সব গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে জড়ো করতে হবে

২২ জুন ২০২০
ওয়েবডেস্কের প্রতিবেদন:

প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠা দিবসে গৌরবোজ্জ্বল ৩৪ বছরের কথা উঠে এল। রবিবার সোশ‌্যাল মিডিয়া জুড়ে অজস্র পোস্টে বারেবারে উল্লিখিত হলো কীভাবে বামফ্রন্ট সরকার এরাজ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছিল, কৃষি শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি কীভাবে স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটাচ্ছিল এবং দুর্নীতিমুক্ত বামফ্রন্ট সরকার কীভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করেছিল। ফেসবুক টুইটারে দাপানো হ্যাসট্যাগ ছিল ‘বেঙ্গল নিডজ লেফট’। বাংলার প্রয়োজন বামেদের। তৃণমূল-বিজেপি’র রাজনীতিতে বিপর্যস্ত বাংলার বুকে ক্রমশ জোরালো হচ্ছে এই আওয়াজ।

কিন্তু সেই বাংলাকে আবার ফিরিয়ে আনা কি সম্ভব? আবার কি পুরানো রূপে ফিরে আসবে বামফ্রন্ট সরকার? এদিন প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে সিপিআই(এম)’র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে ‘বামফ্রন্টই বিকল্প’ শিরোনামের একটি লাইভ আলোচনাসভায় এই প্রশ্নের উত্তরে পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেন, একইভাবে পৃথিবীতে কোনও কিছু ফেরে না। কিন্তু সারা পৃথিবীর গতি বাম দিকে। বিশ্বজুড়ে উগ্র দক্ষিণপন্থার যে বিপদ দেখা যাচ্ছে তার সামনে তীব্র হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে অতিমারীর সঙ্কট, এর মোকাবিলা করার ক্ষমতা দক্ষিণপন্থার নেই। এরমধ্যেই আমেরিকাতেও সমাজতন্ত্রের কথা উচ্চারিত হচ্ছে, ইংল্যান্ডেও হচ্ছে। আমাদের এখানেও বিপদাপন্ন মানুষের পাশে তো বামপন্থীরাই আছে। মানুষ দেখছে সরকার নেই, শাসকদলগুলো নেই, বামপন্থীরাই বিকল্প দেখাচ্ছে। এটাই বামপন্থীদের ভিত্তি। এখন আমাদের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ, তৃণমূল এবং বিজেপি বিরোধী সব গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষদের জড়ো করতে হবে। আমাদের দেশ, আমাদের রাজ্য নিশ্চিতভাবেই বাম দিকেই যাবে, বামপন্থাই বিকল্প। কিন্তু তার রূপ কী হবে সেটা ঠিক সময়ে দেখা যাবে, সেই রূপ তৈরি হচ্ছে।

এদিন ফেসবুকের এই লাইভ অনুষ্ঠানে সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তীও অংশ নেন। সঞ্চালনা করেন পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শমীক লাহিড়ী। জরুরি অবস্থা ও আধা ফ্যাসিবাদী আক্রমণের পটভূমিতে ১৯৭৭ সালের ২১ জুন জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যে কীভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়, কীভাবে নির্বাচিত পঞ্চায়েত ও পৌরসভার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়, ভূমিসংস্কার করা হয়, সরকারে আসার পরের বছরই অর্থাৎ ৭৮ সালের বন্যা মোকাবিলায় কীভাবে পঞ্চায়েত সফল হয়েছিল, ১৮ বছরে ভোটাধিকার থেকে মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ, অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক স্তর থেকে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে ৩৪ বছর ধরে বামফ্রন্ট সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার উল্লেখ করেছেন সূর্য মিশ্র ও শ্যামল চক্রবর্তী। গর্বের সেই নির্মাণ কাজ এখন তৃণমূলের হাতে কীভাবে ভেঙে পড়ছে তারও উল্লেখ করেছেন। অনুষ্ঠানেই জ্যোতি বসুর ভাষণের অংশে শোনানো হয় প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের অগ্রাধিকারের কথা। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির কারণে বৈষম্যের শিকার বাংলায় শিল্পোন্নয়ন কীভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল তার উল্লেখ করে শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, মিথ্যা দোষারোপ করা হয় শ্রমিক আন্দোলনকে।

কিন্তু শিল্পায়নের প্রক্রিয়া শুরু করতে বামফ্রন্ট সরকার কী দেরি করেছিল? আজকের শিল্পহীন বাংলায় কাজ না পাওয়া বেকারদের হাহাকার যখন চরমে তখন প্রশ্নটা সরাসরিই সূর্য মিশ্রের কাছে রেখেছিলেন শমীক লাহিড়ী। ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের লাইসেন্স নীতি, মাশুল সমীকরণ নীতি ইত্যাদির প্রত্যাহারে তৈরি হওয়া সুযোগের উল্লেখ করে মিশ্র বলেন, তখনই আমরা নতুন শিল্পনীতি নিয়েছিলাম বড় উৎপাদনমূলক শিল্প গড়ে তুলতে। তারপরে সেই ধারাতেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ এই স্লোগান দেওয়া হয়। বিরাট সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আমাদের সামনে বাধা তৈরি হলো। সামন্ততান্ত্রিক যে অবশেষ সমাজে থেকে গেছিল তারা বামবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে একজোট করেছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দেশি-বিদেশি কর্পোরেট শক্তি। বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগকে বানচাল করতে তারা চক্রান্ত করেছিল।

এর ফলাফলেই বামফ্রন্টের পরাজয়, মমতা ব্যানার্জির ক্ষমতাসীন হওয়া। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে জমি কাড়া ও গরিব বিরোধিতার অভিযোগ যে ভিত্তিহীন ছিল তা বোঝাতে ২০১১ সালের পরবর্তী সময়ে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দেওয়া সাক্ষাৎকারের অংশ শোনানো হয় এদিনের লাইভ অনুষ্ঠানে। ভট্টাচার্যের সেই উক্তি যা প্রতিদিন জোরালো হয়ে উঠছে রাজ্যবাসীর মনে। ‘‘আমরা পরাজিত হয়েছি। কিন্তু শিল্পায়নের প্রসঙ্গ কি বাতিল হয়ে গেছে? সিঙ্গুর এখন শ্মশান। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ কি অন্ধকারে থাকবে? কী হবে এখানকার ছেলেমেয়েদের?’’

তৃণমূল সরকারের গলায় প্রতিদিন ফাঁসের মতো চেপে বসছে এই প্রশ্নই। বামফ্রন্টের ভোট কমা দেখিয়ে তার থেকে মমতা ব্যানার্জি রেহাই পাচ্ছেন না। সূর্য মিশ্র তাই বলেছেন, শিল্প না হলে কৃষিতে বৃদ্ধির হার ধরে রাখা সম্ভব নয়। আমরা জানতাম ঝুঁকি আছে, কিন্তু তাও সেই ঝুঁকি নিয়েছিলাম, কারণ আমাদের কাছে এটা ছিল বাংলার বাঁচা মরার চ্যালেঞ্জ। তখন বিরোধীরা শিল্পায়নের সঙ্গে কৃষির বিকাশের সম্পর্ক অস্বীকার করেছিল। ওরা হয়তো সাময়িক সফল হয়েছিল, কিন্তু এখন প্রমাণিত যে ওটা ভুল ছিল। মানুষ অভিজ্ঞতায় বোঝেন। সত্যটাও তাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:গণশক্তি পত্রিকা


শেয়ার করুন

উত্তর দিন