুহারাদের অবাঞ্ছিত হিসেবেই গণ্য করেছিল তৎকালীন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। এরাজ্যে লক্ষ লক্ষ বঞ্চিত উদ্বাস্তু জনতাকে সংগঠিত করে তাদের অধিকার হাসিল করার কাজে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে  বামপন্থীদের নেতৃত্বে পরিচালিত ইউনাইটেড সেন্ট্রাল রিফিউজি কাউন্সিল(ইউ সি আর সি)। রিফিউজি ক্যাম্পগুলিতে যে দুর্বিষহ অবস্থা ছিল তার অবসানের লক্ষ্যে,সরকারের দমন পীড়নের বিরুদ্ধে এবং বাস্তুহারাদের সুষ্ঠু পুনর্বাসনের দাবী নিয়ে ইউ সি আর সি লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যায়। দু'দশক ধরে বাঙালি বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন নিয়ে উদাসীন থাকবার পর ১৯৫৭ সালে বাংলার বাস্তুহারাদের দণ্ডকারণ্যে পুনর্বাসনের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় সরকার। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৫৮ সালে দণ্ডকারণ্য ডেভেলপমেন্ট অথরিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। Bet Andreas provides slot machines for virtual coins and gives everyone a bonus of up to $300. Slot machines and casinos have more than 500 types of gambling games. BetAndreas Promotions - available bonus offers for regular and new players.

রিফিউজি ক্যাম্পগুলিতে যে দুর্বিষহ অবস্থা ছিল তার অবসানের লক্ষ্যে,সরকারের দমন পীড়নের বিরুদ্ধে এবং বাস্তুহারাদের সুষ্ঠু পুনর্বাসনের দাবী নিয়ে ইউ সি আর সি লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যায়।


তৎকালীন মধ্যপ্রদেশ ও ওড়িশার বিস্তীর্ণ রুক্ষ ও অনুর্বর এলাকা জুড়ে অবস্থিত দণ্ডকারণ্যে  বাংলার উদ্বাস্তুদের পাঠানোর তীব্র বিরোধিতা করেন বামপন্থীরা। তারা বাঙালি বাস্তুহারাদের রাজ্যের বাইরে পুনর্বাসনের বিরোধী ছিলেন না, তবে তাদের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল এই যে দণ্ডকারণ্যে পাঠানোর আগে এরাজ্যে বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হোক(সূত্র: বিধানসভায় জ্যোতি বসুর বক্তব্য,২৫জুলাই,১৯৫৭)। কিন্তু সরকার সেই সমীক্ষা না করে, উদ্বাস্তুদের আর্থিক সহায়তা বন্ধ  করে দিয়ে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। নিরুপায় হয়ে দণ্ডকারণ্যের রুক্ষ,দুর্গম, অনুর্বর অঞ্চলে যেতে বাধ্য হন হাজার হাজার অসহায় মানুষ। সেখানে তাদের চরম প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। সরকারের অযোগ্যতা ও অমানবিকতা পরিস্থিতিকে আরও সঙ্গীন করে তোলে।

তবে দণ্ডকারণ্যের মধ্যেই পুনর্বাসিত উদ্বাস্তুদের অধিকার যাতে রক্ষা করা যায় তার জন্য সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদের নেতৃবৃন্দ বারেবারে সরব হয়েছেন। সমর মুখার্জি,প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তীর মত নেতৃবৃন্দের তৎপরতার ফলে ধীরে ধীরে দণ্ডকারণ্যে কৃষি,সেচ,কর্মসংস্থানের দিকে নজর দিতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় সরকার। যদিও এই অঞ্চলে পুনর্বাসনের কাজে অগ্রগতি ধীর গতিতে চলছিল,তবু দণ্ডকারণ্য ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়া কোন সমাধান ছিলনা। তার কারণ, এরাজ্যে বাস্তুহারাদের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলছিল এবং তাদের অধিকাংশেরই তখনও পুনর্বাসন হয়নি।উল্লেখ করা প্রয়োজন যে দন্ডকারণ্য প্রকল্পের সূত্রপাত থেকে মরিচঝাঁপির ঘটনার মধ্যবর্তী দুই দশকেরও বেশী সময়ে পশ্চিমবঙ্গে আরো কুড়ি লক্ষ বাস্তুহারা আশ্রয় নেন। তাসত্বেও উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতির নেতৃত্বের মিথ্যে প্রতিশ্রুতিতে বিভ্রান্ত হয়ে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে দণ্ডকারণ্য থেকে এক লক্ষ কুড়ি হাজার বাস্তুহারা এরাজ্যে চলে আসেন। এর আগে ১৯৭৫ সালে সিদ্ধার্থ শংকর রায় পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন দণ্ডকারণ্যের মানা ক্যাম্প থেকে হাজার হাজার উদ্বাস্তু পশ্চিমবাংলার দিকে রওনা দিলে রাজ্য সরকারের পুলিশ নির্মম অত্যাচার করে তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেয়। মরিচঝাঁপি নিয়ে যারা ভীষণ সরব তারা এ বিষয়ে অবশ্য নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করেন!

১৯৭৭ সালে এরাজ্যে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত সঙ্গীন। দীর্ঘ প্রায় তিন দশকের অপশাসন রাজ্যকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল।ইতিমধ্যে ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ বন্যায় রাজ্যের বিপুল ক্ষয় ক্ষতি হয়।পরিকাঠামোর উপরে ব্যাপক চাপ পরে। সর্বোপরি রাজ্যে বসবাসকারী ৮০ লক্ষ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ছিল অনেকাংশেই অসম্পূর্ণ। এহেন পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে এক লক্ষ কুড়ি হাজার উদ্বাস্ত  দণ্ডকারণ্য থেকে চলে এলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা ছিল কার্যত অসম্ভব।

সান্ধ্য গণশক্তি পত্রিকা (১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯)


দণ্ডকারণ্য-ফেরত বাস্তুহারারা সুন্দরবনে বসতি স্থাপন করবেন বলে মনস্থির করেন। তাদের সাথে আলাপ আলোচনা এবং প্রয়োজনীয় খাবার-ওষুধ ইত্যাদি সরবরাহ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুন্দরবন এলাকার হাসনাবাদে ট্রানজিট ক্যাম্প তৈরি করে। সরকারের পক্ষ থেকে বাস্তুহারাদের জানানো হয় যে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদেরকে পুনর্বাসন দেওয়া বাস্তবিক অসম্ভব কেননা পশ্চিমবঙ্গে জমি অপ্রতুল এবং এখানে দীর্ঘকাল ধরে বসবাসকারী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়াই সরকারের অগ্রাধিকার।১৯৭৮ সালের ৭ ই মার্চ ইউ.সি.আর.সি-র সাধারণ সম্পাদক সমর মুখার্জি ও কার্যকরী সভাপতি প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী একটি বিবৃতি মারফত জানান যে দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তুরা  পশ্চিমবঙ্গের ফিরে এলে সমস্যা সমাধান হবে না বরং তারা আরও কঠিন সংকটে পরবেন। কারণ, এখনো কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে, ফুটপাতে, দমদম স্টেশনে, বাগজোলা খাল ও সুন্দরবনের হেড়োভাঙায়  হাজার হাজার উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের আশা নিয়ে পরে আছেন।এই অবস্থায় দণ্ডকারণ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসার অর্থ নিজেদের ভবিষ্যৎ আরো অনিশ্চিত করা,পশ্চিমবঙ্গে এখনো পুনর্বাসন না পাওয়া উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের সম্ভাবনাকে আরো দূরবর্তী করা এবং পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনকে বিপর্যস্ত করা। বরং তারা দণ্ডকারণ্যের ভূমিতে দাঁড়িয়েই তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য সংগ্রাম করুন।

দণ্ডকারণ্য থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য খাবার এবং ওষুধ ইত্যাদি বাবদ রাজ্য সরকার সর্বমোট ৪কোটি  টাকা খরচ করে(সূত্র:জ্যোতির্ময় বসুর লোকসভায় ভাষণ,২৩ফেব্রুয়ারি,১৯৭৯)। সরকারের সাথে আলোচনা ফলপ্রসূ হওয়ায় ১ লক্ষ ১২ হাজার জন উদ্বাস্তু দণ্ডকারণ্যে ফিরে চলে যান। বাস্তুহারাদের কোনমতে বুঝিয়ে দণ্ডকারণ্যে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া বামফ্রন্ট সরকারের উদ্দেশ্য ছিল না।তাদের অভাব অভিযোগের নিষ্পত্তি করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।যে লক্ষাধিক বাস্তুহারা দণ্ডকারণ্যে ফিরে যান তাদের সেখানে জনপ্রতি ১৫দিনের ডোল,দুই কুইন্টাল চাল,পরিবার পিছু একজোড়া চাষের বলদ,বীজ-সার বাবদ টাকা দেওয়া হয়। এছাড়া জমির উন্নয়ন,সেচব্যবস্থার বিস্তার, শিল্প বিকাশের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রস্তাব বিবেচনা করার আশ্বাস দেয় তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতির কুচক্রী নেতৃত্বের প্ররোচনার শিকার হয়ে  আট হাজারের কিছু বেশি সংখ্যক মানুষ দণ্ডকারণ্যে ফিরে যেতে অস্বীকার করেন এবং সুন্দরবনের গভীরে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মরিচঝাঁপি দ্বীপে বসতি স্থাপন করেন।    

                                                               আগামী কালের পর্ব ২ (চলবে)


শেয়ার করুন

উত্তর দিন