সৌভিক ঘোষ
তার যখন ১৭ বছর বয়স জার্মানিতে নাৎসিরা ক্ষমতা দখল করলে তিনি জার্মানি ছেড়ে ইংলন্ডে চলে আসেন।
এই জন্য অনেকেই ধরে নেন তিনি হয়ত রিফিউজি ছিলেন।
সেই ধারণা ভুল। এরিক হবসবম’র গোটা পরিবারই ছিল ব্রিটিশ নাগরিক।
১৯১৭ সালে ইজিপ্টের আলেকজন্দ্রিয়া শহরে তার জন্ম হয়। পিতা লিওপোল্ড পার্সি হবসবম, মা নেলি হবসবম দুজনেই ছিলেন ইহুদি। এরিক ছোট থেকেই ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে শিখেছেন, ইংরেজিই তার প্রথম ভাষা।
জার্মানি থেকে ইংলন্ডে চলে আসার অনেক আগেই এরিকের বাবা মারা যান, কিছু বছর পরে মা’র মৃত্যু হলে তিনি এবং তার বোন ন্যান্সি দুজনেই বার্লিনে কাকার আশ্রয়ে থাকতে শুরু করেন। লন্ডনের সেন্ট মেরিলবোন গ্রামার স্কুলে পড়া শেষ করে ভর্তি হন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজে। সেখান থেকেই ডবল স্টার সহ ফার্স্ট হয়ে কেমব্রিজ অ্যাপষ্টল’দের তালিকাভুক্ত হন, পরে কেমব্রিজ থেকেই ‘ফেবিয়ান সমাজব্যবস্থা’ বিষয়ে ডক্টরেট উপাধি অর্জন করেন।
লন্ডনে কলেজের ছাত্র থাকাকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন, যদিও জার্মানিতে থাকার সময়েই এরিক মার্কসের লেখা ‘ক্যাপিটাল’র ১ম খন্ড, পভার্টি অফ ফিলোজফি এবং ল্যুই বোনাপার্টের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার পড়া শেষ করেছিলেন। ডক্টরেট হওয়ার পরেই শুরু হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধ। এরিক হবসবম যোগ দেন আর্মি এডুকেশনাল কর্পসে। মিলিটারি স্কুল তাকে এক অসাধারণ পাবলিক টিচার বলে চিহ্নিত করে।
বিশ্বের ইতিহাস চর্চায় এরিক হবসবমের কৃতিত্ব ব্যখ্যা করতে তার লেখা এজ অফ রেভোল্যুশন (১৯৬২’তে প্রকাশিত), এজ অফ ক্যাপিটাল (১৯৭৫’এ প্রকাশিত), এজ অফ এম্পায়ার (১৯৮৭) এবং ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত এজ অফ এক্সট্রিমস, দ্য শর্ট টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি বইগুলির নাম উঠে আসে। উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের এক অসামান্য দলীল এই বইগুলি কোন সন্দেহ নেই, শুধুই তথ্যের সমাহারে পাঠককে দিগ্ভ্রস্ট না করে তথ্যের বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণে ইতিহাসের শিক্ষাকে তুলে ধরতে প্রকৃত ইতিহাসবিদের ভূমিকাই পালন করেছেন তিনি। নয়া উদারবাদের মুখোশ পরে পুঁজিবাদ যখন নিজের লুঠেরা চরিত্র আরেকবার উন্মোচন করতে শুরু করেছে, বিভিন্ন প্রান্তে মাথচাড়া দিচ্ছে ফ্যাসিবাদের বিপদ; এমন একটা পৃথিবীকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় আগাগোড়া কমিউনিস্ট ঐতিহাসিক হবসবমের কৃতিত্ব শুধুমাত্র এক আলোকোজ্জ্বল প্রজ্ঞামনস্কতার ব্যাক্তি পরিচয়টুকুই নয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পরে দুনিয়াজুড়ে প্রচার শুরু হয়, সমাজতন্ত্র অচল। পুঁজিবাদ ছাড়া অন্য কোন বিকল্পই নেই – লিখে নোবেল পুরষ্কার অবধি জোটে। এরিক হবসবমের সবাচাইতে বড় কৃতিত্ব এই যে তিনি সচেতন হওয়ার বয়স থেকে জীবনের শেষ দিন অবধি নিজস্ব প্রত্যয়ে দৃঢ় ছিলেন। সেই প্রত্যয় মার্কসবাদের আদর্শে, সেই প্রত্যয় সমাজতন্ত্র নির্মাণের অঙ্গীকারে। এমন প্রচার চলে যে এরিক বলেছেন ‘অসামান্য ব্যর্থতাই অসাধারণ ঐতিহাসিকের জন্ম দেয়’ – সুতরাং সোভিয়েত ইউনিয়ন অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ই এরিকের অসামান্য মেধার সূচক। আসলে পুঁজিবাদ ও তার সংস্কৃতি কখনোই মানুষের অস্তিত্বকে বেচাকেনার নির্দিষ্ট পরিখার বাইরে ভাবতে পারে না, তাই এমন যুক্তি হাজির করে। ঐ কারনেই সাংবাদিকদের একঘেঁয়ে প্রশ্নের উত্তরে এরিক প্রত্যেকবার মনে করিয়ে দেন ‘নতুন পৃথিবী, নতুন সমাজ এবং নতুন মানুষ গড়তেই তিনি মার্কসবাদকে গ্রহণ করেছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হয়েছিলেন, সেই কাজ শেষ হয়নি’।
পুঁজি এই চলমান সক্রিয়তা বুঝতে পারে না বলেই ঐতিহাসিক এরিক এবং কমিউনিস্ট এরিক’কে আলাদা আলাদা করে বুঝতে চায়, ব্যখ্যা করতে চায়। তারা চায় আমরাও ভুলে যাই ঐতিহাসিক না হলেও এরিক কমিউনিস্ট হতেন, কমিউনিস্টই থাকতেন। মেধা সম্পর্কিত পুঁজিবাদী মর্যাদার ধারণা বিনিময় মূল্যের উপরে উঠতে পারে না বলেই কেউ কেউ বোঝেন না পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষায় একজনের রচনা অনুদিত হওয়াই তার মেধার একমাত্র লক্ষণ না, রয়্যালটি ছাড়াও এরিকের প্রাপ্তি আরও অনেক বেশি কিছু। এক দীর্ঘ জীবন (এরিক হবসবম ৯৫ বছর বয়সে মারা যান) লব্ধ অভিজ্ঞতায় এরিক যে ঐতিহ্য খুঁচিয়ে দিয়ে গেছেন তাকেই বলা হয় ‘আয়রন উইল’ যা আসলে লাল ফৌজের মেজাজ। গুলিয়ে দিতে চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি কিংবা আরও কিছু বছর পরে আফগানিস্তানের কথা তোলা যেতেই পারে, কিন্তু অন্যরা পার্টি ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে বলেই আমাকেও যেতে হবে নাহলে বাজারে মান থাকবে না এমন মেধাবৃত্তির মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে এরিক আসলে প্রমান করেন আরেক ঐতিহাসিক জীবনচর্চা – ‘আই অ্যাম দ্য পার্টি’ বলে মাও সে তুং যেমনটি ইঙ্গিত করেছিলেন। কোটেশন পড়ে মার্কসবাদী হওয়া শোভিনিস্টরাও বুঝতে পারেন না ‘লাল ফৌজ’ মানে শুধুই ভিড় নয়, ভিড়ের ভয়ে পালিয়ে না গিয়ে একলা নিজের অবস্থানে দৃঢ় হয়ে থাকাও।
তাই এরিক হবসবম’কে বুঝতে হয় ‘এজ’ সিরিজের বাইরে এসে, আসলে ঐ বইগুলির পরিসর এড়িয়ে না, তাকে অতিক্রম করে। এরিক ‘ঐতিহ্যের উৎস’ অনুসন্ধান করেছেন। তারই গবেষণালব্ধ ‘দুই বিপ্লবের প্রভাব’ যুক্ত হয়েছে আধুনিক ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে। এইসব কাজে তিনি শুধু শিক্ষকের ভূমিকাই পালন করেন নি, কমিউনিস্ট হিসাবে শেষ অবধি নির্দিষ্ট কাজে নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের যে শৃঙ্খলাবোধ ক্যাপিটালিজমের জন্য দুঃস্বপ্ন, কমিউনিজমের প্রতি এরিক হবসবমের একনিষ্ঠ অবস্থান আসলে সেই সিদ্ধান্তেরই প্রয়োগ।
সেই একনিষ্ঠতাকেই বুঝতে ভুল করে পুঁজিবাদ – কতিপয় প্রশ্নে তার চুপ থাকাকে ব্যখ্যা করে পরাজয় হিসাবে।
ওরা বোঝে না ঐ চুপ থাকা আসলে বাকি থাকা কাজ চিনে নিয়ে সেই কাজে এগোনোর পরিকল্পনায় মনোনিবেশ জনিত নৈশব্দ ছাড়া আর কিছুই নয়। পার্টিতে নির্ধারিত কাজ সম্পাদনে জরুরী একাগ্রতা, এমনকি সেই পার্টি আর না থাকলেও।
এই একাগ্রতা, এই একনিষ্ঠতা হল ইতিহাসের শিক্ষা যা কমিউনিস্টদের ঐতিহ্য। এই উত্তরাধিকার আসলে একান্তই তাদের, যারা এখনও মনে করেন যে উদ্দেশ্যে হিটলারের বাহিনীর বিরুদ্ধে হাতে রাইফেল তুলে নেওয়া হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক নির্মাণের কাজ এখনও শেষ হয় নি। কাজ শেষ না হওয়া অবধি কমিউনিস্টদের কাজ করে যেতে হয়।
ইতিহাসের শিক্ষা দিয়ে শুরু করে ইতিহাস রচয়িতার ভূমিকায় ‘অন হিস্টরি’ অবধি এসে নিজের জীবনকে ‘ইন্টারেস্টিং টাইমস’ বলে চিহ্নিত করে এরিক আসলে নির্ধারিত দায়িত্বই পালন করেছেন। সেই কারনেই শেষ বয়সে তার কলম থেকে বেরিয়ে আসে ‘হাউ টু চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড’। আসলে ইঙ্গিত দিয়ে যান কাজ শেষ হয় নি, কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
শেষদিন অবধি সেই কাজ করে গেছেন বলেই এরিক হবসবম আজীবন কমিউনিস্ট।