টিভির পর্দায় যেকোনো পন্যের ঝকঝকে বিজ্ঞাপন হোক, নাটক, চলচ্চিত্রের কোন চরিত্রে সাবলীল অভিনয় হোক অথবা যেকোনো কর্মক্ষেত্রে উচ্চতর বা উচ্চতম পদে কাজ হোক সবজায়গাতেই মহিলাদের উপস্থিতি আজকের দিনে আর বিরল ঘটনা নয়, তবু ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস হিসাবে আজও গুরুত্বপূর্ণ।
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত নিজের জন্মের সাত দিনের মধ্যে সেই দেশে প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের সর্বজনীন ভোটাধিকার দেবার সিদ্ধান্ত নেয়, ঘোষণা করা হয় ৮ মার্চ দিনটি জাতীয় ছুটি যাতে এই দিনের সাথে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস, সংগ্রাম এবং চেতনার যে স্ফুরন সেই বার্তা বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে যাবার পরে দুনিয়া জূড়ে পুঁজিবাদী ব্যাবস্থা এককেন্দ্রিক বিশ্বের সুবিধা পায়, বিস্তর খরচ করে বুদ্ধিজীবী ভাড়া করে পুঁজিবাদের সমর্থনে প্রচার বাড়তে থাকে। বাজারের উপর নিয়ন্ত্রনের ব্যাবস্থাকে সেকেলে তকমা দিয়ে উন্নয়নের নামে মুক্ত বাজারের যুক্তি নির্মাণ করা হয়।
এতসব কিছুর মাঝে আরও একটি ষড়যন্ত্র ধীরে ধীরে চাপিয়ে দেওয়া হয় মানুষের চেতনায়, শিক্ষায়। সেই ষড়যন্ত্র একদিকে জনগণকে ইতিহাস সম্পর্কে উদাসীন করে তোলে, অন্যদিকে ব্যাক্তিস্বাধীনতার নামে জোটবদ্ধ মানবিক সংগ্রামের প্রতি তাচ্ছিল্যের মনোভাব প্রচার করা হয়। এই সাঁড়াশি আক্রমনে ক্রমশ দিশেহারা হয় মানুষ, মূলত গরিব মানুষ, খেটে খাওয়া মজদুর জনতা যার কাছে স্বাধীনতার মানে আজও ক্ষুধানিবৃত্তি, মাথার ওপর শক্তপোক্ত ছাদের আশ্রয়, নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আধুনিক শিক্ষায় অংশগ্রহন এবং সুলভে স্বাস্থ্য পরিষেবা।
শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থা থাকবে অথচ সমাজে শোষণ থাকবে না, বঞ্চনা – অত্যাচার থাকবে না এরকম সোনার পাথরবাটি বাজারে মূল্যহীন। তাই দুই কি এক শতাংশ মহিলার (যারা মূলত সমাজের সকল সুযোগ সুবিধা থেকে আদৌ বঞ্চিত নন) বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের সাথে কাজ করার ছবি আসলে যা প্রচার করে তা হল এক বৈজ্ঞানিক সত্য – পুরুষের তুলনায় নারী কোন দিক থেকেই কম যোগ্যতাসম্পন্ন নয়। কিন্তু চেতনাই যেখানে পন্যসংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন সেখানে এই ছবি সমাজের বেশিরভাগ বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে অমানুষিক পরিশ্রমের বিনিময়ে বেঁচে থাকা খরিদ করা সর্ববৃহৎ সামাজিক শ্রেণীর মানুষদের কাছে কোনোরকম অনুপ্রেরনার বার্তা আদৌ নিয়ে যেতে পারে না। যা নিয়ে যায় তা থেকে এক মায়াময়, অলীক জগতের প্রতি মোহ তৈরি হয়, আকর্ষণ তৈরি হয় কিন্তু শোষণমুক্তির কোন দিশা তাতে থাকেনা।
আর এই সমাজে মেয়েদের অবস্থা হয়ে থাকে আরও বেশি দুর্দশাগ্রস্থ। শ্রেণীভেদের কারনে শোষণ, অত্যাচার এবং বঞ্চনার পাশাপাশি তাদের লিঙ্গভেদের অভিশাপেও আক্রান্ত হতে হয়। এই আক্রমণের ফলে তাদের জীবন হয়ে ওঠে এক দ্বিতীয়শ্রেণীর মানবিক অস্তিত্বের মতোই খাটো, ভাঙা অথবা আরও ভাল করে বললে অবিকশিত। এই অবিচারের বিরুদ্ধেই মহিলাদের লড়াই, শ্রমজীবী মহিলাদের সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, সেই লড়াই আজও চলছে। দুয়েকটি ঘটনার উদাহরণ দেখিয়ে (সেই ঘটনাগুলিকে ছোট না করেও এই কথা বলা যায়) সমাজের আসল সত্য থেকে কখনো চোখ সরিয়ে দেওয়া যায় নি, যায় না।
সহজ সত্যি এই যে এখনও বেশিরভাগ মেয়েরা প্রকৃত অর্থে স্বাধীন নয়, আসল সত্যি এই যে পূঁজির মার খাবার সাথে সাথেই তাদের পুরুষশাসিত সমাজে একচোখা অবহেলার মারও খেতে হয়। তাদের পরিশ্রমকে, রোজগারকে অথবা সহজে বললে বেঁচে থাকার লড়াইতে ব্যয় করা মেহনতকে এখনও স্বীকৃতি দিতে সমাজ নারাজ। তাই লড়াই চলছে, লড়াই চলবে।
আমরা যেন ভুলে না যাই মালালা ইউসুফজাই’র কথা, পড়াশোনা করতে চেয়ে যে মেয়েটিকে কপালের বাঁদিকে পিস্তলের গুলি খেতে হয়েছিল তালিবানদের হাতে - যারা আসলে স্বার্থরক্ষা করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির। সেদিন গুলি মারার স্বপক্ষে যুক্তি হাজির করা হয়েছিল অবাধ্যতার, ফতোয়া না মেনে স্পর্ধা দেখানোর। সেই স্পর্ধা দমেনি এতটুকু – বিশ্বের দরবারে মাইক হাতে নিয়ে মালালা বলেছে “ যখন সারা পৃথিবী মূক হয়ে রয়েছে, তখন কেবলমাত্র একটি স্বরও শক্তিপ্রদর্শনে সক্ষম”।
আমাদের দেশেও ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের নামে মেয়েদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। জরাজীর্ণতাগ্রস্থ অপবিজ্ঞানসম্বলিত বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে মেয়েদের আসলে ঘরের কোনে আটকে রাখার, বিনে পয়সায় খাটিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাকে আইনসম্মত পাকাপোক্ত রুপ দেবার চক্রান্ত করছে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। ওরা প্রগতিকে ভয় পায়, তাই মেয়েদের এগিয়ে যেতে দেখতে চায় না, ওরা ধান্দাবাজ তাই পুরুষদের সাথে করা একই কাজে মেয়েদের শ্রমশক্তির দাম কম রাখতে চায়, ওরা চায় নারী শুধু ভোগ্যপণ্য হয়েই থাকুক তাই মেয়েদের আনন্দের সিমাটুকু প্রসাধনী কেনার মধ্যে বেঁধে দিতে চায়। এইসবকিছুর বিরুদ্ধে মেয়েরা লড়াই করছে, করবেও।
সারা পৃথিবীতে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে মানুষের অস্তিত্বের সামনে একটি বিশাল সংকট উপস্থিত হয়েছে। পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে – কিছুদিন আগে রাস্ট্রপুঞ্জের প্যারিস চুক্তি থেকে একতরফা ভাবে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আসলে পরিবেশ রক্ষায় নিজেদের দেয় ক্ষতিপূরণের অর্থ দিতে অস্বীকার করছে, চাইছে সবাই ভুলে যাক যে তারাই সারা পৃথিবীতে গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী সর্ববৃহৎ দেশ; তখন তাদের সেই অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে সুইডেনের একটি ১৭ বছরের মেয়ে, গ্রেটা থানবুর্গ। তার শানিত বক্তব্যে ভয় পাচ্ছে পুঁজিবাদী শক্তি, তার গলার জোরে সাহস সঞ্চয় করছে গোটা দুনিয়া।
শেয়ার করুন