দ্য ব্যানার অব হিউম্যান ডিগনিটি’

১৮ জানুয়ারী ২০২৩ সম্ভ্রমের দূরত্ব হেলায় ঠেলে সরিয়ে তাঁকে অনায়াসে জড়িয়ে ধরা যায়। কারন — ভালোবাসা বিপ্লবীর অর্দ্ধেক স্থপতি। তাঁর উপস্থিতিতে বারেবারে লেনিনের অনুভবই সত্য হয়ে ওঠে। ‘লেনা নদীর সন্তান’ বলেছিলেন,‘‘এ’ কথা অস্বীকার করে লাভ নেই রোমান্টিকতা ছাড়া কিছু করা যায় না। কিছু কম থাকার চেয়ে একটু বেশি রোমান্টিকতা বোধহয় বেশি ভালো। আমাদের সহমর্মিতা সবসময়ে রোমান্টিক বিপ্লবীদের প্রতি — তাঁদের সঙ্গে মতের মিল না হলেও।’’ আর্নেস্তো চে গুয়েভারা নামে পরিচিত মানুষটি অনেকটা দূর পর্যন্ত পাতোজের সেই কবিতাটির মত। প্রেয়সীর উদ্দেশ্য চে-র দীর্ঘ যাত্রা পথের সহযোদ্ধার লেখা সেই কবিতায় ছিল — ‘‘এই যে! এটা রেখে দাও তোমার হাতে। আমার হৃদয় ছাড়া ওটা আর কিছু নয়! সময় হলে পরে মুঠো খুলে মেলে ধরো। সূর্যের উত্তাপে — উষ্ণতা ফিরলেও ফিরতে পারে —’’ মেক্সিকো থেকে কিউবা পাতোজো ছিলেন চে-র সহযোদ্ধা। সংগ্রামের জন্য পাতোজো কিউবা ত্যাগ করার আগে তাঁর কবিতার খাতা চে-র কাছে রেখে যান। সেখানেই ছিল এই কবিতাটি। চে আসলে আদ্যোপান্ত সেই কবিতাটির মত। যাঁকে সামনে রেখে ট্রেঞ্চে, গেরিলা যুদ্ধে, জলপাই পোষাকে নিজেকে কল্পনা করা যায়। বেয়নেটে মাথা রেখে মাঝরাতে তারাদের অখন্ড ঘননীল দুনিয়ার আর্শিতে চোখ রেখে অনর্গল কথা বলার প্রবল ইচ্ছাকে জাগিয়ে রাখা যায় — সম্ভবত আমৃত্যু।
স্ত্রী সন্তানদের সাথে চে
কিংবা আমাদের পাশে, আমাদের সঙ্গে অসীম শূণ্যতার মুহূর্তেও কল্পনা করে নিতে পারা যায় রিতা উস্তিনোভিচকে। কিংবা হিলদাকে। আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান হতে পারে ঘুমিয়ে থাকা শিশু কণ্যার কপালে, গালে চুমু এঁকে দিচ্ছেন তার বাবা। হিলদা বুঝেছেন মুহূর্ত আসন্ন। তিনি বলছেন,‘‘ইনহেলারটি নিতে ভুলো না, হারিও না রাস্তায়।’’ ‘ঠিক আছে’ বলে বেরিয়ে যাচ্ছেন প্রাণের পুরুষ। ডাক্তারির প্রয়োজনিয় জিনিসের ব্যাগ হাতে তুলে প্রিয়তমাকে আলবিদা জানাচ্ছেন। ‘গ্রানমা’ নামে সেই রণতরী সৈকত ছেড়ে দূরে সরে যাওয়ার পরে হিলদা আবিষ্কার করছেন, হাঁপানির আশঙ্কাকে জয় করার তীব্র ইচ্ছায় রণতরীতে চে উঠেছেন ইনহেলারটি ছাড়াই। বাকিটা? জানে সিয়েরা মায়াস্ত্রার অরণ্য! কিন্তু… কিন্তু যদি সেই আর্নেস্তো দে লা সেরনার সামনে দাঁড়িয়ে, তাঁরই চোখে চোখ রেখে রক্তিম অভিবাদন জানাতে হয় সৈনিকের মত? যদি মনে করতে হয় যে, মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার সংগ্রাম আপাতত পথ নয়, তবু আমারই জন্মভূমির ভূগোল, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, সংস্কৃতির উপযোগী পথে আমিও এক নিরন্তর মুক্তিযুদ্ধের সেনাবাহিনীর অংশ, তাহলে মেরুদন্ড টানটান থাকতে হবে — চে’র সামনে। কারন — চে হৃদয়ের সেই কবিতা। হৃদয়ের অভিমান থাকে। কবিতার থাকে সন্মানের দাবি। শেষ পর্যন্ত ‘চে’ মানে — আত্মমর্যাদা। তিনি আসলে তাঁরই উচ্চারিত বাক্যের চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত — ‘দ্য ব্যানার অব হিউম্যান ডিগনিটি।’ যাঁর আত্মমর্যাদা বোধ নেই, চে-র সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর বিপ্লবের মন্ত্রগুপ্তি নেওয়ার অধিকারই নেই। চে প্রায়ই হোসে মার্তির উর্দ্ধৃতি দিয়ে বলতেন,‘‘যে কোনও মানুষের নিজের গালে চড় মেরে অনুভব করা উচিত অপরের গালে চড় মারলে কেমন লাগে।’’ আসলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা শাসক শুধু সম্পদই লুট করে না, সে শুধু তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্যই গড়ে তোলে না। শাসক, শোষক কেড়ে নেয় মাথা উঁচু করে বাঁচবার অধিকার। সে গড়ে তোলার চেষ্টা করে শোষণের এক শৃঙ্খল — সে দাতা। বাকিরা গ্রহিতা। শুধু নতজানু দয়াকাঙ্খী। তাই পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে বিপর্যস্ত গরিব, মধ্যবিত্তর লড়াই আসলে আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারেরও লড়াই। আর যিনি সেই লড়াইয়ে ভ্যানগার্ড অব দ্য প্রোলেতারিয়েতের ভূমিকায়, তাঁর যদি আত্মসন্মান বোধ না থাকে, তাহলে তিনি চে-র উত্তরসূরী নন।
হিলদা ও চে

চে কে?

এই প্রশ্ন বারবার পৃথিবীতে উঠেছে। কিউবার বিপ্লবের পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়েছিল,‘এ’ একজন রাশিয়ান। মস্কোর এজেন্ট।’ প্রতিবাদে চে কী বলেছিলেন? ‘‘আমি সব দেশের নাগরিক। গুয়েতামালায় নিজেকে সেখানকার লোক মনে হয়। পেরুতে পেরুর। কিউবাতে কিউবার।…কিন্তু..।’’ কিন্তু কী? বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদের রোল মডেল বললেন,‘‘কিন্তু সব জায়গাতেই একই সঙ্গে আমি ভ্রাম্যমান আর্জেন্টিনা।’’ চে সোজা কথায় বুঝিয়ে দিলেন নিজের দেশকে ধারন করা হৃদয়েই মাথা তোলে, পুষ্ট হয় এক আন্তর্জাতিকতাবাদী বিপ্লবী। ১৪ই মার্চ, ১৯৬৫-র পর জনসমক্ষে কিউবাতে আর চে-কে দেখা যায়নি। আবার অপপ্রচার। এবার কেউ বললেন, ফিদেল হত্যা করেছেন। কেউ বললেন, হাঁপানিতে মারা গেছেন। কেউ বললেন,আমেরিকায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। নিউজ উইক জানালো,‘এক লক্ষ ডলারের বিনিময়ে কিউবার গোপন তথ্য বিক্রি করে দিয়েছেন গুয়েভারা।’ ইভিনিং পোস্টে এলো আর এক গল্গ — ‘চে চিনে।’ মাও সে তুঙের চিন সম্পর্কে চে-র অসীম আগ্রহ দিল্লিতে খাবার টেবিলে নেহেরুর সামনেও প্রকাশিত হয়েছিল, ১৯৫৯-র জুলাইয়ের গোড়ায়।
ফিদেল, আলেইদা ও চে
শেষ পর্যন্ত যাবতীয় জল্পনার অবসান ঘটালেন ফিদেল কাস্ত্রো। চে’র বার্তাগুলি প্রকাশ্যে আনলেন তিনি। সেখানে কী জানিয়েছেন চে? তাঁর বয়ানে জানা গেল,‘‘পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তেও আমার কাজ করা দরকার।…কিউবা যা পেরেছে আরও অনেক দেশকে সেটা পারতে হবে।’’ অর্থাৎ সেই ‘অনেকগুলি ভিয়েতনাম’ গড়ে তোলার স্বপ্ন। আর কী ছিল বার্তায়? চে লিখেছিলেন,‘‘আমি জানি আমার পরিবারকে যথা প্রয়োজন দেখবে রাষ্ট্র।…আমার দায়িত্ব আপনাদের আর বইতে দেব না আমি।— চললাম..’’ তারপরের ইতিহাস বহুশ্রুত। অনেকে অনেক ভাবে লিখেছেন। কিন্তু অন্তিম বার্তার শেষ বাক্যে কী আছে? মাইকেল লোয়ির কথাই ধরা যাক। তাঁর ব্যাখ্যায়,‘‘এই আত্মসন্মানবোধ অর্জনের সংগ্রামই ছিল তাঁর অন্যতম নৈতিক দর্শন যা তাঁকে সান্তাক্লারার যুদ্ধ থেকে শুরু করে বলিভিয়ার পর্বতমালায় শেষ মরীয়া সংগ্রাম পর্যন্ত সব কর্মকান্ডে অনুপ্রাণিত করেছিল। চে যাকে বলতেন,‘মানুষের মর্যাদার নিশান (দ্য ব্যানার অব হিউম্যান ডিগনিটি)।’’ চে নিজে কী বলছেন? বিপ্লবের পরে কিউবার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে চে বলছেন,‘‘যখনই কোনও জাতি মুক্তির জন্য চিৎকার করে, কিউবাকে তখনই দোষ দেওয়া হয়। যদিও একদিকে এ কথা সত্য যে কিউবা দোষী, কারন কিউবাই পথ দেখিয়েছে সশস্ত্র গনঅভ্যুত্থানের, প্রমাণ করেছে দুর্ধর্ষ অত্যাচারী বাহিনীকেও পরাস্ত করা সম্ভব। পথ দেখিয়েছে কী ভাবে শত্রুকে তাঁর ঘাঁটি থেকে অনেক দূরে জঙ্গলাকীর্ণ পার্বত্য অঞ্চলে ধ্বংস করা সম্ভব — এককথায়, মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ।’’ সেই আত্মমর্যাদার অনুবাদই লেখা আছে ঠোঁটের জ্বলন্ত সিগারে, জলপাই পোষাকে আর উজ্বল চোখে অনুচ্চারিত স্পর্ধায়!
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া
শেয়ার করুন

উত্তর দিন