ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
কার্যকরী যেকোনো নীতিরই পূর্বশর্ত হলো সমসাময়িক বাস্তবতার এক বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা। সমসাময়িক বাস্তবতার ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করণের কাজে সম্ভাব্য বাধাগুলিকে চিহ্নিত করতে হয় এবং নীতি প্রণয়নের খসড়া প্রস্তুত করতে হয় এমন ভাবে যাতে সময়ের সাথে সাথে সেই সমস্ত বাধা টপকে এগিয়ে যাওয়া যায়। জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যতই গলা ফাটান না কেন তিনি যেভাবে দাবি করেছেন যে এই শিক্ষানীতির প্রস্তুতি হিসেবে গত তিন চার বছর ধরে গভীর এবং আন্তরিক গবেষণার কাজ করা হয়েছে সে ধরনের কোনো নথিপত্র সংযোজন হিসাবে এই শিক্ষানীতির প্রস্তাবনায় পাওয়া যায় নি! সুতরাং অনিবার্য সিদ্ধান্ত হিসাবে এই জাতীয় শিক্ষানীতিকে একটি দার্শনিক এজাহার ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না।
প্রধানমন্ত্রী এই শিক্ষানীতির প্রসঙ্গে জোরালো সত্তয়াল করে জানিয়েছেন এর কোন বিরোধিতা কেউ করেনি। যদিও প্রকৃত সত্য এর চেয়ে অনেকটাই আলাদা। সংসদীয় ক্যাবিনেটে গৃহীত শিক্ষানীতিটি এই বিষয়ে তৃতীয় সংস্করণ। প্রথম প্রস্তাবনাটি ২০১৭ সালে যা সংসদে সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হয়। ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার শিক্ষানীতিতে ভাষার প্রশ্নে প্রয়োজনীয় সংশোধনী যুক্ত করা হয় একদিনের মধ্যে। সেবার প্রস্তাবিত বয়ানের বিভিন্ন অংশে প্রাসঙ্গিক সমস্ত ক্ষেত্র থেকেই বিস্তর আপত্তি জানানো হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ৬৮ পৃষ্ঠার এই জাতীয় শিক্ষানীতি যদি কেউ পড়েন তাহলে দেখবেন শিক্ষা দেশের সংবিধানের কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ তালিকা এক্তিয়ারভুক্ত হওয়া সত্বেও এই প্রসঙ্গে রাজ্যসরকারগুলির কিংবা সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা গুলির, শিক্ষাবিদ দের এবং ছাত্র-ছাত্রীদের কারোরই কোন মতামতের উল্লেখ নেই। এ থেকেই স্পষ্ট প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত অনুগামী ও পারিষদদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থেকেই এই শিক্ষানীতি সম্পর্কে তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
অতিমারির সময় কালে যখন জনসমাবেশের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে সেই অবস্থার সুযোগ নিয়ে মোদি সরকার নিজস্ব আগ্রাসী কায়দায় যাবতীয় অগণতান্ত্রিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো র বিরুদ্ধাচরণকারী একের পর এক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করছে, যাতে তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনগণ কোন বিক্ষোভ প্রদর্শন না করতে পারে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ সরকারপক্ষের সেরকমই এক কর্মসূচি। এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে কেউ নয়, এমন একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রধানমন্ত্রীর হয়েছে কারণ প্রকাশ্যে কোনরকম বিরুদ্ধ মতপ্রকাশের সুযোগই জনগণের নেই।
কার্যকর হিসাবে ফলদায়ক হতে এই শিক্ষানীতির প্রয়োজন অন্তত ১০ বছর, যার উল্লেখ ঐ প্রকাশিত প্রতিবেদনের মধ্যেই রয়েছে - তখন অত্যন্ত দ্রুততার সাথে যেভাবে সংসদে এই সম্পর্কিত যাবতীয় বিতর্ক (যেমনটা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সংসদীয় রাজনীতির দস্তুর) এবং ইতিমধ্যেই উচ্ছারিত কিংবা সম্ভাব্য যেকোন জনমতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এই নীতি গৃহীত হল তা সরকারের স্বেচ্ছাচারী মনোভাবকেই ইঙ্গিত করে যা কোনরকম জনমত কিংবা বিরোধিতা সম্পর্কে ভীত।
সরকারের এধরনের নীতি প্রণয়নের প্রসঙ্গে আরএসএস প্রকাশ্যেই নিজেদের উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করেছে। সরকারি মহলে এই নীতি প্রসঙ্গে পর্যালোচনা সময় সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে সংঘের মতামতগুলিই গৃহীত হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া প্রস্তুতকারী কমিটির চেয়ারম্যান কে কস্তুরীরঙ্গনের সাথে বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী এবং আরএসএসের বিভিন্ন সক্রিয় সদস্যদের উপস্থিতিতে যে সভাগুলি হয়েছে তারই ফলশ্রুতিতে এই নীতি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়। এই নীতির সর্বশেষ সংস্করণে আরএসএস’র দীর্ঘদিনের দাবি "প্রাচীন ভারতীয় ভাষা"কে শিক্ষার বিষয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর প্রভূত সন্তোষ বস্তুত এ কারণেই।
প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যাদি সম্পর্কে উদাসীনতা
দেশ গড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাকে সবসময়ই একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। এরই সাথে জনগণের প্রকৃত সক্ষমতার বিষয়টিকেও একই গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পরে এদেশে শিক্ষায় সকলের সমান সুযোগ সম্পর্কিত যে দীর্ঘ লড়াই চলেছে তার মূল কারণ হল ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়কালে শিক্ষার সার্বিক ক্ষেত্রটি প্রকৃতপক্ষেই কেবলমাত্র অভিজাতদের দখলে ছিল। ব্রিটিশ শাসনে ভারতের জনগণ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। স্বাধীনতার লক্ষ্য হিসেবে শিক্ষার সুযোগ সম্পর্কিত লড়াই সেই কারণেই মূল লড়াইয়ের সাথে অঙ্গাঙ্গীকভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পরে জন শিক্ষা সম্পর্কিত সরকারের কর্মকাণ্ড জোর পায় কারণ দেশের সংবিধানে শিক্ষাকে জনগণের অধিকার হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ হয়েই দেশের সংবিধান ভারতের বৈচিত্র্যময় সমাজ, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি এবং সেই অনুসারে দীর্ঘ যুগ ধরে সমাজ জীবনে চলে আসা বিভিন্ন বঞ্চনা এবং নিপীড়নের সত্যকে স্বীকার করে নেয়। দীর্ঘ যুগ ধরে আমাদের সমাজে দলিত, আদিবাসী এবং মেয়েদের উপর যে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা কায়েম ছিল তার স্বীকৃতি ভারতের সংবিধান দেয়।
জনগণের সবার জন্য সমান নাগরিক অধিকার এবং রাষ্ট্র হিসাবে এক ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণ তন্ত্র গড়ে তোলার যে অঙ্গীকার সংবিধানে শপথ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় তার দ্বারাই এক দীর্ঘ অতীতের সামাজিক নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার মূলচ্ছেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা শুরু হয়। বর্তমান শিক্ষানীতির খসড়া প্রস্তুতির কারিগরেরা নিশ্চিতভাবেই ঔপনিবেশিক যুগে সংগঠিত স্বাধীনতার লক্ষ্যে লড়াই-সংগ্রাম সম্পর্কে সচেতন নন বা সেই সংগ্রামের উত্তরাধিকার সম্পর্কে উৎসাহী নন। তারা “অতীতের গৌরব” সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু না উল্লেখ করেই সেই সম্পর্কে ভারতের আধুনিক এবং আগামী প্রজন্মকে ভাস্বর করে তুলতে চেয়েছেন “to instil among the learners a deep rooted pride in being Indian, not only in thought but also in sprit, intellect and deeds” and “curriculum and pedagogy from the foundational stage onwards will be redesigned in the Indian ethos” – বলে (প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষানীতির অনুচ্ছেদ নম্বর ৪.২৯ দ্রষ্টব্য)। যদিও এক্ষেত্রে ভারতীয় (Indian) বলতে ঠিক কি বোঝানো হয়েছে তা সম্যকরূপে অস্পস্ট! ভারতীয় সমাজের বৈচিত্রকে নাকচ করে বহু পরিবর্তিত আধুনিক পৃথিবীতে জনশিক্ষা সম্পর্কিত সরকারি কর্মসূচীর প্রাসঙ্গিক সাফল্য সম্পর্কে যা কিছু দাবি করেছেন তার স্বপক্ষে কোন ব্যাখ্যাই এই প্রস্তাবিত নীতিতে স্থান পায় নি। এই নীতিতে কোথাও আধুনিক শিক্ষা ব্যাবস্থার এক অতি প্রয়োজনীয় উপাদান বিজ্ঞানমনস্কতার উল্লেখ নেই, দেশের জনগণের বিভিন্ন অংশকে মূলধারার শিক্ষাপ্রকল্পের সাথে সম্পৃক্তকরণের যে কাজ আমাদের দেশে সরকারের অবশ্যকর্তব্য তার বিবরণ নেই অথচ ধারনালব্ধ “অতীত গৌরব”কে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে সেই অভিমুখে দেশোদ্ধারের প্রকল্পনা নেওয়া হয়েছে কিন্তু কোথাও সেই পরিকল্পনার এতটুকুও বিশদ বিবরণ নেই যার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দাবীর সম্ভাব্য সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি সম্পর্কে নৈশব্দ বজায় রেখেই এই প্রস্তাবনায় বস্তুত দেশ গঠনে হিন্দুত্ববাদী একদেশদর্শী ধারণাসমূহকে ব্যাক্ত করা হয়েছে, তাই এ সম্পর্কে আরএসএস উচ্ছ্বসিত হবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই!
শিক্ষাব্যাবস্থার কেন্দ্রিকরনঃ দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার এবং দেশ পরিচালনায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াসমুহকে কবর দেওয়ার পরিকল্পনা
দেশ পরিচালনায় ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ সম্পর্কিত মোদী সরকারের পরিকল্পনার আগ্রাসী মনোভাবটি ফুটে উঠেছিল এই শিক্ষানীতি প্রস্তুত অবার অনেক আগেই অতিমারির সময়ে, যখন সারা দেশে লকডাউন চলছে সেই অবস্থায় ইউজিসি কর্তৃক সমস্ত বিদ্যায়তনগুলীকে ফাইনাল সেমেস্টারের পরীক্ষা নেবার নির্দেশিকা জারি করা হয়। সংশ্লিষ্ট বিদ্যায়তনগুলি যে সব রাজ্য সরকারের অধীনে তাদের তরফে কোনোরকম মতামত জানানোরই সুযোগ দেওয়া হয় নি তখন। পরীক্ষার দ্বারা মূল্যায়নের কাজকে অত্যন্ত কম গুরুত্ব দিতেই এভাবে এক বিশাল পরিমাণ ছাত্র-ছাত্রীদের ডিজিটাল ডিভাইডের কোপে ঠেলে দেওয়া হল। অথচ কি পরিহাস! অতিমারি সম্পর্কিত যে আইনের বলে কেন্দ্রীয় সরকার নিজের একচেটিয়া ক্ষমতার প্রয়োগ করে চলেছে সেই আইনেই রাজ্যগুলিকে নিজেদের সুবিধামত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে! জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’র দ্বারা এধরনের যেকোনো বিরুদ্ধাচরণের সুযোগকেই ধ্বংস করতে চাইছে সরকার। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে গবেষণার কাজ পর্যন্ত শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রকেই এই নীতির বলে এক অতি কেন্দ্রিভুত এবং ভারতের ক্ষেত্রে অভুতপূর্ব ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করা হচ্ছে।
সংবিধান প্রণেতারা শিক্ষাকে রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয় হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। জরুরী অবস্থা এবং ৪২ তম সংবিধান সংশোধনের পরে তা হয় কেন্দ্র এবং রাজ্যের যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়। এর পরেও স্কুলশিক্ষার দায়ভার মূলত রাজ্য সরকারগুলিরই হাতে ছিল, যা মূলত রাজ্য শিক্ষা বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হত। নতুন শিক্ষানিতিতে এই ব্যবস্থা অকেজো হয়ে যাবে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর সারা দেশে বিভিন্ন স্কুলপাঠ্যক্রমের সংশোধন, সংযোজন এবং বিয়োজন সম্পর্কিত বিষয়গুলি জাতীয় স্তরে এক অভিন্ন মঞ্চে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সংস্থার প্রতিনিধিত্বমূলক পর্যালোচনার দ্বারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পদ্ধতি বাতিল করে এখন থেকে একটিই পাঠক্রম সারা দেশে প্রযুক্ত হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে কেন্দ্রীয় সরকার একক ক্ষমতার অধিকারী হবে। ইউজিসি, এআইসিটিই এধরণের সংস্থাগুলিকে টপকে এখন থেকে নবগঠিত হায়ার এডুকেশন কমিশন অফ ইন্ডিয়া (এইচ ই সি আই) হবে নিয়ামক সংস্থা। ১২ জন সরকার নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ এবং মাত্র ২ জন শিক্ষাবিদ সম্বলিত এই কমিশনের প্রধান হিসাবে থাকবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। এই কমিশনের অধীনে সমান্তরালভাবে চারটি ভিন্ন কমিটি তৈরি হবে যারা শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ, শিক্ষান্তে ডিগ্রি প্রদানের কাজ, শিক্ষাব্যাবস্থার মানোন্নয়ন এবং পরীক্ষার নিয়ামক সংস্থা হিসাবে কাজ করবে। গবেষণার সম্পুর্ন ক্ষেত্রটিকে একটিই পরিচালক সংস্থার (National Research Foundation) অধীনে রাখার কথা বলা হয়েছে যারা গবেষণায় অর্থব্যয় থেকে শুরু করে গবেষণার বিষয় নির্ধারণ করা অবধি সবকিছুর ক্ষেত্রে নিয়ামক হবে।
১৯৭৬ সালের সংবিধান সম্পর্কিত সংশোধনী সহ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যাবতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকেই নস্যাৎ করে এই শিক্ষানিতি আসলে যা করবে তা হল শিক্ষা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র রাজ্যের যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয় থেকে সরিয়ে কেন্দ্রের একক ক্ষমতাধীন বিষয়ে রুপান্তর।
যুক্তরাষ্ট্র হিসাবে ভারতের ধারনাকে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রিভুত জিএসটি প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে, এর ফলে রাজ্যগুলির আত্মনির্ভরতা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে – কেন্দ্রের উপরে তাদের নির্ভরশীলতা বেড়েছে। জাতীয়শিক্ষানীতি ২০২০ এধরণের কেন্দ্রীভবনের তীব্রতা বাড়িয়ে দেবে।
ভাষা প্রসঙ্গে এই শিক্ষানীতিতে সংস্কৃতকে যে ধরনের পক্ষপাতের দৃষ্টিতে বাড়তি গুরুত্ব হয়েছে তাতে ভারতের অন্যান্য ভাষাগুলিকে এক অবাঞ্ছিত প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দেওয়া হল, অ-হিন্দি ভারতীয় ভাষাগুলিকেই এক্ষেত্রে লক্ষ্য হিসাবে বেচে নেওয়া হয়েছে।
“জাতীয় ঐক্যস্থাপন” নামক বুলির আড়ালে আসলে আমাদের দেশের বহুত্ত্ববাদী সংস্কৃতিকেই নাকচ করতে চাওয়া হয়েছে। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের রাজনৈতিক বিন্যাসকে আলোচনার বাইরে রাখলেও আরেকটি প্রয়োজনীয় প্রসঙ্গ এক্ষেত্রে উল্লেখ করা দরকার। দেশের উন্নতিকল্পে শিক্ষাব্রতীদের (শিক্ষাবিদ, ছাত্র-ছাত্রী এবং বিভিন্ন বিদ্যায়তন সংস্থাগুলি) বিভিন্ন পর্যায়ে গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহনের যে ঐতিহ্য রয়েছে তা এই নতুন শিক্ষানীতিতে নষ্ট হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলীর সজীব প্রাঙ্গনের সাথে সারা দেশের সর্বস্তরের গবেষণাকেন্দ্রগুলির যে প্রানবন্ত সংযোগসুত্র আমাদের এতদিনের সংস্কৃতি তাকে ধ্বংস করে গোটা ক্ষেত্রের মাথায় চড়ে বসবে সরকারি আমলাতান্ত্রিকতা নির্ভর এক ব্যবস্থাপনা। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সেনেট, সিন্ডিকেট এবং অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলগুলীর দ্বারা পরিচালনার পরিবর্তে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন HECI’র হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখা হবে। দেশের শিক্ষাঙ্গনের পরিচালকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে পেশ করা বহুদিনের দাবী “আকাডেমিক স্বায়ত্বশাসন”কে এভাবে এক কলমের খোঁচায় নাকচ করে দেওয়া হল। উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলিকে স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার ব্যাপারে ২০১৭ সালে নীতি আয়োগের তিন বছরের প্রকল্পনার ঘোষণা এবং ২০১৮ সালে ইউজিসি’র পক্ষ থেকে গ্রেডেড অটোনমই দেবার সিদ্ধান্ত সেই আশায় কিছুটা উৎসাহ দিয়েছিল। কিন্তু এই শিক্ষানীতির ফলে কানে শুনতে ভাল লাগলেও আসলে শিক্ষাকেন্দ্রগুলিকে নিজেদের পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক স্বায়ত্বশাসনের দিকে ঠেলে দেওয়া হল যার অনিবার্য ফল হিসাবে শিক্ষাক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের রাস্তা খুলে গেল।
শিক্ষাক্ষেত্রকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর আসল উদ্দেশ্য
জাতিয় শিক্ষানিতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর অভূতপূর্ব, বাড়তি উচ্ছ্বাসের কারন বুঝতে খুব বেশি মাথা না খাটালেও চলে - অতিমারি মোকাবিলাই হোক কিংবা তার আগের পর্বে দেশের অর্থনৈতিক অধোগতি রোধ যাই বিচার করা হোক না কেন সব ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকার সম্পুর্ন ব্যার্থ হয়েছে। সুতরাং এবার তো সুগভীর প্রজ্ঞার সাক্ষাৎ প্রমান দিতেই হতো! আর সেই কারনেই গলা উঁচু করে তিনি দাবী করে বসেছেন এই নতুন শিক্ষানীতির ফলে ভারতে কাজ খোঁজার লোক কমে গিয়ে কাজ দেওয়ার লোকের সংখ্যা বাড়বে।
তার এই কথার আসল উদ্দেশ্য হল নতুন শিক্ষানীতিতে যেভাবে শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন পর্বে পড়ুয়ার পাঠক্রম ত্যাগ করেও সংশাপত্র জুটিয়ে নেবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে তাকে বেশি বেশি করে তুলে ধরা। এই নীতির ফলে ষষ্ঠশ্রেণীতে পাঠরত ১২ বছরের যে কোন ছাত্র-ছাত্রী পাঠক্রমের সংবেদি হবার আইনগত সুযোগকে ব্যাবহার করে এবং স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে আনন্দ এবং কাজের (Fun and Work) খুশিতে ডগমগ হয়ে যে কোন কাজে বিনে পয়সার শিক্ষানবিশ হিসাবে নিযুক্ত হতে পারে। ১৪ বছরের কম বয়সিদের কাজের সাথে যুক্ত করতে এই প্রকল্পকে যদি শিশুশ্রমে বৈধতা দেবার সরকারি ধান্দাবাজি না বলা যায় তবে আর কাকে বলা হবে!
স্বাধিনতাত্তোর সময়ে দেশের শিক্ষানীতির সামনে সবথেকে বড় সমস্যাই ছিল স্কুলছুট এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েও পরিবারের সংস্থানের চাপে কাজে যুক্ত হয়ে পড়াকে মোকাবিলা করা। সামাজিক বৈষম্যের যে অব্যাবস্থা এদেশের বাস্তবতা তার সাথেই সম্পৃক্ত হিসাবে এই সমস্যাকে বিচার করতে হত। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় সারা দেশে বিদ্যালয়গুলিতে প্রথম শ্রেণীতে যারা ভর্তি হয় তাদের মধ্যে মাত্র ৬% সিডিউল্ড ট্রাইব, ৮% সিডিউল্ড কাস্ট, ৯% মুসলমান এবং ১০% অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সামাজিক শ্রেণী থেকে আসা পড়ুয়ারাই দ্বাদশ শ্রেণীর গন্ডি পেরোতে পারত। জীবনভর শিক্ষার সুযোগ এবং যেকোনো সময়ে শিক্ষাক্রমে সংযুক্ত কিংবা বিযুক্ত হবার সুযোগ দেবার নামে কার্যত এই অংশের ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সরকারের দায় অস্বীকার করা হল। আর সেই জন্যেই গোটা খসড়া প্রতিবেদনটি পড়ার পরে কেউ যদি চমকে উঠে উপলব্ধি করেন একটিবারের জন্যেও কোথাও “সংরক্ষন” শব্দটির উল্লেখমাত্র নেই তবে তাকে বলতেই হয় – এতে আশ্চর্যের কিছুই নেই।
জনগণের টাকায় চলা অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবসথার উপরে সরাসরি আঘাত
এই শিক্ষানীতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ভীষণ প্রজ্ঞান্বিত বক্তব্যের সারটুকু সহজেই পাওয়া যাবে যদি কেউ সরকারি গ্রুপ ডি পদে আবেদনকারীদের তালিকায় স্নাতকোত্তর কিংবা পিএইচডি ডিগ্রি প্রাপকদের খুঁজে পান, কেন পাঠক্রমে একাধিকবার যুক্ত কিংবা বিযুক্ত হবার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে তার সহজ কারন এর থেকেই অনুমেয়। কাজ দেওয়া এবং কাজ খোঁজা এই দুই শব্দবন্ধের ভিতরের রসায়নটুকু বুঝতে এটুকু মনে রাখলেই যথেষ্ট হবে যে কর্মসংস্থান এবং কর্মসংস্থানের সমস্যা নিরোধে উপযুক্ত সরকারের প্রসঙ্গ বস্তুত সম্পূর্ণ দুই ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করে! বাস্তবে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ হল জনগণের টাকায় চলা শিক্ষাব্যবসথার উপরে সরাসরি আঘাত।
জাতীয় শিক্ষানীতির গালভরা দাবিসনদের মধ্যে একটি হল কেন্দ্রীয় বাজেট থেকে জিডিপি’র ৬% শিক্ষাখাতে ব্যয়বরাদ্দ করা হবে। একথা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না কারন যে সরকারি ব্যাবস্থা ইতিমধ্যেই জনগণের আয় থেকে ৪% হারে শিক্ষা সেস আদায় করে চলেছে তা সেই অর্থ কি উপায়ে ৩ থেকে ৬ বছর বয়সি শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকল্পে অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পকে ইতিমধ্যেই তাদের হাজারটা কাজের সাথে আবার এই কাজে যুক্ত করে খরচ করা হবে তার কোন স্পষ্ট উল্লেখ নেই। উচ্চশিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয়বরাদ্দের বর্তমান চিত্রটির দিকে তাকালেই বোঝা যায় জল কোন দিকে গড়াতে চলেছে। স্বায়ত্ত্বশাসনাধীন কলেজ, গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা টিচার ট্রেনিং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন আসলে যা করবে তা হল ব্যাপক বেসরকারিকরণ। বলাই বাহুল্য এর ফলে অলাভজনক শিক্ষাক্ষেত্রগুলীকে সংযুক্তির নাম করে বেসরকারি কলেজগুলির হাতে তুলে দেওয়া হবে।
কোনোরকম বাস্তব সম্মত গবেষণার ফলাফল হিসাবে যে এই শিক্ষানীতি প্রস্তুত হয় নি সেই সত্য আরই স্পষ্ট হয় যখন এতে প্রস্তাব দেওয়া হয় স্বায়ত্ত্বশাসনাধীন কলেজগুলীতে ন্যুনতম ৩০০০ শিক্ষার্থি থাকতে হবে। সারা দেশে এই মুহূর্তে ৩৯০০০ কলেজ চালু রয়েছে, সারা ভারত উচ্চশিক্ষা সমীক্ষা তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে প্রস্তাবিত ৩০০০ শিক্ষার্থী থাকার শর্ত পূরণ করতে পারবে সেইসব কলেজের মাত্র ৪.৩%ই!
যেভাবে “সরল কিন্তু কড়া” নিয়মাবলীর কথা বলা হয়েছে তাতে বেসরকারি ক্ষেত্রগুলি অস্বাভাবিক ফি আদায়ে খেপে উঠতে বাড়তি সাহস পাবে। উচ্চশিক্ষার সুযোগকে আরও প্রসারিত করতে সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থির উপর থেকে খরচের বোঝা কমানোই ছিল শিক্ষানীতির জন্য মোকাবিলা করার মুখ্য বিষয়। অন্যান্য সমমাত্রার উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় ভারতের শিক্ষাব্যাবস্থায় সুলভে উচ্চশিক্ষার সুযোগ এমনিতেই অনেকটা কম।
স্কুল পাঠক্রমের ক্ষেত্রেও যেভাবে সংযুক্তিকরণের মধ্যে দিয়ে উন্নতিসাধনের কথা বলা হয়েছে তাও বস্তুত অনেককেই শিক্ষাপ্রকল্পে যুক্ত হতে বাধাস্বরুপ হবে। এই শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে দেশের বিভিন্ন জনাকীর্ণ প্রান্তে যেসব স্কুলগুলি রয়েছে তাদেরকে একটি ছাতার তলায় নিয়ে এসে কার্যকরী করে তোলা হবে। শিক্ষার অধিকার আইনে সবাইকে অধিকার দেওয়া হয়েছিল নিজের বাসস্থানের ১ কিলো মিটারের ব্যাবধানে স্কুলে যুক্ত হবার সেই প্রেক্ষিতে বিচার করলেই বোঝা যায় এই নতুন নীতির ফলে গ্রাম ভারতের হাজার হাজার স্কুল বন্ধ করে দিতে চাইছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। উদ্দেশ্য শিক্ষাক্ষেত্রে বড় কর্পোরেটদের ব্যাবসায় লাভের সুযোগ করে দেওয়া। এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাপক হারে অনালাইন শিক্ষার পরিকাঠামোর প্রয়োজন হয়ে পড়বে যার ফলে বহু সরকারি স্কুলগুলি সেই খরচের ধাক্কা সামলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাবে, একই মাত্রায় মাথাচাড়া দিয়ে গজিয়ে উঠবে অজস্র বেসরকারি শিক্ষাকেন্দ্র। ব্যাপক হারে শিক্ষাব্যবসথার পন্যিকরণ কিংবা বেসরকারিকরণই হল এই নতুন শিক্ষানীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট।
এই ব্যাবস্থাকে কেরলের বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে বিচার করলে আশ্চর্য হতে হয়, সেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা বেসরকারি স্কুল ছেড়ে এসে জনগণের টাকায় পরিচালিত সরকারি স্কুলে ভর্তি হচ্ছে।
নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করার নামে আসলে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণতন্ত্রকেই নাকচ করা হচ্ছে
নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির আড়ালে আসলে যে রাজনৈতিক লক্ষ্যসাধনের উদ্দেশ্য রয়েছে তা হল যেন তেন প্রকারে ভারতের শিক্ষা ব্যাবস্থায় শিক্ষার্থীর চেতনায় গনতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাধারনতন্ত্র সম্পর্কিত যে মূল্যবোধগুলি গড়ে ওঠে সেগুলির ধ্বংসসাধন। বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের’ যে ধারনাকে দেশের অন্যতম বৈশিষ্ট হিসাবে ধারন করা হয়েছিল তাকেই উচ্ছেদ করতে চাইছে সরকার, স্বাধীনতার পরে শিক্ষাকে কেন্দ্রীভূত না করার সিদ্ধান্ত ছিল সেই বৈশিষ্টেরই সুরক্ষাকবচ। আজ সেই মুল্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে অতীতের সুদিন ফিরিয়ে আনার নাম করে এমনই এক ব্যাবস্থার পক্ষে সাফাই দেওয়া হচ্ছে যা মানুষের মধ্যে জাতিগত বৈষম্য এবং উচ্চ-নিচ ভিত্তিক নিপীড়নমূলক সনাতনী ধারণা যা নিজের অকর্মণ্যতার প্রমান দিতে ইতিমধ্যেই ইতিহাসের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার প্রয়োজন নিশ্চয়ই রয়েছে, কিন্তু সেই অতীত হল বহু সংস্কৃতি এবং বহু জ্ঞানের এক অপূর্ব সমাহার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ঐতিহাসিক শিক্ষা হিসাবে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, জ্যোতিবা ফুলে’র মতো প্রভুত মনিষীরা যে শিক্ষাক্রমের, যে শিক্ষাব্যাবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন সেই অভিজ্ঞতা থেকে আধুনিক ভারতের জন্য রসদ সংগ্রহ করা। আরএসএস বর্ণিত হিন্দুত্বের আলোকেই কেবলমাত্র ব্যাখ্যা করা যায় এমন এক গৌরবের অতীত যার কোন বাস্তব নিদর্শন নেই এবং যার ফলে আসলে কর্পোরেটদের মুনাফা নিশ্চিত হয় এমন কিছুর দিকে আমাদের গর্বের সেই শিক্ষাব্যাবস্থাকে পিছু হঠতে দেওয়া যায় না, দেওয়া যাবে না।
মূল লেখাটি পিপলস ডেমোক্রেসি’তে প্রকাশিত
শেয়ার করুন