বিবেকানন্দের প্রাসঙ্গিকতা আজও অপরিসীম।- বিনয় চৌধুরী

আমার বিপ্লবী জীবনে বিবেকানন্দ

বিনয় চৌধুরী

আমি ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে যখন আমার বন্ধু সরোজ মুখার্জির সঙ্গে শ্রীরামপুর কলেজে ভর্তি হলাম সেই সময়েই আমি 'যুগান্তর' দলেতে যুক্ত হই এবং সেই সময় থেকেই আমরা বিবেকানন্দের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। শুধু আমি নই, আমার সময়ের অনেক ছাত্র এবং যুবক তাঁরা বিবেকানন্দের আদর্শের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন কারণ আমার এবং অন্যান্য যুব সম্প্রদায়ের তখন এই ধারণাই ছিল যে বিবেকানন্দ ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্যে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেছিলেন এবং বিবেকানন্দ সব সময়ই এই কথা বলতেন - যে আগামী অর্ধশতাব্দী ভারতবর্ষের যুবকদের কাছে দেশের স্বাধীনতাই হবে মূল লক্ষ্য।এছাড়াও বিবেকানন্দের লেখা অনেক বইও তখনকার ছাত্র সম্প্রদায়ের অনেকেই গভীর মনোযোগ সহকারে পড়তেন। তাঁর লেখাতেই প্রথম ভারতের অবহেলিত শ্রেণী - অজ্ঞ, মুচি,মেথর, চন্ডাল ইত্যাদি অশুদ্ধ গোত্রের মানুষজনেদের সমাজে উপযুক্ত মর্যাদায় স্থান দেওয়ার কথা ধরা পড়েছিল। তাছাড়াও দরিদ্র ভারত, অবহেলিত ভারতবর্ষের কথাও বিবেকানন্দ তাঁর বক্তৃতায়, চিঠিপত্রে বার বার উল্লেখ করেছিলেন। এই সমস্ত চিন্তাভাবনা আমার মত সেই সময়কার ছাত্রসমাজকে সাংঘাতিকভাবে নাড়া দিয়েছিল।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দেই বিবেকানন্দের ভ্রাতা শ্রীভূপেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে আমার সাক্ষাত ঘটেছিল এবং তখনই আমি প্রথম জানতে পারি যে বিবেকানন্দের ইউরোপ ভ্রমণকালে তাঁর সঙ্গে অ্যানার্কিস্ট রুশ নেতা ক্রপটকিনের সাক্ষাৎকার ঘটেছিল, এবং পরাধীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে আলোচনাও হয়েছিল। তাছাড়াও এটা লক্ষ্য করার বিষয় যে বিবেকানন্দের অনেক চিন্তাধারার সঙ্গে সাম্যবাদের চিন্তাধারার অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বিবেকানন্দ তো  বলেছিলেন - আমি সমাজতন্ত্রী। এসব কারণে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলতেন যে আমি একটা বই লিখব, যার নামকরণ হবে - Vivekananda the Socialist। আমার মতে ইংরেজ আমলে অনেককেই দেশের জন্য কাজ করতে বাইরের একটা আবরণ নিয়ে কাজ করতে হত কিন্তু তাঁদের অন্তর্নিহিত জিনিসগুলো বিপ্লবী চরিত্রগঠনে এবং যুবকদের মধ্যে Moral Values তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। সেদিক দিয়ে দেখলে বিবেকানন্দের লেখা শুধু আমাকেই নয় অনেকের জীবনদর্শন তৈরি করতেই সাহায্য করেছিল।

বিবেকানন্দ অনুজ  শ্রীভূপেন্দ্রনাথ দত্ত যখন আমেরিকা থেকে ভারতে ফিরে এলেন তখন বৈপ্লবিক দলে বিপ্লব সম্পর্কে যে ক্লাসগুলি হত তাতে আমি নিয়মিত উপস্থিত থাকতাম। যতদিন শ্রীদত্ত বেঁচে ছিলেন তাঁর সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক ছিল। এছাড়া ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে যখন মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা চলছিল তখন কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা স্থির করলেন যে কোর্টকেই  তাঁদের প্রচারের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেবেন। তখন 'আত্মশক্তি' নামক সাপ্তাহিক পত্রিকায় ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের বিভিন্ন ও উদ্দীপনামূলক লেখা ছাপা হতো। তা পড়ে বিপ্লবীরা উদ্দীপ্ত হতেন। একসময়ে ভূপেন্দ্রনাথ মস্কোতে লেনিনের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন, এবং লেনিন তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে 'তুমি ফিরে গিয়ে কৃষকদের মধ্যে কাজ করো'। আমি এবং বর্তমান অনেক কমিউনিস্ট নেতা যাঁরা সে সময়ে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন এবং আজও সেই আন্দোলনে যুক্ত আছেন - এঁরা সকলেই ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের কাছ থেকেই অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন।

Source:Google
Peter Kropotkin

শ্রীভূপেন্দ্রনাথ দত্ত যখন দেশে ফিরে দেশের বিপ্লবীদের মধ্যে ক্লাস নিতেন তখন তাঁর অগ্রজ বিবেকানন্দ সম্বন্ধে বলতেন যে বিবেকানন্দের মধ্যে এমন সমস্ত চিন্তাধারা ছিল যা সাম্যবাদীদের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায়; সেই জন্য তিনি অন্য ধরনের ভাষা শব্দ ব্যবহার করতেন যেমন - 'নরনারায়ণ' শব্দ তিনি বারবার ব্যবহার করেছেন এবং বলেছেন একসময়ে শূদ্রের জাগরণ আসবে,- যা কিনা সমাজতন্ত্রের চিন্তাধারাকেই বোঝায়। তাই তাঁর ভাষাটাতে সাধারণভাবে সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যা বলা হয় তা না করে, বলা যায় ভারতবর্ষের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিয়ে এবং খানিকটা তিনি যে ধর্মের সাথে যুক্ত ছিলেন তার উপর ভিত্তি করে বললেও তিনি যা তা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন এবং জোরের সঙ্গে বলেছেন। তাঁর এই উক্তিটি আমাদের এখনো শিহরিত করে - তিনি যখন বলেন অভিজাত মানুষদের উদ্দেশ্যে - 'তোমরা শূন্যে বিলীন হও, নতুন ভারত বেরুক, বেরুক চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে,মালো, মুচি, মেথরের ঝুপড়ির মধ্য থেকে'।

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজী যখন সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন তখন আমি বর্ধমান জেলা থেকে প্রথম সত্যাগ্রহী। তাছাড়াও যখন তিনি বৈপ্লবিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তখন সর্বস্ব পণ করে দেশের স্বাধীনতা আনার মন্ত্রের বীজ পূর্বেই রোপিত হয়েছিল এবং তার ফলে স্বাভাবিকভাবেই বর্ধমান জেলার তৃণস্তরের জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনেও আমি সমর্থ হই এবং আমি ছিলাম সেসময় বর্ধমান জেলার সত্যাগ্রহী দলের অধিনায়ক। বিবেকানন্দ দেশের তৃণমূলে জনসাধারণের উন্নতির যে কথা বারবার উচ্চারণ করেছিলেন সেই বাণী এই আন্দোলন চলাকালে আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।

১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের 'রাউলাট অ্যাক্ট' যেটি সিডিশন কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল সে সময় সেই অ্যাক্টের প্রচলনের ফলে যে সব বিপ্লবী ধৃত হয়েছিলেন তাঁদের জীবনী পাঠ করলে দেখা যায় যে তাঁরাও বিবেকানন্দের জীবন এবং তাঁর রচনাবলীর দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।আর আমরা বিবেকানন্দ তো বটেই তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলাম। একটা জাতীয় চেতনার উন্মেষ শুধু একটা দিক থেকে হয় না। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা - 'স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়', কিংবা হেমেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা প্রভৃতি রচনাও আমাদের উদ্দীপিত করেছিল। বঙ্গভঙ্গের সময় রবীন্দ্রনাথের গান বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, আমাদের সমকালীন বিপ্লবীদের সমানভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। জালিয়ানবাগের হত্যাকাণ্ডের সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'নাইট' উপাধি বর্জন করেছিলেন।‌ আবার ১৯৩২-৩৩-এ হিজলী বন্দীনিবাসে গুলিচালনায় সন্তোষ মিত্র, তারকেশ্বর সিংহ প্রমুখ প্রাণ হারিয়েছিলেন।তখন অসুস্থ শরীরে রবীন্দ্রনাথ মনুমেন্টের নিচে আয়োজিত সভায় যোগ দিয়েছিলেন, আবার পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদের যখন অভ্যুদয় হয় তখন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- 'নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস'। কিংবা তাঁর জাপানের কবি নোগুচি, রোমারোঁলা প্রমুখকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লেখা চিঠি - এসব ঘটনা একদিকে যেমন আমায় বিপ্লবী আন্দোলনে প্রভাবিত করেছিল অন্যদিকে বিবেকানন্দের বাণী করেছিল উদ্বুদ্ধ।

 মার্কসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েও বিবেকানন্দের স্বাদেশিক চেতনা, মানুষের জন্য ভাবনা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মার্কসবাদের বস্তুবাদ বা Dialectical materialism দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং স্বাভাবিক ভাবেই ঈশ্বর চিন্তার প্রশ্ন এখানে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিবেকানন্দের স্বদেশ চিন্তার দিকটি আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।

সাম্প্রতিককালে বিবেকানন্দের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে বলতে হয় যে কোনো বড় ব্যক্তির জীবন কখনই কাল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় না। কতকগুলো জিনিস যা সমাজ গঠনে বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় যেমন নৈতিকতার দিকটি। সামাজিক বিকাশ কথার অর্থ এই নয় যে পুরানো মূল্যবোধকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলে নতুন মূল্যবোধের সৃষ্টি - যেমন শরৎচন্দ্রের ভাষা, রবীন্দ্রনাথের ভাষা, আধুনিক যুগের ভাষা-এর সৃষ্টি সেই বিদ্যাসাগরের গদ্য সাহিত্যের রচনাশৈলী থেকেই। তাই বলা যায় অতীতের ভিতরেই নিহিত থাকে বর্তমানের বীজ, আবার বর্তমানের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যতের বীজ। এইভাবেই চলতে থাকে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ। যেমন ইউরোপে যখন মার্কসবাদের অভ্যুত্থান হয় তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লেনিন  Three sources of Marxism-এর কথা বলেছিলেন অর্থাৎ তৎকালীন জগতে বিজ্ঞানের তিনটি ক্ষেত্রে, অর্থনীতিতে সবচেয়ে উন্নত ছিল ইংলন্ড।সেজন্য ইংলন্ডের Economic Science-এর উপর ভিত্তি করেই ওঁর Theory তৈরি হয়। জার্মানি ছিল দর্শনে সবচেয়ে উন্নত এবং যে দুজনের Theory-এর উপর ভিত্তি করে Dialectical Method Theory তৈরি করেন সেই দুজন হলেন দার্শনিক হেগেল ও দার্শনিক ফয়েরবাক্ । কিন্তু সেই বস্তুবাদ ছিল মেকানিক্যাল। সেই বস্তুবাদকে লেনিন অনেক উন্নত করলেন।

Source: Google

 আজকের দিনে সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সবচেয়ে বেশি অভাব দেখা দিয়েছে। মানুষের যেখানে সৎ, চরিত্রবান, সত্যবাদী,নির্লোভ হওয়ার কথা ছিল তার পরিবর্তে তারা উপরোক্ত মূল্যবোধগুলিকে বিসর্জন দিয়েছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আজকের দিনে বিবেকানন্দের প্রাসঙ্গিকতা বিশেষভাবেই প্রয়োজন। আমার বিরাশি বছরের জীবন উপলব্ধির সূত্রেই বিশেষভাবে বলতে চাই, মানুষের চরিত্রের Basic Qualities গুলির Development-এর প্রয়োজনে বিবেকানন্দের প্রাসঙ্গিকতা আজও আমাদের কাছে অপরিসীম।

*সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রচিত


শেয়ার করুন

উত্তর দিন