কুৎসার আড়ালে প্রকৃত সত্য (মরিচঝাঁপি - ২)

১৩ জানুয়ারি ২০২১,বুধবার
মরিচঝাঁপি - পর্ব ২


রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের উদ্দেশ্যে বারে বারে আবেদন করে বলেন যে সুন্দরবনে নতুন করে কোন বসতির সম্ভাবনা নেই। সেখানে স্থানীয় অসংখ্য ক্ষেতমজুর ও গরীব মানুষের জন্য তখনও কোন ব্যবস্থা করা যায়নি।প্রয়োজনীয় জমিও তাদের দেওয়া সম্ভব হয়নি। ওখানে নদীর জল নোনা। চাষাবাদ করে ফসল তৈরি করা খুবই কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ। নিচু জমি বাঁধ দিয়ে জল আটকাতে হয়।এমতাবস্থায় সুন্দরবনে নতুন করে লোকের পুনর্বসতি কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। তিনি তাদের বলেন, "সুন্দরবনে পুনর্বাসন সম্পর্কে আপনাদের মনে যে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে তা একান্ত ভাবে উদ্দেশ্যমূলক একথা আপনারা নিশ্চয়ই আপনাদের বর্তমান অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন"। মরিচঝাঁপির মানুষ যে ক্ষুধা, দারিদ্র ও নানারকম রোগের শিকার হচ্ছেন তা উল্লেখ করে তিনি ঐ বিপদ সঙ্কুল জায়গা থেকে চলে আসার জন্য আহ্বান জানান, যদিও উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতির নেতাদের দৃষ্টি এড়িয়ে সে কাজ করা কার্যত অসম্ভব ছিল।

এছাড়াও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণে রাজ্য সরকার এই দ্বীপে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনার সাথে কখনোই সহমত ছিল না। প্রথমতঃ এই দ্বীপ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত যেখানে বসবাস আইনত নিষিদ্ধ। দ্বিতীয়তঃ আন্তর্জাতিক সীমান্তের খুব কাছে অবস্থিত এই দ্বীপকে ব্যবহার করে চোরাচালান ইত্যাদি বেড়ে গিয়েছিল। তৃতীয়তঃ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বেআইনিভাবে গাছ কাটা চলছিল এবং কাঠের বড় ব্যবসায়ীরা উদ্বাস্তুদের কাজে লাগিয়ে ব্যাপক মুনাফা করছিল। স্বাভাবিকভাবেই এই বেআইনী কাজকে উৎসাহিত করা সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। চতুর্থতঃ বেআইনিভাবে, সরকারি নিয়ম কানুনকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে গাজোয়ারি এবং চোরাকারবারের মাধ্যমে যে সমান্তরাল সরকার গড়ে ওঠে তা মেনে নেওয়া কোন স্বাধীন দেশের নির্বাচিত সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

মরিচঝাঁপি সম্পর্কে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বিবৃতি


ঘটনাপরম্পরা প্রমাণ করে যে বামফ্রন্ট সরকারকে কালিমালিপ্ত করার জন্য মরিচঝাঁপিকে বেছে নেয় বামবিরোধী শক্তি। তীব্র শ্রেণীসংগ্রাম ও গণআন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৭৭সালে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে সেই সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে গরীব বাস্তুহারাদের একাংশকে ব্যবহার করা হয়।মরিচঝাঁপি নিয়ে রাজ্য সরকারের সাথে সংঘাতের বাতাবরণ তৈরী করে সংকীর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা তোলাই ছিল এই ঘৃণ্য পরিকল্পনার উদ্দেশ্য।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই মরিচঝাঁপি নিয়ে রাজ্য সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করেছিলেন।অথচ রাজ্যে কংগ্রেস,জনসংঘ,আনন্দমার্গী, জনতা পার্টি সহ সব বামবিরোধী দল ও গোষ্ঠী মরিচঝাঁপির বাসিন্দাদের প্ররোচিত করে এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসা চালিয়ে যায়। বিরোধী পক্ষের অন্যতম নেতা শ্রী প্রফুল্ল সেন মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের জন্য সত্যাগ্রহ করার হুমকি দেন ও লাগাতার প্ররোচনা সৃষ্টি করেন। অথচ শ্রী প্রফুল্ল সেন  রাজ্যের ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের মন্ত্রী থাকাকালীন দণ্ডকারণ্যে বাঙালি  উদ্বাস্তুদের পাঠানোর জন্য  বিধানসভায় সওয়াল করেছিলেন(১৫ জুন,১৯৫৭, রাজ্য বিধানসভায় বক্তব্য )।সেসময় পশ্চিমবঙ্গে যে পরিমাণ জমি বাড়তি ছিল সেখানে সকল উদ্বাস্তুকে পুনর্বাসন দেওয়া কঠিন কাজ ছিল না,কাউকেই দণ্ডকারণ্যে পাঠানোর প্রয়োজন পড়তোনা। অথচ তিনি তখন সে কাজ করেননি এবং ১৯৫৯ সালে এই অসত্য দাবী করেন যে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কাজ প্রায় শেষ। অথচ ১৯৭৮-৭৯ সালে যখন পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু সংখ্যা কুড়ি লক্ষ আরো বেড়ে গিয়েছে এবং বাড়তি জমি আর পাওয়া যাচ্ছে না তখন সেই প্রফুল্ল সেন বিরোধী নেতা হিসেবে মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের দরদী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। মরিচঝাঁপির বাস্তুহারাদের জন্য যারা কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করছিলেন তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মানুষের অসুবিধা হয়নি।তাই যথেচ্ছ অপপ্রচার সত্বেও সমসাময়িক জনমত বামফ্রন্ট সরকারের পক্ষেই ছিল।

বামফ্রন্ট সরকারের সমালোচকরা দাবী করেছেন যে ১৯৭৭ সালের ৩০ নভেম্বর তৎকালীন রাজ্য সরকারের মন্ত্রী রাম চ্যাটার্জি নাকি দণ্ডকারণ্য সফরে গিয়ে বাস্তুহারাদের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই দাবী ছিল সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। বিশিষ্ট লেখক কল্যাণ চৌধুরীর নিবন্ধ 'Victims of Their Leaders' Making' যা ১৯৭৮ সালের ৮ জুলাই 'ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি'তে প্রকাশিত  হয় সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে রাম চ্যাটার্জি তেমন কোন বার্তা দেননি।বরং বাস্তুহারাদের এখুনি হতাশ না হয়ে দণ্ডকারণ্যে থেকে অধিকার আদায় করে নেবার কথা তিনি বলেছিলেন। এমনটাই স্বাভাবিক কেননা উদ্বাস্তু আন্দোলনের  নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে দণ্ডকারণ্য উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে কিছু অগ্রগতি ঘটেছিল এবং সেচের কাজ ও চাষবাসের উন্নতির সম্ভাবনা ছিল।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রী এইচএম প্যাটেল এর মরিচঝাঁপি প্রসঙ্গে বিবৃতি


১৯৭৯ সালে সাংসদ সমর মুখার্জি দণ্ডকারণ্য সফরে গিয়ে প্রকল্পের চেয়ারম্যান সি চন্দ্রশেখরের সাথে আলোচনার সময় জানতে পারেন যে সেখানে কাজের  বিনিময়ে খাদ্য  প্রকল্প চালু হয়েছে। সুতরাং অনাহারে মৃত্যুর ভয় আর আগের মত নেই। তাই দণ্ডকারণ্য এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে আগত উদ্বাস্তু প্রতিনিধিরাও জানিয়েছিলেন যে তারা দণ্ডকারণ্যেই তাদের জীবন-জীবিকার সমাধান চান।

সন্দেহ হয় যে দণ্ডক প্রকল্পে সেচের জল যাওয়া শুরু হলে চাষবাসের যে উন্নতি হবে তা যাতে বাস্তুহারা ভোগ করতে না পারেন তার জন্য তাদের এলাকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য স্থানীয় জোতদার ও মহাজনেরা চক্রান্ত করেছিল।প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই সন্দেহকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা।দণ্ডকারণ্য ত্যাগী বাস্তুহারাদের পশ্চিমবঙ্গ যাওয়ার খরচ কিভাবে জোগাড় করা হয়েছিল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সবচেয়ে বেশী বাস্তুহারা গিয়েছিলেন মালকানগিরি থেকে যেখানে পটারু ড্যাম সেচ প্রকল্প রূপায়িত হচ্ছিল।সে সময় মালকানগিরি থেকে কলকাতা যাওয়ার ট্রাকের ভাড়া ছিল ৮ হাজার টাকা। প্রথম দফাতেই বাস্তুহারারা অন্তত ১০০ টি ট্রাকে করে দণ্ডকারণ্য ত্যাগ করেছিলেন। এই বিপুল অঙ্কের টাকা যোগাড় হলো কিভাবে সে এক রহস্য। কারা জুগিয়েছিল এই পরিমাণ  টাকা ও এই সংখ্যক ট্রাক সেই রহস্য CBI পর্যন্ত জেনে উঠতে পারেনি। (সূত্র: EPW,8th July,1978)

মরিচঝাঁপিতে বসবাসকারী উদ্বাস্তুরা ছিলেন তফসিলি জাতি ভুক্ত।সমালোচকরা অভিযোগ করেন যে, বামপন্থী উদ্বাস্তু নেতারা নাকি  ভদ্রলোক  শ্রেণীর প্রতিনিধি ছিলেন বলে নিম্নবর্গের বাস্তুহারাদের অধিকার রক্ষায় আগ্রহী হননি এবং তাদের অনীহার জন্যই নাকি কলকাতা ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে নিম্নবর্গের উদ্বাস্তু জনবসতি গড়ে ওঠেনি।এখানে উল্লেখ করা দরকার যে নমশূদ্র সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ মূলতঃ ১৯৫০ সালের পরে সীমান্ত পেরিয়ে আসতে বাধ্য হন।পাকিস্তান প্রস্তাবকে নমশূদ্র ফেডারেশন সমর্থন করেছিল এবং তাদের নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মহম্মদ আলি জিন্নার ক্যাবিনেটে মন্ত্রী হয়েছিলেন। ১৯৫০সালের পর সাম্প্রদায়িক হিংসা ও মেরুকরণ ব্যাপক আকার ধারণ করলে নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন।কলকাতা ও তার নিকটবর্তী এলাকায় তখন আর কোন খালি জমি ছিলনা। উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের প্রাক্তন মুখ্যসচিব হিরণ্ময় বন্দোপাধ্যায় তার লেখা ‘উদ্বাস্তু’ বইয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে , “যতগুলি জবরদখল কলোনি গড়ে উঠেছিল সে সবই ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল। এরপর আর নতুন কলোনি গড়ে উঠেছে বলে আমার জানা নেই কারণ যত সম্ভব জমি খালি অবস্থায় পড়েছিল তা এর মধ্যেই দখল হয়ে যায়। তারপর আর বৃহত্তর কলিকাতা অঞ্চলে জবরদখল করবার মত জমি ছিল না”। স্বভাবতই, সীমান্ত পেরিয়ে আসা নিম্নবর্গ ভুক্ত বাস্তুহারা জনতা যারা মূলত কৃষি কাজ, মৎস্য চাষ, হস্তশিল্পের মত পেশায় যুক্ত ছিলেন তারা বৃহত্তর কলকাতার বাইরে বসতি গড়তে বাধ্য হলেন। আর এই কলোনি গড়া ও তাকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে লালঝাণ্ডার পার্টি।

মরিচঝাঁপি'র প্রকৃত সত্য তুলে ধরে বিশাল লোকের মিছিল সংগঠিত হয়.....(সান্ধ্য গণশক্তি)


এও বলা হয়েছে যে নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ বলেই মরিচঝাঁপিতে যাওয়া উদ্বাস্তুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে বামফ্রন্ট সরকার। যারা এহেন অভিযোগ করেছেন তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার যে বাংলার বুকে  নিম্নবর্গের শোষিত মানুষ,তিনি কৃষক কিম্বা শ্রমিক অথবা বাস্তুহারা যাই হোন না কেন তার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে বামপন্থীরাই সর্বাগ্রে থেকেছে। আর যারা তেভাগার লড়াই থেকে বাস্তুহারা আন্দোলন সব ক্ষেত্রে মেহনতি মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তারাই মরিচঝাঁপি নিয়ে গলাবাজি করছে।

আগামীকাল - মরিচঝাঁপি পর্ব ৩ প্রকাশিত হবে।

                                                                                                         
শেয়ার করুন

উত্তর দিন