নীলোৎপল বসু
এটা নভেম্বর মাস। বিপ্লবের মাস। কিন্তু রোমান্টিক নস্টালজিয়ায় মোহমুগ্ধ থাকলে আজকে সমকালীন পৃথিবীতে এবং ভারতেও জনগণের সামনে বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জের সফল মোকাবিলা অসম্ভব।
২০০৮ সালে বিশ্ব জুড়ে যে আর্থিক সংকট, তারপর থেকেই বিশ্বায়িত পৃথিবীর অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে গেছে। ফুঁসতে ফুঁসতে ফণা তুলেছে উগ্র দক্ষিণপন্থার বিষাক্ত কালনাগিনী। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বিশেষ করে সদ্য সমাপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন বা ইদানিং সময়ের ইউরোপ ও অন্যান্য দেশের নির্বাচনের ফলাফল দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সমকালীন পুঁজিবাদ এই সংকটের কোনও পূর্ণাঙ্গ এবং গ্রহণযোগ্য সমাধান হাজির করতে পারছে না। ২০০৮ এর সংকটের পর নয়া উদারবাদী বিশ্বায়িত পুঁজিবাদ এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে পারছে না। শুধু তাই নয়, ক্রমশ লগ্নিতাড়িত পুঁজিবাদ তীব্র কেন্দ্রীভবনের রাস্তায় হাঁটছে। যেহেতু পুঁজির অন্যান্য রূপের তুলনায় লগ্নিপুঁজির প্রাবল্যই প্রধান, সুতরাং পুঁজির এই কেন্দ্রীভবনের প্রক্রিয়াই আরও জাঁকিয়ে বসছে।
আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, কর্মহীনতা এবং দারিদ্রের বৃদ্ধি আরও প্রকট। কিন্তু এই বৈষম্যের রেখাচিত্র একমাত্রিক নয়। জনজীবনের এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যেখানে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ, কষ্টের ভার লাঘব হতে পারে। এই পর্যায়ে বাস্তবতা ও ক্ষমতার রাজনীতি অনিবার্য ভাবেই পরিচিতি-সত্ত্বার রাজনীতিকে প্রবল ভাবে সামনে নিয়ে আসছে। দেশ দুনিয়ার প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই দেখা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ এই মৌলিক অভিমুখের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে।
কিন্তু, সবচেয়ে যেটা উল্লেখযোগ্য যে, প্রাত্যহিক জীবনে মানুষের সামনে যে অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতা কারণে যেমন ক্ষমতাসীন সরকার এবং দলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, ঠিক তেমনই এই সামগ্রিক দক্ষিণপন্থী নীতির ভিত্তিতে কোনও সুসংহত বিকল্প নীতির অনুপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রেই উগ্র দক্ষিণপন্থার প্রতিও সাময়িক আস্থা প্রকাশ করছে। এটি একটি বিপজ্জনক বৃত্ত।
একথা জোর দিয়ে বলাই যায়, সামাজিক উৎপাদনের যে বৈশিষ্ট্য, উৎপাদন সম্পর্কে জগদ্দল বাধা প্রতি মূহুর্তে তীব্র সঙ্ঘাত তৈরী করছে, উৎপাদনের উপকরণের সামাজিকীকরণ ছাড়া এই গোলক ধাঁধাঁর থেকে বেরোনও সম্ভব নয়। উৎপাদনের উপকরণ এবং মালিকানার সামাজিকীকরণ ছাড়া কোনও সমাধানই অসম্ভব। সুতরাং, পুঁজির সমর্থকদের যতই অপছন্দ হোক না কেন, ঘুরে ফিরে সমাজতন্ত্রের মৌলিক প্রশ্ন অর্থাৎ উৎপাদনের উপকরণের সামাজিকীকরণের প্রশ্নটিকেই সজোরে পুনরুত্থাপন করছে সমকালীন পৃথিবী।
একুশ শতকের সমাজবাদ অর্থ কি?
উৎপাদনের উপকরণের সামাজিকীকরণ সমাজবাদের একটি অলঙ্ঘনীয় বুনিয়াদ। এই লক্ষ্য অর্জন করতে পুঁজিবাদী মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের মডেলে উৎপাদনের উপকরণে জনগণের মালিকানাকে রাষ্ট্রের মালিকানার সঙ্গেই সমার্থক করে তোলা হয়েছিল। ফলে রাষ্ট্রের মালিকানায় চলা উদ্যোগগুলির অনিবার্য পরিণতি ছিল, অতি কেন্দ্রীক আমলাতান্ত্রিক পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ। শ্রমজীবীদের কোনও ভূমিকা এই উদ্যোগগুলি পরিচালনায় দৃশ্যমান করে তোলা যায়নি। সুতরাং সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্র নির্মাণের ব্যর্থতাগুলি একুশ শতকের সমাজবাদে বর্জন করে চলতে হবে। সমাজতন্ত্রে জনগণের মালিকানা একাধিক রূপে প্রকাশিত হবে, যার একটি রূপ রাষ্ট্রীয় মালিকানাও হতে পারে। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চলা উদ্যোগ বা পাবলিক সেক্টর যেখানে ব্যাপক এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ মালিকানাস্বত্ত্ব বা কো-অপারেটিভের ভূমিকা থাকবে প্রত্যক্ষভাবে শ্রমিক কর্মচারীদের যৌথ মালিকানায়। মালিকানার এই বৈচিত্র্য সোভিয়েত ব্যবস্থায় চূড়ান্ত কেন্দ্রীভবনের বিপরীতে প্রতিস্থাপিত হবে এবং পারস্পরিক প্রতিযোগিতার সম্ভবনাকে অবারিত করবে।
পণ্য উৎপাদন ও বাজারের উপস্থিতি সমাজবাদে অচল নয়। এটি একটি মৌলবাদী ধারণা। এটি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারণার একটি বিকৃতি। সোভিয়েত ইউনিয়নে পণ্য উৎপাদনের ক্ষুদ্র উদ্যোগ বা খুচরো ব্যবসারও জাতীয়করণ করা হয়েছিল। কিন্তু একুশ শতকের সমাজবাদ নির্মাণে বাজারের একটি ভূমিকা থাকবেই। কিন্তু অবশ্যই তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে রাষ্ট্রীয় তদারকির মধ্যে দিয়ে, যা সুনিশ্চিত করবে বড় বা দেশী বিদেশী কর্পোরেটের বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রয়াসকে কিভাবে স্তিমিত করা যায়।
পরিকল্পিত অর্থনীতি সমাজবাদের আরেকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, পরিকল্পনার চরিত্র কখনই সমস্ত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীভূত কোনও ব্যবস্থা হবে না। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এবং অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলিকে পরিচালনা করবার লক্ষ্যে পরিকল্পনাকে অনিবার্যভাবেই বিকেন্দ্রীভূত করতে হবে৷
গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের জীবনরেখা
সমকালীন পৃথিবী দেখিয়ে দিচ্ছে যে, পুঁজিবাদী উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা গণতন্ত্রকে অন্তঃসারশূন্য আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত করে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সম্পূর্ণভাবে অকেজো করে দেয়। সুতরাং, একুশ শতকের সমাজতন্ত্র এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা সুনিশ্চিত করবে, যাতে জনগণের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত হবে। এর জন্য প্রয়োজন, জনগণের ইচ্ছা প্রকাশের জনপ্রিয় ব্যবস্হাপনা যার মাধ্যমে শুধুমাত্র প্রশাসনিকই নয়, আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও জনগণকে ক্ষমতায়িত করতে হবে। সমাজতন্ত্রের নেতৃত্বে এক বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা, স্থায়ী একদলীয় শাসনের বিকৃতিগুলো প্রতিরোধ করতে পারে। একুশ শতকের সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্র এবং শাসক দলের মধ্যে পৃথকীকরণকে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিতে হবে। এটা জরুরি কারণ, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমস্ত জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে, অন্যদিকে শাসকদল শুধুমাত্র শ্রমিক শ্রেণী ও শ্রমজীবী জনগণের একটি ভগ্নাংশ। সুতরাং কোনও ভাবেই এটি পরস্পরের সমার্থক হতে পারে না। এ বিষয়ে কোনও বিতর্ক থাকতে পারে না যে, একুশ শতকের সমাজবাদকে অবশ্যই পুঁজিবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এই অনিবার্য বাস্তবতা এড়িয়ে একুশ শতকে সমাজতন্ত্রের নির্মাণ বিলাসিতা। একুশ শতকের সমাজতন্ত্রকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে সমাজতান্ত্রিক চেতনা গড়ে তোলা এবং নতুন সমাজের সুরক্ষার জন্যে জনগণকে সমাবেশ করার একটি হাতিয়ার হিসাবেই গড়ে তুলতে হবে৷
লিঙ্গের প্রশ্নটি সমকালীন পৃথিবীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই প্রশ্নটিকে শুধুমাত্র পরিচিতির দৃষ্টিকোণ থেকে উত্থাপিত করা হচ্ছে। লিঙ্গ সাম্যের প্রশ্নটি কোনওভাবেই শ্রেণী শোষণ ও সামাজিক বিশ্লেষণের মূল ধারার বিশ্লেষণের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা যায় না। শ্রমবিভাজনের বৈষম্য মহিলাদের প্রতি বৈষম্যকে অনিবার্যভাবেই প্রভাবিত করে। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থাপনা অনিবার্যভাবেই সমাজে পরিষেবার দায়ভার মহিলাদের ওপরেই ন্যস্ত করছে। সস্তা নারীশ্রম উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সুতরাং লিঙ্গের প্রশ্ন অনিবার্যভাবেই শ্রেণী এবং সামাজিক বৈষম্যের যৌথ অভিব্যক্তি। মহিলাদের প্রতি বৈষম্য, বৈষম্যমূলক মজুরি এবং শ্রমের ব্যবস্থাপনার উপাদান, শ্রমশক্তির উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তিতে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। সমাজ এবং অর্থনীতিতে মহিলাদের কাজের মূল্যায়নও কার্যত অন্তর্হিত। তাদের শ্রমের এই অবমূল্যায়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে সামাজিকভাবে পিতৃতান্ত্রিক জীবনশৈলীর আবহাওয়ায়। নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদে মহিলাদের শোষণ একটি স্বাভাবিক উপাদান হিসাবেই গ্রাহ্য হচ্ছে। স্বভাবতই একুশ শতকের সমাজবাদকে পিতৃতান্ত্রিক এবং শ্রেণী শোষণের থেকে নারীকে মুক্ত করার প্রশ্নটিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে।
আজকের পৃথিবী এবং এই গ্রহ অস্তিত্বের সংকটে। উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তন এই গ্রহের জীবন এবং প্রকৃতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গ্রহের জীবন এবং প্রকৃতিকে রক্ষা করার সংগ্রামকে পরিবেশ সংক্রান্ত প্রশ্নগুলির বৈজ্ঞানিক ও বস্তুবাদী বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই উত্থাপন করতে হবে। মুনাফা অর্জনের জন্যে পুঁজিবাদের অবাধ ভক্ষণের লক্ষণ, আজকের পৃথিবীর পরিবেশের ভারসাম্যকে টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে প্রধান অন্তরায়। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন প্রাকৃতিক সম্পদকে বড় কর্পোরেটগুলির আগ্রাসী লুঠের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সুতরাং, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তন আজ সামগ্রিকভাবে বিশ্ব মানবতার অস্তিত্বের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জের সামনে স্পষ্ট হচ্ছে যে, আজকের দুনিয়ার পরিবেশের গতিপ্রকৃতির এই নেতিবাচক পরিস্থিতির জন্য মূলত ধনী শিল্পোন্নত দেশগুলোর নীতিই দায়ি। সুতরাং একুশ শতকের সমাজবাদে বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্বে সাথে বিবেচনা করতে হবে।
আজকের ভারত
আজকের ভারতে এই শতকের সমাজবাদ নির্মাণের চ্যালেঞ্জটি মোকাবিলা করতে সবচেয়ে বড় যে পরিহাসের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা বিশ শতকের সমাজবাদী নির্মাণ বা সোভিয়েত মডেলের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণেই সীমাবদ্ধ। সোভিয়েত মডেলের মূল সমালোচনা তার একদলীয় শাসন এবং চূড়ান্তভাবে কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাপনাকে ঘিরেই। বৈচিত্র্য এবং গণতন্ত্রের সুসংহত বিকাশের অভাব কি পুঁজিবাদের বিকল্প ব্যবস্থাপনাতে সম্ভব?
আজকের ভারতের বাস্তবতার দিকে একনজর চোখ বোলালেই সবটা স্পষ্ট হয়। এক দেশ এক বাজার- এক দেশ এক ট্যাক্স- এক দেশ এক নির্বাচন- এই গগনভেদী স্লোগানের আড়ালেই রয়েছে চূড়ান্ত কেন্দ্রীভবনের অভিমুখ। আর সমস্তটাই হচ্ছে বিশ্বায়িত নয়া উদারবাদী কর্পোরেট লগ্নি চালিত অভিমুখের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে। ফলাফলও স্পষ্ট। ২০২২ এর ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট বলছে, ভারতবর্ষ পৃথিবীর অন্যতম প্রধান বৈষম্যের দেশ। জনসংখ্যার ওপরতলায় থাকা মাত্র ১০% মানুষ জাতীয় আয়ের ৫৭% এবং ওপরের ১% জাতীয় আয়ের ২২% কুক্ষিগত করে রেখেছে। আর ২০২৪ এর জানুয়ারীতে নিচের ৫০% মানুষ জাতীয় আয়ের মালিকানার মাত্র ১৩% নিয়ে খাদের কিনারায়।
অথচ দেশে জিএসটি-র ৬৪% ই দিচ্ছে নীচের দিকে থাকা ওই ৫০% মানুষ। আর উপরের ১০% দিচ্ছে মাত্র ৪%। সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবাংলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অরাজকতা নিয়ে যথেষ্ট হইচই হচ্ছে। কিন্তু এই সশব্দ বিতর্কে এই বাস্তবতা হারিয়ে যাচ্ছে যে, বেশীরভাগ ভারতীয়র কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা অমিল এবং বিলাসিতা মাত্র। ৬ কোটি ৩০ লক্ষ ভারতীয় (প্রতি দু’জনে এক জন) দারিদ্র্য সীমার নীচে চলে যাচ্ছে শুধুমাত্র স্বাস্থ্য পরিষেবার খরচ জোগাতে। পৃথিবীর খাদ্য এবং পুষ্টি নিরাপত্তার ২০২৩ সালের রিপোর্ট দেখাচ্ছে, ভারতের জনসংখ্যার ৭৪% ই স্বাস্থ্য সম্মত খাবার থেকে বঞ্চিত আর ৩৯% পুষ্টিকর খাবার থেকে। ২০২৩ সালের বিশ্ব ক্ষুধাসূচক বলছে, বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে ভারতের প্রাপ্ত নম্বর ২৮.৭ - যা ক্ষুধার পরিমাপে বিপজ্জনক মাত্রা। এই রিপোর্টে ভারতীয় শিশুদের অপুষ্টিজনিত কারণে আক্রান্ত হওয়ার সূচক ১৮.৭, যা গোটা পৃথিবীতে শিশু অপুষ্টিতে সর্বোচ্চ।
একইভাবে লিঙ্গ বৈষম্যের ক্ষেত্রেও ১৪৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১২৭ তম। বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্যের এই রিপোর্ট ২০২৩ সালের। এই রিপোর্ট বিশেষভাবে শ্রমশক্তির থেকে নারীদের অন্তর্ধানের বাস্তবতাটি সজোরে উত্থাপিত করেছে।
দ্রুতগতির আর্থিক বৃদ্ধির হার সত্ত্বেও ভারতের এই তীক্ষ্ণ বৈষম্যের কারণ কি? রিপোর্ট বলছে, সম্পদের কেন্দ্রীভবন- যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত এবং ক্রমপ্রসারিত হয়ে চলেছে। অপ্রতুল ভূমি সংস্কার, যা জনসংখ্যার একটি বড় অংশকেই প্রান্তিক বা ভূমিহীনে পরিণত করে চলেছে, যা তাদের দারিদ্র ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার সামনে ফেলে দিচ্ছে। এটা বিস্ময়কর যে, এই ওয়ার্ল্ড ইন-ইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট দেখিয়ে দিচ্ছে যে, দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণ, সম্পদ অর্জন এবং কেন্দ্রীভবন মুষ্টিমেয়র হাতে অপরিসীম ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে এবং বৈষম্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তীব্রতা নিয়ে আসছে।
সরকারী নীতির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার কোনও নীতি নেই। সব অংশের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করে সুসমন্বিত একটি উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করার অস্বীকৃতি এবং বিরোধিতা সংকটকে গভীরতর করছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং লাভ বন্টনের ক্ষেত্রে অসম বিকাশ, সম্পদ বন্টনেও বৈষম্য সৃষ্টি করছে। প্রতিগামী অর্থাৎ সাধারণের ওপর কর বৃদ্ধি ও ধনীর কর হ্রাস করার ব্যবস্থা, সম্পদশালীদের বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে, যা আয়ের বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তুলছে। একইভাবে সামাজিক নিরাপত্তা এবং জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমের অভাব, দুর্বল অংশগুলিকে যথোপযুক্ত সাহায্য থেকে বঞ্চিত করছে এবং পক্ষান্তরে সম্পদের বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছে ।
ভারতের অর্থনীতিতেও লগ্নি পুঁজিমুখী অভিমুখ এবং বিনিয়োগ নিয়ে ফাটকাবাজি ও সম্পদের কেন্দ্রীভবনের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে আর্থিক ক্ষেত্রগুলিকে। ন্যূনতম মজুরির অনুপস্থিতি এবং মজুরির বৈষম্যও অন্যতম প্রধান কারণ বৈষম্যের বৃদ্ধির ক্ষেত্রে।
ভারতের অর্থনৈতিক বৈষম্যের সাথে সাথে সামাজিক বৈষম্যও সামগ্রিক বৈষম্য বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা নিচ্ছে। জাতপাত, লিঙ্গ বৈষম্য, শিক্ষা এবং প্রযুক্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা, এসবই ভারতে বৈষম্য বৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
অতঃকিম
ক্রমবর্ধমান এই বৈষম্যে, কর্মহীনতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া এই সবকিছুর নিরিখে থাকা পৃথিবীর সর্বোচ্চ এই দেশ কোথায় যাবে? সামাজিক অর্থনৈতিক সুবিধা বঞ্চিতদের পরিস্থিতি বদলের আওয়াজ তোলা স্বাভাবিক। কিন্তু অভিমুখ কি হবে? এটা স্পষ্ট – থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়, এই বৃত্তের মধ্যে আটকে থাকা কোনও গ্রহণযোগ্য বিকল্প নয়। সমাজবাদ চাই। সমাজবাদই চাই, এর মূলনীতি এবং বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই। বিংশ শতাব্দীর সমাজবাদের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত নির্মাণের সেই ভুল ত্রুটিগুলির বর্জনের ভিতের উপর দাঁড়িয়েই তৈরি হবে একুশ শতকের সমাজবাদ – আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমিতে।