সীতারাম ইয়েচুরি
বর্তমানের জটিল পরিস্থিতিতে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডঃ জাকির হুসেনের জীবন ও কর্ম তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল স্রোতধারার তিনি ছিলেন একজন প্রতিনিধি। সে সময়ে তাঁদের স্বপ্ন ছিল যে, স্বাধীন ভারত সুনিশ্চিতভাবেই গড়ে উঠবে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক ও বৌদ্ধিক দিক থেকে সুদৃঢ় স্বয়ম্ভরতার নীতির উপর ভিত্তি করে। রাষ্ট্রপতি পদে শপথ গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি ওই স্বপ্নের সারকথাটুকুই ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ভারত এমন এক তরুণ রাষ্ট্র’ যার বহুধা বিভক্ত নৃগোষ্ঠীর মানুষজন হাজার হাজার বছর ধরে পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে নিজেদের মতো করে বসবাস করছেন এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধ সত্ত্বেও নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলেছেন এক সময়োত্তীর্ণ মূল্যবোধ।
সুতরাং, আমি, এই মূল্যবোধের উপর পূর্ণ আস্থা রেখে আমাদের দেশের পুরাতন সংস্কৃতি – তা যেখান থেকেই বা যার মাধ্যমেই আসুক না কেন সামগ্রিকতাভাবে রক্ষা করার ব্যাপারে শপথ গ্রহণ করছি; কোনোরকম বৈষম্য না করে আমি আমার দেশের সকল অঞ্চল তথা সব ভাষার প্রতি সমদৃষ্টি দেবার শপথ গ্রহণ করছি; শপথ গ্রহণ করছি জাতি, ধর্ম, বর্ণগত কোনো বিভেদ না করে সামগ্রিকভাবে ভারতীয় জনতার অগ্রগতি ও শক্তিবৃদ্ধির জন্য নিরন্তর প্রয়াস চালাব। সমগ্র ভারতই আমার গৃহ এবং এখানকার সব অধিবাসীই আমার পরিবারের সদস্য। ভারতীয় জনগণ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্বের জন্য আমাকে এই পরিবারের গৃহকর্তা হিসাবে নির্বাচিত করেছেন। আমি এই গৃহটিকে (অর্থাৎ ভারতবর্ষকে) শক্তিশালী এবং সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাব, আমার লক্ষ্য থাকবে যাতে করে এই গৃহকে উন্নত এবং আকর্ষণীয় মর্যাদায় গড়ে তোলার দুরূহ কাজে যারা নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন তাঁদের জন্য এক আদর্শ গৃহনির্মাণ করা।...... সময় আমাদের ডাকছে, কাজ, আরো কাজের জন্য, নিঃশব্দ এবং আন্তরিকভাবে কাজে নেমে পড়ার জন্য, আহ্বান জানাচ্ছে জনগণের বস্তুগত এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি পুনর্নির্মাণের কাজে দৃঢ়তার সঙ্গে শামিল হওয়ার জন্য।
"আমার মতে এর দুটি দিক রয়েছে। এক, আত্মোন্নতি ঘটানো এবং দুই, চারপাশের সমাজের উন্নয়ন সাধন। দুটি দিকই পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। নিজের উন্নতির জন্য কাজ করার অর্থ হলো নৈতিক উন্নতির জন্য অন্তরে তাগিদ অনুভব করা এবং নিজেকে স-আরোপিত শৃঙ্খলার বাঁধনে বেঁধে রাখা। একমাত্র এই পথেই নিজের উন্নতি সম্ভব। এর চূড়ান্ত ফল হলো স্বাধীন নৈতিক ব্যক্তিত্ব। এটিকে অবহেলা করার অর্থ হলো নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা।”
কিন্তু, বড়ো বেদনার সাথে আমরা লক্ষ্য করছি যে স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরেও এই নীতি নৈতিকতার উন্নতির বদলে দ্রুত তার অবক্ষয় ঘটছে। তেহেলকা দুর্নীতি ফাস হওয়ার ঘটনাটি প্রমাণ করে দিয়েছে যে আমরা দুর্নীতির কোন্ কুণ্ডীপাকে জড়িয়ে পড়ছি। নৈতিক অবক্ষয়ের কোন্ অতলতলে আমরা তলিয়ে যাচ্ছি। থাক সে কথা এখন, পরে আমরা আবার ফিরে আসব এই প্রসঙ্গে।
ডঃ জাকির ঘসেন তাঁর স্বপ্নের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আমি শুধু বিশিষ্ট কবি ও গীতিকার ফিরাখ গোরখপুরীর রচনা থেকে দুটি লাইন তুলে ধরব:
‘হাসিল-ই-এসেন ও ইশক বস ইতনা,
আদমি আদমিকো পহেচানে’
সৌন্দর্য ও ভালোবাসার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, মানুষ মানুষকে সঠিকভাবে বুঝতে পারবে। হায়, আজ চতুর্দিকে তাকালে এর বিপরীতটাই শুধু চোখে পড়ে, আসল জিনিসটার দেখা মেলে না। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো এই যে আমাদের চারপাশে এটি ঘটে চলেছে ধর্মের নামে।
এই ছিল ডঃ জাকির হুসেনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সময় থেকেই এই নিয়ে মতাদর্শগত লড়াই চলছিল। বস্তুত, এই লড়াই আজও অব্যাহত। স্বাধীন ভারতের চরিত্র কি হবে তা নিয়ে তিনটি সম্পূর্ণ পৃথক দৃষ্টিভঙ্গির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। এক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলস্রোতধারার লক্ষ্য। অন্যদিকে এই শাসনব্যবস্থার সরাসরি বিরোধিতা করে একটি ক্ষুদ্র সংকীর্ণ গোষ্ঠী চাইছিল চরম অসহিষ্ণু "হিন্দুরাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠা করতে। এই দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা হয় ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আর. এস. এস.) প্রতিষ্ঠার সময় থেকে। ১৯৩৯ সালে আর এস এস সঞ্চালক এম.এস. গোলওয়ালকর তাঁর 'We or our Nationhood defined' নামক বিস্ফোরক বইটিতে তাদের এই উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যের কথা সবিস্তারে ব্যক্ত করেছেন। সংঘের মতামত ভারতবাসীর উপর চাপিয়ে দেবার উদগ্র বাসনায় তিনি বলেছেন, “প্রাচীন হিন্দু জাতির হৃদয় থেকেই হিন্দুস্থানের উদ্ভব, অন্য কোনো জায়গা থেকে নয়। অন্য যারা এই হিন্দুজাতির অন্তর্ভুক্ত নয় অর্থাৎ যারা হিন্দু জাতিকুল, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষার অংশীদার নন তাঁদের অবস্থান অবশ্যই প্রকৃত জাতীয় জীবনের আভিনার বাইরে। হিন্দুস্থান হলো হিন্দুদের। এটাই ছিল এবং এটাই থাকবে। আধুনিক বিশ্বে জাতি হিসাবে চিহ্নিত হতে গেলে যে পাঁচটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন হিন্দুজাতি তা পূরণ করেছে। হিন্দু জাতিকে বর্তমান দুর্দশার হাত থেকে মুক্তির জন্য তার পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে একমাত্র সেগুলিকেই বলা হবে জাতীয় কর্মসূচি। হিন্দু জাতির গৌরব ও মহিমাকে উজ্জ্বলতর করে তোলার কাজকে যারা হৃদয়ের গভীরে স্থান দিতে পারবেন এবং সেই লক্ষ্য পুরণের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাবেন শুধুমাত্র তাঁদেরই জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিকের মর্যাদা দেওয়া হবে। বাকি সবাইকে হয় বিশ্বাসঘাতকও দেশের শত্রু হিসাবে গণ্য করা হবে নতুবা ক্ষমাঘেন্না করে বড়জোর তাদের ইডিয়ট' আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।" (গোলওয়ালকর, ১৯৩৯, পৃষ্ঠা ৪৩-৪৪)। তিনি লিখছেন, 'জাতি সত্তার ব্যাপারে আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, জাতি হিসাবে পরিগণিত হবার জন্য পূর্বোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যর বাইরে যারা থেকে যাবেন, জাতীয় জীবনে তাদের কোনো স্থান থাকতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের পার্থক্য বর্জন করে জাতীয় জীবনের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠতে পারেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের পৃথক জাতি, ধর্ম এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখবেন ততক্ষণ তাদের গায়ে 'বিদেশি' তকমা এঁটেই থাকতে হবে” (গোলওয়ালকর, ১৯৩৯, পৃষ্ঠা ৪৫)।
এই 'বিদেশি'দের সামনে মাত্র দুটি পথ খোলা থাকবে। হয় তারা ভারতীয় জাতির সঙ্গে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে গিয়ে তার সংস্কৃতিকেই নিজের সংস্কৃতি হিসাবে গ্রহণ করবেন, নতুবা, এই জাতির (হিন্দু জাতির) দয়া দাক্ষিণ্যের উপর বেঁচে থাকতে হবে। সেটাও নির্ভর করবে হিন্দু জাতি যতদিন চাইবেন ততদিনই, তার বেশি নয়। দেশ ছেড়ে যেতে হলে তা-ও নির্ভর করবে হিন্দুজাতির ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর। পুরোনো জাতির চতুর আধুনিক মাতব্বরেরা এর মধ্য দিয়ে যে কথা বলতে চাইছেন তার নির্যাস হলো এই যে, “তথাকথিত বিদেশিদের হিন্দুস্থানে বসবাস করতে হলে হিন্দু সংস্কৃতি, তাদের ভাষাকে গ্রহণ করতে হবে, হিন্দুধর্মকে সম্মান করা শিখতে হবে, হিন্দু জাতি, হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষার গুণগান ছাড়া অন্যকিছু করা চলবে না, পৃথক অস্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে হিন্দুজাতির সঙ্গে মিলে যেতে হবে। বিকল্পে হিন্দুজাতির অধীনস্থ হিসেবে থেকে যেতে হবে, কোনো কিছু দাবি করা চলবে না, কোনো কিছুতে অগ্রাধিকারের সুযোগ থাকবে না, বিশেষ সুবিধা পাওয়া যাবে না, এমনকি নাগরিক অধিকারও কেড়ে নেওয়া হতে পারে। এছাড়া দ্বিতীয় কোনো রাস্তা তাদের সামনে খোলা থাকবে না। আমরা এক প্রাচীন জাতি, সেই অনুযায়ী আমাদের আচরণে সে কথা প্রতিফলিত হওয়া দরকার। প্রাচীন জাতিরা বিদেশিদের সঙ্গে যেরকম আচরণ করে থাকে আমাদেরও এই বিদেশিদের সঙ্গে আচরণ সেই রকমই হওয়া উচিত—যদি অবশ্য তারা আমাদের দেশে বসবাস করতে চায়।” (গোলওয়ালকর, ১৯৩৯, পৃঃ ৪৭-৪৮)।
অন্যদিকে বামপন্থীদের এব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি মূলস্রোতধারার বিপরীত এবং 'হিন্দুরাষ্ট্র' পন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এক্ষেত্রে কোনোরকম আপসে তারা অরাজি। এব্যাপারে তারা মূলস্রোত ধারার প্রজাতন্ত্র সংক্রান্ত যে দৃষ্টিভঙ্গি তার পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে ভারতীয় জনতার অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের দিকে নিয়ে যেতে চায়। মূল স্রোতধারাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে না দিয়েও তার ত্রুটি বিচ্যুতি গুলির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের স্বাধীনতাকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে ভারতীয় জনতার অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় পর্যবসিত করাই সমাজবাদী অবস্থানের আসল লক্ষ্য। বর্তমান রাজনীতিতে যে বিরোধাভাস আমরা প্রতিদিন লক্ষ্য করছি তার মূল উৎস হলো এই দৃষ্টিভঙ্গির দ্বন্দ্ব।
এক ক্ষুদ্র গণ্ডিবদ্ধ সংকীর্ণ অসহিষ্ণু সাম্প্রদায়িক হিন্দুরাষ্ট্রের' ফেরিওয়ালারা এইভাবে শুধু যে ভারতের সমস্ত জাতি ধর্মের মিলিত সংগ্রাম থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছে তা-ই নয়। প্রকারান্তরে কার্যত ব্রিটিশ রাজশক্তির এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছে।
একটা কথা খুব কম লোকেই জানেন যে, গৈরিকবাহিনীর অবিসংবাদী নায়ক 'বীর' সাভারকর ১৯১৩ সালের ১৪ নভেম্বর আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে মুক্তির জন্য ব্রিটিশের কাছে মার্জনা ভিক্ষা করে চিঠি লিখেছিলেন। এই আত্মসমর্পণের ফলে তিনি ব্রিটিশ শাসকবর্গের একরকম প্রকাশ্য মিত্রে পরিণত হন। একথা ভুললে চলবে না যে এই সাভারকরই প্রথম 'হিন্দুত্ব' কথাটি রাজনীতিতে আমদানি করেন।
নিজের মুক্তির জন্য জেলবন্দি সাভারকর মার্জনা ভিক্ষা প্রার্থনা করে যে চিঠি ব্রিটিশ রাজশক্তিকে দিয়েছিলেন তাতে সরকারকে আশ্বস্ত করে তিনি লিখেছিলেন, "ভারতের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হৃদয়বান কোনো মানুষই শান্তি ও প্রগতির পথ পরিত্যাগ করে ১৯০৬-১৯০৭ সালের এই উত্তেজনাপূর্ণ কাঁটা বিছানো আশাহীন অন্ধকার পথ বেছে নেবেন। তাই, সরকার যদি আমার ক্ষমা ভিক্ষার আর্জি মঞ্জুর করে আমাকে মুক্তি দেন তবে আমি অতি অবশ্য সাংবিধানিক পথে প্রগতির সপক্ষে দাঁড়াব এবং সেই উন্নতির স্বার্থে বর্তমান পরিস্থিতিতে ইংরেজ সরকারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যে অবিচল থাকব (রমেশচন্দ্র মজুমদার, পেনাল সেটেলমেন্ট ইন আন্দামানস পূঃ ২১১-২১৩)।
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো অন্য এক চিঠিতে সাভারকর লেখেন, 'আমি স্বীকার করছি যে, আমি আদালত থেকে সুবিচার পেয়েছি এবং আমার শাস্তিও যথাযথ হয়েছে। অতীতে যে হিংসাত্মক পথে আমি বিচরণ করেছিলাম তার থেকে আমি সরে এসেছি এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে দেশের আইন ও সংবিধানকে রক্ষা করতে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ভবিষ্যতে আমাকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় তবে সংস্কারের সাফল্যের জন্য যা করার দরকার তা আমি নিশ্চিত ভাবেই করব'। (নুরানি, ফ্রন্টলাইন, এপ্রিল-৭, ১৯৯৫, পৃঃ ৯৪) ।
তিনি খুবই গর্বের সঙ্গে দ্বিজাতি তত্ত্বের পূর্ণাঙ্গ রূপায়ণের পক্ষপাতী ছিলেন। ১৯৩৯ সালে হিন্দু মহাসভার এক সভায় সভাপতির ভাষণে সাভারকর ঘোষণা করেন যে আমরা হিন্দুরা নিজেরাই হলাম একটি জাতি। ...তারা আইন মেনে চলা নিজস্ব সত্তার অধিকারী। (ইন্ডিয়ান অ্যানুয়াল রেজিস্টার, ১৯৩৯, ভলিয়্যুম-২) । পরে আবার তিনি ঘোষণা করেন যে, “মিঃ জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের সঙ্গে আমরা কোনো বিরোধ নেই। আমরা হিন্দুরা একটি পৃথক জাতি এবং ঐতিহাসিকভাবে এটা সত্য যে হিন্দু ও মুসলমানরা দুটি ভিন্ন জাতি।” (সুত্র-পূর্বোক্ত) ।
ব্রিটিশের সঙ্গে সন্ধি করার পরবর্তী বাকি জীবনের অধিকাংশটাই তার কেটেছে ব্রিটিশের পরিবর্তে কংগ্রেস ও বামপন্থী আন্দোলনের বিরোধিতায়। হিন্দু মহাসভার নেতা হিসেবে গোলওয়াকরের তীক্ষ্ণ নজর ছিল যাতে করে হিন্দু মহাসভা অথবা সংঘ পরিবারের কেউ যেন '৪২-এর 'ভারত ছাড়' আন্দোলনে যোগ না দেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় হিন্দুদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন যে কোনোভাবেই এই আন্দোলনকে তাঁরা যেন সমর্থন না করেন। (আশ্বাপ্রসাদ, দি ইন্ডিয়ান রিভোল্ট অব্ ১৯৪২)।
এইসব অপশক্তির আঘাত অগ্রাহ্য করে ভারতীয় জনতা সে সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকেই নবজাত রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। শুধুমাত্র এই নীতি গ্রহণের কারণে ভারতের সর্বাগ্রগণ্য নেতা মহত্মা গান্ধীকে এই ধর্মান্ধশক্তির হাতে প্রাণ দিতে হয়। ভারতের মতো বহুধা বিভক্ত এবং বহুত্ববাদের দেশ ঐক্যবদ্ধ রাখতে হলে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিকতাই হলো একমাত্র রাজনৈতিক ভিত্তি। আজ সেই ভিত্তিভূমিই প্রবলভাবে আক্রান্ত। যদিও বহু বিতর্ক সত্ত্বেও অনেক আগে থেকেই এই রাজনৈতিক ভিত্তিকে সবাই একরকম মেনে নিয়েছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে যে, স্বাধীনতা আন্দোলন পর্বের সেই দৃষ্টিভঙ্গিগত মতবিরোধ আজও রয়েই গেছে।
স্বাধীন ভারতে যে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিগ্রহণ করা হয়েছে তা পশ্চিমের দেশগুলি থেকে আমদানি করা বলে বিজেপি প্রায়শ যে অভিযোগ করে থাকে তা আদৌ সত্য নয়। কারণ সম্রাট অশোকের বিখ্যাত শিলালিপিগুলিতে ধর্মনিরপেক্ষতার নিদর্শন এখনও দেখতে পাওয়া যায়। বস্তুত, একটি শিলালিপিতে এমনও লেখা আছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তি বিশেষের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসকে রক্ষার দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের। এটা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের কথা। ভারত শুধু বহু ধর্মের দেশ বলেই যে সহিষ্ণুতা' এখানকার রাষ্ট্রীয় নীতি হওয়া উচিত তা কিন্তু নয়। ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে এমন বহু বর্ণময় বৈচিত্র্যের বিকাশ ঘটেছে এই ভারতভূমিতে যে পারস্পরিক সহিষ্ণুতা এদেশের পক্ষে অপরিহার্য। তাই আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার মর্মবাণী শুধুমাত্র রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনীতি থেকে ধর্মের পৃথকীকরণ নয়। ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত তাৎপর্য হলো সকল ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের জন্য সমান সুযোগ ও সহাবস্থান এবং একে অপরের আধিপত্যের আশষ্কামুক্ত অবস্থায় অবাধ বিকাশের সুযোগ লাভ।
এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আমরা যদি বিচার করতে বসি তাহলে আমরা দেখতে পারব যে, ভারতের মতো দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র অনিবার্য ভাবেই অবিভাজ্য। ভাষা, ধর্ম ইত্যাদি নির্বিশেষে সব ধরনের সংখ্যালঘুর অধিকার সংরক্ষণ গণতন্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ। এর কোনোরকম ব্যতিক্রম ঘটলে তা হবে ধর্মীয় বা ভাষাগত সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে অযথা নাক গলানো এবং এটা শুধু ধর্মনিরপেক্ষতাই নয় গণতন্ত্রের উপরও আঘাত হানবে।
কাজেই ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার উপর আক্রমণ একই সঙ্গে গণতন্ত্র তথা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর আক্রমণকে ডেকে আনবে। সুতরাং এটা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয় যে উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি কৌশলগত কারণে নিজেদের খানিকটা সংযত রাখতে বাধ্য হলেও এদের আসল লক্ষ্য ধর্মীয় অসহিঞ্চুতা ছড়িয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিমূলে আঘাত করার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকেও দুর্বল করে দেওয়া। ভারতীয় সংবিধানকে নতুন করে রচনা করা, বর্তমান শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তনের জন্য ক্রমাগত চিল চিৎকার-এসবের পিছনে লুকিয়ে আছে এক হিন্দুরাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত।
ভারতের ইতিহাসকে নতুন করে লেখার প্রয়াস এবং সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার সাম্প্রদায়িকীকরণের প্রচেষ্টার মধ্যেও সেই একই উদ্দেশ্য কাজ করছে। ডঃ জাকির হুসেনের জীবন ও কর্মের একটা বড়ো অংশ ছিল শিক্ষার সঙ্গে জড়িত। আজ যদি তিনি জীবিত থাকতেন তাহলে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে ইতিহাসের এই জঘন্য বিকৃতির চেহারা দেখে তিনিও শিউরে উঠতেন।
এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্রের উপর আঘাত হানা হচ্ছে ধর্মেরই নামে। এতদিনে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে, সব ধরনের ধর্মীয় মৌলবাদের সঙ্গে, তা সে গৈরিক কিংবা তালিবান যা-ই হোক না কেন, ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। ধর্মের নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সংহত করাই এদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
পাঠকের অনুমতি নিয়ে আমি সামান্য সময়ের জন্য মূল বিষয় থেকে একটু বিষয়ান্তরে যাচ্ছি। ধর্ম সম্পর্কে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বহুকাল ধরেই বিতর্ক রয়েছে। সাধারণভাবে পূর্বাপর সঙ্গতি না রেখে বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়ে থাকে যে, 'ধর্ম হলো জনগণের কাছে আফিমস্বরূপ।' প্রকৃতপক্ষে যে বইতে এবং বিশেষ করে যে প্যারায় এই আপ্তবাক্য বা প্রবচনটি রয়েছে সে প্যারাটি কখনোই সম্পূর্ণভাবে উদ্ধৃত করা হয় না উদ্দেশ্যমূলকভাবেই। মার্কস লিখেছিলেন যে, ধর্মীয় ক্লেশ হলো বাস্তব ক্লেশের অভিব্যক্তি এবং একইসঙ্গে বাস্তব ক্লেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। ধর্ম হলো অবদমিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, ঠিক যেমন সেটা হলো আত্মাবিহীন পরিবেশের আত্মা। ধর্ম হলো জনগণের জন্য আফিম। [১৮৪৪ সালে বিখ্যাত ভাববাদী। দার্শনিক হেগেলের আইন দর্শনের পর্যালোচনা প্রসঙ্গে কার্ল মার্কস রচিত প্রবন্ধ থেকে উৎকলিত।
আফিম যেমন একটা মায়াময় কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করে, ধর্মও তেমনি বাস্তববর্জিত মোহময় বিভ্রান্তির স্রষ্টা। অবদমিত, নিপীড়িত মানুষের যখন মোহজাল ছিন্ন করে কোমর বেঁধে শক্ত হয়ে ওঠা দরকার তখন ধর্ম পরিত্রাণের পথ হিসেবে পলায়নী মনোবৃত্তির, হৃদয়হীন পৃথিবীতে তথাকথিত হৃদয়ের এবং উদ্যমহীনতার পরিবেশে একরকম উদ্যমের জন্ম দেয়। এসবের জন্য মানুষের দরকার হয় ধর্মের মতো আফিমের আশ্রয়। তার ফলে তারা আত্মসমর্পণের আনন্দে মশগুল হয়ে থাকে। এটা এমন এক অবস্থা যা তাদের নিজস্ব উপলব্ধি ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়।
ধর্ম সম্পর্কে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়, সামগ্রিকভাবে মার্কসবাদী তত্ত্বের সঙ্গে তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি ছোট্ট প্রশ্ন থেকে যায় যে, একজন মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা এবং তার সঙ্গে যুক্ত মানবমুক্তির প্রকৃত উপাদানগুলি কী? এক্ষেত্রে হেগেলের মানবমনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে তত্ত্ব, যা পরবর্তীকালে ফয়েরবাখের উত্থাপিত তত্ত্বের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে মার্কস তা নাকচ করে দিয়েছেন। কারণ সে সময়ে তিনি একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন। মানুষের সচেতনতা তার সামাজিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল হয়, বিপরীতটি ঘটে না। মানুষের সচেতনতার উপর তার সামাজিক অস্তিত্ব নির্ভর করে না, বরং তার সচেতনতাই নির্ভর করে সামাজিক বাস্তবতার উপর। (রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনার ভূমিকা প্রসঙ্গে মার্কস) সাম্প্রতিক ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্তসমূহ এই তত্ত্বকে বিরাটভাবে সমর্থন জানিয়েছে।
সুতরাং ধর্ম সম্পর্কে মার্কস স্বয়ং এবং মার্কসবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো এই যে, ধর্ম সামাজিক পরিবেশের সৃষ্টি। এক অর্থে ধর্মের ইতিহাস মানব ইতিহাসের বিবর্তনের সঙ্গে জড়িত, মোটামুটিভাবে মানব ইতিহাসের প্রতিফলন ঘটে থাকে ধর্মের ইতিহাসে। সুতরাং অন্যান্য ধরনের সচেতন ক্ষেত্রের মতই ধর্মও স্বয়ম্ভূ নয়, বরং প্রকৃত পৃথিবীর বাস্তব জীবনের ছায়াপাত ঘটে থাকে এর উপর। এতাবৎকাল পর্যন্ত বিস্মিত মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন রহস্যের উপযুক্ত ব্যাখ্যা না করতে পেরে এবং সমাজজীবনে কোন শক্তি তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত করে তার দিশা না পেয়ে ভেবে নিত যে নিশ্চয়ই কোনো অদৃশ্য আধিভৌতিক শক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাই ধর্ম মানুষকে এক ধরনের স্বস্তি, সান্ত্বনা ও সৌন্দর্যের কল্পিত আশ্রয়ের সন্ধান দেয়। অথচ, বাস্তব পৃথিবীর চেহারাটা সম্পূর্ণ পৃথক। একই সঙ্গে ধর্ম একটা আধিপত্যকামী মতাদর্শও বটে। তাই চলতে চলতে একটা সময়ে এসে সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে।
এটাই হলো ধর্ম সম্পর্কে মার্কসবাদী বস্তুবাদী ধারণা বা অভিব্যক্তি। ধর্মের মানবিক মুখ এবং একই সঙ্গে শ্রেণিশাসনের অস্ত্র হিসেবে তার ব্যবহার সম্পর্কে সামগ্রিক ভাবে বিচার করতে হবে। ধর্মীয় এলাকা, প্রতিপত্তি এবং শক্তিবৃদ্ধিকারী অবস্থার বিরুদ্ধে কমিউনিস্টরা কাজ করে, কিন্তু অহেতুক ধর্মকে আক্রমণ করা তাদের লক্ষ্য হতে পারে না। কারণ, কমিউনিস্টরা সমাজ বিচ্ছিন্ন নন। এবং মানব সভ্যতার গতিপথে যেসব সামাজিক সংগঠন গড়ে ওঠে তার থেকে সম্পর্কচ্যুত হয়ে একলা চলো-রে নীতি গ্রহণও সম্ভব নয় এবং উচিতও নয়।
ফিরে আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সংহত করার লক্ষ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজশক্তি ধর্ম এবং ধর্মীয় আবেগকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার বা অপব্যবহার করেছিল। ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে রানী লক্ষ্মীবাঈ ও বেগম হজরত মহল এবং মৌলবী আহমদুল্লাহ ও রাও টুলারাম কাধে কাধ মিলিয়ে একত্রে লড়াই চালিয়ে ব্রিটিশদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন। মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর এই লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। এই যুদ্ধ থেকে ব্রিটিশরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লাভ করেছিল যে কোনো একটি সাধারণ বিষয় নিয়ে যদি ভারতের হিন্দু মুসলমান এবং সামন্ততান্ত্রিক রাজন্যবর্গ একত্রিত হবার সুযোগ পায় তাহলে ব্রিটিশের পক্ষে আর এখানে উপনিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হবে না। ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে একজন সমকালীন সাংবাদিক বিস্ময় প্রকাশ করে লেখেন: 'শিশুঘাতী রাজপুত থেকে হতদরিদ্র ব্রাহ্মণ গোঁড়া মুসলমান, গো-পূজক থেকে গোহত্যাকারী, বরাহ ঘৃণাকারী থেকে বরাহ খাদক পর্যন্ত সবাই একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিদ্রোহে শামিল হয়েছিলেন'। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতেই হবে। এজন্যই ব্রিটিশ শাসকবর্গ তাদের কুখ্যাত 'বিভেদ সৃষ্টি করে শাসন চালাবার নীতি' চালু করে। এইভাবেই শুরু হলো হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে বিষাক্ত বিভেদ সৃষ্টিতে উষ্কানি দেওয়ার প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ায় নিশ্চিতভাবেই সহায়তা যোগালেন উভয় সম্প্রদায়ের কট্টর সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা। এই ঘৃণ্য নীতি ভারতীয় সমাজজীবনের এতটাই গভীরে প্রবেশ করে যে তার বেশ ধরে ভারতবাসীদের মধ্যে আজ পর্যন্ত ঐক্য ও সংহতির ক্ষেত্রে বিদ্বেষ বিষের আগুন অনিবার্য শিখায় জ্বলছে, আমাদের এখনও তার জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে।
সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু ধর্মীয় মৌলবাদকে খাড়া করে দিলে চলবে না। বস্তুত, সব ধরনের মৌলবাদই—তা সে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান বা শিক্ষা যা-ই হোক্ না কেন—আসলে পরস্পরের পরিপূরক। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে রক্ষা করা এবং তাকে আরো শক্তিশালী করে তোলার জন্য নানা বৈচিত্র্য ও বিবিধ ধর্মের সাধারণ মানুষের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলাটা অত্যাবশ্যক। আর এস এস এবং তার লেজুড়দের ফ্যাসিবাদীসুলভ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য এই ধরনের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম একান্ত জরুরি। গোয়েবলস্-এর (গোয়েবলস্ ছিলেন। হিটলারের প্রচারমন্ত্রী। তাঁর বিখ্যাত কৌশল ছিল— ক্রমাগত মিথ্যার পর মিথ্যা বলে যাও। এক সময়ে মানুষ তাকেই সত্য বলে মেনে নেবে।) প্রচার কৌশলের ধাঁচে এরা মিথ্যা প্রচারের পাশাপাশি জাতীয়তাবাদের জাগরণ এবং নীতি নৈতিকতার আদর্শকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। বাস্তবে অবশ্য এদের প্রচারের প্রায় সবটাই ফাকা আওয়াজ ছাড়া কিছু নয়। উগ্র জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে সেই ডামাডোলের মধ্যে জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে, জাতীয় নিরাপত্তাকে বিপন্ন করেও আপন স্বার্থসিদ্ধি করতে এরা বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করে না। ব্যক্তিগত লাভের জন্য রাজনৈতিক অসততার কোন গভীর এরা প্রবেশ করতে পারে তার জ্বলন্ত নিদর্শন হলো তেহেলকা সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি।
নাজি ফ্যাসিস্টবিরোধী সংগ্রামের অনন্য নায়ক জর্জি ড্রিমিট্রভ লিখেছিলেন, “ফ্যাসিজম মানুষকে কৌশলে একটা চরম দুর্নীতি পরায়ণ এবং উৎকোচ লোলুপদের দয়ার পাত্রতে পরিণত করে। কিন্তু তারা এমন ভান করে যেন তারা সততার প্রতীক হয়ে এসেছে এক দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য। মানুষের সুগভীর স্বপ্নভঙ্গের এক চূড়ান্ত পর্যায়ে ফ্যাসিবাদ উগ্র স্বদেশীয়ানার মোড়কে তুখোড় বাক্চাতুর্যে মানুষের মনে মায়াজাল সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালায়। পাতি বুর্জোয়া এবং শ্রমিকদের একাংশও অভাব, বেকারত্ব এবং বেঁচে থাকা নিয়ে শঙ্কার কারণে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের সৃষ্ট আবেগের স্রোতে ভেসে যায়।” (ডিমিট্রন্ড, নির্বাচিত রচনাবলি, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৭২, পৃঃ২)। ফ্যাসিবাদীদের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি আজকের গৈরিক বাহিনীর সুচতুর বক্তৃতা ও প্রচারে প্রতিফলিত হচ্ছে।
কাজেই বর্তমান সময়ে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যেখানে আমরা লক্ষ্য করছি যে ফ্যাসিবাদসুলভ সাম্প্রদায়িকতা আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের উপর অভূতপূর্ব আক্রমণ চালাচ্ছে এবং এই প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছে। 'স্বদেশী'-র স্লোগান তুলে ভোট দখল করার পর তারা কার্যত 'বিদেশি' অর্থনৈতিক নীতি আমদানি করে তাকে এদেশের বুকে রূপায়িত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। একদিকে তাদের মার্কামারা জাতীয়তাবাদের নামে এরা ভারতকে বিদেশের হাতে বন্ধক দিচ্ছে এবং অন্যদিকে জনগণের উপর অপরিমেয় বোঝা চাপাচ্ছে। যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভারতকে পুনরায় অর্থনৈতিক উপনিবেশের আওতায় আনতে চাইছে এরা তাদেরই বিশ্বস্ত এজেন্ট হিসাবে কাজ করছে।
এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় নিজেদেরকে ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র এবং আর্থিক স্বনির্ভরতার নীতিকে বজায় রাখার জন্য আজকের দিনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো গণ্ডিবদ্ধতার বৃত্তের বাইরে এসে সমমতাবলম্বীদের নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশপ্রেমের এটাই হলো আসল অর্থ।
স্বয়ং গোলওয়ালকর একবার বলেছিলেন যে 'হিন্দুরাষ্ট্র' ভাবনার তিন অভ্যন্তরীণ শত্রু হলো মুসলমান, খ্রিস্টান এবং কমিউনিস্টরা। আমি এটার সঙ্গে শুধু যোগ করতে চাই যে ঈশ্বরে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী নির্বিশেষে ভারতীয় জনতার অধিকাংশই আর এস এস-র তথাকথিত 'হিন্দুরাষ্ট্র' তত্ত্বের ঘোরতর বিরোধী এবং তাঁরা চান না যে ভারতের বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রের কোনোরকম পরিবর্তন করা হোক। ভারতের বিপুল বৈচিত্র্যের মাঝে যে অভিন্নতার অবস্থান রয়েছে একমাত্র তাকে শক্তিশালী। করার মধ্য দিয়েই এদেশের ঐক্য এবং সংহতি বজায় রাখা সম্ভব। বর্তমান সময়ে সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও মৌলবাদ যেভাবে অভিন্নতার নামে জাতীয় সংহতি এবং ঐক্যের উপর আঘাত হানতে চাইছে তাতে করে দেশের সংহতিই বিপন্ন হয়ে পড়বে। আরও উন্নততর দেশ গঠনের লক্ষ্যে আসুন আমরা ভারতকে মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হই।
২০০১ সালে হায়দরাবাদে ডঃ জাকির হুসেন স্মারক বক্তৃতায় ভাষণ
অনুবাদ: শ্যামল সেনগুপ্ত