লেনিনের চোখে রোজা - শান্তনু দে....

১৫ জানুয়ারি , ২০২২

লেনিনের কাছে রোজা ছিলেন ‘ঈগলপ্রতিম’। তিনি রোজার তুলনা করেছিলেন খোলা আকাশে ঘুরে বেড়ানো ঈগল পাখির সুদূরপ্রসারী দৃষ্টির সঙ্গে।

লেনিন আর রোজা— বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লবের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে দৃঢ় লড়াই চালিয়েছেন দু’জনে।

১৯০৭, রুশ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক দিবস উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে লেনিনের সঙ্গে প্রথম দেখা। রোজা আর লেনিনের মধ্যে সেই বৈঠকের কোনও রেকর্ড নেই। তবে ইউরোপের বেশকিছু পার্টির মধ্যে সংশোধনবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই নিয়ে দু’জনের মধ্যে সবিস্তার আলোচনা হয়।

লেনিনকে অপার শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন রোজা। ক’দিন বাদে, ওই বছরই আগস্টের ২৪-২৮, জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে দ্বিতীয় অন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেস। বেবেল, বার্নস্টাইন, কাউটস্কি, রোজার সঙ্গে সেই কংগ্রেসের প্রতিনিধি ক্লারা জেটকিনও। ‘কারো চরিত্র বর্ণনায় তাঁর শিল্পী চোখ নিয়ে’ ক্লারাকে দেখিয়ে রোজা বলেন, ওই মানুষটাকে দেখো, ‘একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখো। উনিই লেনিন। তাকিয়ে দেখো ওই একরোখা, ওই একগুঁয়ে মাথাটিকে। রুশ কৃষকের প্রকৃত মাথা, সঙ্গে অল্পকিছু অস্পষ্ট এশীয় রেখা। ওই মানুষটিই পাহাড়গুলিকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করবে। সম্ভবত, উনি ওদের ভারে গুঁড়িয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কখনও আত্মসমর্পণ করবেন না, বশ্যতা স্বীকার করবেন না।’ (ক্লারা জেটকিন: রেমিনিসেন্সেস অব লেনিন)।

দু’জনের মধ্যে নির্দিষ্ট মতবিরোধ ছিল। আবার একইসঙ্গে ছিল আন্তর্জাতিক প্রলেতারিয় ঐক্য।

দু’জনেই ছিলেন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে সংশোধনবাদ-সুবিধাবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অক্লান্ত যোদ্ধা। স্টুটগার্ট কংগ্রেসে যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করেন বেবল। যুদ্ধ বিষয়ক প্রস্তাব প্রণয়নের সাব কমিটিতে ছিলেন লেনিন আর রোজা দু’জনেই। লেনিনের সঙ্গে আলোচনা করে রোজা যে সংশোধনী ও সংযোজনী পেশ করেন, তা গৃহীত হয় কংগ্রেসের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে। সংশোধনীতে বলা হয়, শ্রমিকশ্রেণিকে এবং সংসদে তাদের সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ ঠেকানোর চেষ্টা করতে হবে। যুদ্ধ যদি বেধে যায়, তা দ্রুত অবসানের জন্য হস্তক্ষেপ করতে হবে। সংশোধনীর আরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে বুর্জোয়া শাসনের পতন ঘটানোর জন্য জনগণকে রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা। পরবর্তীতে এই লাইনেই লেনিনের অবস্থান ছিল ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করো।’ শ্রমজীবী মহিলাদের ইস্যুকে কংগ্রেসের অ্যাজেন্ডায় আনার জন্য ক্লারার প্রস্তাবকে সমর্থন করেন রোজা।

তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সময় রোজা ছিলেন না। তার ঠিক আগেই শহীদ হন। বার্লিন থেকে রোজা আর কার্লের হত্যার খবর মস্কোতে পৌছয় দু’দিন বাদে। সতেরো জানুয়ারি। এবং সেদিনই ঘোষণা করা হয়। পরদিন প্রকাশিত হয় ইজভেস্তিয়া ও প্রাভদায়। উনিশ জানুয়ারি, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সর্বত্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভসভার ডাক দেয়। শামিল হতে বলে পার্টির সমস্ত সংগঠন ও সোভিয়েতকে। মস্কোয় শ্রমিকরা ও লালফৌজের ইউনিট জড়ো হয় সোভেতস্কায়া স্কোয়ারে। সোভিয়েত ভবনের ঝুলবারান্দা থেকে ভাষণ দেন লেনিন, লুনাচারস্কি-সহ অন্যরা।

সেদিন লেনিন বলেন: ‘আজ, বার্লিনের বুর্জোয়া এবং সামাজিক-বিশ্বাসঘাতকরা আনন্দে আত্মহারা। কার্ল লিবনেখট এবং রোজা লুক্সেমবার্গকে হত্যা করতে তারা সফল হয়েছে। এলবার্ট ও শেইডম্যান, যারা লুটের কারণে চারবছর ধরে শ্রমিকদের বধ করে এসেছে, তারাই এখন সর্বহারা নেতাদের কসাইয়ের ভূমিকায়। জার্মান বিপ্লবের উদাহরণ প্রমান করল ‘গণতন্ত্র’ হলো বুর্জোয়াদের লুটের একটা ছদ্মবেশ মাত্র এবং বর্বর হিংসা। কসাইদের মৃত্যু হোক!’ (২১ জানুয়ারি, প্রাভদা)।

দু’মাস বাদেই মার্চের গোড়ায় মস্কোয় তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসের অধিবেশন শুরু হয় কার্ল আর রোজার স্মরণে নীরবতা পালন করে।

রোজা তাঁর লেখা বিতর্কিত ‘রুশ বিপ্লব’ লিখেছিলেন ব্রেসলাউ জেলখানায় বসে (১৯১৬-১৮), বন্দি অবস্থায়। কারাগারে বসে যেটুকু খবরাখবর পাচ্ছিলেন, তার ভিত্তিতে। বেঁচে থাকতে এই পাণ্ডুলিপি তিনি প্রকাশ করেননি। লেখাটি জনসমক্ষে আসে তাঁর মৃত্যুর দু’বছর পর। ১৯২২, পল লেভির সম্পাদনায় এই পাণ্ডুলিপির একটি অসম্পূর্ণ ও অনেকাংশেই অসংশোধিত একটি ভাষ্য প্রকাশিত হয়। পরে ১৯২৮ সালে ফেলিক্স ভাইল মূল ও সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশ করেন। লেনিন অবশ্য এই সংস্করণটি দেখে যাওয়ার সুযোগ পাননি। দেখেছিলেন পল লেভির ১৯২২ সালের ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ সংস্করণ।

কে এই পল লেভি? রোজা ও কার্ল খুন হয়ে যাওয়ার পর জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হন পল লেভি। ১৯২০, মস্কোতে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে জার্মান প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দেন। ১৯২১’র জানুয়ারিতে উপস্থিত ছিলেন ইতালির সোশ্যালিস্ট পার্টির ঐতিহাসিক লিবর্নো কংগ্রেসে। যে সপ্তম কংগ্রেস থেকে ভেঙে বেরিয়ে ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা। তার আগের বছর মে মাসে ল’ অর্দিনো ন্যুভো পত্রিকায় গ্রামশি একটি প্রবন্ধ লেখেন। যা ছিল ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির গড়ে ওঠার ভ্রুণ। লেনিন এই প্রবন্ধটির যথেষ্ট প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন এই প্রবন্ধের বক্তব্য কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ও প্রেক্ষিতের সঙ্গে প্রকৃত অর্থেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। অথচ, লিবর্নো কংগ্রেস থেকে ফিরে এসে পল লেভি ইতালিতে গিয়াসিনতো সেরাতির নেতৃত্বাধীন মধ্যপন্থীদের পক্ষে অবস্থান নেন। পরে ফেব্রুয়ারিতে জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সেরাতি ও তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সঙ্গেই ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানিয়ে প্রস্তাব নিলে, লেভি-সহ কমিটির পাঁচজন সদস্য তাতে অসম্মতি জানান। পরে জার্মানিতে ‘মার্চ অ্যাকশান’ ব্যর্থ হওয়ার পর লেভি প্রকাশ্যে পার্টির অবস্থানের বিরোধিতা করলে, সেবছরই তাঁকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়।

বহিষ্কারের পর এই লেভিই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন রোজার ‘রুশ বিপ্লব’কে। যে লেভি ১৯১৮-তে রুশ বিপ্লব সম্পর্কে রোজার সমালোচনা প্রকাশ না করার জন্য বুঝিয়েসুঝিয়ে তাঁকে নিরস্ত করেছিলেন, সেই তিনিই রোজাকে ব্যবহার করলেন জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে বলার জন্য। (দ্য ট্র্যাজেডি অব পল লেভি: এ জার্মান রেভেলিউশনারি বিটিউইন কমিউনিজম অ্যান্ড সোশ্যাল ডেমোক্রেসি)।

বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি লেনিনের। লেভিকে চিনতেও বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি। ১৯২২ সালে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ‘নোটস অব এ পাবলিসিস্ট’-এ লেনিন লিখছেন: ‘পল লেভি এখন বুর্জোয়াদের অনুগ্রহ পেতে চাইছেন— এবং সঙ্গে তাদের দালাল দ্বিতীয় ও আড়াই আন্তর্জাতিকের কৃপাও— সেকারণেই রোজা লুক্সেমবার্গের সেইসব লেখা যথাযথভাবে পুনরায় প্রকাশ করে চলেছেন, যেসব প্রশ্নে রোজা ভুল ছিলেন।’

রোজার ভ্রান্তিগুলি লেনিনের কাছে মোটেই অজানা ছিল না। সেইসব ভ্রান্তিকে মনে রেখেও মার্কসবাদী ঐতিহ্যে তাঁর অবদানের অপরিসীম গুরুত্বের পক্ষে সওয়াল করেন লেনিন। একইসঙ্গে ‘প্রাচীন রুশ নীতিকথার দু’টি লাইন ব্যবহার করে’ লেভির জবাব দেন: ‘ঈগল কখনও মুরগির চেয়েও কম উচ্চতায় উড়তে পারে, কিন্তু মুরগি কখনও উড়তে পারে না ঈগলের উচ্চতায়।’ যোগ করেন, ‘শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের আঙিনায় গোবরের স্তুপের মধ্যে পল লেভি, শেইডম্যান, কাউটস্কির মতো মুরগি এবং তাদের সমধর্মীরা কেবলই মহান কমিউনিস্টদের ভ্রান্তিগুলি নিয়ে মুরগির ডাক ডেকে যাবে।’

রোজার ভ্রান্তিগুলি কোথায় ছিল? আবারও আমাদের ফিরে যেতে হবে লেনিনের কাছে।

‘রোজা ভুল করেছিলেন পোল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে, তিনি ভুল করেছিলেন ১৯০৩ সালে তাঁর মেনশেভিকদের প্রশংসায়, ভুল করেছিলেন পুঁজির পুঞ্জিভবনের তত্ত্বে, তিনি ভুল করেছিলেন ১৯১৪ সালে, যখন প্লেখানভ, গান্দারভেলদে, কাউটস্কি এবং অন্যান্যরা ছিলেন একসঙ্গে, বলশেভিক এবং মেনশেভিকদের মধ্যে ঐক্যের পক্ষে তিনি সওয়াল করেছিলেন, তিনি ভুল করেছিলেন ১৯১৮-তে জেলে থাকার সময় (এইসব ভুলগুলির অধিকাংশই তিনি ১৯১৮’র শেষে এবং মুক্তির পর ১৯১৯ সালের গোড়ায় সংশোধন করেছিলেন)।’

এবং, এখানেই থামেননি লেনিন, যোগ করেন, ‘কিন্তু তাঁর ভ্রান্তিগুলি সত্ত্বেও তিনি ছিলেন, তিনি আমাদের মধ্যে থাকবেন একটি ঈগলপ্রতিম হিসবে। বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্টরা শুধু তাঁর স্মৃতিকে লালন করবেন না, তাঁর জীবনী ও তাঁর তাবৎ কাজ (যে প্রকাশনার জন্য জার্মান কমিউনিস্টরা মাত্রারিক্ত বিলম্ব করে চলেছেন, যার জন্য তাঁদের গুরুতর সংগ্রামে যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির তাঁরা মুখোমুখি হয়েছেন, সেটা হতে পারে আংশিক অজুহাত মাত্র) বিশ্বজুড়ে বহু প্রজন্মের প্রশিক্ষণের জন্য একটি কার্যকরী ম্যানুয়াল হিসেবে কাজ করবে।’





শেয়ার করুন

উত্তর দিন