শান্ত ঋজু দৃঢ় মানুষটি চলে গেলেন

সুবিনয় মৌলিক

বাংলা কবিতার পাঠকমাত্র জানেন , শিরোনামের বিশেষণগুলি গোলাম কুদ্দুসের এমন একটি কবিতা থেকে নেওয়া যার প্রেক্ষিত বা মর্মবস্তু এই লেখাটির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তবুও চার চারবার জাতীয় পুরস্কার জয়ী চলচ্চিত্রকার তরুণ মজুমদার সম্পর্কে যে কোনো আলোচনায় তাঁর সম্পর্কে এই শব্দগুলি অব্যর্থ। আজ আবেগতাড়িত কেউ কেউ তাঁকে প্রবীণ চলচ্চিত্র পরিচালক বলে আখ্যায়িত করলেও প্রবীণত্ব তাঁর চিন্তাজগৎকে গভীরতা ও স্বচ্ছতাকে শেষ সচেতন মুহূর্ত পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর জীবনদর্শনের স্পষ্টতার কারণেই তিনি পরিবারের কাছে ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর শেষ ইচ্ছা -- মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহে যেন কেউ ফুল বা মালা না দেন। কোনও শোক যাত্রার আয়োজন না করা হয় । কিংবা সরকারি কোন প্রেক্ষাগৃহে তাঁর মরদেহ যেন নিয়ে যাওয়া না হয়। সামান্য কয়েকটি অনুজ্ঞা , কিন্তু তার মধ্যেই অকথিত রয়ে গেছে এমন এক বোধ , যা এক আলোকসাধারণ জীবনাদর্শের দিকদিশারী। নিথর দেহের ওপর কেবল রক্ত পতাকা আর বুকের সামনে গীতাঞ্জলি রেখে যে মানুষটিকে এসএসকেএম হাসপাতালের অ্যানাটমি বিভাগের সামনে আমরা বিদায় জানালাম তাঁর মরণোত্তর দেহদান ও চক্ষুদানের সিদ্ধান্তও একইরকম ভাবে ব্যতিক্রমী। চিরকাল সাধারণের মধ্যে একজন হয়ে থাকতে চাওয়া মানুষটি শারীরিক মৃত্যুর পরেও সাধারণ্যের মনোরাজ্যে চিরতরে অমর হয়ে রইলেন।

সক্রিয় রাজনীতির জগৎ থেকে খানিক দূরে থাকলেও এই সচেতনভাবে অনাড়ম্বর জীবনযাপনের শেষতম অধ্যায়ে বড়ো নিবিড় সান্নিধ্যে জড়িয়ে গেছিলাম আমরা, বামপন্থীরা। একথা অনেকেরই জানা যে তিনি তাঁর সদ্য প্রকাশিত আত্মজৈবনিক স্পর্শমধুর আখ্যায়িকা 'সিনেমাপাড়া দিয়ে '' বইটির ভূমিকায় তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন গণশক্তি পত্রিকা দপ্তরের পাঠাগার মুজফ্ফর আহমেদ লাইব্রেরির কর্মীদের। বিগত বেশ কয়েক বছর দিনের পর দিন অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে লাইব্রেরির দপ্তরে বই-কাগজ ঘাঁটা , সামান্য মুড়ি-বাদাম টিফিনেই অসীম পরিতৃপ্তি , চেনা কারো সাথে দেখা হলেই ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি মাখানো সৌজন্য বিনিময় --যে মানুষটির প্রায় নিত্য উপস্থিতি পাঠাগারকে অন্য মাত্রা দিয়েছিলো, তিনি জানতেন তাঁকে যারা ঘিরে আছে তারা সবাই কমরেড-ইন-আর্মস। তারই স্বীকৃতি এই শব্দমালা। আমাদের গর্বিত সঞ্চয়।

গণশক্তি পত্রিকার সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক বহুকালের। আমরা একসময় মজা করে বলতাম , তরুণ মজুমদার যদি আর ফিল্ম না বানিয়ে ঘরে বসে ওই 'হিরণ সেনের ডায়েরি' সিরিজ লিখে যান,বাঙালির সাহিত্য ভান্ডারে যে ঐশ্বর্য সঞ্চিত হবে ,তা অতুলনীয় । বছরের পর বছর শারদ গণশক্তির পাতায় টানটান গদ্যে, অনুপম চিত্রভাষ্যে তাঁর এই আলেখ্যগুলির স্বাদ গ্রহণ করতে আক্ষরিক অর্থে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম।

পাশাপাশি স্থায়ী সম্পদ হয়ে থাকবে গত এক দশকের নানা প্রতিবাদী সমাবেশে তাঁর সংক্ষিপ্ত কিন্তু আন্তরিকতার বর্ণে মর্মস্পর্শী ভাবনার উপস্থাপন । মনে আছে ২০১৬ সালে রানুচ্ছায়া মঞ্চে এক বুদ্ধিজীবী সমাবেশে স্বভাবসিদ্ধ মসৃণ বাক্যচয়নে বলেছিলেন , "যাঁরা দায়বদ্ধ ছিলেন ,আছেন ,থাকবেন তাঁদের উৎসাহ দেখে অতিরিক্ত কিছু ভেবে ফেলবেন না।বরং সুবিধাবাদীদের সুযোগসন্ধানীদের নড়াচড়াগুলো লক্ষ করুন। সেই নিরিখে পরিস্থিতির ভাল দিকগুলো বুঝতে পারবেন।" স্বল্প শব্দে অসাধারণ ইঙ্গিত ,আপোষহীন সোজাসাপ্টা । এমনটাই ছিল তাঁর বক্তব্য। রাজ্যে চলমান প্রতিটি কুৎসিত বীভৎসতার বিরুদ্ধে যে কোনো আকৃতির প্রতিবাদ সমাবেশে তাঁর দ্বিধাহীন সম্মতি ও অংশগ্রহণে ঋদ্ধ হয়েছে এ রাজ্যের মাথা না নোয়ানো বিদ্বৎসমাজ। বারংবার বলেছেন শুধু প্রতিবাদ নয় , প্রতিকারও চাই। মানুষের প্রতি শুভ্র ন্যায়সংগত ভবিষ্যতের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন দায়বদ্ধতা থেকে অসুস্থ শরীর নিয়েও দীর্ঘপথ মিছিলে হেঁটেছেন । বাম রাজনীতির মানুষজনের কাছে এমনটাই প্রগাঢ় ছিল তাঁর উপস্থিতি , ফলত আজকের এই স্বজন হারানোর অপরিসীম শূন্যতা।

কিন্তু বামবৃত্তের বাইরেও যে অগণিত মানুষ তাঁর সৃষ্টির গুণমুগ্ধ তাদের কাছে কেমন ছিলেন তরুণ মজুমদার ? বিদগ্ধজন নিশ্চয়ই নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে তাঁর বিখ্যাত ছবির অক্ষয় জনপ্রিয়তা নিয়ে চর্চা করবেন, কিন্তু এক্ষেত্রেও আমাদের মূলগতভাবে যা আকর্ষণ করতো তা হলো তাঁর ছবির অন্তর্নিহিত মানবিক মূল্যবোধ। টিভিতে 'নিমন্ত্রণ' দেখতে বসে হীরু কুমুর অসার্থক ভালোবাসায় চোখে জলে ভরে আসা বা 'আলো' দেখতে গিয়ে হৃদয়ের এ কুল ও কুল ভাসানো হাহাকার আসলে কোনো এক আশ্চর্য ইন্দ্রজালে আমাদের মনের গভীর তন্ত্রীতে আঘাত করে ভেতরের মনুষ্যত্বে অনুরণন। ঠিক একই কারণে কোথায় যেন মফস্বলের তিন বার পরীক্ষা পাস করতে না পারা কেদারের সততা , বিনম্রতা আমাদের অন্তরের দাগগুলো ফুটিয়ে তোলে। এই যে আমাদের মতো যারা এই অতিকায় সমাজযন্ত্রের অকিঞ্চিৎকর প্রত্যঙ্গ , তাদের সঙ্গে ছবির মানুষজন একাত্ম হয়ে যাচ্ছে- এই সামান্যতেই আমাদের কাছে তরুণবাবুর অসামান্যতা। প্রায় নিয়ম করে রবীন্দ্রসংগীতকে তাঁর চলচ্চিত্রের আবশ্যিকতায় পরিণত করা , এর মধ্যেও তো নিশ্চিতভাবেই ছিল এক বিশ্বাস -মানবিক উত্তরণের প্রতি আস্থা।

আমাদের সঙ্গে শেষবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ এ বছর সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন উদযাপন অনুষ্ঠানে কলামন্দিরে। সেখানেই তাঁর মুখে শোনা একদা সত্যজিৎ তাঁকে বলেছিলেন পর্দায় কখনো মিথ্যে কথা বলবে না। । এভাবেই ছবিকে দেখতেন, ভাবতেন তরুণ মজুমদার ।

আজকে বড়ো বেশি যে কথা মনে পড়ছে তা হলো সত্যজিতের নিবিড় সানিধ্যে থাকা ভি শান্তারামের স্নেহভাজন জননন্দিত এই যে একজন মানুষ এতগুলো বছর সম্পূর্ণত আমাদের ধরা ছোঁয়ার মধ্যেই ছিলেন, কখনো কোনো অবকাশেই তাঁর আমিত্বের বিন্দুমাত্র পরিচয়ের কোনো মুহূর্ত ঘটেনি। বারবার তাঁর কথায় ফিরে আসতো পৃথ্বীরাজ কাপুর, বলরাজ সাহানিদের মতো মহীরুহদের আশ্রয়ভূমি গণনাট্য সংঘের গর্বিত উত্তরাধিকারের প্রসঙ্গ। জনতার মুখরিত সখ্যে মিশে থাকার অনমনীয় শপথ। সেইভাবেই নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে বাঁচতেন তিনি। আজ বড় অসময়ে চলে গেলেন। বাংলার প্রগতিশীল সৃষ্টির ভুবনে আরো খানিকটা নিঃস্ব করে গেলেন আমাদের।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন