সুকুমার ১৩৫ - সংগ্রাম চ্যাটার্জী

৩০ অক্টোবর ২০২১ ,শনিবার

"....................... বিশেষতঃ, আত্মতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, ঈশ্বরতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে এক-একটা কথার সঙ্গে মানুষের সঙ্গত অসঙ্গতি নানাপ্রকার সংস্কার এমনভাবে জড়িত থাকে যে এক-একটা শব্দ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক মানুষের অলক্ষিতে এক-একটা ব্যক্তিগত সংস্কারে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ধর্ম বলিতে, আত্মা বলিতে, হাজার লোকে হাজার রকম অর্থ করে, অথচ এই কথাগুলি লইয়া লোকে এমনভাবে মারামারি করে যেন অর্থ সম্বন্ধে আর কোনো মতান্তর নাই। ............ "

লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছে না, ঠিক আজকের প্রেক্ষিতেই লেখা এটা। একটু কম চেনা জানা প্রবন্ধ থেকে নেওয়া এই অংশটা। প্রবন্ধটার নাম 'ভাষার অত্যাচার', লেখা হয়েছিল অন্ততঃ একশ' বছর আগে! কিন্তু এখনও প্রাসঙ্গিক এর প্রতিটা বাক্য। লেখক কে??
পড়তে শেখার পর যাঁর লেখা পড়তে বসায়, কিংবা যাঁর লেখা পড়ে "হিয়ার মাঝে ধাঁই ধপাধপ্ তবলা বাজে"— সেই সুকুমার রায়।

এই নিচের লেখাটাও তাঁরই, এটা আবার খুব চেনা। এটাও ঐ একইভাবে আজকেও খুব প্রাসঙ্গিক। যখন পরের হোক বা নিজেরই নামকরণের রোগ খুবই মাথাচাড়া দিচ্ছে, ঠিক এইসময়ে ঐ ওনারই একটা লেখার অংশ একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক্— "হিজিবিজ্‌বিজ্‌ বলল, 'একজনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে সব জিনিসের নামকরণ করত। তার জুতোর নাম ছিল অবিমৃষ্যকারিতা, তার ছাতার নাম ছিল প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, তার গাড়ুর নাম ছিল পরমকল্যাণবরেষু- কিন্তু যেই বাড়ির নাম দিয়েছে কিংকর্তব্যবিমুঢ়, অমনি ভূমিকম্প হয়ে বাড়িটাড়ি সব পড়ে গিয়েছে..."

একেবারে বিপরীত দুইরকম দুটো লেখা, দুটো লেখাই একজনের— সুকুমার রায়।
আজ ৩০ অক্টোবর, সুকুমারের দিন।

একদিকে অবিমিশ্র হাস্যরসের সাথে সুনিপুন ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছন্দ গতি, ভাব-সমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা এবং সর্বোপরি বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য— এককথায় এগুলির সবটা নিয়েই সুকুমার। কে লিখছেন এ' কথা? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। লিখছেন সুকুমারের প্রথম গল্প সংকলনের ভূমিকায়।

রবীন্দ্রনাথেরই 'রাজর্ষি' উপন্যাসের দুই চরিত্র— 'হাসি' ও 'তাতা'। এই দুই নাম ধার নিলেন উপেন্দ্রকিশোর, নিজের মেয়ে আর ছেলের ডাকনাম রাখলেন এই দুই চরিত্রের নামে। সবাইই জানেন. এই 'তাতা' হচ্ছেন সুকুমার রায়।

মাত্র ৩৬ বছরের সল্পায়ূ সুকুমার, মারা গেলেন কার্যত বিনা চিকিৎসায়— কালাজ্বরে। যার ওষুধ আবিষ্কৃত হল ওনার মৃত্যুর সামান্য কিছু পরে!
জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেন নি নিজের লেখা একটা বইও। নিজের হাতে সম্পূর্ণ তৈরি করা বই 'আবোল তাবোল' প্রকাশিত হল মৃত্যুর ক'দিন পরে। আরও অনেক পরে ১৯৪০ নাগাদ প্রকাশিত হল 'পাগলা দাশু'। যার ভূমিকায় লেখা রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো আগেই উল্লেখ করেছি...

মাত্র ৩৬ বছরের জীবন, কিন্তু কী না করেছেন এইটুকু সময়ে! সন্দেশ সম্পাদনা-প্রকাশনা থেকে শুরু করে মণ্ডা ক্লাব (Monday), ননসেন্স ক্লাব থেকে শুরু করে ফটোগ্রাফি চর্চা— আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে একের পর এক ছড়া-ছবি-গপ্পো লেখা! বাঙালির ছোটবেলা জুড়ে বিরাজ করা একের পর এক চরিত্রের ভিড়— কাকেশ্বর কুচকুচে থেকে শুরু করে হিজিবিজবিজ্, হুঁকো মুখো হ্যাংলা, কাতুকুতু বুড়ো থেকে রামগরুড়ের ছানা, বাবুরাম সাপুড়ে থেকে হেড্ আফিসে বড় বাবু, ষষ্ঠিচরণ থেকে বোম্বাগড়ের রাজা, ট্যাঁশ গরু থেকে পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা, কুমড়োপটাশ থেকে ভীষ্মলোচন শর্মা, কিংবা ঐ হাঁসজারুরা...
এবং সর্বোপরি পাগলা দাশু!!

সুকুমারকে বাঙালি বেশি করে মনে রেখেছে তাঁর ঐ তথাকথিত 'ননসেন্স' এর জন্যে ঠিকই, কিন্তু তাঁকে এই একটা গণ্ডিতে আটকে রাখাটাও আবার ঠিক না। আবোল তাবোল, হ য ব র ল, পাগলা দাশু কিংবা কিছু নাটক (ঝালাপালা, লক্ষ্মণের শক্তিশেল,অবাক জলপান

ইত্যাদি)— এগুলোর সাথেই আমরা বেশি পরিচিত। এই ফাঁকে আমরা হয়তো বা অবহেলা করেছি ওনার আরেকটা দিককে।

সুকুমারের তথাকথিত ননসেন্সে পাওয়া আজব জীবজন্তুর পাশাপাশি সত্যিকারের জীবজন্তুকে নিয়ে লেখা বেশ কিছু ছোটো ছোটো প্রবন্ধ— যার মধ্যে গোরিলা, বেবুন, শিম্পাঞ্জি, বাঁদর থেকে শুরু করে বীভার, গ্লাটন, ঘোড়া, বাদুড়, আদিম বাঘ, তিমি, পিরানহা থেকে শুরু করে নানারকম টিপিক্যাল মাছ, কুমির, কাঁকড়া, ঝিনুক, শামুক এমনকি ধনেশ (ধনঞ্জয়)— কার্যত একটা ছোটোখাটো না-মানুষ-বিশ্বকোষ খুলে বসেছেন সুকুমার। আমরা পড়ি না, বা কমই পড়ে থাকি।
একইরকমভাবে অবহেলিত জীবনী সমগ্রটাও। যেখানে গ্যালিলিও, আক্রিমিডিস, লিভিংস্টোন থেকে শুরু করে সুকুমার তুলে এনেছেন বহু বিজ্ঞানী ও পর্যটকদের কথা।

তবে সবচেয়ে কম আলোচনা করি বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক / আবিষ্কার থেকে শুরু করে মৌলবাদী চিন্তা ও কুসংস্কার বিরোধিতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে সুকুমারের প্রবন্ধগুলি। যারই অন্যতম 'ভাষার অত্যাচার' থেকে কোট করেছিলাম এই লেখার একদম শুরুতে।

সুকুমার রায়ের এই প্রবন্ধগুলো বিশেষ করে ছোটদের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনা বাড়াতে, কুসংস্কার মুক্ত মন তৈরি করতে, অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা অবহেলা করেছি। এই যেমন ধরেন সুকুমারের 'শনির দেশে' প্রবন্ধ থেকে নেওয়া এই অংশটা—
"....................... আকাশে কত চাঁদ। একটি নয়, দুটি নয়, একেবারে আট দশটা চাঁদ— ছোট বড় মাঝারি নানারকমের। সওয়া দশ ঘন্টায় এখানকার দিন রাত— ঘুমের পক্ষে ভারি অসুবিধা। দিনটাও তেমনি— পৃথিবীর রোদ এখানকার চাইতে একশ গুণ কড়া। পৃথিবী থেকে সূর্যকে যদি চায়ের পিরিচের মত বড় দেখায় তবে এখান থেকে তাকে দেখায় আধুলিটার মতো। যখন তখন চন্দ্রগ্রহণ আর সূর্যগ্রহণ ত লেগেই আছে; তার উপর আবার চাঁদে চাঁদেও গ্রহণ লেগে যায়, এক চাঁদ আর-এক চাঁদকে ঢেকে ফেলে। এখানকার জন্য যদি পঞ্জিকা তৈরি করতে হয়, তবে তার মধ্যে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কেবল গ্রহণের হিসাব লিখতেই কেটে যাবে।...... "

এইরকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়াই যায়, দিয়ে সময় নষ্ট করছি না। যাঁরা এখনও পড়ে উঠতে পারেন নি, শুরু করে দিন। নিজে পড়ে বাড়ির ছোটোদেরও পড়ান, সেটাই হবে এই "ব্যাকরণ না মানা" সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা মানুষটার প্রতি সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।

শেষে আবোল তাবোলের এই লাইনগুলো আরেকবার পড়ে নেওয়া যাক—

"........ আজকে দাদা যাবার আগে / বল্‌ব যা মোর চিত্তে লাগে
নাই-বা তাহার অর্থ হোক্ / নাই-বা বুঝুক বেবাক্ লোক।
আপনাকে আজ আপন হতে / ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে।
ছুট্‌লে কথা থামায় কে? / আজকে ঠেকায় আমায় কে?"


যার শেষ দুটো লাইন বোধহয় সব্বার চেনা—
".........
আদিম কালের চাঁদিম হিম, / তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।
ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর, / গানের পালা সাঙ্গ
মোর।"
৩০ অক্টোবর। আজ সুকুমার রায়ের দিন।



শেয়ার করুন

উত্তর দিন