"পিনাকেতে লাগে টঙ্কার"- সোমনাথ ভটাচার্য্য

ফরাসি বিপ্লব(১৭৮৯) এবং নভেম্বর বিপ্লব(১৯১৭) এর মধ্যবর্তী সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রাম ছিল প্যারি কমিউন(১৮মার্চ থেকে ২৮ মে,১৮৭১)।

কার্ল মার্কস কমিউনের গুরুত্ব বোঝাতে বললেন, যে ঘটনা স্বর্গে ঝড় তুলেছিল। মাত্র ৭২ দিন স্থায়ী হয়েছিল প্যারি কমিউন। প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণী প্যারি নগরীকে দখল করে নতুন সরকার পরিচালনা শুরু করে দেয়। কিন্তু ৭২ দিন পর শাসকের ভয়ঙ্কর আক্রমণে পতন হয় প্যারি কমিউনের। হাজার হাজার কমিউনার্ডদের রক্তে লাল হয়ে যায় প্যারিসের প্রতিটি রাস্তা। যত্রতত্র পড়ে থাকে কমিউনার্ডদের লাশ। 

আজ ২৮ শে মে ২০২১। আজ থেকে দেড়শ' বছর আগে ১৮৭১-র ২৮মে পতন হয় প্যারি কমিউনের। কিন্তু এ হল সেই ব্যতিক্রমী সংগ্রাম যা পরাজিত হয়েও বিজয়ী। যেমন স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ। দু' হাজার বছরেরও বেশি আগে বিদ্রোহ করে দাস প্রভুদের হাতে খুন হয় স্পার্টাকাস। কিন্তু আজ এত বছর পরেও স্পার্টাকাস আমাদের হৃদয়ে অমর। প্যারি কমিউনও ছিল এমন এক ঘটনা যা পরাজিত হয়েও অপরাজিত। যার শিক্ষাগুলি অপরাজেয়। ভবিষ্যতের সংগ্রামে সার্চ লাইটের মত। যুগ যুগ ধরে আলো দেখিয়েছে। কোন পথে গন্তব্য আর কোন পথ পরিত্যাজ্য তা শিখিয়ে দিয়েছে। শাসকের বুকে কাঁপন তুলে বুঝিয়ে দিয়েছিল :

"পিনাকেতে লাগে টঙ্কার 
বসুন্ধরার পঞ্জরতলে, কম্পন জাগে শঙ্কার।"

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম শোষিত জনগণ, শ্রমজীবী মানুষ সংক্ষিপ্ত পরিসরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করল প্যারি কমিউনের হাত ধরে। ১৮৪৮-র ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় মার্ক্স-এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ইস্তেহার। শোষণহীন সমাজ গড়ার ব্লুপ্রিন্ট। সেই দলিলের প্রথম বাস্তবায়ন প্যারি কমিউন। শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষমতা দখল। মার্ক্স এঙ্গেলসের নেতৃত্বে ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংগঠন। যা পরবর্তী পৃথিবীতে প্রথম আন্তর্জাতিক বলে পরিচিত হয়েছে। এই আন্তর্জাতিকের মানস সন্তান প্যারি কমিউন। 

ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকেই ইউরোপের রাজনীতিতে ফ্রান্সের গুরুত্ব অপরিসীম। ফ্রান্স তার চিন্তা দিয়ে গোটা ইউরোপকে ভাবাতে পারত। যে কারণে মেটারনিক বলতেন, If France is sneezing,  rest of Europe catches cold। আর বলার অপেক্ষা রাখেনা ফরাসি বিপ্লবের শিক্ষা মার্কসবাদের অন্যতম উপাদান। তাই মার্ক্স-এঙ্গেলস বিপ্লবী ফ্রান্সের লড়াই আন্দোলন সম্পর্কে সব সময় বাড়তি মনোনিবেশ করতেন। ১৮৩০ এর জুলাই বিপ্লব, ১৮৪৮-র ফেব্রুয়ারি বিপ্লব কিংবা ১৮৭০-র ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ মার্ক্স-এঙ্গেলস গভীর মনোযোগ সহকারে এগুলিকে লক্ষ্য করেছেন। 

১৮৭১-এর আগে ১৮৭০ ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। প্রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন তৃতীয় নেপোলিয়ন।ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রজাতন্ত্র। এ প্রসঙ্গে মার্কসের মন্তব্যটি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বললেন, ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্রের আবির্ভাবকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু সেইসঙ্গে আমাদের মনে কিছু সংশয়ও আছে।এই প্রজাতন্ত্র রাজ সিংহাসনের মূলোৎপাটন করেনি তার শূণ্যস্থানে গিয়ে বসেছে মাত্র। 

এই প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে মার্কসের মূল্যায়ন ছিল ষোলআনা খাঁটি। সত্যি সত্যিই দেখা গেল এই প্রজাতন্ত্র প্রজাদের স্বার্থে আদৌ কোনও মনোযোগ দিতে পারেনি। এই সময় ফ্রান্সের একের পর এক শহরকে দখল করছে প্রাশিয়া।তখন প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণী সিদ্ধান্ত নেয় তাদের সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দেবে প্রুশিয় (জার্মান) সেনাদের। রক্ষা করবে নিজেদের পিতৃভূমিকে। রক্ষা করবে প্যারিসকে। এই সংকল্পে শুরু হয় লড়াই। তারা ফিরিয়ে দেয় জার্মান সেনাদের। এই লড়াই লড়তে লড়তে আসে ১৮৭১-র ১৮ ই মার্চ। সেদিন সকাল হতে না হতেই প্যারিসের শ্রমিক শ্রেণী Vive la Commune! অর্থাৎ 'কমিউন দীর্ঘজীবী হোক' এই স্লোগানে মুখরিত করে প্যারিসের আকাশ বাতাস। শাসকের পুলিশ আর বুর্জোয়াদের সৈনিকদের পিছু হটতে বাধ্য করে অভ্যুত্থানকারী জনগণ। নেতৃত্বে প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণী। দখল নেয় প্যারি নগরীর। তাড়া খাওয়া শাসকেরা পালিয়ে যায় ভার্সেইয়ে। শ্রমজীবী মানুষের এই অভ্যুত্থানের দশ দিন পর ২৮ শে মার্চ ঘোষিত হয় প্যারি কমিউন। পৃথিবীর প্রথম প্রলেতারীয় রাষ্ট্র। এ এক নতুন ধরনের ব্যবস্থা। মূলত শ্রমজীবী জনগণের দ্বারা পরিচালিত। শ্রমিকশ্রেণী তথা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ এক সরকার। যে সরকার শ্রমিকের কথা বলল। যে সরকার মানুষের রুটি-রুজির কথা বলল। যে সরকার নারীর অধিকারের কথা বলল। যে সরকার রাষ্ট্রপরিচালনায় ধর্মীয় আগলকে মুক্ত করে দিল। 

কমিউনার্ডদের হাতে ভূলুন্ঠিত নেপোলিয়ানের মূর্তি

এত কিছুর পরেও ব্যর্থ হলো প্যারি কমিউন। ১৮৭১-র ২৮মে  জার্মান ও ফরাসি সেনা, যারা এতদিন পরস্পরের প্রতি সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল তারা সম্মিলিতভাবে এক হয়ে আক্রমণ করল কমিউনকে ।কমিউনার্ডদের রক্তে হোলি খেলা হলো। হাজারে হাজারে কমিউনার্ডদের প্রাণের বিনিময়ে পতন হল প্যারি কমিউনের। 

একথা ঠিক প্যারিসের শ্রমিকদের মার্ক্স বারবার সতর্ক করেছিলেন উপযুক্ত সময় আসেনি বলে। কিন্তু শ্রমিকশ্রেণী যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে মার্ক্স-এঙ্গেলস তখন সর্বতোভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কমিউনের পতনের পর বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া কমিউনার্ডদের সাহায্যের জন্য মার্কস এঙ্গেলস নতুন অভিযানে নেমেছিলেন। আর বুকের মধ্যে যন্ত্রণাকে চেপে রেখে এর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কমিউনিস্ট ইস্তেহারের ১৮৭২ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় আজও তা জ্বলজ্বল করছে। তাঁরা বললেন, 
কমিউন শিক্ষা দিল শ্রমিকশ্রেণীর শুধু রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেই চলবে না। তাকে রক্ষা করে তাদের শ্রেণীর স্বার্থে ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। অর্থাৎ প্যারি কমিউন আমাদের শেখালো : লড়াই করে পেয়েছি যা লড়াই করে রাখব তা। 

কমিউন ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর অনুপস্থিতি। বরং শাসকেরা কৃষকদের ব্যবহার করেছিল শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। ছিল না আদর্শে বলীয়ান বিপ্লবী পার্টি। প্যারি কমিউন আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে শিখিয়ে গেল বিপ্লবী পার্টি ছাড়া বিপ্লবী সংগ্রামী সফল হতে পারে না। 
কেন এই পরাজিত বিপ্লবকে আজও স্মরণ করছি আমরা? লেনিন আমাদের দুটি কথা শিখিয়ে দিলেন। এক, কমিউন ইউরোপীয় প্রলেতারিয়েতকে শিখিয়েছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্তব্যগুলি যথাযথভাবে উপস্থিত করতে। 
দুই, প্যারিসে কামানের বজ্রনির্ঘোষ প্রলেতারিয়েতের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশগুলিকেও গভীর নিদ্রা থেকে জাগিয়ে তুলেছিল। আর একই সঙ্গে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক প্রচারকে বাড়াতে উদ্দীপনা যুগিয়েছিল। 

নভেম্বর বিপ্লব এর প্রতিটি পদক্ষেপে প্যারি কমিউন এর শিক্ষা লেনিনকে আলো দেখিয়েছে। কমিউন ভীষণভাবে লেনিনকে প্রভাবিত করেছিল।সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাষ্ট্র যখন ৭২ দিন অতিক্রম  করল তখন লেনিন বললেন এটাই হল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। আমরা এখন 'কমিউন প্লাস ওয়ান' যুগে পদার্পন করেছি। অর্থাৎ প্যারি কমিউন ছিল একটা প্যারামিটার।

প্যারি কমিউন আমাদের পথ দেখায়। অন্ধকার রাস্তায় সার্চ লাইটের মত আলো ফেলে। আর শিক্ষা দেয় পরাজয় শেষ কথা বলে না। পরাজয়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে থাকে আগামী বিজয়ের সম্ভাবনার মহীরূহ।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন