E M S Namboodiripad

ইতিহাস চর্চায় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়োগ

মুখবন্ধ

নয়া-উদারবাদ প্রতিষ্ঠার তিন দশক পেরিয়ে আজকের ভারতে কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক আঁতাতের শাসন। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং ক্ষমতাসীন রাখতে এমন বন্দোবস্তের অন্যতম কৌশলই হল দেশের ইতিহাস, অতীতের সমাজ-সভ্যতা ও সেসবের ঐতিহ্য-উত্তরাধিকারের নামে অসত্য, অর্ধসত্য ও মনগড়া গল্পের ব্যাপক প্রচার। এমন জঘন্য কৌশলকে সামনে রেখেই নয়া-ফ্যাসিবাদী প্রবণতার যাবতীয় বাড়-বাড়ন্ত। আসলে ধান্দার ধণতন্ত্র ও তার ধামাধারিরা উপলব্ধি করেছে আর পিছনে ফেরার উপায় নেই। এই তিন দশকে জনসাধারণের একটিও বুনিয়াদী সমস্যার সমাধান হয়নি অথচ নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। মুনাফার লক্ষ্যে মরিয়া পুঁজিবাদ তাই আরও একবার কৌশল বদলাতে চাইছে। এ হল এড়িয়ে যাওয়ার ফিকির, সমাধান নয়।

ঐ রাজনীতির স্বার্থেই ভারতীয় মনীষার উজ্জ্বলতম উদাহরণগুলিকে নির্লজ্জের ন্যায় দখল করার চেষ্টা চলছে। এমন প্রচেষ্টার সবটাই নতুন নয়, কিন্তু এ কাজে শাসকের আগ্রাসী মেজাজের মাত্রা অবশ্যই অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। তাই আমাদের বারংবার চর্চা করতে হবে ইতিহাসকে কিভাবে উপলব্ধি করতে হয়, কিভাবে তার শিক্ষাকে আত্মস্থ করতে হয়।

এ পরিস্থিতিতে ভারতের মতো দেশে বস্তুনিষ্ঠ, যুক্তিনির্ভর ও বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস চর্চার ধারাকে উর্ধে তুলে ধরতে হয় কমিউনিস্টদেরই। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ধারায় সেই কাজের নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। সে ঐতিহ্যেরই অন্যতম একজন কমরেড ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ।

১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬, ‘নিউ এজ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রবন্ধ হিসাবে, পরে ১৯৫৮-এ বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য মহাত্মা অ্যান্ড দ্য ইজম’। এ বই কমরেড ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের কৃতিত্বের নিদর্শন মাত্র নয়, ভারতে ইতিহাস চর্চার ধারায় এক মাইল ফলক। মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে মার্কসবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গী কী এবং কেন- সেই উপলব্ধির জন্য বইটি প্রবীন ও নবীন সকলের জন্যই অবশ্যপাঠ্য। এ কর্তব্য কেবল মহাত্মা গান্ধী’কে জানা, বোঝার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না, ইতিহাসে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ভুমিকাকে মার্কসবাদী দর্শনের আলোকে আত্মস্থ করা অবধি প্রাসঙ্গিক। এ প্রসঙ্গেই মনে রাখার কথা হল কমরেড ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ নিছক বুদ্ধিবৃত্তি কিংবা মেধার চর্চা হিসাবে এমন কাজ করেননি। মার্কসবাদী হিসাবে এবং কমিউনিস্ট পার্টিতে তার কাজ হিসাবেই সম্পন্ন করেছেন, পার্টি নির্ধারিত অন্যান্য যাবতীয় দায়িত্বের মতোই। এমন কাজের সুবাদে তাকে ‘মার্কসবাদী ইন্টেলেকচ্যুয়াল’ বলে চিহ্নিত করার যে প্রবণতা, আজকের প্রজন্মের পার্টি কর্মীদের ঐ ফাঁদ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি জরুরী বিষয়ের চর্চা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের জন্য স্বাভাবিক কাজ, বিশেষ কিছু না।

আজ কমরেড ই এম এস নাম্বুদিরপাদের জন্মদিবস।

পার্টির কর্মী, সমর্থকদের জন্য ঐ বইটির অংশবিশেষ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হল।

ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’র তরফে ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘মহাত্মা এবং মতবাদ’ বইটিকেই আমরা ব্যবহার করেছি।

প্রতিবেদনের ইংরেজি ও বাংলা শিরোনাম ওয়েবসাইটের নিজস্ব।

ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ

আমাদের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে গান্ধীজির ভূমিকার প্রগাঢ় গুরুত্ব বোঝার একটা মাপকাঠি হচ্ছে যে, কমিউনিস্ট পার্টি বাদ দিয়ে প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং কংগ্রেসের মধ্যে থাকা সমস্ত ধরনের নীতিপন্থী ও উপদলগুলি তাদের রাজনীতির ন্যায্যতা তৈরি করার জন্য, তাদের রাজনীতির পক্ষে সমর্থন তৈরি করার জন্য গান্ধীজির নাম ও তাঁর শিক্ষার কথা ব্যবহার করে। সুতরাং, গান্ধীজি ও তাঁর শিক্ষার ভূমিকা ও গুরুত্ব মূল্যায়নের আন্তরিক প্রয়াসগুলি বিবেচিত হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গান্ধীবাদের যে অসংখ্য ব্যবহার, তার নিরিখে।

এটা কোনো সহজসাধ্য কাজ নয়। ইতিহাসের অন্যান্য বহু মহান ব্যক্তিত্বের মতোই গান্ধীজিরও ছিল একটি ভীষণ জটিল ব্যক্তিত্ব। আবার, তিনি ছিলেন “জাতীয় আন্দোলনের অনুপ্রেরণাদাতা, যাঁর হাত ধরে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে জনগণ জাগ্রত হয়ে উঠেছিল”; অথবা, তিনি ছিলেন “প্রতিবিপ্লবী, যাঁর কারণে জাতীয় আন্দোলন বিপ্লবী আন্দোলনে উন্নত হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল”-ইত্যাকার মতামতের উপর ভিত্তি করে তাঁর শিক্ষাকেও মূল্যায়ন করা যায় না।

তাঁর জীবন ছিল এতটাই ঘটনাবহুল: তাঁর বক্তব্য ও লেখাগুলি ছিল এতটাই বিষয়-ভিন্নতা-সমৃদ্ধ এবং মানুষের কার্যকলাপের এতটাই বিস্তৃত পরিসরকে ছুঁয়ে থাকা; বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর কর্মকাণ্ড ছিল এতটাই নাটকোচিত চমকপ্রদ; যে তাঁর জীবন ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে থাকা কোনো ছাত্র বা ছাত্রীর পক্ষে গান্ধী ও গান্ধীবাদ প্রসঙ্গে তাঁদের নিজস্ব পছন্দের তত্ত্ব প্রমাণ করা খুবই সহজসাধ্য বিষয় হবে। এর জন্য সেই ছাত্র বা ছাত্রীকে একমাত্র যেটা করতে হবে তা হলো, তাঁর জীবন থেকে নির্ধারিত কিছু ধারাবাহিক ঘটনাবলি তুলে নিতে হবে এবং তাঁর বক্তব্য ও লেখাগুলি থেকে নির্ধারিত ঘোষণাগুলির সাথে সেগুলিকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলতে হবে। তা সত্ত্বেও, ইতিহাসের দৃষ্টিকোন থেকে প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলিকে নির্ধারণ করা; তাঁর জীবন ও শিক্ষার বিভিন্ন দিকগুলির মধ্যে পারস্পরিক সংযোগস্থাপন করা; এবং তারপরে ওই মানুষটিকে ও তাঁর নির্ধারিত লক্ষ্যটিকে একসাথে অনুভব করার জায়গায় পৌঁছানো-অনেক অনেক বেশি কঠিন।

আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক যে, এক্ষেত্রে এতদ্যাবৎ যা যা প্রয়াস আমরা দেখতে পেয়েছি সেগুলি দু'ধরনের-অতিসরলীকৃত ও তাঁর প্রতি একদেশদর্শী শ্রদ্ধাজ্ঞাপন: অথবা, একইরকমভাবে অতিসরলীকৃত ও তাঁর বিরুদ্ধে একতরফা সমালোচনা। সুতরাং, প্রতিটি প্রয়াসের ক্ষেত্রেই এই ফাঁদগুলিতে পা দেওয়া সমীচীন হবে না। তাঁর জীবনপ্রবাহ বর্তমান লেখকের কাছে যেভাবে ধরা পড়েছে, নিম্নলিখিত সেই সিদ্ধান্তগুলিই হলো ওই দুই প্রবণতার বাইরে থাকা প্রয়াসগুলিতে একটা যোগদান।

প্রথম যে বিষয়টি উল্লেখ্য তা হলো, গান্ধীজি একজন আদর্শবাদী ছিলেন। ‘আদর্শবাদী’ শুধুমাত্র এই অর্থে নয় যে, তাঁর পথপ্রদর্শক বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি দার্শনিক বস্তুবাদের বিরোধী ছিল; এটা এই অর্থেও যে, তিনি তাঁর সামনে নির্দিষ্ট কিছু ধারণা রেখেছিলেন, যেগুলিকে তিনি জীবনভর আঁকড়ে ধরেছিলেন। তাঁর জীবন ও শিক্ষার অবিভাজ্য অংশগুলি ছিল সত্য, অহিংসা, জীবনের কামনাগুলিকে পরিত্যাগ করার মতো নৈতিক মূল্যবোধ; স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, শান্তির মতো রাজনৈতিক চেতনা: জাতপাতের বিভাজন দূর করা, নারীর ক্ষমতায়ন, সমস্ত ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যস্থাপনের মতো সামাজিক উদ্দেশ্য। এই ধরনের নির্দিষ্ট কিছু আদর্শের প্রতি আনুগত্যের কারণেই তাঁর প্রথমদিকের সামাজিক জীবনে দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি সত্যাগ্রহ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আবার, এই আদর্শই তাঁকে সক্ষম করে তুলেছিল দেশের স্বাধীনতার জন্য অসহযোগ ও অন্যান্য কর্মসূচি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে। এই কারণেই অসংখ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিজয়ী এবং শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্য রক্ষার মহানব্রতে তিনি একজন শহিদ হয়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত, সেই সময়কালে গ্রামের লাখো লাখো তন্দ্রাচ্ছন্ন গরিব মানুষকে জাগিয়ে তুলতে তাঁর এই আদর্শবাদ একটা বিশাল ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁদের সাথে কথা বলার সময় তিনি যে আধো-ধর্মীয় ভাষা ব্যবহার করতেন; সাধারণ ও বাহুল্যবর্জিত যে জীবন তিনি নির্বাহ করতেন; তাঁদের দাবি আদায়ের জন্য যে আবেগ দিয়ে তিনি লড়াই করতেন-সেগুলি সবকিছু মিলে গ্রামের গরিব মানুষকে তাঁর দিকে টেনে নিয়ে এসেছিল। তাঁরা গান্ধীজির মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন একজন রক্ষাকর্তাকে; তাঁকে দেখেছিলেন ঈশ্বরের একজন অবতার হিসেবে যে দুর্দশাগ্রস্ত জীবনে তাঁরা পড়েছিলেন তাঁর থেকে যিনি তাঁদের মুক্তি দেবেন।

বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সংস্কৃতির প্রসঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে বিবেচনা করতে পারি ঠিকই (কিছু কিছু দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসন্দেহে প্রতিক্রিয়াশীল)। কিন্তু, আমরা যদি এই বাস্তবতা দেখতে না পাই যে, কৃষক সমাজ এবং আধুনিক জাতীয়-গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অভিজাত সমাজ থেকে আগত নেতা ও প্রতিনিধিদের মধ্যে সেতুবন্ধনে এই ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ দৃষ্টিভঙ্গিগুলিই তাঁকে সক্ষম করে তুলেছিল, তাহলে তা খুব বড় একটা ভুল হবে। আবার, যদি কেউ বলেন, এই 'প্রতিক্রিয়াশীল' দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই গান্ধীজি হাতিয়ার হয়ে উঠেছিলেন একটা প্রগাঢ় বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের-গ্রামের গরিব মানুষকে আধুনিক জাতীয়-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আঙিনায় টেনে নিয়ে এসেছিলেন, তাহলে সেটা স্ববিরোধী বক্তব্য হিসেবে প্রকাশ পাবে। এই স্ববিরোধিতাই হলো আমাদের দেশের প্রকৃত রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে থাকা দ্বন্দ্বের প্রকাশ; যে দ্বন্দুের উদ্ভব এমন একটা বাস্তবতা থেকে, যেখানে দেশের জাতীয়-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সামন্ততন্ত্রের সাথে সংযুক্ত থাকা দেশের বুর্জোয়া সমাজ।

তৃতীয়ত, এটা চিহ্নিত করা উচিত যে, জাতীয় আন্দোলনে গ্রামের গরিব মানুষকে টেনে আনার ক্ষেত্রে তাঁর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়পর্বে ওই মানুষগুলি যে প্রবলভাবে জেগে উঠেছিলেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্য বলে দেখালে ভুল হবে। কারণ, এই প্রবলভাবে জেগে ওঠা ছিল সেই সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনাবলির ফলাফল, যেগুলি সেই সময়ে ভারতে এবং একই সাথে গোটা বিশ্বে ঘটে চলছিল। ভারতে কৃষকদের অর্থনৈতিক দৈন্যতা ধীরলয়ে হলেও ক্রমাগত বেড়ে চলছিল, যা উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তার ঠিক পরবর্তী সময়পর্বে; ভারতের জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে প্রগতিশীল শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল, যাঁরা কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কৃষক সমাজকেও স্পর্শ করতে পেরেছিল; তুর্কি, চিন দেশে বিপ্লব এবং সর্বোপরি, রাশিয়ার বিপ্লবের প্রভাব সামগ্রিকভাবে এশিয়াবাসীর মনে দাগ কেটেছিল-এই সমস্ত ঘটনাবলি ছিল মৌলিক কারণগুলির মধ্যে কয়েকটি, যেগুলি ভারতের কৃষকদের চেতনার উপর তখন প্রভাব বিস্তার করছিল। গান্ধীজি যদি এই দৃশ্যপটে না আসতেন, তাহলেও তাঁরা এভাবেই সাড়া দিতে পারতেন; তবে সম্ভবত একই পথ অনুসরণ করে নয়।

এই ঘটনাবলি তুলে ধরার উদ্দেশ্য এই নয় যে, ভারতের কৃষক সমাজের জাগ্রত চেহারাটিকে একটি সুনির্দিষ্ট ছাঁচে গড়ে তুলতে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে গান্ধীজি যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাকে অস্বীকার করা: স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সেই নয়া জাগরণ যুক্ত হয়ে পড়ার বাস্তবতায় তাঁর ব্যক্তিগত অবদানকে অস্বীকার করা। গ্রামের দরিদ্র মানুষকে টেনে নিয়ে আসা এবং তার ফলে জাতীয়-গণতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে গান্ধীজির অবদান অস্বীকার করলে, সেটা হয়ে দাঁড়াবে একতরফা; যেন তাঁকে বাদ দিয়ে জনজাগরণ নিজে থেকেই ঘটেছিল।

চতুর্থত, সেই সময়ে গ্রামের অংসগঠিত গরিব মানুষের এক বিশাল অংশকে আন্দোলনে টেনে নিয়ে এসে জাতীয়-গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রকৃত অর্থে জাতীয় ও সমস্ত শ্রেণির আন্দোলনে পরিণত করা; তার মধ্যে দিয়ে এই আন্দোলনের একটা বড় দুর্বলতাকে দূর করার ক্ষেত্রে গান্ধীজির ভূমিকা প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু এটা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ভীত ছিলেন এই ভাবনা থেকে যে, গ্রামের দরিদ্র মানুষ স্বাধীন শক্তি হিসাবে আন্দোলন গড়ে তুলছেন। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে জনগণের বিপুল অংশকে যুক্ত করার জন্য তিনি তাঁর সমস্ত উদ্যম দিয়েছিলেন। কিন্তু, তাঁরা যাতে তাঁর নিজের শ্রেণি, অর্থাৎ বুর্জোয়াদের অধীনে থেকে আন্দোলন করেন, সেই বিষয়েও তিনি ব্যগ্র ছিলেন।

চৌরি চৌরার দিনগুলি থেকে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি সমস্ত কর্মসূচি এমনভাবে পালন করতেন, যাতে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে গ্রামের গরিব মানুষ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নিজেদের আটকে রেখে আন্দোলনে যুক্ত থাকেন; যে সীমানাটা বুর্জোয়াশ্রেণির পক্ষে নিরাপদ। এই বাস্তবতা চিনতে কেউ যদি ব্যর্থ হন, তাহলে তিনি এটা ব্যাখ্যা করতে অক্ষম হয়ে পড়বেন যে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তার দালালদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জনগণ যাতে অহিংস নীতি প্রতিপালন করেন, সেই বিষয়ে গান্ধীজি ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেও, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জন্য সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করানোর লক্ষ্যে সার্জেন্ট হিসেবে কাজ করতে কেন তাঁর বিবেক কোনো বাধা দেয়নি।

পঞ্চমত, শুধুমাত্র গ্রামের গরিব মানুষের ক্ষেত্রে নয়, শ্রমিকশ্রেণি এবং শ্রমজীবী মানুষের অন্যান্য অংশের ক্ষেত্রেও তাঁর কাজের যে ধারা ছিল, সেটা বুর্জোয়াশ্রেণিকেই সাহায্য করেছিল। তাঁর অছিপরিষদ গঠনের তত্ত্ব, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি হিসাবে সুনির্দিষ্ট কিছু নৈতিক মূল্যবোধের পক্ষে তাঁর জেদি অবস্থান, তাঁর সেনাপতিদের সংসদীয় কার্যকলাপের সাথে সংসদীয়ব্যবস্থা-বহির্ভূত তাঁর নিজস্ব কার্যকলাপের (গঠনমূলক কর্মসূচি ও সত্যাগ্রহ) সুচারু মেলবন্ধন ঘটানোর কৌশল, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ গণ-আন্দোলন পরিচালনার সময়েই তার সাথে আলোচনা চালানোর জন্য বৈশিষ্ট্যগতভাবে গান্ধীবাদী পথেই চলা-এই সমস্ত উদ্যোগগুলির প্রকৃত অনুশীলন বুর্জোয়াশ্রেণিকে বিপুলভাবে সাহায্য করেছিল দু'দিক থেকে: সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে জনগণকে জাগ্রত করা; একইসাথে, সেই জাগ্রত জনগণকে নিজেদের স্বেচ্ছাধীন গণ-আন্দোলন থেকে বিরত রাখা। জনগণকে জাগ্রত করা ও তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রত্যক্ষ আন্দোলন গড়ে তোলা সত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদী শাসকের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পন্থা, তাঁকে করে তুলেছিল বুর্জোয়াশ্রেণির অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ছিলেন এমন একজন নেতা, যাঁর প্রতি বুর্জোয়াশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি উপদল ও গোষ্ঠীর ভরসা ছিল। সুতরাং, গোটা শ্রেণিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ ও সক্রিয় করতে পেরেছিলেন।

শেষে যে বিষয়টি উল্লেখ করা যায় তা হলো, বুর্জোয়াশ্রেণির নেতা হিসেবে ইতিহাসে গান্ধীজির যে ভূমিকা তার থেকে এটা অর্থ করে নেওয়া উচিত হবে না যে, বুর্জোয়াশ্রেণির সাথে তিনি সর্বদা এবং প্রতিটি বিষয়ে একমত ছিলেন। অন্যদিকে, এটা তাঁর নিজের এবং যে শ্রেণির তিনি বন্ধু, দার্শনিক ও পথপ্রদর্শক ছিলেন, তাঁদেরও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যে, বহু সময়ে ও বহু বিষয়ে তাঁর বক্তব্য সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল: যদি না সেই বক্তব্য তাঁর একার বক্তব্য হিসাবে পরিগণিত হয়। এই ধরনের প্রতিটি ঘটনায় তিনি এবং তাঁর শ্রেণির বাকিরা নিজেদের মধ্যে একমত হয়েছিলেন যে, তাঁরা যাঁর যাঁর নিজের পথেই চলবেন। এটা একটা প্রত্যক্ষভাবে অনুধাবনযোগ্য বিষয় য। বারবার দেখা গিয়েছিল-প্রথমে অসহযোগ পরবর্তী সময়ে (স্বরাজি ও স্থিতাবস্থা-রক্ষাপন্থীদের মধ্যে কাজের বিভাজন); তারপরে, ১৯৩২-৩৩ সালের আইন অমান্য আন্দোলনের পরবর্তী বছরগুলিতে: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়পর্বের বহু ঘটনায়, শেষপর্যন্ত স্বাধীনতা প্রাপ্তির কিছুদিন আগে ও পরের দিনগুলিতে।

এই মতপার্থক্যের বিষয়টি আরও সুনির্দিষ্টভাবে সত্যি হয়ে উঠেছিল তাঁর শেষ জীবনে, যখন তাঁর আদর্শবাদ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল ‘ইস্পাত দৃঢ় মানসিকতার’ সর্দার প্যাটেলের ‘লৌহদৃঢ় বাস্তববাদী অনুশীলনের’ সাথে, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী পণ্ডিত নেহরুর আধুনিক চিন্তার সাথে; এবং আরও বহু মানুষের সাথে, যাঁরা বহু বছর ধরে তাঁর সহকর্মী বা সেনাপতি ছিলেন। তাঁর সাথে সহকর্মীদের ক্রমবর্ধমান যোজন-বিস্তৃত মতপার্থক্যের কারণেই স্বাধীনতা পরবর্তী মাসগুলিতে তাঁর জীবন বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছিল; এমনকি, তাঁর সেই দুঃখজনক শেষ পরিণতির আগেই।

শেষ জীবনে সহকর্মীদের সাথে তাঁর এই যোজন-বিস্তৃত মতপার্থক্য আমরা পরীক্ষা করে দেখলে, একজন মানুষ ও তাঁর নির্ধারিত জীবনব্রতের প্রেক্ষিতে গান্ধীজি সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে একটা প্রকৃত বস্তুবাদী মূল্যায়ন করতে পারব। কারণ, কিছু নৈতিক মূল্যবোধ প্রসঙ্গে গান্ধীজির ধারাবাহিক বক্তব্য একদা বুর্জোয়াশ্রেণির পক্ষে সহায়ক হয়ে উঠেছিল; কিন্তু, তাঁর জীবনের শেষদিকে সেই বক্তব্যই তাঁদের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল- এই বাস্তব অবস্থাই ছিল ওই যোজন-বিস্তৃত মতপার্থক্যের বহিঃপ্রকাশ।

সেই সমস্ত দিনগুলিতে, যখন দু'দিকেই লড়াই চালাতে হচ্ছিল- একদিকে, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই এবং সেই লড়াইয়ে শহরে ও গ্রামীণ গরিব মানুষকে কর্মসূচিতে টেনে নিয়ে আসা; অন্যদিকে, জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈপ্লবিক কার্যকলাপের প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই- সেই সময়ে বুর্জোয়াশ্রেণি দেখতে পেয়েছিল, গান্ধীজির গড়ে তোলা অহিংস প্রতিরোধী লড়াই তাঁদের পক্ষে সহায়ক হবে। কিন্তু, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে যেই একবার বিজয়ীর মুকুট তাঁরা পরে নিতে পারলেন, অর্থাৎ বুর্জোয়াশ্রেণি ও তার শ্রেণি-মিত্ররা যখন রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেল, তখন আর দু'দিকেই যুদ্ধ চালানোর প্রয়োজনীয়তা তাঁদের রইল না। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের আরও যা যা লড়াই চালানোর দরকার হতো, সেগুলি তাঁরা রাষ্ট্রস্তরেই চালাতে পারত; ফলে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষকে আরও আন্দোলনমুখী করার প্রয়োজনীয়তা তাঁদের ছিল না।

আরও বাস্তবতা হলো, বুর্জোয়াশ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে যখন সেটা তাদের শ্রেণিস্বার্থে ব্যবহার করতে গেল, তখন দেশের সাধারণ মানুষের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ল রাষ্ট্রক্ষমতা ও রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যবস্থা। ক্ষমতা লাভের আরও একটা ফলাফল হলো যে, বুর্জোয়াশ্রেণি প্রতিনিধি হিসাবে যে ব্যক্তিরা ক্ষমতায় এলেন (মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক ইত্যাদি হিসাবে) তাঁরা নিজেদের এবং তাঁদের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজন, অনুগত মানুষদের বড়লোক করে তুলতে শুরু করে দিলেন; এবং সেটা করছিলেন দেশ ও সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিনিময়ে। এই কাজ করার জন্য তাঁরা যেকোনো ধরনের দুর্নীতির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন, যখন সেটা ফলপ্রসূ হতো।

 ভাষান্তর- জয়দীপ ভট্টাচার্য

 

ওয়েবডেস্কের পক্ষে মুখবন্ধ- সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন