এসওএস সংহতি - শান্তনু দে

 

১৪ জুলাই ২০২১



  ‘এসওএস কিউবা!’

মুহূর্তে ভাইরাল সমাজমাধ্যমে। কিউবায় ‘জমনা বদলের’ এক নতুন ছক। দ্বীপরাষ্ট্রে অস্থিরতা তৈরিতে সরাসরি মার্কিন-মদত। ‘মিয়ামি-কেন্দ্রিক যে সংস্থা এই লেবেলটি তৈরি করেছিল, তাতে টাকা ঢেলেছিল ফ্লোরিডা সরকার।’ জানাচ্ছে হাভানায় চীনের দূতাবাস। খাদ্যসঙ্কট, করোনা চিকিৎসা এবং বিদ্যুৎ ঘাটতি নিয়ে রবিবার কিউবার কিছু এলাকায় বিক্ষোভে নামেন মানুষ। নিউ ইয়র্ক টাইমসের শব্দবন্ধে ‘হাজারো’! লাখো নয়। একইসঙ্গে বিক্ষোভ হয় মিয়ামি-সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায়। এবং অন্য কয়েকটি দেশেও। বিক্ষোভের ধরনেই স্পষ্ট, স্বতস্ফূর্ততার থেকে এটি অনেক বেশি সংগঠিত।

একইসঙ্গে, ‘এসওএস কিউবা’ লেবেলকে ব্যবহার করে মুহূর্তে শুরু হয়ে যায় মার্কিন শীর্ষ কর্তাদের টুইট। যেমন অ্যান্থনি সাবাতিনি। যে সে লোক নন সাবাতিনি। ফ্লোরিডা প্রদেশের প্রতিনিধিসভার রিপাবলিকান প্রতিনিধি। কিউবায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার খোয়াব দেখে তাঁর টুইট, ‘কিউবার শীর্ষস্তরের কমিউনিস্ট কর্তাদের এখন চরমপত্র দেওয়া উচিত: হয় এখনই, কমিউনিজম থেকে সরকারের রূপান্তরে সহযোগিতা করুন, নাহলে পরে মামলা, ফাঁসির মুখোমুখি হতে হবে। #এসওএস কিউবা।’

উচ্ছ্বাস চেপে না রেখে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন দাবি করেন, এ তো দেখছি কিউবার জনগণের ‘স্বাধীনতার জন্য তূর্যনিনাদ’, এক জোরালো দাবি। সত্যিই ‘অসাধারণ’! কিউবার ‘স্বৈরাচারী জমানা থেকে স্বাধীনতার তূর্যনিনাদ শুনিয়েছেন জনগণ। এরকম প্রতিবাদ বহুদিন আমরা দেখিনি।’ আমরা থাকব ‘কিউবার জনগণ ও তাঁদের স্বাধীনতার’ দাবির সঙ্গে।

স্বাভাবিক।

বিপরীতে, বিপ্লবকে রক্ষা করতে রাস্তায় নামে কিউবা।
মার্কিন-মদতপুষ্ট প্রতিবিপ্লবী প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে তাঁরা আওয়াজ তোলেন ‘ভিভা ফিদেল’! ‘হয় সমাজতন্ত্র, না হয় মৃত্যু’!

রাস্তায় নামেন রাষ্ট্রপতি দিয়াজ ক্যানেলসহ শীর্ষ নেতারা। পরে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘ওরা (পশ্চিম) যদি কিউবার জন্য কিছু করতেই চায়, ওরা যদি সত্যিই আমাদের জনগণের জন্য উদ্বিগ্ন হয়, ওরা যদি কিউবার সমস্যার সমাধান করতে চায়, তাহলে আগে ওরা অবরোধ প্রত্যাহার করুক, তারপর আমরা দেখব।’

টানা ৬০-বছর অবরুদ্ধ কিউবা। যদি টানা ষাট বছর আমেরিকা অবরুদ্ধ থাকত, আজ তাহলে মার্কিনমুলুকের অবস্থা কেমন হতো? পৃথিবীর আর কোনও দেশকে দীর্ঘদিন ধরে এমন বর্বরতার শিকার হতে হয়নি। আজ কিউবার এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? তবু একরত্তি কিউবা মাথা নত করেনি। এক মুহূর্তের জন্য না। আজ রাষ্ট্রসঙ্ঘে, অবরোধ প্রত্যাহারের দাবিতে কিউবার পাশে গোটা বিশ্ব। আর একঘরে আমেরিকা। সঙ্গে শুধু ইজরায়েল।

আর তাই কিউবার প্রতি ‘এসওএস সংহতি’!

‘আমরা সবাই কিউবান!’ মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতি লোপেজ ওব্রাডোর থেকে আর্জেন্টিনার আলবার্তো ফার্নান্ডেজ। নিকারাগুয়ার রাষ্ট্রপতি দানিয়েল ওর্তেগা থেকে বলিভিয়ার লুইস আরসে, ভেনেজুয়েলার নিকোলাস মাদুরো। সবাই অবরোধ প্রত্যাহারের দাবিতে সরব। মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরোধিতায় সোচ্চার। কিউবার পাশে চীন, রাশিয়া। দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টি। বামপন্থী রাজনৈতিক দল। দুনিয়ার ট্রেড ইউনিয়নগুলির আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ডব্লিউএফটিইউ থেকে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন সংগঠন। সবার কাছে তাই কিউবার প্রতি ‘এসওএস সংহতি’!
কিউবায় মানবাধিকার নিয়ে লাগাতার অভিযোগ জানিয়ে আসছে ওয়াশিংটন থেকে ব্রাসেলস। কিউবায় না কি শ্রমিকদের মতপ্রকাশ, ইউনিয়ন গঠনের কোনও স্বাধীনতা নেই?

ঘটনা হলো, কিউবার শ্রমিকদের ৯০ শতাংশের বেশি ইউনিয়নের সদস্য। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই হার মাত্র ১১.৩ শতাংশ। ১৯৫৯, কিউবায় বিপ্লব। তার ২০-বছর আগে ১৯৩৯ সালে সমস্ত ইউনিয়নকে নিয়ে তৈরি হয় ফেডারেশন অব কিউবান ওয়ার্কার্স (সিটিসি)। ইউনিয়নগুলি পুরোপুরি স্বাধীন, স্বনির্ভর। সদস্যপদের চাঁদা মজুরির ১ শতাংশ সরাসরি সংগ্রহ করা হয় কর্মস্থল থেকে, কেটে নেওয়া হয় না মজুরি থেকে।

২০১৬’র এপ্রিলে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তম কংগ্রেসে এর জবাব দেন রাউল কাস্ত্রো।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবর দাবি করে কিউবায় না কি মানবাধিকার নেই, আর সেটাই অর্থনৈতিক অবরোধ তোলার ক্ষেত্রে তাদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আমাদের কাছে, মানবাধিকারের অর্থ: সমকাজে সমমজুরি, তা সে পুরুষ হোন, আর মহিলা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ অন্যান্য দেশে এটা নেই। মহিলারা পান কম মজুরি। অথচ, এনিয়ে কয়েকডজন মানবাধিকারের উল্লেখ করা যেতে পারে। বিনমূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা— কিউবায় অন্যতম একটি মানবাধিকার। এরকম মানবাধিকার এই বিশ্বে আর ক’টি দেশে আছে? বহু দেশে এটা কোনও মানবাধিকারই নয়। বরং, ব্যবসা। আমাদের দেশে শিক্ষা মেলে বিনামূল্যে। বিশ্বে আর ক’টি দেশ আছে, যেখানে ফ্রি-তে শিক্ষা মেলে? এটাও সব দেশে ব্যবসা।’

‘সেকারণেই এনিয়ে আমরা যে কারোর সঙ্গে যে কোনও জায়গায়, যে কোনও সময় আলোচনা করতে প্রস্তুত।’ বলেন রাউল।

এবং, আজ পর্যন্ত কেউ এনিয়ে কিউবার সঙ্গে আলোচনায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ পর্যন্ত করেনি।
কিউবায় প্রতি ১৭০ জন পিছু একজন ডাক্তার। আমেরিকায় দ্বিগুণেরও বেশি, ৩৯০ জন পিছু একজন ডাক্তার। আর ভারতে, সাড়ে আটগুনেরও বেশি, ১৪৫৭ জন পিছু একজন ডাক্তার।
টানা ছ’দশক অবরোধের মুখেও কিউবা মানব উন্নয়নে গোটা বিশ্বের কাছে এক অনন্য নজির। বর্ণবিদ্বেষের অবসান। মহিলাদের সমানাধিকার, মহিলাদের উত্থান। নিরক্ষরতার হার, শিশুমৃত্যু তলানিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা, ক্রীড়ায় সমানে পাল্লা দিয়ে চলেছে দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে।

মানব উন্নয়ন সূচকে সবচেয়ে উন্নত দেশগুলির তালিকায় কিউবা। ১৮৯টি দেশের মধ্যে স্থান ৭২, যেখানে ভারত ১২৯। গড় আয়ু ৭৯.৫, যেখানে আমেরিকায় ৭৮.৯৩, আর ভারতে প্রায় ৭০। পাঁচ বছরের কম বয়েসী শিশুর মৃত্যু হার প্রতি এক হাজারে মাত্র ৫, যেখানে আমেরিকায় ৬.৫, আর ভারতে ৩৬.৬। একরত্তি দেশ কিউবা। আয়তন মেরেকেটে ১ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। জম্মু কাশ্মীরের চেয়ে বড়, তেলেঙ্গানার চেয়ে ছোট। জনসংখ্যা সাকুল্যে এক কোটি দশ লক্ষ। উত্তর চব্বিশ পরগণা, দক্ষিণ দিনাজপুর মিলিয়ে এর চেয়ে বেশি মানুষ থাকেন। আমেরিকার জনসংখ্যা এর ৩৩ গুণ। তেত্রিশ কোটি।

এহেন এক ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রের লড়াই এই দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে। মাত্র নব্বই মাইল দূরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় কিউবা। এমন এক দ্বীপ, যা তার শত্রুর চেয়ে ৮৪ গুণ ছোট।

তবু প্রত্যয়ী। যেমন জানিয়ে দিয়েছেন কিউবার রাষ্ট্রপতি, ‘কোনও ভাড়াটে প্রতিবিপ্লবী, যাঁরা অস্থিরতায় প্ররোচনা দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থ পাচ্ছেন, তাঁদেরকে কোনওভাবেই কিউবা বরদাস্ত করবে না।’

গত এপ্রিলেই হয়েছে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম কংগ্রেস। সেখানে রাউল কাস্ত্রোর সতর্কবার্তা ছিল, ‘কেউ কেউ বিদেশী বাণিজ্যের উপর রাষ্ট্রের আধিপত্যের সমাজতান্ত্রিক নীতির অবসান চাইছেন। বিদেশী বাণিজ্যে একটি রাষ্ট্র-বহির্ভূত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বেসরকারি বাণিজ্যিক আমদানির কর্তৃত্ব চাইছেন।’

রাউল বলেন, ‘এই পথে হাঁটা মানে, জাতীয় শিক্ষা, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা— যা সমস্ত কিউবাবাসীর জন্যই বিনামূল্যে এবং যার সুযোগ সর্বজনীন— তাকে স্বল্প সময়ের মধ্যে গুঁড়িয়ে ফেলা।’ যোগ করেন, ‘এটি হবে আমাদের রণনীতিগত বিচ্যুতি। সমাজতন্ত্রের ধ্বংসসাধন, আর সেকারণে আমাদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার ধ্বংসযজ্ঞ।’


শেয়ার করুন

One comment

উত্তর দিন