Sangharsh Rally

জনবিরোধী স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধেই আজকের সংসদ অভিযান

অনাদি সাহু

আজ, ৫ এপ্রিল, ২০২৩ দিল্লিতে শ্রমিক-কৃষক সংঘর্ষ অভিযানের ডাক দিয়েছে সিআইটিইউ, সারা ভারত কৃষকসভা, সারা ভারত খেতমজদুর ইউনিয়ন। দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী, কৃষক, খেতমজুর পার্লামেন্ট অভিযানে শামিল হতে প্রস্তুত হচ্ছেন। দেশ বাঁচাতে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে বিজেপি-কে পরাজিত করতে হবে- এই হল স্পষ্ট দাবী। দিল্লি থেকে লাল ঝান্ডার সেই আহ্বান সারা দেশ শুনবে।

ভারতের স্বনির্ভর অর্থনীতি, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা, রাষ্ট্রায়ত্ত‍‌ ক্ষেত্র, শ্রমিকশ্রেণির অর্জিত অধিকারই শুধু আক্রান্ত তাই নয়, দেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, ধর্মনিরেপেক্ষ রাষ্ট্রীয়নীতি, গণতন্ত্র সবেতেই আক্রমন চলছে।

গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের স্বার্থে, উদার অর্থনীতির নামে আর্থিক সংস্কারের কর্মসূচি চলছে। ২০১৪-য় ক্ষমতায় আসে বিজেপি সরকার। গত ন-বছর ধরে দেশের জনসাধারণের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা চলছে। কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে জনগণের জীবন-জীবিকার উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি, তীব্র বেকারি, কলকারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস, কৃষকের আত্মহত্যা আজকের ভারতে রোজকার ঘটনা। দেশজুড়ে বাড়ছে অভুক্ত মানুষ। মোদী জমানায় ভারতে ৮৬ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকার এই মুহূর্তের পরিস্থিতি। খাদ্য সুরক্ষার সূচকে বর্তমানে আমরা বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নিচে নেমে গেছি।

আমাদের দেশের শ্রমজীবী নিপীড়িত মানুষ এই অবস্থার বিরুদ্ধে বিভিন্ন লড়াই-আন্দোলনে যুক্ত রয়েছেন। সেইসব আন্দোলনেরই একটি সম্মিলিত চেহারা হতে চলেছে এই সংঘর্ষ অভিযান। বলা চলে আজকের রামলীলা ময়দান দেশের শ্রমজীবী মানুষের সেই সম্মিলিত সংগ্রামের একটি যৌথমঞ্চ।

৯০-এর দশকের প্রথম থেকেই সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজির স্বার্থে পরিচালিত উদার অর্থনীতির বিরুদ্ধে দেশে সিআইটিইউ সহ বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলি লড়াই করে আসছে। আইএনটিইউসি, এইচএমএস এবং পরে বিএমএস অবধি সেই ঐক্যবব্ধ আন্দোলনে শামিল হয়। ক্ষমতায় আসার পর আরএসএস, বিজেপি’র পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী, দেশবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বেসরকারিকরণ, শ্রমআইন সংশোধন সহ বিভিন্ন ইস্যুতে শ্রমিক শ্রেণির লড়াই আন্দোলন ধর্মঘটের পথে অগ্রসর হলে বিএমএস নিজেদের যুক্ত আন্দোলন থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এর পরেও শ্রমিক আন্দোলন প্রসারিত হয়েছে এবং কেন্দ্রের বিরুদ্ধে গত ৪ বছরে চারটি সর্বভারতীয় ধর্মঘটই সফল হয়েছে। শ্রমিক আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষকরাও রাস্তায় লড়াইতে শামিল হয়েছেন।

মোদী জমানায় দেশ কেমন আছে তা বুঝতে সরকারি তথ্যই যথেষ্ট। আন্তর্জাতিক ক্ষুধার সূচকে ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১০১তম। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশের বর্তমান সময়কে অমৃত মহোৎসব পর্ব হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। শ্রমিক-কৃষক, দেশের সাধারণ মানুষের গভীর সঙ্কটে কেন্দ্রীয় সরকার জনস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে কেন্দ্রীয় বাজেটে (২০২৩-২৪) খাদ্য, সার, স্বাস্থ্য, রেগা প্রকল্প সামাজিক সুরক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক বরাদ্দ ছাঁটাই করেছে। শিক্ষাখাতে দাবী থাকা সত্বেও বরাদ্দ বৃদ্ধি হয়নি। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ বা বেকার সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে মোদী সরকার উদাসীন। কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে ১০ লক্ষ শূন্য পদ। ব্যাঙ্ক, বিমা, রেল, প্রতিরক্ষা সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিয়োগের ব্যবস্থা না করে উল্টে কর্ম সঙ্কোচনের নীতি নিয়েছে। গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পয় (এমএনরেগা) ৩৩,০০০ কোটি টাকা, কৃষিতে সার বাবদ ৫০,০০০ কোটি টাকা সহ আরও ১০,০০০ কোটি টাকা, গরিব মানুষের জন্য খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পে ৫৯,৭৯৩ কোটি টাকার বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে। স্কুল পড়ুয়াদের মিড-ডে মিল প্রকল্পে ৯.৪ শতাংশ বরাদ্দ ছাঁটাই করা হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছাঁটাই হয়েছে ৩৪ শতাংশ। অক্সফ্যামের রিপোর্ট অনুযায়ী মোদী জমানায় দে‍‌শের ১০ শতাংশ সবচেয়ে ধনীদের তুলনায় দেশের দরিদ্রতম ৫০ শতাংশ জনগণকে বর্তমানে ছগুণ বেশি পরোক্ষ কর দিতে হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, ওষুধের দামে জিএসটি চাপানো হয়েছে। অথচ উচ্চবিত্ত ও কর্পোরেটদের জন্য কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। আদানি, আম্বানিদের জন্য বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া প্রায় ১০ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকার কর্পোরেট ঋণ মুকুব করা হয়েছে।

এসব থেকে দেশের অবস্থা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আরও কিছু জরুরী প্রসঙ্গ মনে রাখতে হবে।

মহারত্ন, নবরত্ন, মিনিরত্ন সংস্থাসমুহকে দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইনের নামে যে পরিকল্পনা ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, তা জনস্বার্থ বিরোধী। বহু লড়াইতে অর্জিত ২৯টি শ্রম আইন বাতিল করে চারটি শ্রমিক-বিরোধী শ্রম কোড নির্মিত হয়েছে। পার্লামেন্টে কোনও আলোচনা ছাড়াই। কল-কারখানায় শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, মালিকদের সাথে মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা আদায়ে দর-কষাকষি, ৮ঘণ্টা কাজের সময়, ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা সবই আক্রান্ত। মালিকদের‍ অবাধ লুণ্ঠনের জন্যে নতুন শ্রম আইনে (লেবর কোড) দেশের ৭০ শতাংশ শিল্প ও কল-কারখানার শ্রম আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। নয়া শ্রম আইন অনুযায়ী ভবিষ্যতে এরা শ্রম দপ্তর বা কোনও লেবার কোর্টে যাওয়ার অধিকারটুকুও পাবেন না। শ্রমিক কারা? যারা দেশের সম্পদ সৃষ্টির মূল কারিগর। কৃষক, খেতমজুররা কোন মানুষ? এরাই আমাদের খাদ্যের যোগানদার। মোদী জমানায় এরাই আক্রান্ত, লুণ্ঠিত। তাই শ্রম আইন সংশোধন আমাদের দাবী নয়। ইতিপূর্বেই প্রতিরক্ষা শিল্পে শ্রমিক ধর্মঘট নিষিদ্ধ করে এসমা জারি করা হয়েছিল, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের ধর্মঘটও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

বিদেশে নিজের লোক (বেশ কিছু ক্ষেত্রে একেবারে পরিবারের লোক) বসিয়ে রেখে অন্য নামে কোম্পানি খুলে নিজেরই শেয়ারকে বারংবার কেনাবেচা করা হয়েছে, অথচ বাজারে মোট শেয়ারের পরিমাণ এক থেকেছে। সুতরাং শেয়ারের দাম বেড়েছে- কেননা দেখানো হয়েছে চাহিদা বাড়ছে। শেয়ার কেনাবেচায় নিয়ামক সংস্থা সেবি’র আইন আছে এমন কায়দায় শেয়ারের দাম বাড়িয়ে কোনও কোম্পানি যদি বাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করতে চায় তবে সেই কাজকে জালিয়াতি বলা হবে। আদানিরা ঠিক সেটাই করেছেন। বাজারের অবস্থা যখন একেবারেই ভালো না অথচ সামনের নির্বাচনে সরকারী দলের প্রচার তহবিলের জন্য বিরাট পরিমানে নির্বাচনী বন্ড কিনতে বাধ্য হতে হবে তখন একটি বহুজাতিক বিলিওনেয়ার সংস্থার পক্ষে আর কিই বা করার ছিল? মোদী সরকারও অবশ্য নিজেদের কথা রেখেছে- আদানিদের শেয়ার কিনতে তারা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে (স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া, এলআইসি ইত্যাদি) বাধ্য করেছে।

আদানি কোম্পানির উত্থানে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধীদের জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি গঠন করে তদন্ত করার দাবিতে জোটবদ্ধ লড়াই এবং অতীতের একটি মন্তব্যের জন্য সাংসদ রাহুল গান্ধীর জেল এবং সাংসদ পদ খারিজের ঘটনায় কেন্দ্রের শাসকদলের অসন্তোষ তৎপরতা ও ভূমিকা দেশের গণতন্ত্রের সামনে বিপদ। দে‍‍‌শের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজ আক্রান্ত। মোদী এখনও কিছু বলেন নি। এহেন অবস্থান লজ্জাজনক।

আদানিদের ব্যবসা যে আসলে মিথ্যার বেসাতি হিন্ডেনবার্গ সেটুকুই বলেছে। আমরা বলছি এসবই জানা কথা। ফিন্যান্স পুঁজি দেশের সীমার এদিক ওদিক করতে বাধাহীন ক্ষমতার দাবী করেছিল এই জন্যই। যতক্ষণ মুনাফা ততক্ষণই পুঁজি একটি নির্দিষ্ট দেশের বাজারে থাকবে, এতটুকু বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিলেই সে অন্যত্র চলে যাবে- এটাই আধুনিক সভ্যতার সবচাইতে অসভ্য বন্দোবস্তের সার কথা। এই লক্ষ্যেই বিকাশের ঢাকঢোল, এই উদ্দেশ্যেই ডিজিটাল ইন্ডিয়া, ক্যাশলেস ইকোনমি। কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক শক্তির এই আঁতাত দেশের জনসাধারণ ক্রমশ উপলব্ধি করছেন। শ্রমজীবী মানুষের উপরে আজকের আক্রমণ ভবিষ্যতে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত জনগণের উপরেও বিস্তৃত হবে- একথাও সকলেই বুঝছেন। কতিপয়ের ভাল থাকার বিনিময়ে লক্ষ-কোটি জনসাধারণের জীবন-জীবিকা লুট চলবে না- আজ সেই ঘোষণাই শুনবে গোটা দেশ।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন