গত ৩ জানুয়ারি কলকাতার প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে গনশক্তি পত্রিকার ৫৭তম বার্ষিকী উপলক্ষে বক্তৃতা করেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাত। তার সেই বক্তব্যের সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ চারটি পর্বে রাজ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। আজ তারই তৃতীয় পর্ব।
হিন্দুত্বের এই উগ্র উৎকট ধারণাকেই জাতীয়তাবাদ বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে,হিন্দুরাই আসল ভারতীয় । এই বিকৃত জাতীয়তাবাদের ধারণাই ভারতের বেশিরভাগ জায়গায় এখন প্রকট। এই জাতীয়তাবাদ দেশের মধ্যেই শত্রু খুঁজে নেয়। ভারতে যেমন মুসলমান, খ্রীস্টান রা, তুরস্কে কুর্দরা, ব্রাজিলে আদি বাসিন্দারা, ইউরোপের ক্ষেত্রে অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীরা। এবং এই সব ডান ও অতিডানপন্থী দলগুলো তারা কখনোই পুঁজিবাদকে চ্যালেঞ্জ করে না, নব্য উদারপন্থীদের উৎখাত বা শেষ করার আহ্বান জানায়না। পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা নিয়ে তারা যা বলে তা হল আমাদের জনগণের সেবা করার জন্য আমরা এগুলো করছি, অন্য সম্প্রদায়েরর জন্য আমরা ভাবব না। তাই তাদের সবাই আসলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বা নিওলিবারাল ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। শ্রেণীগতভাবে তাদের মধ্যে কেউই পুঁজিবাদবিরোধী অবস্থান নেয় না, কেবলমাত্র জনসমর্থন জোগাড়ের প্রয়োজন পরলে তারা নানান আলঙ্কারিক শব্দে ভরিয়ে দেয়।
ভারতের দিকে তাকালে আমরা দেখবো একটি অতি দক্ষিণপন্থী দল সরকার চালাচ্ছে, যার নাম বিজেপি। কিন্তু দেশগুলোর থেকে ভারত আলাদা, এর একটা বিশেষত্ব আছে, বিজেপি কিন্তু আসল রাজনৈতিক দল নয়, এটা আসলে একটা মুখোশ, গোবিন্দাচার্য যেমন একসময় বলেছিল বাজপেয়ী আসলে ‘মুখোশ’। আরএসএস হল ঐ বিজেপি নামক মুখোশের আড়ালের মুখ । আপনারা যদি আরএসএস-এর আদর্শ, ওদের প্রচার পুস্তিকা,বই এগুলো পড়েন , যদিও বাংলায় কয়েক বছর আগেও এদের নিয়ে ভাবতে হত না, দুর্ভাগ্যবশত এখন ভাবতে হচ্ছে, ওদের সরসঙ্ঘ চালক বা প্রধান সে গোলওয়ালকার থেকে আজকের মোহন ভাগবত ;তারা যে ভাষায় কথা বলে তা বিংশ শতাব্দীর শুরুতে চরম ডানপন্থীদের ব্যবহৃত ভাষার কথা মনে করিয়ে দেয়। এর কিছুটা ফ্যাসিবাদী কিন্তু এটি শুধুমাত্র ফ্যাসিবাদী নয় এর কিছু অংশ জাতিগত তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে। অনেক লোক ছিল যারা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিভিন্ন জাতিগত তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিল, এখনও এরা সেই সব ধারণা, যেমন হিন্দুরা একটি জাতি এবং হিন্দুরা আর্য, আর্যরা ছিল
ভারতের আদিবাসী, তারা ভারতের বাইরে থেকে আসেনি - সমস্ত অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং তারপর ব্যতিক্রমবাদের কথায় আসে হিন্দুরা একটি ব্যতিক্রমী জাতি। এর পরেই তাদের দাবি হল ভারত হিন্দুদের মাতৃভূমি, অন্য গোষ্ঠী বা ধর্মের লোকেরা এই দেশে বহিরাগত। এই প্রকার ধারণাগুলো বিংশ শতকের গোড়ার দিকের অতি ডান, ফ্যাসিবাদী ধারণাগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। এরা এই দেশে ঐ ধারণাগুলোর ভারতীয়করণ করেছে ও ভারতের মত করে প্রযোগ করছে, একথা বলাই যায়। আরএসএস সমস্ত ভাবে রাষ্ট্র শক্তির ব্যবহার করছে নিজেদের মতবাদ ছড়াতে। ভুলে গেলে চলবে না মোদি ছিল আরএসএস-এর প্রচারক, যার অর্থ মোদি আরএসএস-এর সর্বক্ষণের কর্মী বা ক্যাডার ছিল। স্বয়ংসেবক আর প্রচারক আলাদা। স্বয়ংসেবক তার সময় সুবিধা মত আরএসএস-এর হয়ে কাজ করবে,স্বেচ্ছাসেবী, বাজপেয়ী ছিলেন আরএসএস- স্বয়ংসেবক। প্রচারকদের রীতিমত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাদের কঠোর অণুশাসনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একজন প্রচারক হতে হলে তিন বছরের অফিসার ট্রেনিং ক্যাম্প (OTC) সম্পূর্ণ করতে হবে। শেষ বছরের প্রশিক্ষণ নাগপুরে আরএসএস সদর দফতরে অনুষ্ঠিত হয়। এখন আরএসএস রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরেও এদের অনুপ্রবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং এদেশে আর বিষয়টা চরম দক্ষিণপন্থার উত্থান নয়, কারণ তারা ইতিমধ্যেই ক্ষমতায় রয়েছে, যেখান ইউরোপের এই ধরণের দলগুলো ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে, তার মতবাদের উত্থান ঘটানোর চেষ্টা চালচ্ছে। ইতালিতেও যে সরকার চলছে সেটাও একটা জোট সরকার একক ভাবে কোন ফ্যাসীবাদী দল ক্ষমতায় নেই।
ভারতের সাথে বরং এরদোয়ানের তুরস্কের তুলনা করা যেতে পারে। এই দুটো দেশে এরা একটা বড় সময় ধরে ক্ষমতায় আছে। এদের বা এই প্রজাতির দল, সংগঠনগুলোর সঠিক চরিত্র বিশ্লেষণ না করলে এদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রণনীতি রণকৌশল নির্ধারনে আমাদের ভুল হবে। ইউরোপে , যেমনটা আমি আগেই বলেছি, অনেক উন্নত একটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বহাল আছে, এখানে বিশ্বের পুঁজির বড় বড় সব কেন্দ্র- লন্ডন,প্যারিস, ফ্রাঙ্কফার্টের মত জায়গা গুলো আছে, আর নয়া উদারবাদের ধাক্কাটা তারা তিন দশকেরও আগে অনুভব করে ফেলেছে। ভারতের দুর্ভাগ্য এখানে ইতিমধ্যেই সাড়ে ৮ বছর এই রকম অতি দক্ষিণপন্থী সরকার চলছে। এই দলটা প্রমাণ করে দেখিয়েছে তারা তাদের পক্ষে জনতার এক বিপুল অংশকে একজোট করতে সক্ষম। অতি ডানপন্থা মূল ধারা হয়ে উঠছে। এখন ইউরোপে আলোচনা হচ্ছে কীভাবে একটা ছোট্ট উপাদান থেকে অতি ডানপন্থা হঠাৎ করে মূলধারার অংশ হয়ে উঠল। তাদের ভাষা, তাদের স্লোগান , তাদের রাজনীতি ক্রমশ মূলধারা হয়ে উঠছে।
আমাদের দেশে এটা ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে। আরএসএস-বিজেপি যাই বলে মিডিয়া তার প্রচার করে। কর্পোরেট মিডিয়া প্রতিদিন এদের মতবাদ, রাজনীতি, ঘৃণার রাজনীতি সমস্তটাই প্রচার করে চলেছে। এই উত্থানের পেছনের শ্রেনী রাজনীতিটাও আমাদের বুঝতে হবে। বিজেপি-আরএসএস এর সাথে ভারতের কর্পোরেটদের যোগসাজোশ রয়েছে, এই হিন্দুত্ব-কর্পোরেট আঁতাতের ফলেই বিজেপি আরএসএস বিপুল সাহায্য পাচ্ছে আর আধিপপত্যকারী শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে কংগ্রেসের সরকার বা আগের এনডিএ সরকার কারুর ক্ষেত্রেই ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়াদের মধ্যে এমন ঐক্য লক্ষ্য করা যায়নি- এটা একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। আমরা তো আম্বানি-আদানীর কথা হামেশাই বলে থাকি, এরা দুজনেই মোদির পছন্দের। কিন্তু গোটা ভারতীয় কর্পোরেট জগত এক বাক্যে বলে- এই সরকার ভালো সরকার, আমাদের পছন্দের সরকার। যেহেতু আরএসএস-বিজেপি বড় বড় ব্যবসায়ীদের পক্ষেই সওয়াল করে নির্লজ্জের মত বড় বুর্জোয়ারা বুঝে গেছে ফায়দা লোটার এটাই সঠিক সময়। জিএসটি এর জন্য ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে কিন্তু কর্পোরেটরা জিএসটি নিয়ে খুশি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বড় পুঁজিপতিরা এই সরকারকে সমর্থন করে, সেই ভাবেই এরা হিন্দুত্বের এ্যাজেন্ডাকেও সমর্থন করে কারণ এইরকম একটা স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাদের জন্য আদর্শ, তাদের সমস্ত স্বার্থ পূরণ হবে তাই তারা বিজেপি-আরএসএস কে সমর্থন করে। আর শাসক শ্রেনীর সবথেকে শক্তিশালী অংশের, বড় পুঁজিপতিদের, সমর্থনই বিজেপি-হিন্দুত্ব এ্যাজেন্ডার শক্তিশালী হওয়ার মূল চাবিকাঠি। এই নিয়ে বিশেষ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, যেকোন একটা নির্বাচনে বিজেপি যে বিপুল অর্থ-সম্পদের ব্যবহার করে তার ধারেকাছে কোন রাজনৈতিক দল আসতেই পারবে না। এই বিপুল সম্পদ তারা তাদের সংগঠন বাড়াতে,নিজেদের মতবাদের প্রচার চালাতে , মিডিয়াতে ব্যবহার করে থাকে। ভারতে অতি ডানপন্থার এটাই হল চরিত্র।
একে মোকাবিলা করতে গেলে সবার আগে, বিভিন্ন ডানপন্থী দল যেমন ভেবে থাকে কিছু রণকৌশল করে এমন একটা জোট করতে হবে যাতে বিজেপিকে হঠানো যায়, এমন ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে বিজেপি আরএসএস-এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত লড়াই করতে হবে। হ্যাঁ নির্বাচনী জোট করাই যেতে পারে কিন্তু শুধু ভোটের সময় এই শক্তি বিরুদ্ধে প্রচার করলে কোন লাভ হবে না, সংঘ যেভাবে সারা বছর ধরে তার বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে দিয়ে সমাজের ভেতরে কাজ করে চলে সেইটা আমাদের করতে হবে। স্কুল,সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আরএসএস কাজ করে চলে, আমাদেরকেও সেই রকম বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে যারা মানুষের কাছে আরএসএস বিরোধী, হিন্দুত্ববাদ বিরোধী মতাদর্শকে নিয়ে যাবে, কিন্তু সেটা যেন কখনই নেতিবাচক ভাবে নয়। আমাদের বামপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ,গণতান্ত্রিক আদর্শকে মানুষের সামনে তুলে ধরেই এই কাজ করতে হবে। এই জায়গায় আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি, এই মতাদর্শের সংগ্রাম অত্যন্ত জরুরি। পশ্চিমবঙ্গেও চিত্রটা খুব ভালো এমনটা মনে হয় না। ১৫ বছর আগে উড়িশ্যায় গিয়ে আমি পার্টি কমরেডদের কাছেই শুনেছিলাম সেই সময়তেই গোটা রাজ্যে আরএসএস ১০০০ এর বেশি স্কুল চালায়! শিশু মন্দির, সরস্বতী বিদ্যালয় এইসব নাম। ওরা এইভাবে নিরন্তর কাজ করে চলেছে সমাজের ভেতরে। ইতিমধ্যেই ভারতের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে উত্তর আর পশ্চিম ভারতে জনমানসে হিন্দুত্ববাদের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের চেতনার মধ্যে হিন্দুত্বের ধারণা গেঁথে গেছে, এটা যে সবসময় সচেতন ভাবে হয়েছে তা নয় কিন্তু এটাই বাস্তব। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনেই দেখা গেছে বাস্তবটা কী, বা সম্প্রতি ঘটে যাওয়া গুজরাটের নির্বাচনও দেখতে পারেন। সাংবাদিকদের সামনে মানুষ জিনিসপত্রের দাম বাড়া, বেকারত্ব,কৃষকদের সমস্যা এইসব নিয়ে বলেছেন কিন্তু ভোটে কী দেখা গেল ? বিজেপি দুটো রাজ্যেই বিপুল ভাবে জিতল, গুজরাটে ভোটের শতাংশও অনেকটা বাড়িয়ে নিয়েছে তারা। কোন প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা কাজ করল না। বিরোধীদের মধ্যে মনোমালীন্য বা তাদের একজোট হওয়া না হওয়ার ওপর এটা নির্ভরই করেনি। কারণ একটা বড় অংশের মানুষেরই হিন্দুত্বের আদর্শ দিয়ে মগজ-ধোলাই হয়ে গেছে ,তাই যাই হোক না কেন তারা মনে করে বিজেপিই তাদের আদর্শ রাজনৈতিক দল।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদ – সরিৎ মজুমদার