প্রতিদিন ১ হাজার কোটি খরচ? বরাদ্দ উল্লেখ নেই - চন্দন দাস

রেগা নিয়ে ভাঁওতা বাজটে

‘প্রত্যেক জবকার্ডধারী’কে কাজ দেবে রাজ্য সরকার। কাজ দেবে ‘কমপক্ষে ৫০ দিন’ করে। মমতা ব্যানার্জির সরকার বৃহস্পতিবার বাজেটে এই ঘোষণা করেছে। এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘কর্মশ্রী।’ এই প্রকল্প আগামী মে থেকে চালু হবে বলে রাজ্য সরকারের প্রতিশ্রুতি।
উল্লেখযোগ্য হলো, এই প্রকল্পে রাজ্য সরকার আগামী এক বছরে কত টাকা খরচ করবে, তার বরাদ্দ কত— এসব কিছুই ওই ঘোষণায় নেই। কিন্তু হিসাব বলছে, দৈনিক মজুরির হার এখনকার মতো থাকলেও এই খাতে সরকারের খরচ হবে অন্তত ৪৭,৭০০ কোটি টাকা! পুরোপুরি ভাঁওতার ঘোষণা এটি— দাবি পঞ্চায়েতের অনেক কর্মী, অফিসারেরই।
রেগায় কাজ দিতে পারলে, ১৫ দিন পর থেকে কাজ চাওয়া গ্রামবাসীকে ভাতা দিতে বাধ্য থাকে রাজ্য সরকারগুলি। মমতা ব্যানার্জির সরকার এই ভাতা দেয় না। এই নিয়ে বারবার কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক রাজ্যকে চিঠি পাঠিয়েছে। ইউপিএ সরকারও পাঠিয়েছে। বিজেপি সরকারও। রাজ্য সরকার দেয়নি। সেই রাজ্য সরকার এতগুলি টাকা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে!
রাজ্যে এখন জবকার্ডধারীর গ্রামবাসী পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৩৬ লক্ষ ৬২ হাজার ৩০৩ জন। প্রতি পরিবারে গড়ে তিনজন জবকার্ডের আওতায় আছেন। অর্থাৎ জবকার্ডের আওতায় থাকা গ্রামবাসী প্রায় ৪ কোটির বেশি। এত মানুষকে ৫০ দিন করে কাজ দেবে রাজ্য সরকার— দাবি তেমনই। মমতা ব্যানার্জির প্রতিশ্রুতি শুনে আরও গ্রামবাসী জবকার্ড পেতে আবেদন করবেন, এই সম্ভাবনা দূরে সরিয়ে রাখার পরেও যে আশঙ্কা থাকে, তা হলো প্রায় ৪ কোটি জবকার্ডধারীকে বছরে ৫০ দিন কাজ দেওয়ার টাকার সংস্থান রাজ্য সরকার করবে কী করে? যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ২০১২-তে আমলাশোলে গিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, রাজ্যে ১৫০ দিন রেগার কাজের বন্দোবস্ত করবেন তিনি। কিন্তু তা কখনও হয়নি।


রাজ্যে রেগার কাজে দৈনিক মজুরি এখন ২৩৭ টাকা। ৪ কোটি মানুষকে ওই হারে ১ দিন কাজ দিতে খরচ হবে ৯৪৮ কোটি টাকা। বছরে ৫০ দিন কাজ দিলে খরচ হবে ৪৭,৪০০ কোটি টাকা। রাজ্যের বাজেট ৩,৬৬,১১৬ কোটি টাকার। তার মধ্যে সরকারের যাবতীয় খরচ আছে। সেই বাজেট বরাদ্দের ১৩% টাকা যাবে এই প্রকল্পে!
ইতিমধ্যেই মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করেছেন যে, আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের ২১ লক্ষ জবকার্ডধারী ব্যাঙ্ক অ্যাকাউণ্টে বকেয়া মজুরির টাকা দেওয়া হবে। বৃহস্পতিবারের বাজেট ঘোষণাতেও তা আছে। রাজ্য সরকার জানাচ্ছে, ওই ২১ লক্ষ জবকার্ডধারীকে বকেয়া মজুরি দিতে সরকার ৩৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।
ধোঁয়াশা দেখা দিয়েছে বরাদ্দ নিয়ে। ২০২২-এর ১১ মে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে একশো দিনের প্রকল্প, অর্থাৎ রেগার বকেয়া টাকার বিষয়ে চিঠি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী লেখেন,‘‘রাজ্যে গত চার মাসের বেশি মজুরির টাকা বকেয়া একশো দিনের প্রকল্পে। মজুরি ছাড়া একশো দিনের অন্যান্য ক্ষেত্র (মেটিরিয়াল কস্ট মূলত)-র টাকাও বকেয়া। সব মিলিয়ে ৬৫০০ কোটি টাকা বকেয়া। এর মধ্যে মজুরি বাবদ বকেয়া প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা।’’
তারপরে কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দেয়নি। রাজ্য সরকারও রেগার কাজ করাতে পারেনি। তাহলে ২০২৪-র ফেব্রুয়ারিতে রাজ্যের মজুরি বাবদ বকেয়ার পরিমাণ ৩৭০০কোটি টাকা হলো কী করে? ৭০০ কোটি টাকা কোথায় বাড়লো? কাজই তো হয়নি। রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের এক অফিসার এদিন জানিয়েছেন,‘‘আমাদের হিসাবে বকেয়া মজুরির পরিমাণ ২৮০০ কোটির কিছু বেশি টাকা।’’ তাহলে বাজেটে বাড়তি বরাদ্দ দেখানো হলো কেন? প্রসঙ্গত, রেগায় ঠিকাদারদের দিয়ে অনেক কাজ তৃণমূল সরকার কমিয়েছে। সেই সব টাকা বকেয়া আছে। নির্বাচনের আগে ঠিকাদারদের টাকা মিটিয়ে না দিলে নির্বাচনে সমস্যা হতে পারে, এই আশঙ্কা তৃণমূলের অনেক নেতারই আছে।

মদে আরও জোর মমতার,
বিক্রি থেকে ১২ বছরে
আয় বেড়েছে ৬৭৯%

২০১১’র বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে তৃণমূলের নির্বাচনী ইশ্‌তেহারের ৯ নম্বর পাতায় বামফ্রন্টের তীব্র সমালোচনা করে মমতা ব্যানার্জি লিখেছিলেন— ‘‘শিল্পের থেকে আজ শুঁড়িখানা অনেক বেশি। শিল্প মানে শুধু মদের বন্যা।’’
কিন্তু আসলে ‘মদের বন্যা’ দেখিয়ে চলেছেন মমতা ব্যানার্জি।
বামফ্রন্ট সরকারের শেষ বাজেটে, অর্থাৎ ২০১১’র বাজেটে মদ বিক্রি করে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪১৮ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকা। মমতা ব্যানার্জির সরকার আগামী এক বছরে রাজ্যে মদ বিক্রি করে তুলবে ২১ হাজার ৮৪৬ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা! বিধানসভায় বৃহস্পতিবার ২০২৪-২৫’র বাজেট পেশ করেছেন অর্থ মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। সেখানে এই লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হয়েছে।
সিঙ্গুরে কারখানা আটকানোর সময় মমতা ব্যানার্জি দাবি করেছিলেন, সিঙ্গুরে সুইমিং পুল, ওয়াইন শপ হবে। এখন মদের দোকান শুধু সিঙ্গুরে নয়, সারা রাজ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে তাঁর সরকার।
গত বছর বাজেটে মদ বিক্রি করে যত টাকা তোলার কথা তৃণমূল সরকার ঘোষণা করেছিল, তার থেকে বেশি আয় করেছে। গতবারের বাজেটে ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে মদ বিক্রি করে রাজ্য সরকার ১৭ হাজার ৯২১ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করেছিল। আর্থিক বছর শেষ হতে এখনও প্রায় দেড় মাস বাকি। রাজ্য সরকার জানাচ্ছে, ইতিমধ্যেই প্রায় ১৮ হাজার ৮৫১ কোটি ৬ লক্ষ টাকা ওই খাতে আয় হয়েছে। গত ১২ বছরে মদ বিক্রিতে রাজ্যের আয় বাড়ানো হয়েছে ৬৭৯ শতাংশ।
ধারাবাহিকভাবে রাজ্যে মদ বিক্রিতে জোর দিয়েছে তথাকথিত ‘মা মাটি মানুষ’-এর সরকার। এবারও মদ বিক্রিতে আরও জোর দিয়েছে রাজ্য সরকার। আগামী বছর সেই তুলনায় আরও প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা আয় বেশি করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে তৃণমূল সরকার।

মাথাপিছু ধার ৬৩ হাজার,
ঋণ ৬ লক্ষ কোটি ছাড়িয়ে

রাজ্যের জনসংখ্যা দশ কোটি ছাড়িয়েছে। রাজ্য সরকারের ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ লক্ষ ৩১ হাজার কোটি টাকায়। আগামী আর্থিক বছরে সেই ধার ৬ লক্ষ ৯৩ হাজার ২৩১ কোটি ৬৬ লক্ষ টাকায় পৌঁছে যাবে বলে বৃহস্পতিবার বাজেট প্রস্তাবে তৃণমূল সরকার জানিয়েছে।
স্পষ্টতই মমতা ব্যানার্জি সরকারের বাজেট প্রস্তাব অনুসারে রাজ্যের মাথাপিছু দেনা এখন প্রায় ৬৩ হাজার ৭৮ টাকা!
আগামী এক বছরে অর্থাৎ ২০২৪-২৫ সালে শুধু বাজার থেকেই রাজ্যের তৃণমূল সরকার ধার করবে ৭৯ হাজার ৭২৭কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ আর্থিক বছ‍‌রে বাজার থেকে রাজ্য সরকার ধার করেছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী আর্থিক বছরে (২০২৪-২৫) বছরে রাজ্য মোট যা আয় হবে বলে ধরেছে, সেই আয়ের প্রায় ২৩.৭২ শতাংশ আসবে বাজার থেকে নেওয়া ধারের মাধ্যমে।
২০১১ সালে রাজ্যে যখন সরকার পরিবর্তন হচ্ছে, তখন রাজ্যের মোট ঋণের পরিমাণ কত ছিল? ১ লক্ষ ৯২ হাজার ৯১৯ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ ১৯৪৭ থেকে ২০১১— এই সময়কালে রাজ্যের ধার তা-ই দাঁড়িয়েছিল। এখন রাজ্যের ঋণ কত? প্রায় ৬ লক্ষ ৩০ হাজার ৭৮৩ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। ১২ বছর সরকার চালিয়ে মমতা ব্যানার্জি রাজ্যকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছেন এবং রাজ্য ও রাজ্যবাসীকে কতটা দেনায় ডুবিয়ে দিয়েছেন, এটি তার প্রমাণ।
মমতা-শাসনে ১২ বছরে রাজ্যের ধার বেড়েছে ৪ লক্ষ ৩৭ হাজার ৮৬৩ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন