সিনেমার চির বিদ্রোহী - শান্তনু চক্রবর্তী

১৭ সেপ্টম্বর ২০২২
‘ইউথ্যানেসিয়া’ বা স্বেচ্ছামৃত্যু কখনো তাঁর ছবির বিষয় হয়ে আসে নি কোনো দিনই। তিনি, জঁ লুক গোদার জীবনের ক্লাইম্যাক্স সিকোয়েন্সের জন্যই বোধ হয় এই অপ্রত্যাশিত চমকটা ভেবে দেখেছিলেন। তবে এই সিদ্ধান্তটাও বোধ হয় শুধু তাঁকেই মানায়।
তিনি যে জীবন ও শিল্প-যাপন করেছেন, সেখানে অন্য কেউ এক মুহূর্তের জন্য কোন শর্ত চাপিয়ে দিতে পারে নি। তাই মৃত্যুর সঙ্গে বোঝা পড়াতে বসেও তিনি নিজের শর্ত বহাল রেখেছিলেন। নিজের পরিবার, দেশের সরকার, রাস্ট্রের আইনও, তাঁর ইচ্ছে ও সিদ্ধান্তকেই মেনে নিতে ও মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছে। স্বর্গ বা অমৃতের আকাঙ্খা কখনো করেননি! নরোকের দরজায় দাঁড়াতে ভয় পান নি। বরং ‘হেইলমেরি-র’ মত ছবি বানিয়ে পোপ, ভ্যাটিকান তথা ঈশ্বর-বিশ্বাসী সমাজে একটা বিরাট অংশে নিন্দা-ঘৃণা কুরিয়েছেন। তিনিই জীবনের শেষ চিত্রনাট্যে মৃত্যুকে অমরত্ব দিয়ে গেলেন।


আমাদের এই প্রতিবেদনের শুরুটা যেখান থেকে শুরু হল, পাঠকদের মনে হতে পারে এটাই প্রয়াত চলচ্চিত্র স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে শেষ অনুচ্ছেদ হওয়া উচিত ছিল। হয়তো পাঠক ঠিকই ভাবছেন। কিন্তু সেই স্রষ্টার নাম যখন গোদার, যিনি অবশ্যই ন্যারেটিভ-এ বিশ্বাস করতেন - শুধু আখ্যানের আদি, মধ্য ও অন্ত্য-র ক্রম বা আর্ডার-টা এদিক-ওদিক সাজিয়ে নিতে চাইতেন-তাহলে হয়তো প্রতিবেদন বিচ্যুতি টুকুও ক্ষমা পেয়ে যেতে পারে।

আসলে বিশ্ব-সিনেমার ইতিহাসে গোদার’ই তো সেই ‘চির বিদ্রোহী বীর, যিনি তাঁর তলোয়ার কোষবদ্ধ করেননি কখনো। এবং তাঁর উন্নত শীর পুঁজিকে সর্বঞ্জ আর বাজারকে সর্বশক্তিমান ভেবে কুর্ণিশ করতে ঝোকেঁনি কখনো। তাঁর প্রতিষ্ঠান-বিরোধীতার চর্চা শুরু হয়েছিল ১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে। সদ্য তরুন গোদার তখন প্যারিসের ফিল্ম ক্লাবগুলোয় অফুরান সিনেমা দেখে বেড়াচ্ছেন। এই সিনেমা দেখতে দেখতেই তুমূল বন্ধুত্ব ফ্রাঁসোয়া-ক্রফো, প্লোদ শ্যাব্রল, জ্যাকুইস রিভেতদের সঙ্গে। একসঙ্গে ছবি দেখা, ক্যাফেতে বসে সেই সব ছবি নিয়ে প্রবল আড্ডা, তর্ক, কাটাছেরা। তারপর ১৯৫১য় ফরাসি ফ্লিম তাত্মিক-গবেষক-দার্শনিক আন্দ্রে বাঁজার হাত দিয়ে শুরু হলো চলচ্চিত্রের রনাঙ্ঘাগনে কাহিয়ে দ্যু সিনেমা পত্রিকার লং মার্চ। গোদার- ক্রফো-শ্যাব্রল’রা হলেন বাঁজার বিশ্বস্ত সৈনিক।


অনেক পরে গোদার কোথাও বলেছিলেন, কাহিয়ে দ্যু সিনেমার পাতায় একটা লেখা মানে প্রায় একটা আস্ত সিনেমা বানানোর সমান। অবশ্যই অতিশয়োক্তি। এমন তীক্ষণ, সপ্রতিভো, মেধা-কৌতুক-বৈদ্বগ্ধ্যে ঝকঝকে চমক দেওয়া মন্তব্য দীর্ঘ জীবনে বারবরই করেছেন গোদার। তার কিছু কিছু বিশ্ব-সিনেমার চিরোকালীন ক্লাসিক কোট্ হিসাবে থেকে গেছে। এটাও সেরকমই। তবে এই মন্তব্য থেকে একটা ব্যাপার পরিস্কার হয়ে যায়, কাহিয়ে দ্যু’তে একটা সমালোচনা বা প্রবন্ধ লেখার পিছনে গোদার ও তার বন্ধুদের কি দীর্ঘ প্রস্তুতি, পরিশ্রম ও কতটা তীব্র প্যাশন ও মনস্কতা থাকত। গোদারদের কলমে গোটা দুনিয়ার মূল ধারার ছবি, ফরাসি-ইতালিও-আমেরিকান সিনেমার বিশ্ববিখ্যাত সব পরিচালক, তাঁদের তথাকথিত মহান ধ্রুপদি কীর্তি শুধু কচু কাটা নয় ধূলিসাৎ হতে থাকল। কাহিয়ে দ্যু’র পাতায় এই তরুণ-ব্রিগেড শুধু আক্রমণাত্মক নন - তাঁরা ধ্বংসপ্রবন কালা পাহাড় - যাকে বলে ‘হাই কনোক্লাস্ট’ সিনেমার যা কিছু প্রচলিত রীতি, নিয়ম, উৎপাদন, অর্জন - সেগুলোকে তারা শুধু বিদ্ধ নয়, বিধ্বস্ত - তছনছ - চুরমার করে দেন। আর প্রচলিত সিনেমার এই ধ্বংস স্তুপের ওপরই তাঁরা গড়ে তোলেন ‘ন্যুভেল ভাগ’ বা নবতরঙ্গ আন্দোলন।
১৯৫৯-এ ক্রফো বানালেন ‘ফোর হ্যান্ডেড ব্লোজ’-শেষ দৃশ্যের সেই ফ্রিজ শর্টের মতই পৃথিবী চমকে থমকে গেল! তারপর ১৯৬০ সালে ক্রফোর কাহিনীর ভিত্তিতে গোদারের হাতে তৈরী হল ‘ব্রেথলেস’- সারা দুনিয়ার নিশ্বাস যেন আটকে গেল। হলিউডের গ্যাংস্টার সিনেমার জঁ-র নিয়ে নানান তামাশা-রগর-রঙ্গ বা স্পুফ্ করতে করতেই তখনও ত্রিশ না পেরোনো পরিচালক জীবন, ভালোবাসা, সম্পর্ককে দেখার একটা ত্যারচা, তীতকুটে, নিরমোহ ধূসর ভঙ্গি আবিস্কার করে ফেললেন। তাঁর ছবি একই সঙ্গে সিনেমার ভিতরের আর বাইরের গল্পটা বলতে লাগল। থিয়েটারের ক্ষেত্রে ব্রেখ্ট অনেক বছর আগেই যেটা করেছেন, সেই ‘অ্যালিয়েনেশন’ তত্তে¡রই একটা ধরণ যেন গোদার তাঁর ছবিতে নিয়ে এলেন। দর্শককে প্রত্যেক মুহূর্তে টের পাইয়ে দিতে হবে, তুমি যেটা দেখছো, সেটা আসলে সত্যি নয়। ক্যামেরার মোহ - মায়া- ইলুউশন দিয়ে গড়া একটা ফেক্ বা নকল দুনিয়া। এই ক্যামেরাকে দিয়ে সেকেন্ডে ২৪টা মিথ্যা বলানো যায়। পুঁজির দাসত্ব করে যে সিনেমা, সে তো এভাবেই চারপাশের ক্ষুদার্থ - দরিদ্র-বিক্ষুব্ধ পৃথিবীকে সাজিয়ে-গুছিয়ে, রম্য-মহল রুপে হাজির করতে পারে। ‘ব্রেথলেস থেকেই গোদার তাই তার সিনেমার শীয়র থেকে যন্ত্র বা প্রযুক্তি-কুশলতার ছাপ মুছে ফেলতে চাইলেন। চাইলেন কম বাজেটের ছবির গায়ে পুঁজির তোয়াক্কা না করা মেহনত-লড়াইয়ের চিহ্ন থাকুক। তাই ব্রেথলেসে দৃশ্যান্তরে জাওয়ার জন্য ল্যাবোটারি - নির্ভর ফেড ইন-ফেড আউট বা ডিজলভ্ -এর পেলবতার বদলে পেলো ঝাঁকুনি দেওয়া জাম্পকাট-এর রুক্ষতা। ট্রলিপেতে ট্র্যাকিং শর্টের বদলে শেষ দৃশ্যে নায়কের সঙ্গে ক্যামারে ম্যানও ক্যামেরা হাতে ধরে ছুট লাগালেন। তাঁর হাত কাঁপলো। পর্দার ছবিতেও সেই অস্থিরতা ধরা পড়ল। পুঁজি শাসিত সিনেমা ভাবনার প্রথাগত বুর্জোয়া নন্দন তত্ব, গোদারের বিকল্প র্যা ডিক্যাল নব - সিনেমার তরঙ্গাঘাতে খানখান হয়ে গেল।


ছবির পর ছবিতে গোদার তাঁর এই প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধী নাশকতা বা অর্ন্তঘাত চালিয়ে গেছেন। একই সঙ্গে গোদারের রাজনৈতিক দর্শন - মতাদর্শ ক্রমশ স্পষ্ট আর প্রকাশ্য হতে শুরু করেছিল। বামপন্থার প্রতি তাঁর পক্ষপাত তিনি কোনদিনই গোপন করেন নি। ১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সিনেমায় ও সিনেমার বাইরে তাঁকে প্রায় এ্যাক্টিভিস্ট-এর ভূমিকায় দেখা গেল। ১৯৬৫ সালের সাই-ফাই ছবির আল্ফাভিন-এ তিনি রোবর্ট শাসিত যে কল্প একনায়কতন্ত্রের গল্প বলেন, সেখানে কোথাও হয়ত ফ্রান্সে দ্যগলে’র বলদর্পী শাসনের ছায়া পড়েছিল। তারও আগে ‘দ্যা লিটিল সোলজা’রে আলজেরিয়ায় ফরাসি উপনিবেশবাদের বিরোধীতা করে তিনি রাষ্ট্রের কুনজরে পড়েছিলেন। ১৯৬৬-৬৭ তে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও মাও সেতুং-এর সদর দপ্তরে কামান দাগার আহবন, তাঁকে মাও বাদের কাছাকাছি নিয়ে আসে। ১৯৬৮ তে ফ্রান্সের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া দ্যাগল বিরোধী ছাত্র বিদ্রোহের পাশে সরাসরি দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধীতা করেছেন সরবে। যুদ্ধ বিরোধী প্রতিবাদী হলিউড নায়িকা জেনফন্ডা’কে নিয়ে ‘লেটার টু জেন’-এর মতো ছবি করেছেন।

একই সঙ্গে মহাবিদ্রোহী ও মহা-প্রতিভাধর এই চলচিত্রকার তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে আপোস করতে চাননি কোনদিন। এই বিশ্বাসের প্রশ্নেই প্রাণের বন্ধু, সাথী ফ্রাসোয়া-ত্রুফোর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদেও পিছপা হননি। ইজরায়েল-বিরোধী প্যালেস্তাইনের মুক্তি যুদ্ধকে সমর্থন করেছেন দ্বিধাহীনভাবে ১৯৭৬-এর ছবি ‘হিয়ার এ্যান্ড এল্সহোয়ার’-এ পাশাপাশি শর্টে ইজরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামেয়ার ও হিটলারের ছবি দেখিয়েছিলেন। আমেরিকান জিওনবাদী সংগঠনগুলো তাঁর বিরুদ্ধে ইহুদী বিদ্বেষের অভিযোগ আনলেও গোদার তাতে পাত্তা দেননি। প্রতিষ্ঠানকে তিনি কবেই বা পরোয়া করেছেন? একদিকে আমেরিকার মোশান পিকচার্স এ্যাকাডেমি তাকে সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি জন্য অস্কার দিলেও তিনি নিতে যাননি। আবার ফরাসি সরকারের দেওয়া অর্ডার অফ মেরিট-ও ফিরিয়ে দিয়েছেন। ক্ষমতাকে উপেক্ষার এই মহত্বও বোধহয় তাকেই মানায়।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন