কাকাবাবু স্মরণে
বিনয় চৌধুরী
কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গনশক্তি পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সেই বিশেষ সংখ্যায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র অনেক নেতৃত্বই মুজফ্ফর আহ্মদ স্মরনে লিখেছিলেন। সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ওয়েবডেস্কের পক্ষে সেই লেখাগুলির মধ্যে থেকে কয়েকটি আজ কাকাবাবুর ১৩৩তম জন্মদিবসে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হল।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান নেতা মুজফ্ফর আহ্মদের নাম ১৯২৯ সাল থেকেই – মামলার যেসব বিবরণী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তখন প্রকাশিত হতো তার মারফত আমার মনে এক গভীর শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাছাড়া আমার দূর সম্পর্কের দাদা অবনীর চৌধুরী হালিম সাহেব প্রমুখদের সাথে ঐ সময় হতেই যুক্ত থাকায় এবং তার কাছ থেকে মাঝে মাঝে যে খবরা-খবর পেতাম তাতে এই শ্রদ্ধা দিনে দিনে বাড়তে থাকে। ইতিমধ্যে ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের সাথেও আমরা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসি। ভূপেন দা’র সাথে কথাবার্তায় বুঝি তিনিও কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদকে খুবই শ্রদ্ধা করেন তার আন্তরিকতা, বিপ্লবী নিষ্ঠা ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতার জন্য। এই সব মিলে কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের প্রতি আমার আকর্ষণ ক্রমশ বাড়তে থাকে।
১৯৩৩ সালে মে মাসের প্রথমে গ্রেপ্তার হই এবং ১৯৩৮ সালের অক্টোবর মাসে জেল থেকে ছাড়া পাই। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকার সময়ে, প্রায়ই হালিম সাহেব, সরোজ, হুদা সাহেব গ্রেপ্তার হয়ে আসতেন এবং ওদের সাথে যোগাযোগ হতো। জেলে তখন ‘কমিউনিস্ট কনসলিডেশনের’ কাজ চলত, আমি তার সাথে যুক্ত হয়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল, রাজশাহী সেন্ট্রাল জেল ও দমদম সেন্ট্রাল জেলে ‘মার্ক্সিস্ট স্টাডি সার্কেল’ পরিচালনা করতাম। ১৯৩৮ সালে অক্টোবরে জেল থেকে বেরিয়ে এসে সর্বপ্রথম কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের সাথে সাক্ষাৎ করি এবং তখনই আমি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ পাই। সেই সময়েই তার সাথে আমার ভবিষ্যৎ কাজকর্ম সম্বন্ধে আলোচনা হয়। আমি জানাই আমি আসানসোল শিল্পাঞ্চলে কাজ করতে চাই। তিনি বলেন ঠিক আছে। ওখানে তখন কোলিয়ারি অঞ্চল থেকে কমরেড বঙ্কিম মুখার্জি নির্বাচিত হয়েছেন। এই নির্বাচন উপলক্ষে কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ বেশ কিছুদিন আসানসোলে ছিলেন এবং নির্বাচনের পর কমরেড নিত্যানন্দ চৌধুরীকে ওখানে পাঠানো হয়। রানীগঞ্জ কাগজকলে তখন ইউনিয়ন গঠিত হয়। শহীদ সুকুমার ব্যানার্জি এই ইউনিয়নে সহ সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন। নিত্যানন্দ চৌধুরী ছিলেন সম্পাদক, কমরেড বঙ্কিম মুখার্জি ছিলেন সভাপতি এবং আব্দুল মোমিন ছিলেন সহ-সভাপতি। এছাড়াও তখন বার্নপুর ইস্পাত কারখানায় যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য চেষ্টা চলছিল। তখনকার ওই অঞ্চল সম্পর্কে মোটামুটি ওয়াকেফহাল করে দিয়ে তিনি আমাকে ওই অঞ্চলে কাজ করার অনুমতি দিলেন। এই সময়ে অনুভব করি একজন দক্ষ সংগঠক হিসাবে – প্রত্যেক নেতা ও কর্মী সম্বন্ধে তিনি সব খবর পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে রাখতেন এবং সব বিষয় বিবেচনা করে সঠিক উপদেশ দিতেন। এরপর আমার যতদূর স্মরণ আছে ১৯৩৪ সালের শেষে অথবা ১৯৪০ সালের প্রথম দিকে বীরভূম জেলা কৃষক সম্মেলন হয় মল্লারপুরে। কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ ও আমি ওই সম্মেলনে যাই। তখন ওখানে পার্টিগত কিছু সমস্যাও ছিল। তিনি রাত্রে ওখানে ওখানকার নেতৃস্থানীয় কমরেডদের সাথে আলোচনা করে সে সমস্যার মীমাংসা করেন। ওই সময়ের আলোচনায় দেখেছি তিনি সমস্যার যতই জটিল হোক তার মূল সূত্রটি খুঁজে বার করতে পারতেন; তাই সমাধানও সম্ভব হতো।
এরপর আমার যতদূর মনে পড়ে, ১৯৪০ সালের গোড়ার দিকেই কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের আন্ডার গ্রাউন্ডে যাওয়া ঠিক হয়। ব্যবস্থা হয় তিনি প্রথমে কমরেড শাহেদুল্লাহর বাড়ি এসে উঠবেন। সেখান থেকে তাকে আবার সরিয়ে গোপনে নবদ্বীপ পৌঁছে দিতে হবে। সেই অনুযায়ী তিনি এসে কমরেড শাহেদুল্লাহর বাড়িতে উঠলেন। বাড়ির সামনে আই বি পাহারা বসলো। গোপনে সব বন্দোবস্ত করে রাত্রের দিকে শাহেদুল্লাহদের বাড়ির পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে খানিকটা গলির মধ্যে একটা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড় করানো ছিল, তাতে চাপিয়ে তাকে সেখান থেকে নিয়ে গিয়ে ২-৩ বার যান পরিবর্তন করে নবদ্বীপ পৌঁছে দেওয়া হল। এর কিছুদিন বাদে আমিও আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যাই। ৪০ হতে ৪২ সালে মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে এই সময়ে তার আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনের বিভিন্ন দিক ও শৃঙ্খলাবোধ প্রভৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাই।
কৃষক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। ১৯৩৭ সালে পাত্রসায়র কনফারেন্সে তার নিবন্ধ আজও একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃত। ফ্লাউড কমিশনের সামনে কৃষক সভার পক্ষ থেকে যে মেমোরেন্ডাম রচনা করা হয় তার অন্যতম রচয়িতা কমরেড রেবতী বর্মন হলেও কাকাবাবুর অবদান ছিল অনেকখানি। প্রথম দিককার রাজ্য কৃষক সভা ও সর্বভারতীয় কৃষক সভার অধিবেশনের অনেকগুলিতে তিনি নিজে অংশ নেন। ১৯২৬-২৭ সালের ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজান্টস পার্টির যুগ থেকে কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব হিসাবে তিনি স্বীকৃত।
পার্টির বিভিন্ন যুগে মতাদর্শগত সংগ্রামেও তার ভূমিকা ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিশুদ্ধতা রক্ষার সংগ্রামে তিনি ছিলেন অতন্দ্র প্রহরী। ১৯৬৪ সালের সপ্তম পার্টি কংগ্রেসের অব্যবহিত আগে যে ২৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়, তিনি তাদের অন্যতম ছিলেন। এই সময়ে তিনি প্রায় দেড় বছরের উপর দমদম সেন্ট্রাল জেলে ছিলেন। দমদম সেন্ট্রাল জেলে তার পাশের ঘরেই আমি ছিলাম। এই সময়ে তার শরীর বেশ অসুস্থ ছিল। কিন্তু তার অদম্য মনের জোর নিয়ে “আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি” রচনায় তিনি আত্মনিয়োগ করেন। এই ধরনের ঐতিহাসিক দলিল রচনায় তার ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠার যে পরিচয় পেয়েছি তা আমাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছে। তিনি বিভিন্ন প্রামাণ্য বইপত্র জোগাড় করেন অনেক তথ্যের নির্ভুলতার সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবার জন্য – তিনি বহুজনকে জেল থেকে চিঠিপত্র দিয়ে তাদের মতামত আনিয়ে প্রত্যেকটি তথ্যের সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। কাকাবাবুর নিজের স্মৃতিশক্তি এই বয়সেও খুবই প্রখর ছিল, তবুও তিনি তথ্যাদির সত্যতা সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হবার জন্য যে নিরন্তর প্রয়াস চালাতেন অশেষ ধৈর্য সহকারে তা সত্যই শিক্ষনীয়। তার ভাষণ অত্যন্ত সহজ ও সরল ছিল।
প্রথম জীবনে মুসলিম সাহিত্য পরিষদের সাথে যুক্ত থাকাকালীন সরকারি ট্রান্সলেটরের কাজের সময়ে কাজী নজরুলের দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য থাকায় ভাষার অনুশীলনে তিনি দীর্ঘদিন ব্যয় করেছেন। বাসায়ও দেখেছি অনেকগুলি ভালো অভিধান তার ছিল। জেলে থাকার সময় তিনি কয়েকটি অভিধান নিয়ে গিয়েছিলেন। বানান সম্বন্ধে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তার লেখা সহজবোধ্য ও সহজপাঠ্য ছিল। কাকাবাবু প্রতিটি কমরেড সম্বন্ধে খবরা-খবর রাখতেন। তাদের সুবিধা-অসুবিধা সম্বন্ধে নজর রাখতেন এবং নানাভাবে তাদের সাহায্য করতেন। প্রধানত তারই উদ্যোগ অসুস্থ কমরেড দের চিকিৎসা ও পরিচর্যার জন্য ‘রেড এড কিওর হোম’ প্রতিষ্ঠিত হয়। কালিম্পং এ তখন সত্যনারায়ন চ্যাটার্জি ও জগদীশ ঘোষ ছিলেন, তাদের ওখানেও অজস্র কমরেডদের পাঠাতেন। বরাকর নদীর ধারে একজন এই উদ্দেশ্যে জমি দিতে চান শুনে, তিনি আমাকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বলেন কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হওয়ায় সে ব্যবস্থা করে উঠতে পারিনি। কমরেডদের প্রতি মমত্ববোধ ছিল অপরিসীম।
কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে একজন আদর্শ কমিউনিস্ট নেতার বহুবিধ গুণাবলিকে অনুসরণ করে আমাদের পার্টিকে প্রকৃত বিপ্লবী পার্টি হিসেবে গড়ে তোলার সংকল্প গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় জীবনের বিভিন্ন দিকের ক্রমবর্ধমান সংকটের মোকাবিলা করে – শ্রমিক, কৃষক ও শোষিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প গ্রহণ করতে হবে।