কার্ল মার্কস
মানবিকতার আন্দোলনকে পথ দেখায় এমন নীতিসমূহের এক সবচাইতে প্রগাঢ় অথচ চমৎকার অনুমানকারী যাকে সে চরম বিষয়ের চুক্তি বলে অভিহিত করে,তাকে প্রশংসা করতে চায় প্রকৃতির আধিপত্যকারী গোপনীয়তাগুলির একটি বলে। তার মতে ‘চূড়ান্ত এক জায়গায় মেলে’ এই ঘরোয়া প্রবাদটি জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে এক মহান ও শক্তিশালী সত্য। এ এমন এক স্বতঃসিদ্ধ যে দার্শনিকের একেবারেই কিছু করার নেই যেমন কেপলারের সূত্র বা নিউটনের মহান আবিস্কার নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কিছু বলার বা করার নেই।
‘চূড়ান্তদের চুক্তি’ এরকম এক সার্বজনীন নীতি কিনা, সে আলোচনা সরিয়ে রেখে এর এক চমৎকার ছবি দেখা যায় চিনের বিপ্লবের প্রয়োগ সভ্য বিশ্বের উপর খেয়াল করলে। এটা মনে হতে পারে খুবই আশ্চর্যজনক, এবং এক আপাতবিরোধী দাবি যে ইউরোপের মানুষের পরবর্তী অভ্যুত্থান ও সাধারণতন্ত্রের সাথে যুক্ত মুক্তি এবং সরকারের অর্থনীতি সম্ভবতঃ অনেক বেশি নির্ভরশীল যা এখন অমর সাম্রাজ্যে চলছে। একেবারে ইউরোপের বিপরীত। অন্য যে কোন রাজনৈতিক কারণ যার অস্তিত্ব এখন আছে তার তুলনায়। এমনকি রাশিয়য়ার ভীতিপ্রদর্শন ও তার ফলে ইউরোপ জুড়ে এক সাধারণ যুদ্ধের সম্ভাবনারও তুলনায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি আপাতবিরোধী নয়। এ ক্ষেত্রের সবদিক গভীর ভাবে বিবেচনা করলে তা সবাই বুঝতে পারবেন।

সামাজিক কারণ যাই হোক বা যে কোন ধর্মীয়,রাজবংশীয় শাসন চলুক অথবা যে কোন জাতীয়তাবাদ তারা গ্রহণ করুক,তা বিগত দশ বছর ধরে চিনে এক ক্রমান্বয় বিদ্রোহোর জন্ম দিয়েছে যা এখনো চলছে। এখন তা একত্রিত হয়ে এক শক্তিশালী বিপ্লবের সম্ভাবনা তৈরী করেছে। যার ফেটে পরার ঘটনার জন্য প্রশ্নাতীত ভাবে ইংরেজ কামান দায়ী। চিনকে যা বাধ্য করেছে নেশার ওষুধ আফিম গ্রহণ করতে। ব্রিটিশ অস্ত্রের কাছে মাঞ্চু রাজবংশ খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়েছে। অমর সাম্রাজ্যের অনন্তকাল টিঁকে থাকার অন্ধ কুসংস্কারজনিত বিশ্বাস ভেঙ্গে পড়েছে। সভ্য বিশ্ব থেকে বর্বরোচিত ও সম্পূর্ণ ভাবে অবরুদ্ধ করে পৃথক করেছে। একই সাথেএক সু্যোগ তৈরী করা হয় সেই সঙ্গমের জন্য যা ক্যালিফোর্নিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার সোনার সু্যোগের নীচে থেকে এতো দ্রুত অগ্রসর হয়েছে। একই সাথে সাম্রাজ্যের জীবনের রক্তপ্রবাহ, এর রৌপ্য মুদ্রা চলে যেতে থাকে ব্রিটিশ পূর্ব-ভারতে।
১৮৩০ সাল অবধি বাণিজ্যের ভারসাম্য সবসময়েই চিনের পক্ষে ছিলো। ভারত,ব্রিটেন ও ইউনাইটেড স্টেট থেকে কোন রকম বাধা ছাড়াই চিনে রূপার আমদানি অব্যাহত ছিলো। ১৮৩৩ থেকে,বিশেষ করে ১৮৪০ থেকে চিন থেকে ভারতবর্ষে রূপার রপ্তানী,স্বর্গীয় সাম্রাজ্যের পক্ষে কার্যতঃ ক্লান্তিকর হয়ে যায়। তাই আফিম বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সম্রাটের কঠোর নির্দেশাবলী জারি হয়। তার নেওয়া ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে তখনো পর্যন্ত শক্তিশালী প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়নি। এই তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক ফলাফল ছাড়াও আফিমের চোরাচালানের সাথে যুক্ত ঘুষের কারবার দক্ষিণের প্রদেশগুলিতে চিনের সরকারীআধিকারিকদের নৈতিক ভাবে দুর্বল করে ফেলে। চিনের সম্রাট যেমন নিজেকে গোটা চিনের পিতা হিসাবে বিবেচিত হোন,এটা চাইতেন,তার আধিকারিকরাও নিজ নিজ জেলায় একই রকম পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্কে বিশ্বাসী ছিলেন। রাষ্ট্রের বিশাল ব্যবস্থাপনাকে একমাত্র যে নৈতিক সূত্র জড়িয়ে ছিলো তা হোল এই পিতৃতান্ত্রিক ধারণা। কিন্তু তাও ক্রমে নষ্ট হয়ে যায় এই আধিকারিকদের জন্য যারা আফিমের চোরাচালনের ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত থেকে বিপুল ভাবে লাভবান হয়েছেন। মূলতঃ এটা ঘটে দক্ষিণের প্রদেশগুলিতে যেখানে বিদ্রোহ হয়েছিলো। এ কথা বলা বাহুল্য,যে মাত্রায় আফিম চিনে সার্বভৌমত্ব অর্জন করে,সম্রাট ও তার পাণ্ডিত্যাভিমানী রাজকর্মচারীরা সেই মাত্রায় তাদের নিজস্ব সার্বভৌমত্ব হারাতে থাকে। এরকম মনে করা যেতেই পারে ইতিহাস সবার আগে এই মানুষদের নেশাগ্রস্থ করেছে,তারপর তাদের প্রজন্মগত ভাবে প্রাপ্ত বোকামি থেকে তুলে বিতাড়িত করেছে।
ইংল্যাণ্ডের তুলো ও খুব কম পরিমাণে ইংল্যাণ্ডের পশমের অস্তিত্ব আগে খুবই কম ছিলো। এর আমদানি ১৮৩৩ সাল থেকে দ্রুত বেড়ে যায়। এটা সেই সময় যখন চিনের সাথে একচেটিয়া বাণিজ্যের ভার ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্যক্তি বাণিজ্যে হস্তান্তরিত হয়। এটা ১৮৪০ থেকে আরো বাড়ে যে সময় অন্যান্য জাতি(দেশ) বিশেষ করে আমাদের দেশ (এখানে আমাদের বলতে মার্কস জার্মানীর কথা বলছেন মনে হয়--অনুবাদক) চিনের বাণিজ্যের এক অংশ লাভ করে। বিদেশী যন্ত্রপাতির প্রচলন দেশীয় শিল্পের উপর একই প্রভাব ফেলে যে প্রভাব পড়েছিলো এশিয়া মাইনর, পার্শিয়া ও ভারতবর্ষের উপর। বিদেশী প্রতিযোগিতার মুখে চরকা ও তাঁত শিল্পীরা খুবই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই সম্প্রদায় জনসংখ্যার অনুপাতে ছড়িয়ে ছিটে পড়ে।
আফিমের মহান অনুৎপাদক ব্যবহার,এই বাণিজ্যে মূল্যবান ধাতুর অপচয়,দেশীয় কারিগরদের উপর বিধ্বংসী বিদেশী প্রতিযোগিতা ও সরকারী প্রশাসনের বিধ্বস্ত মনোভাবের জন্য দূর্ভাগ্যজনক যুদ্ধের জন্য ইংল্যাণ্ডের সম্মান প্রাপ্য। দুটি ঘটনা এর ফলে ঘটে: পুরোন কর ব্যবস্থা অসহনীয় ও হয়রানিকর হয়ে ওঠে। এর সাথে যুক্ত হয় নতুন কর। ১৮৫৩ সালের ৫ জানুয়ারী পিকিং থেকে প্রচারিত সম্রাটের এক ডিক্রিতে আমরা দেখি দক্ষিণের ভাইসরয় ও গর্ভনরদের, Wu-chang ও Hang--Yang, বলা হচ্ছে কর দেওয়ায় ছাড় দিতে বা কর দেওয়ার দিন পিছিয়ে দিতে। কোন ক্ষেত্রেই সাধারণ ভাবে যা দেওয়া কথা তার থেকে বেশি না নিতে। অন্যথায় ডিক্রি বলছে ‘আর তাই সাধারণ ভাবেই এই কষ্টের ও শ্রান্তির সময়ে সম্ভবতঃ আমার প্রজাদের কর সংগ্রাহকদের থেকে আতঙ্কমুক্ত রাখতে হবে, তাদের কর আদায়ের জন্য পিছনে তাড়া করতে হবে না’।
এরকম ভাষা আর এই ধরণের ছাড় আমরা স্মরণ করতে পারি ১৮৪৮ সালে অস্ট্রিয়াতে, জার্মানীতে।
অর্থনৈতিক, নৈতিক, শিল্প ও রাজনৈতিক কাঠামো- সমস্ত ধরণের ক্রমশঃ ক্ষয়প্রাপ্ত সংস্থাগুলি একসাথে তাদের পরিপূর্ণ বিকাশ প্রাপ্ত হয় ১৮৪০ সালে ইংরেজ কামানের নীচে। যা সম্রাটের কর্তৃত্ব ভেঙ্গে দেয় এবং স্বর্গীয় সাম্রাজ্যকে ভূমিস্থ পৃথিবীর সংস্পর্শে আসতে বাধ্য করে। পুরোন চিনের সংরক্ষণের প্রাথমিক শর্ত ছিলো সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা। ইংল্যাণ্ডের মাধ্যমে এই বিচ্ছিন্নতার এক হিংস্র অবসান ঘটে। মমি বায়ুরুদ্ধ ভাবে বন্ধ করা থাকে। তা মুক্ত বাতাসের সংস্পর্শে এলেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। নিশ্চিতভাবেই ঠিক তেমনি এই বিচ্ছিন্নতা ধ্বংস হয়ে যায়। এখন চিনে এই বিপ্লব ইংল্যান্ড আবাহন করে এনেছিলো। প্রশ্ন হোল এই বিপ্লব সময়ান্তরে কি ভাবে ইংল্যান্ডের উপর ও ইংল্যাণ্ডের মাধ্যমে ইউরোপের উপর প্রভাব বিস্তার করবে। প্রশ্নটা খুব কঠিন না। প্রায়শঃই আমাদের পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় ১৮৫০ সাল থেকে ব্রিটিশ উৎপাদনের অতুলনীয় উন্নতির দিকে। সবচাইতে আশ্চর্যজনক সমৃদ্ধির মধ্যে ক্রমশঃ এগিয়ে আসা এক শিল্প সংকটের পরিস্কার সংকেতও লক্ষ্য করা কঠিন না। ক্যালিফোর্নিয়া ও অস্ট্রেলিয়া সত্ত্বেও,বিপুল ও অভূতপূর্ব দেশত্যাগ সত্ত্বেও,কোন নির্দিষ্ট দুর্ঘটনা ছাড়াই, ঠিক সময়ে সেখানে নিশ্চিত ভাবে এক মূহুর্ত তৈরী হবে যখন বাজারের বিস্তৃতি অক্ষম হবে ব্রিটিশ উৎপাদনের বিস্তৃতির গতির সাথে সমপদক্ষেপ করতে। এই অসামঞ্জস্য নিশ্চিত ভাবেই এক নতুন সংকট ডেকে আনবে একই নিশ্চয়তার সাথে,অতীতে যা সে করেছে। কিন্তু যদি একটা বৃহৎ বাজার হঠাৎ সংকুচিত হয়ে যায়, সংকটেরআবির্ভাব আবশ্যিক ভাবে ত্বরান্বিত হয়। এখন চিনের বিদ্রোহ নিশ্চিতভাবেই কিছু সময়ের জন্য ইংল্যাণ্ডের উপর একই অভিঘাত তৈরী করেছে। ব্রিটিশদের চা এর উপর কর কমে যাওয়ার অন্যতম মূল কারণ হোলনতুন বাজার খোলার আবশ্যিকতা অথবা পুরোনো বাজারের বিস্তৃতি অর্থাৎ চা আমদানির বৃদ্ধি ও চিনে ব্রিটিশ উৎপাদিত যন্ত্রের রপ্তানী। ব্যাবসা করার জন্য ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার ১৮৩৩ সালে কেড়ে নেবার আগে,ইউনাইটেড কিংডমের চিনে রপ্তানীর পরিমাণ ছিলো মাত্র ৬০০,০০০ পাউণ্ড;১৮৩৬ সালে তা পৌঁছায় ১,৩২৬,৩৮৮ পাউণ্ড;১৮৪৫ সালে এটা বৃদ্ধি পেয়ে পৌঁছায় ২,৩৯৪,৮২৭ পাউণ্ডে;১৮৫২ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩,০০০,০০০(সবই মুদ্রায়)। চিন থেকে আমদানি করা চা' এর পরিমাণ ১৭৯৩ সালে ১৬,১৬৭,৩৩১ পাউন্ড ছাড়ায়নি। কিন্তু ১৮৪৫ সালে এটার পরিমাণ হয় ৫০,৭১৪,৬৫৭ পাউণ্ড। ১৮৪৬ সালে ৫৭,৫৮৪,৫৬১ পাউণ্ড; এখন এর পরিমাণ ৬০,০০০,০০০ পাউণ্ড (সব ওজনে)।
গত মরশুমে চা শষ্যের ফলন কমেনি, তা প্রমাণিত। যা বোঝা যায় সাংহাই এর আগের বছরের রপ্তানির তালিকা থেকে ২,০০০,০০০ পাউণ্ড (ওজনে)। এই অতিরিক্তটিকে ব্যাখ্যা করতে হবে দুটি ঘটনা দিয়ে। একদশকে ১৮৫১ সালে বাজার বন্ধ হবার সময় এটা মন্দার মুখোমুখি, তাই বৃহৎ অতিরিক্ত পড়ে থাকা মালকে ১৮৫২ সালে রপ্তানীর জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে চা রপ্তানি সংক্রান্ত ব্রিটিশ সংসদের শেষতম সংশোধিত হিসেবনিকেশ দেখাচ্ছে,চিনে পৌঁছে,সমস্ত চা কে এক প্রস্তুত বাজারে জড়ো করা হয়েছে এক বিশাল বেশি দামে বিক্রির জন্য। কিন্তু আমদানিকৃত শষ্যের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি একটু আলাদা ঠেকছে। লণ্ডনে অবস্থিত এক বৃহৎ চা ফার্মের চিঠিপত্রের থেকে সংগৃহীত নির্যাস থেকে এটা পাওয়া যায়:
‘সাংহাইতে অবস্থা ভয়ংকর। সোনার দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। যার ফলে তাকে জমিয়ে রাখার বাসনা উদগ্র। রূপা অদৃশ্য। ফলে কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না চিনের জাহাজের প্রাপ্য মেটানোর জন্য যা বন্দরের অনুমতির জন্য দরকার। এর ফলাফল হিসাবে মিস্টার আলকক নিজে চিনের কর্তৃপক্ষের কাছে এই বকেয়া পরিশোধের জন্য দায়িত্ব নিয়েছেন। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বিলের রসিদ অথবা অন্যান্য অনুমোদিত জামানতের ভিত্তিতে। বাণিজ্যের এই মূহুর্তের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে মূল্যবান ধাতুর দুষ্প্রাপ্যতা সবচাইতে প্রতিকূল পরিস্থিগুলির একটি। এই প্রত্যাহার নির্দিষ্টভাবে সেই সময় ঘটছে যখন তাদের ব্যবহার সবচাইতে জরুরী। চা ও সিল্ক ক্রয়কারীদের যখন দেশের মধ্যে যেতে হবে,তাদের কেনা সম্পূর্ণ করতে হবে। তার জন্য এক বড়ো অংশের দুষ্প্রাপ্য ধাতুর বাট তাদের অগ্রিম দিতে হবে যাতে উৎপাদকেরা তাদের প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে পারে।’
বছরের এই সময় নতুন চা"য়ের জন্য সাধারণ ভাবে ব্যবস্থা শুরু করা হয়। কিন্তু এখন, যখন সমস্ত বিনিময় স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছে,কোন কথাই হচ্ছে না কেবলমাত্র ব্যক্তি আর সম্পত্তির সুরক্ষা ছাড়া।
‘......এপ্রিল আর মে মাসে চা পাতার, যা প্রাথমিক ফসল, নিশ্চিতকরণের জন্য ব্যবস্থাপনা যদি না করা যায়, যার মধ্যে থাকে কালো ও সবুজ চা’য়ের সবচাইতে ভালো ধরণগুলি, তাহলে ফসল নষ্ট হবে যেমন হয় ক্রিসমাসের সময় নষ্ট হয়ে যাওয়া গমের মতন।’
চিনা সাগরে দাঁড়িয়ে থাকা ইংরেজ,আমেরিকান বা ফরাসী স্কোয়াড্রন নিশ্চিত ভাবেই চা পাতা জোগাড়ের রসদ জোগাবে না। বরং তারা তাদের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এমন সমস্যাবলী তৈরী করবে যে চা উৎপাদনকারী দেশের অভ্যন্তরের সাথে চা রপ্তানী কারক সমুদ্র বন্দরের দেওয়া নেওয়া বন্ধ হয়। তাহলে বর্তমান শস্যের দাম বৃদ্ধি প্রত্যাশিত। লণ্ডনে জল্পনা শুরু হয়ে গেছে-এক বড়ো পরিমাণের চা যে কম আসবে তা নিশ্চিত। এটাই সব নয়। বিপ্লবী ঝটকার সময় সমস্ত মানুষের মতোই চিনের মানুষেরা,সম্ভবতঃ তারা প্রস্তুতই ছিলো,বিদেশীদের কাছে তাদের কাছে থাকা সমস্ত ভারী সামগ্রী বিক্রি করে দিতে প্রস্তুত। পাশাপাশি প্রাচ্যের মানুষজন বড়ো পরিবর্তনের সময় যা করতে অভ্যস্থ,সেরকমই তারা প্রস্তুত মুদ্রা মজুত করে রাখতে। তারা তাদের চা ও দুধের বিনিময়ে বেশি কিছু চায় না। মুদ্রা ছাড়া। সেই অনুযায়ী ইংল্যাণ্ডকে প্রস্তুত থাকতে হবে। তার উপভোগ করার মূল সামগ্রীর মধ্যে একটির দাম বৃদ্ধির জন্য। প্রস্তুত থাকতে হবে মূল্যবান ধাতুর মুদ্রার নিস্কাশনের জন্য ও তার সূতো এবং উলের সামগ্রীর বাজারের এক বড়ো সঙ্কোচনের জন্য। এমনকি বাণিজ্য গোষ্ঠীর শান্ত মনকে হুমকি দেয় এমন সব কিছুর বিরুদ্ধে-- আশাবাদী যাদুকর ইকনমিস্ট এই ভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে:
‘আগেকার মতন চিনে আমাদের রপ্তানীর এতো বিস্তৃত বাজার আমরা খুঁজে পাবো এটা ভেবে আমাদের নিজেদের নিজেকে স্তুতিবাক্য নিশ্চিত ভাবেই শোনান উচিত না। ....সুতরাং এটা খুবই সম্ভব চিনে আমাদের রপ্তানী বাণিজ্য মার খাবে,ম্যাঞ্চেস্টার ও গ্লাসগোতে উৎপাদিত সামগ্রীর চাহিদা সঙ্কুচিত হবে।’
এটা কখনো ভোলা উচিত হবে না যে চা'এর মতন অপরিহার্য সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি ও চিনের মতন এতো গুরুত্বপূর্ণ বাজারের সঙ্কোচন সমাপতিত হবে পশ্চিম ইউরোপে কম ফসল উৎপাদনের সাথে। তার ফলে দাম বৃদ্ধি হবে মাংস,শস্য ও অন্যান্য কৃষিজ উৎপাদনের। সুতরাং উৎপাদকদের জন্য সংকুচিত বাজার। কারণ জীবনের প্রাথমিক আবশ্যিক সামগ্রীর প্রত্যেক দাম বৃদ্ধি, দেশে ও বিদেশে, সমতা আনয়ন করে সংশ্লিষ্ট উৎপাদিত দ্রব্যের চাহিদা সঙ্কুচিত হয়ে। বেশির ভাগ শস্যের পিছিয়ে ৎাকা অবস্থা সম্পর্কে গ্রেট ব্রিটেনের প্রত্যেক অংশ থেকে অভিযোগ আসছে। এই বিষয়ে ইকনোমিস্ট বলছে:
দক্ষিণ ইংল্যাণ্ডে ‘কেবল মাত্র অনেক জমিতে চাষ হয়নি এমন না, যে কোন শস্যের জন্যেও অনেক দেরী হয়ে গেছে। বেশিরভাগ চষা জমি খারাপ প্রমাণিত হবে অথবা শস্য উৎপাদনের জন্য খারাপ অবস্থায় আছে।’
গমের জন্য নির্ধারিত ভেজা আর খারাপ জমি ইঙ্গিত দেয় যে স্পষ্ট বদমাইশি চলছে। ‘mangel-wurzel চাষ করার সময় বলা যায় পেরিয়ে গেছে আর খুবই কম বীজ পোঁতা হয়েছে। শালগমের জন্য জমি তৈরীর কাজ দ্রুত কমে আসছে, এই গুরুত্বপূর্ণ শষ্যের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই। ....ওট চাষ খুবই বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বৃষ্টি ও তুষারপাতের জন্য। আগে সামান্য ওট চাষ হয়েছে, কিন্তু পরে এর চাষ সামান্যই ফলন দেয়।’
অনেক জেলাতেই প্রজনন ঝাঁকের ক্ষতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণের। ভুট্টার তুলনায় ফার্মে উৎপাদিত অন্যান্য সামগ্রীর দাম ২০-৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি। গত বছরের থেকে বেশি। মহাদেশে ভুট্টা ইংল্যাণ্ডের তুলনায় বেশি উঠেছে। বেলজিয়াম ও হল্যাণ্ডে সরষের উৎপাদন ১০০ শতাংশ বেড়েছে। গম ও অন্যান্য দানা শষ্যেরও অবস্থা একই।
এই অবস্থায় যেহেতু নিয়মিত বাণিজ্য চক্রের বড়ো অংশ ইতিমধ্যেই ব্রিটিশ বাণিজ্য দ্বারা পরিচালিত, নির্ভয়ে এ কথা বলা যায় যে চিন বিপ্লব বর্তমান শিল্প ব্যবস্থার অত্যধিক বোঝা সম্পন্ন খনিতে এক বিদ্যুৎ ঝলক নিক্ষেপ করবেই। কারণ হবে দীর্ঘদিন ধরে তৈরী হওয়া সাধারণ সংকটের বিস্ফোরণের। যা ছড়িয়ে পড়বে সীমানা ছাড়িয়ে। খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে তাকে অনুসরণ করবে মহাদেশের রাজনৈতিক বিপ্লব। এ এক কৌতূহলদ্দীপক দৃশ্য হবে,যে চিন পশ্চিমী বিশ্বে বিশৃঙ্খলা তৈরী করছে যখন ইংলিশ ফরাসী ও আমেরিকান যুদ্ধ স্ট্রীমার গুলি সাংহাই,ন্যানকিং ও গ্রেট ক্যানালের মুখে ‘নিয়ন্ত্রন’ সংক্রান্ত নির্দেশ জানাচ্ছে। কাঁপতে থাকা মাঞ্চু বংশকে সমর্থন করার চেষ্টা করতে থাকা এই নিয়ন্ত্রণ লোভী শক্তিগুলি কি ভুলে গেছে যে একদা চিনের ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতির জন্য বিদেশীদের প্রতি ঘৃণা ও সাম্রাজ্য থেকে তাদের বহিস্কার এক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে,মাঞ্চু তাতার জাতি দেশকে জয় করে নেবার পর? এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে চিনের সাথে বাণিজ্যের প্রশ্নে যারা পরষ্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী সেই ইউরোপীয়ানদের মধ্যেকার অশান্ত অনৈক্য, এক শক্তিশালী সাহায্য জুগিয়েছিলো মাঞ্চুদের একচেটিয়া নীতি গ্রহণে। কিন্তু এর থেকেও বেশি এটা করা হয়েছিলো নতুন রাজবংশের ভয়ে। পাছে তাতারদের কাছে,প্রথম অর্ধ শতাব্দীতে এক বড়ো অংশের চিনের মানুষের বশ্যতা স্বীকারের অসন্তোষের সু্যোগ বিদেশিরা না নেয়। এই সব বিবেচনা থেকে বিদেশিদের চিনের মানুষের সাথে কোন রকম যোগাযোগ থেকে দূরে রাখা হয়েছিলো। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলো ক্যান্টন। ক্যান্টন শহর পিকিং এবং চা তৈরী হয় এমন জেলাগুলি থেকে অনেকদূর। তাদের বাণিজ্যকেবল মাত্র হয় বণিকদের সাথে। তা সরকারী লাইসেন্স প্রাপ্ত। এটা করাই হয়েছিলো ঘৃণ্য অপরিচিতদের থেকে সাম্রাজ্যের প্রজাদের দূরত্ব বজায় রাখার জন্য। যাই হোক পশ্চিমী সরকারগুলির পক্ষ থেকে এই সময় কোনোরকম হস্তক্ষেপ বিপ্লবকে আরো প্রবলতর করে তুলবে এবং বাণিজ্যের স্থবিরতাকে আরো বাড়াবে।
একই সাথে ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে এই দেশের ব্রিটিশ সরকার তার রাজস্বের সাত ভাগের এক ভাগের উপর নির্ভরশীল চিনে আফিম বিক্রির উপর। যখন ব্রিটিশ উৎপাদনের এক উল্লেখযোগ্য অংশ নির্ভর করে ভারতে আফিমের উৎপাদনের উপর। এ কথা সত্যি,জার্মানরা যেমনভাবে তামাক পরিত্যাগ করেছে,চিনের মানুষ ঠিক ওই ভাবে আফিম পরিত্যাগ করেনি। কিন্তু জানা যাচ্ছে নতুন সম্রাট পোস্তদানার সংস্কৃতি ও চিনে নিজের থেকে আফিম তৈরীর পক্ষে। ফলে এটা নিশ্চিত ভারতবর্ষে আফিম চাষের উপর এক বড়ো ভয়ংকর আঘাত আসতে চলেছে,আঘাত আসতে চলেছে ভারতবর্ষের রাজস্বের উপরও, হিন্দুস্থানের বাণিজ্যিক রসদের উপর। যদিও যাদের যাদের স্বার্থ নিহিত তারা এক্ষুনি এই আঘাত অনুভব করবেন না,ঠিকঠাক সময়ে এটা মসৃণ ভাবে কাজ করবে। এটা তীব্র ভাবে কাজ করবে এবং দীর্ঘায়িত করবে সর্বজনীন আর্থিক সংকটকে যার ভবিষ্যৎ আমরা আগেই বর্ণনা করেছি।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকে ইউরোপে এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব হয়নি যার অগ্রগামী হয়নি কোন না কোন বাণিজ্যিক বা আর্থিক সংকট। এটা ১৭৮৯ সালের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য,একই ভাবে প্রযোজ্য ১৮৪৮ সালের ক্ষেত্রেও। এটা হোল আমরা প্রতিদিন শাসক ক্ষমতা আর তার প্রজা-রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যেকার সংঘর্ষের সম্ভাবনায় আতঙ্কগ্রস্থ ক্ষমতায় আসীন শক্তিগুলির মধ্যেকার সংঘর্ষ যা এতো উচ্চতায় যেতে পারে যে তরোয়াল কোষ থেকে নিষ্কাশিত হতে পারে এবং প্রিন্সদের চূড়ান্ত অনুপাতের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। ইউরোপের রাজধানীগুলিতে প্রত্যেকদিন বড়ো খবর হচ্ছে সর্বজনীন যুদ্ধের। যা পরের দিন এক সপ্তাহ বা এইরকম সময়ের জন্য শান্তির আশ্বাসের খবরে মুছে যাচ্ছে। এতৎসত্ত্বেও আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি ইউরোপীয়ান ক্ষমতাগুলির মধ্যেকার সংঘর্ষ যে উচ্চতায় উঠুক না কেন,যতই আতঙ্কজনক পরিপ্রেক্ষিত কূটনৈতিক দিগন্তে প্রকাশিত হোক,এই দেশ বা অন্য দেশে কিছু উৎসাহী গোষ্ঠীর দ্বারা যে কোন আন্দোলনের প্রচেষ্টা করা হোক না কেন,প্রিন্সদের রাগ আর মানুষের ক্রোধ একইরকম ভাবে সমৃদ্ধির প্রশ্বাস দ্বারা উদ্দীপিত। না যুদ্ধ না বিপ্লব,কোন কিছুইতেই ইউরোপ কর্ণপাত করবে না,যতক্ষণ না পর্যন্ত এক সাধারণ বাণিজ্যিক ও শিল্প সংকটের ফলাফলের সে মুখোমুখি হয়। স্বাভাবিকভাবেই তার ইঙ্গিত বিশ্ববাজারে ইউরোপীয়ান শিল্পের প্রতিনিধি হিসাবে ইংল্যাণ্ডকেই দিতে হবে।
এই সময়ে এই ধরণের সংকটের ফলে উদ্ভুত রাজনৈতিক ফলাফল নিয়ে আলোচনা অর্থহীন; যখন ইংল্যাণ্ডে কোন রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই,এই রকম মাত্রায় ইংল্যাণ্ডে কারখানার প্রসারণ ঘটছে; সম্পূর্ণ ভাবে বিলুপ্ত হচ্ছে সরকারী পার্টিগুলি; ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা পরিণত হচ্ছে প্রতারণামূলক শেয়ারের দালালচক্রে; যখন অস্ট্রিয়া দেউলিয়া হওয়ার মুখে, যখন সর্বত্র অন্যায়, যার প্রতিশোধ নেবে মানুষ। প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলি তাদের পরস্পরবিরোধী স্বার্থের জন্য আর বিশ্বের কাছে রাশিয়া জয় করার স্বপ্নের পরিকল্পনা আর একবার উন্মোচিত হবে।
১৪ জুন, ১৮৫৩- নিউ ইয়র্ক প্রাত্যহিক ট্রিবিউনে প্রকাশিত প্রবন্ধ
সুত্রঃ চিন সম্পর্কিত কার্ল মার্কসের প্রবন্ধাবলী (১৮৫৩-১৮৬০)
ভাষান্তরঃ গৌতম গাঙ্গুলি
ব্যবহৃত ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সংগৃহীত