জয়দীপ মুখার্জী
দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের কাঠামোকে চুরমার করে ‘হিন্দু-রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা ও ‘নয়া-ফ্যাসিবাদী’ রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমই যে আরএসএস-বিজেপি’র আসল লক্ষ্য তা নিয়ে এখন আর কোনও সংশয়ের অবকাশ নেই। ২০১৪ এবং ২০১৯ দুটি লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও টানা দশ বছর শাসন ক্ষমতা ভোগের পর আরএসএস-বিজেপি এখন মরিয়া। তারা মরিয়া প্রতিবেশী ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পালটা ভারতকে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে রূপান্তর ঘটাতে। তাই এই নির্বাচনে আরও একবার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জনের সর্বগ্রাসী প্রচেষ্টায় আরএসএস-বিজেপি ইডি, সিবিআই, আয়করের মতো সরকারি এজেন্সিকে ব্যবহার করে, নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির নিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দিয়ে সরকারের বিরোধী বামপন্থী, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির বিরুদ্ধে তীব্র স্বৈরাচারী আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।
ভোটের মুখে জনমত তৈরি করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এককভাবে দলের ৩৭০ আসন এবং এনডিএ’র ৪০০ নিশ্চিত বলে জানিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গেই সরকারের বশংবদ কর্পোরেট মালিকানায় পুষ্ট মিডিয়া মোদীর বচনকে অভ্রান্ত প্রমাণ করতে একের পর এক জনমত সমীক্ষার ফলাফল প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। খবরের কাগজ, টেলিভিশনের চ্যানেল, সোশাল মিডিয়া সর্বত্র শাসক দল ‘বিজেপি’র ঝুলিতে ৩৭০ আসন নিশ্চিত’, এমন একটা আবহ তৈরির অবিরাম চেষ্টা চলছে। দফায় দফায় সাজানো সমীক্ষার ফল প্রচারের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠীর সপক্ষে জনমত নির্মাণ এবং একইসঙ্গে জনগণের হকের দাবি রুটি-রুজি-বাসস্থানের লড়াই’কে বিনির্মাণের প্রচেষ্টায় শোরগোল তোলা হচ্ছে। এপর্যন্ত প্রকাশিত সবকটি সমীক্ষাতেই দেখা গেছে নরেন্দ্র মোদীর জমানায় ক্রমবর্ধমান বেরোজগারি, দারিদ্র, ক্ষুধা, বৈষম্য, মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশছোঁয়া মূল্য, পরিশোধিত পানীয় জলের অভাব, দুঃসহ স্বাস্থ্য পরিষেবা, নারীদের নিরাপত্তা, ফসলের ন্যায্য মূল্য, সম্প্রীতির পরিবেশ রক্ষা এগুলোই হলো মানুষের আলোচনার বিষয়বস্তু। অথচ, কর্পোরেট মিডিয়ার সমীক্ষার ফলাফলে মানুষের এই অ্যাজেণ্ডার ছাপটুকু রাখা হচ্ছে না।
অতীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রাজিলে বোলসেনারো, ইজরায়েলে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুদের ক্ষেত্রেও একই প্রচেষ্টা দেখা গেছে। হকের লড়াইকে আড়াল করতে মিডিয়াকে সরকারি দলের প্রচার যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে নিজেদের স্বপক্ষে জনমত নির্মাণের চেষ্টা হয়েছে। ক্ষমতায় ফিরতে বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচনী বিধিবদ্ধ আইন, নিয়ম, কানুন জলাঞ্জলি দিয়ে সাংবিধানিক অধিকারের ঊর্ধ্বে ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রনায়কদের চূড়ান্ত স্বৈরাচারী রূপ ইতিহাসের একেকটি কলঙ্কিত অধ্যায়।
দশ বছরের শাসন ক্ষমতার পর রাজনৈতিক ভাবে বিজেপি’র বাড়-বাড়ন্তের মূলে রয়েছে বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির একচেটিয়া মদত এবং হিন্দুত্বের মতাদর্শগত প্রভাব। ভারতের মূল শাসক শ্রেণি নয়া-উদারবাদী চরম দক্ষিণপন্থী বৃহৎ বুর্জোয়া গোষ্ঠী এবং হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির মেলবন্ধন, রাজনৈতিক পরিসরে বিজেপি’র উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছে। দেশের অন্যান্য বুর্জোয়া দলের সঙ্গে এখানেই বিজেপি’র তফাৎ। বিজেপি আদতে একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী, উগ্র জাত্যাভিমানসম্পন্ন, হিন্দু ব্যতিরেকে অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা বর্ষণকারী, অসহিষ্ণু, চরম দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারী দল। বিজেপি’র চালিকা শক্তি হলো, হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শে বিশ্বাসী ফ্যাসিস্ত সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা, আরএসএস। বিজেপি’র প্রতিটি রাজনৈতিক কার্যক্রম, সাংগঠনিক কর্মসূচি, সরকার চালনায় নীতি প্রণয়ন, বিচার ব্যবস্থা ও বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারী বাছাই, সাংগঠনিকস্তরে নেতা চয়ন, দায়িত্ব বণ্টন সবকিছুরই মস্তিষ্ক হলো আরএসএস। যাদের আদর্শগত হাতিয়ার হলো জাতি বৈষম্যে পুষ্ট মনুবাদ। জাতিভেদ, বর্ণভেদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ ইত্যাদি মধ্যযুগীয় সামাজিক ভেদাভেদ ব্যবস্থাকে তারা ঈশ্বরের বিধি বলে প্রতিষ্ঠা দিতে চায়।
১৯২৫ সালে ব্রিটিশ ভারতে জন্মকাল থেকেই আরএসএস ইতালির স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ক বেনিতো মুসোলিনির প্রতিষ্ঠিত সেদেশের ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ত পার্টি’র অনুগামী। পরাধীন দেশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্ত করার চেয়ে হিন্দুত্বের লক্ষ্যে সকল হিন্দুদের সমবেত করাই ছিল তাদের মূল কর্মসূচি। ‘হিন্দুত্ব’ আরএসএস’র একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। এরসঙ্গে হিন্দু ধর্মের কোনও কর্মসূচিগত মিল নেই। ‘হিন্দুত্ব’ মানে, যারা ভারতবর্ষকে তাদের মাতৃভূমি, পিতৃভূমি এবং পুণ্যভূমি হিসাবে গ্রহণ করে তারাই হিন্দুত্বের অংশ। মুসলিম ধর্মালম্বী যাঁদের পুণ্যভূমি মক্কা ও মদিনা, খ্রিস্টান যাঁদের পুণ্যভূমি জেরুজালেম বা ভ্যাটিকান, আরএসএস’র বিধানে তাঁরা বহির্দেশীয়, অর্থাৎ অভারতীয়। হিন্দুত্বের অংশ নয়। অর্থাৎ, ‘হিন্দুত্ব’ হলো ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী। স্বাধীনতার পর দেশের সংবিধানে ভারত রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য এবং বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের আহ্বানকে কখনোই আরএসএস মেনে নিতে পারেনি। তাই দেশের সংবিধানকে কখনও তারা মান্যতা দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে আরএসএস’র দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকারের উক্তিটি যথেষ্ট অর্থবহ। “ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তি অপচয় না করে বরং, হিন্দু ভাইয়েরা মুসলমান, খ্রিস্টান এবং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য শক্তি সঞ্চয় করুন। কারন এরাই আমাদের দেশের প্রকৃত অভ্যন্তরীণ শত্রু। হিন্দুদের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ ”। কমিউনিস্টরা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে এবং ধর্ম, বর্ণ, মনুবাদী সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তাই তারাও হিন্দুত্বের শত্রু। তাঁর “বাঞ্চ অব থটস্” বইয়ে এভাবেই ‘হিন্দুভাই’দের হিন্দুত্বের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন গোলওয়ালকর। ঐ বইয়ে অ-হিন্দু মানুষদের জন্য তাঁর নিদানটিও ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার। “The non-Hindu peoples in Hindusthan must either adopt the Hindu culture and language, must learn to respect and hold in reverence Hindu religion, must entertain no idea but those of glorification of the Hindu race and culture — in one word they must cease to be foreigners, or may stay in the country, wholly subordinated to the Hindu nation, claiming nothing, deserving no privileges, far less preferential treatment—not even citizen's rights ”। সংক্ষিপ্ত বাংলা তর্জমায় যার মূল অর্থ, হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতির গৌরব চর্চা ব্যতিরেকে অন্য কোন জাতি বা, ধর্মীয় সংস্কৃতির গুণগান করা যাবে না। এককথায়, অন্য জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের নিজস্ব আদব-কায়দা পরিহার করতে হবে। এদেশে থাকতে হলে হিন্দু জাতির সম্পূর্ণ অধীনস্ত হতে হবে। তাঁদের কোনও দাবি থাকা চলবে না। কোনোরকম সুযোগ সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশা ত্যাগ করতে হবে। তাঁদের স্বার্থবাহী কোনোরকম অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা থাকবে না। এমনকি, নাগরিক অধিকারও নয়।
লক্ষণীয় হলো, ২০১৯ সালে বিপুল সংখ্যায় গরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকে কেন্দ্রের আরএসএস-বিজেপি সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডই ছিল হিন্দু-রাষ্ট্র গঠনের দিকে একেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। অযোধ্যায় বাবরি ধ্বংসস্থলে রামের মূর্তি স্থাপন ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রামমন্দির নির্মাণ, কাশ্মীরের জন্য সংবিধানের ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি। রাষ্ট্রীয় প্রতীকের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের প্রতীককে মিলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। নতুন সংসদ ভবনে লোকসভা কক্ষে সেঙ্গল বসানো। পুরাণ বা, পৌরাণিক মহাকাব্যের সঙ্গে ইতিহাস ও বিজ্ঞান’কে গুলিয়ে দেওয়া। দেশের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে পালটে হিন্দুত্বের মতাদর্শের আদলে চালু করা। গোহত্যা, গোমাংস ভক্ষণ, লাভজিহাদ ইত্যাদির অছিলায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর দলবদ্ধ আক্রমণ সংঘটিত করা। তাঁদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আইন লাগু করা। সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রগুলির প্রতি ঘৃণা উদ্রেককারী উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাব জনমানসে সংক্রামিত করার জন্য সরকারি বেসরকারি সমস্ত মাধ্যমকে দল ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যবহার করা। ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে সহজে জনমনে যুক্তিহীন, বৈজ্ঞানিক ধারণা বিবর্জিত, সংস্কারাচ্ছন্ন বিভ্রান্তিকর ধারণা বপনের জন্য একের পর এক চলচ্চিত্র, ওয়েব সিরিজ, সিরিয়াল নির্মাণ। সেন্সর বোর্ড, প্রসারভারতী’কে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে সরকারের উদ্যোগে সর্বত্র এর প্রদর্শনের বন্দোবস্ত।
দেশজুড়েই চলছে নয়া-ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উত্থান। পৌরাণিক চরিত্রগুলোকে ঐতিহাসিক রূপ দিয়ে অতীত সম্পর্কে জনমানসে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একটা মায়াজাল বিস্তারের অদম্য চেষ্টা। ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, সময় পর্যালোচনা, প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার, বিশ্লেষণ ইত্যাদি দ্বান্দ্বিক চর্চাকে অসাড় করে দিয়ে অতীতের শ্রুতি নির্ভর যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাসপুষ্ট মনগড়া ধারণাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সরকারি উদ্যোগে পড়ছে বিচারবিভাগের সিলমোহর। এ’যেন ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রনায়ক মুসোলিনীর প্রদর্শিত পথে দেশকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সুচতুর প্রচেষ্টা।
আজ থেকে ঠিক একশত দুই বছর আগে ১৯২২ সালে ইতালির নাপেলস্ শহরে ফ্যাসিস্ত কংগ্রেসে মুসোলিনির সদর্ভ ঘোষণা ছিল, “We have created our myth. The myth is a faith, a passion. It is not necessary for it to be a reality…. Our myth is the nation, our myth is the greatness of the nation! And to this myth, greatness, which we want to translate into a total reality, we subordinate everything.” অর্থাৎ, “আমরাই আমাদের মিথ বা, অতিকথনগুলো সৃষ্টি করেছি। এই মিথ বা, অতিকথনগুলো হলো আমাদের বিশ্বাস, আমাদের গভীর আসক্তি বা আবেগ। এর বাস্তবতা যাচাই বা, সত্যতা বিচার নিষ্প্রয়োজন… আমাদের মিথ হলো, আমাদের জাতি, আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠত্ব! এই মিথ, এই শ্রেষ্ঠত্বের অতিকথনকে আমরা সার্বিক সত্যে রূপান্তর ঘটাতে চাই, এরজন্য আমরা বাকি সব কিছুকে খাটো বা তুচ্ছ করে তুলি”।
পাঁচ বছর আগে অযোধ্যা মামলার রায় দানেও কী শোনা গিয়েছে ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রনায়ক মুসোলিনিরই কণ্ঠস্বর? রায় দানের সময় ‘শ্রী রামচন্দ্রের’ জন্মস্থান সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতির বক্তব্য ছিল, “Hindus consider Ayodhya as the birthplace of Lord Ram. They have religious sentiments. Hindus have faith and belief that Lord Ram was born under the dome. The faith of Hindus that Lord Ram was born here is undisputed.” একইসঙ্গে তাঁর স্পষ্ট কথা, “The titles cannot be decided on faith and belief but on the claims. Historical accounts indicate belief of Hindus that Ayodhya was the birthplace of Lord Ram.” বাংলায় এর অর্থ, “ হিন্দুরা মনে করে অযোধ্যাই হলো প্রভু রামের জন্মস্থান। তাঁদের ধর্মীয় ভাবাবেগ আছে। হিন্দুদের প্রত্যয় এবং বিশ্বাস হলো প্রভু রাম ঐ গম্বুজের তলাতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রভু রাম যে এখানেই জন্মেছিলেন হিন্দুদের এই বিশ্বাস অবিসংবাদিত ”। পরের অংশের অর্থ, “স্বত্বাধিকার তো কেবলমাত্র বিশ্বাস এবং আস্থা দিয়ে নির্ণয় করা যায় না, দাবির ওপর নির্ভর করে। ঐতিহাসিক বিবরণগুলি হিন্দুদের বিশ্বাসকে নির্দেশ করে যে অযোধ্যাই ছিল প্রভু রামের জন্মস্থান।"
ফ্যাসিস্ত কংগ্রেসে মুসোলিনির অমোঘ বার্তা এবং অযোধ্যার রায়ের ভাষ্যে এই মিল কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়। ইতালির ফ্যাসিস্ত শক্তির মতো এদেশের আরএসএস শুরু থেকে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের শিলমোহরে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন পৌরাণিক মহাকাব্যটির প্রধান চরিত্রের জন্মস্থান নির্ণয় করতে চেয়েছে। পৌরাণিক চরিত্রকে রক্তমাংসের রূপ দিয়ে ঐতিহাসিক নায়কে রূপান্তরিত করার অভিযানে এটা তাদের জন্য আবশ্যিক ছিল। কারণ হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডায় এই বিশ্বাস অবিসংবাদিত।
দ্বান্দ্বিক বিচারে রাম এবং রামের জন্মস্থান সম্পর্কে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রজ্ঞাবহ মূল্যয়নের বিকল্প বোধকরি কোনোদিনও হবার নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাল্য জীবনে তিনজনের রচিত পৃথক তিনটি রামায়ণ পড়েছিলেন। এই তিনটি রামায়ণের রচয়িতারা ছিলেন বাল্মীকি, কৃত্তিবাস এবং তুলসীদাস। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন তিনটি রামায়ণেই ঘটনার বিবরণে বিস্তর ফারাক। তাঁর সেই উপলব্ধি থেকে রবীন্দ্রনাথ ভাষা ও ছন্দ কবিতায় লিখলেন,
“সেই সত্য যা রচিবে তুমি,
ঘটে যা তা সব সত্য নহে।
কবি, তব মনোভূমি
রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো ।”
রামের ভক্তবৃন্দদের জন্য রবীন্দ্রনাথের বার্তা ছিল, রামের প্রতি তাঁদের অধিকার রামজন্মভূমির অধিকার নয়, রামমনোভূমির অধিকার। তাঁর বক্তব্য ছিল, কবিরা তাঁদের কল্পনায় যে রামকে গড়ে তোলেন সেই রামের অবস্থান কবির মনোভূমিতে, রামের জন্মস্থান অযোধ্যার থেকেও তা অধিক সত্য। রবীন্দ্রনাথ অনায়াসে পেরেছিলেন। রাম’কে হিন্দুত্বের খাঁচা থেকে মুক্ত করা এখন বাম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরই দায়িত্ব।
ব্যবহৃত ছবি- সোশ্যাল মিডিয়া