Jaydeep Mukherjee Cover

সমাজতন্ত্র নির্মাণের পথে উদ্ভাসিত উন্নত সংস্কৃতি

জয়দীপ মুখার্জী

রাশিয়ায় ১৯১৭ -এর অক্টোবর (পুরনো ক্যালেন্ডার) বিপ্লব সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক  নজিরবিহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থার সূচনা ঘটেছিল। বিপ্লবের সর্বাধিনায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন।

নীতি নির্ধারন ও রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুভার একেবারে  চাষাভুষো-মজুরশ্রেণী, নিরঙ্কুশ ভাবেই আমজনতার ওপর।    উৎপাদন সম্পর্কের  গুণগত পরিবর্তন। রাষ্ট্রের ক্রম অবলুপ্তি ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্মাণ। প্যারি কমিউনের   অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শুরু হয়েছিল শ্রেণী বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার দীর্ঘায়ত সংগ্রাম। নেতৃত্বে  বলশেভিক (পরবর্তীতে, কমিউনিস্ট) পার্টি। সমাজ কাঠামোর এই পরিবর্তনের পথেই উদ্ভাসিত হয়েছিল উন্নত এক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল।

নতুন ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ওপর গরিবেরও ন্যায্য অধিকার। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ন্যুনতম প্রয়োজনীয় এই পাঁচটি বিষয়ের দায়িত্বে নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা। উৎপাদনের উপকরণের  সামাজিক মালিকানা। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণার নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্র। শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্যে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ।

সোভিয়েত বিপ্লবের প্রাক্কালে ১৯১৭ -এর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে লেনিন তাঁর ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ পুস্তিকায় পুঁজিবাদের পূর্ণ উচ্ছেদের পর নির্দিষ্ট একটি পর্যায় পর্যন্ত রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা এবং পরবর্তীতে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্রের রূপান্তর সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছিলেন। তাঁর ব্যাখ্যা ছিল, বিপ্লব পরবর্তী যুগে মূলত দুটি স্তর। নিম্নতর স্তরের সমাজতন্ত্র এবং চূড়ান্ত লক্ষ্যে সাম্যবাদে উত্তরণ। তাঁর অভিমত ছিল, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের  উপকরণগুলির অভাব বজায় থাকবে। পর্যায়ক্রমে সাম্যবাদে উত্তরণ ঘটলে উৎপাদিত বস্তুর প্রাচুর্যতার কারণে প্রধান প্রয়োজনগুলির ক্ষেত্রে সেই অভাব দূর হয়ে যাবে।

প্রসঙ্গত পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণের দীর্ঘ পথ সম্পর্কে কার্ল মার্ক্সের বুনিয়াদি বিশ্লেষণ ছিল, পুঁজিবাদের গর্ভেই সাম্যবাদের উৎস্যমুখটি নিহীত আছে। পুঁজিবাদ থেকেই তার ঐতিহাসিক বিকাশ। পুঁজিবাদ যে সামাজিক শক্তির জন্ম দেয় তারই দ্বান্দ্বিক ফলশ্রুতি সাম্যবাদ। এই উত্তরণের পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা ছিল, পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদী ব্যবস্থা দুটির মধ্যবর্তী পর্যায়ে আছে একটি থেকে অন্যটিতে বৈপ্লবিক রূপান্তরের কালপর্বটি। অর্থাৎ, আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার বিশেষ স্তর। এই স্তরে জুড়ে আছে রাজনৈতিক উৎক্রমণের একটি পর্বও, যেখানে শুধুমাত্র সর্বহারার বৈপ্লবিক একনায়কতন্ত্র ব্যতীত রাষ্ট্র আর কোনো কিছুই হতে পারে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি চূড়ান্ত বৈষম্যকে বিবেচনায় রেখে মার্ক্সের সতর্কীকরণ ছিল, শুধুমাত্র উৎপাদনের উপকরণগুলিকে  সমগ্র সমাজের সর্বজনীন সম্পত্তিতে পরিবর্তন করা হলেই যে বন্টনের ত্রুটিগুলি এবং বুর্জোয়া অধিকারের অসাম্য বিলুপ্ত হয় না। ‘শ্রমদানের পরিমাণ মোতাবেক’ উৎপাদিত বস্তু যতদিন পর্যন্ত ভাগ করে দেওয়া হতে থাকবে, এই বুর্জোয়া অসাম্য ততদিন বজায় থাকবে।

মার্কস তাঁর গোথা কর্মসূচীর সমালোচনা রচনায় রাষ্ট্রের ক্রম অবলুপ্তির প্রসঙ্গে বিশদে আলোচনা করেছিলেন। তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল, ‘কিন্তু, সাম্যবাদী সমাজের প্রথম দশায় এই ত্রুটিগুলির অস্তিত্ব থাকা অবশ্যম্ভাবী। কেননা, সুদীর্ঘ প্রসব যন্ত্রণার পরে পুঁজিবাদী সমাজের গর্ভ চিরে তখন তার সদ্য জন্ম হয়েছে। সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং তার দ্বারা নির্ধারিত সাংস্কৃতিক বিকাশের থেকে অধিকার কখনই উচ্চতর হতে পারে না’।

অতএব, বিপ্লবের পর সমাজতন্ত্র নির্মাণের সংগ্রাম মোটেই সহজ ছিল না। পুঁজিবাদের উচ্ছেদ হলেও পুরনো ব্যবস্থার সমস্ত বৈশিষ্ট্য জন্মদাগ হিসেবে তখনও বহন করতে হচ্ছিলো তার অর্থনীতি, নৈতিক মূল্যবোধ, বুদ্ধিবৃত্তি, সংস্কৃতি থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। এর পাশাপাশি, রাশিয়াসহ গোটা বিশ্বের পুঁজিবাদী শিবিরের জন্যই সর্বহারা শ্রেণীর এই বৈপ্লবিক জয় ছিল চরম হতাশাব্যাঞ্জক ঘটনা। তাই শৈশবেই সমাজতন্ত্রকে বিনাশ করতে তৎপর হয়ে ছিল ব্রিটেন,  ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকার মতো সামরিক শক্তিধর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি। ১৯১৮ -এর জানুয়ারি থেকে ১৯২২ -এর অক্টোবর, রাশিয়া জুড়ে টানা চার বছর ক্ষমতাচ্যুত জারের শ্বেত সৈন্য বাহিনী এবং তাদের সহায়তাকারী সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন-ব্রিটিশ-ফরাসি-জার্মান সম্মিলিত ২ লক্ষ  বহির্দেশীয় সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লাল ফৌজ ও বলশেভিক পার্টির রক্তক্ষয়ী লড়াই জারি ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত তখনও শুকোয়নি। পুঁজিবাদী শিবিরের প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্র মোকাবিলার পর গোটা  রাশিয়া  তখন রণক্লান্ত, বিধ্বস্ত। দেশজুড়ে চরম খাদ্য সংকট। আভ্যন্তরীন উৎপাদন তলানিতে। কল-কারখানার রুগ্ন দশা, মজুরির নিশ্চয়তা নেই, অযুত হাতে কোনো কাজ নেই। আইন শৃঙ্খলা ভগ্নপ্রায়, প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্থবির, একেবারে অচলাবস্থা।  জবরদস্তি জারের সৈন্যবাহিনীতে নাম লেখানো লক্ষ শ্রমিক-কৃষক যুদ্ধের জের -এ পঙ্গুত্বের শিকার। তার ওপর দেশজুড়ে মারাত্মক সংক্রামক রোগের প্রকোপ, ভয়ানক টাইফাস মহামারি। এক চূড়ান্ত অরাজক অবস্থার মধ্যে  সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণের কাজ শুরু করতে হয়েছিল বলশেভিক পার্টিকে।

সঙ্কটে দীর্ণ, অভূক্ত রাশিয়ার বিভ্রান্ত মানুষকে সমাজতন্ত্রের আদর্শে প্রাণিত করার দুরূহ দায়িত্বে দেশের সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোকে গড়ে তোলার দিশা  দিয়েছিল ত্রয়োদশ পার্টি কংগ্রেস। শুধুমাত্র স্বতস্ফুর্ততার ওপর নির্ভরশীল না থেকে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল চলচ্চিত্র শিল্পের বিস্তার ঘটানোর ওপর। এই শিল্পের মাধ্যমে দেশের জণগনের বৃহত্তর অংশকে সমাজতন্ত্রের আদর্শে প্রাণিত করতে সোভিয়েত সরকার ও পার্টিকে যুথবদ্ধ ভুমিকা পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বিপ্লবোত্তর প্রথম সরকারের শিক্ষা বিষয়ক কমিশার আনাতলি লুনাচারেস্কি’র প্রতি লেনিনের পরামর্শ ছিল, চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশে গুরুত্ব আরোপ এবং সমাজতন্ত্র নির্মাণে এর ব্যবহার। বলশেভিক সরকার এবং পার্টির কাছে সেসময়  সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দায়িত্ব ছিল রাশিয়ার জনগণকে একাধারে সাক্ষর ও নতুন ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। তাঁরা জানতেন প্রাথমিক এই কাজটি সম্পন্ন না করা গেলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর নয়।

যদিও আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাপ ফেলতে শুরু করেছিল কবিতা, উপন্যাস, বইয়ের  পাতায়, নাটক-থিয়েটারের মঞ্চে, সিনেমার পর্দায়। সাংস্কৃতিক চর্চা এবং বিনোদনের অধিকার যে শুধুমাত্র সমাজের উচ্চমার্গে অধিষ্ঠিত ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ের একান্ত, অনন্তকালের এই স্বেচ্ছাচার ভাঙতে শুরু করলো। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সিনেমার নায়ক-নায়িকা হয়ে উঠলেন ধুলো-ময়লা-ঘামে ভেজা শরীরে মেহনতি মানুষজন, আমজনতার ঘরের লোক। গল্পের ভাষ্যে উঠে এলো দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষাপটে জীবন সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। সুন্দর সুবেশিত অভিজাত চেহেরার নায়ক-নায়িকার একক ক্ষমতাবলে বলীয়ান সদর্প নায়কোচিত উপস্থিতির বদলে ভিড়ে মিশে থাকা চেতনাসম্পন্ন, সৎ, সাহসী কোনো অখ্যাত মানুষের সমষ্টিগত  প্রয়াস প্রধান চরিত্রের জায়গা করে নিল। শুধু সোভিয়েত রাশিয়ার জন্যই নয়, বিশ্বের শিল্প-সাহিত্যে এক নতুন ধারার সূচনা হলো। সংস্কৃতির জগতে নিয়ে এলো এক গুণগত পরিবর্তন। ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির কবিতায়, ম্যাক্সিম গোর্কির গল্প-উপন্যাসে তার ছাপ পড়লো। নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি, বরিস পলেভয়’দের লেখায় সমাজতন্ত্রকে রক্ষার মরনপণ সংগ্রামের বিজয়গাথা। লাজার লিসটজস্কি, কাজিমির ম্যালেভিচ, তাতলিনের তুলিতে বাঙময় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মৃত্যুঞ্জয়ী লড়াই।

বিপ্লবের আগে থেকেই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁদের সাহিত্য কর্মে সোচ্চার ছিলেন তলস্তয়, পুসকিন, দস্তয়ভস্কি, নিকোলাই গোগল’রা। বিপ্লবের পর এঁদের গল্প উপন্যাসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ আরও বেড়ে গেল। শিক্ষার বিস্তার সর্বস্তরে পৌঁছে দিয়েছিল তাঁদের অমর সাহিত্য।

এমন কি, গোটা বিশ্বের সাহিত্য সম্ভার চলে এলো সাধারণ মানুষের হাতে। অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন পাশ্চাত্যের সাহিত্যিক বিশ্ববরেণ্য উইলিয়ম শেক্সপিয়ের। পুঁজিবাদী শিবিরের কোঁক থেকে তাঁর সাহিত্যকর্মকে মুক্ত করার প্রশ্নে  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সাবেক সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের। তাঁর একের পর এক সাহিত্য কর্ম নিয়ে রূশ ভাষায় নাটক, থিয়েটার, সিনেমা তৈরি হলো। শেক্সপিয়েরের গল্প-উপন্যাস-কবিতা-নাটক সেদেশের ২৮টি ভাষায় প্রকাশনার পরিমাণ ছিল মোট পঞ্চাশ লক্ষ কপি। ইংল্যান্ড কেন বাকি ইউরোপেও ঐ সময়ে তাঁর সাহিত্যের এতো প্রকাশনার নজির নেই। তাঁর লেখা নাটক প্রযোজনা হয়েছিল ৩০০ টিরও বেশি।

বিদেশী সাহিত্যিকদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে ছিলেন না আমাদের রবীন্দ্রনাথও। ১৯২৬ -এ সোভিয়েত সরকার প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য সমগ্র রুশ ভাষায় প্রকাশ করে। আনাতোলি লুনাচারেস্কি তাঁকে ভারতের তলস্তয় বলে উল্লেখ করেছিলেন। প্রখ্যাত রুশ সাহিত্যিক, চিত্রকর, দার্শনিক নিকোলাস রোয়েরিখ তাঁর স্মৃতিচারণায়  লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি আমাদের কাছে এসেছিল গণজাগরণের মত। তাঁর কবিতা, গান শুধু গণ জমায়েতেই নয়, গৃহস্থের অন্দরেও নিয়মিত পাঠ হতো। রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া ভ্রমণ ১৯৩০ -এর ১১ সেপ্টেম্বর। ১৪ তারিখ তিনি সেখানকার অনাথ শিশুদের কমিউন পরিদর্শনে গিয়ে অভ্যর্থনায় আপ্লুত হয়ে পড়েন। দীর্ঘক্ষণ তিনি শিশুদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলেন। নিজকন্ঠে তাদের ‘জনগণ মন অধিনায়ক...’ গেয়ে শুনিয়েছিলেন।

সমাজতন্ত্রের নির্মাণের পথে উন্নত সংস্কৃতির যে উদ্ভাস ঘটেছিল তার প্রামাণ্য দলিল রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’।  পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কবি লিখলেন, “প্রত্যেক সমাজের নিজের ভিতরেও এই একই কথা। যে মানুষকে মানুষ সম্মান করতে পারে না সে মানুষকে মানুষ উপকার করতে অক্ষম। অন্তত যখনই নিজের স্বার্থে এসে ঠেকে তখনই মারামারি কাটাকাটি বেধে যায়। রাশিয়ায় একেবারে গোড়া ঘেঁষে এই সমস্যা সমাধান করবার চেষ্টা চলছে। তার শেষ ফলের কথা এখনো বিচার করবার সময় হয়নি, কিন্তু আপাতত যা চোখে পড়ছে তা দেখে আশ্চর্য হচ্ছি”। ঐ চিঠিতেই তিনি আরু লিখলেন,  “এখানে থিয়েটারে ভালো ভালো অপেরা ও বড়ো নাটকের অভিনয়ে বিষম ভিড়, কিন্তু যারা দেখছে  তারা কৃষি ও কর্মীদের দলের। কোথাও এদের অপমান নেই। ইতিমধ্যে এদের যে দুই–একটা প্রতিষ্ঠান দেখলুম সর্বত্রই লক্ষ্য করেছি এদের চিত্তের জাগরণ এবং আত্মমর্যাদার আনন্দ।” দ্বিতীয় চিঠিতে কবির উপলব্ধি আরও স্পষ্ট। তিনি লিখছেন, “এখানে এসে যেটা সবচেয়ে আমার চোখে ভালো লেগেছে সে হচ্ছে এই ধনগরিমার ইতরতার সম্পুর্ণ তিরোভাব। কেবলমাত্র এই কারণেই এ দেশে জনসাধারণের আত্মমর্যাদা এক মুহুর্তে অবারিত হয়েছে। চাষাভুষো সকলেই আজ অসম্মানের বোঝা ঝেড়ে ফেলে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে। এইটে দেখে আমি যেমন বিস্মিত তেমনই আনন্দিত হয়েছি। মানুষে মানুষে ব্যবহার কী আশ্চর্য সহজ হয়ে গেছে।”

রাশিয়ার চলচ্চিত্র জগতের দুই পথিকৃৎ ভ্লাদিমির গার্ডিন এবং লেভ কুলেশভের তত্ত্বাবধানে ১৯১৯ -এ চালু হলো, স্টেট স্কুল অব সিনেমাটোগ্রাফি। সুপ্রাচীন বাজারমুখী অভিজাত ঘরানার সমান্তরালে শুরু হলো একেবারে অন্য ঘরানার বাস্তবমুখী চলচ্চিত্র নির্মানের প্রতিষ্ঠান। দুটি ধারাই চলতে থাকলো। জনপ্রিয়তায় ছাপিয়ে গেল বাস্তবমুখী চলচ্চিত্রের ধারা। প্রখ্যাত অভিনেতা ও পরিচালক গ্রিগরি কোজিনৎসেভ, লিওনেড ট্রাউবার্গ, সের্গেই  ইউৎকেভিচ’রা সকলে এই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনি। একে একে সামনের সারিতে চলে এলেন বিশ্ববরেণ্য সের্গেই আইজেনস্টাইন, ভেসভলভ পুদোভকিন, বরিস বার্ণেট, মিখাইল রোমের মতো পরিচালকরা। তাঁদের সৃজনশীল ভাবনা এবং উদ্ভাবনী শক্তির মিশেলে কালোত্তীর্ন হয়ে উঠেছিল সোভিয়েত রাশিয়ার চলচ্চিত্র শিল্প।

কুলেশভ তৈরি করলেন, মিঃ ওয়েস্ট ইন দ্য ল্যান্ড অফ দ্য বলশেভিকস অফ  ১৯২৪, বাই দ্য ল অফ ১৯২৬, দ্য কনসোলার অফ ১৯৩৩ এবং অন দ্য রেড ফ্রন্ট (১৯২০) -এর মতো অবিস্মরণীয় সমস্ত ছবি।

১৯০৫ -এর ব্যর্থ অভ্যুত্থান থেকে ১৯১৭ -এর সফল বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে আইজেনস্টাইনের ট্রিলজি স্ট্রাইক, ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন এবং অক্টোবর সারা বিশ্বেই আলোড়ন তৈরি করেছিল। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেই প্রথম কারখানার মজদুর, জাহাজের খালাসি, বলশেভিক বিপ্লবীরা নায়কের আসনে। তাঁদের সাজসজ্জায় রং-চঙ্গের কোনো   আতিশয্য নেই, সোভিয়েত রাশিয়াসহ দুনিয়ার মেহনতি মানুষ নিজেদের খুঁজে পেলেন সিনেমার পর্দায়। পরাজয়ের গ্লানিতে নয়, বিজয়ের সরনিতে।  আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রে সর্বকালের অন্যতম সেরা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এই ছবিগুলিকে। চলচ্চিত্র নির্মাণশৈলীতেও নতুনত্বের জনক ছিলেন আইজেনস্টাইন। ভিন্ন মুহুর্তের অনেক ছোটো দৃশ্যকে কেটে জুড়ে রূপক-দৃশ্যের সম্পাদনায় আরেকটি মুহুর্ত সৃষ্টি, চলচ্চিত্রের পরিভাষায় মন্তাজ তাঁরই অবদান। আলো আঁধারির বিপরীতধর্মী দৃশ্যের বিন্যাসে যুক্তির বৈপরিত্য তুলে ধরা এবং সমাধান খুঁজে বের করার তাত্ত্বিক কৌশলও তাঁর মৌলিক সৃষ্টি। এ যেন কার্ল মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রতিফলন, যুক্তি পালটা-যুক্তি থেকে সংশ্লেষে উত্তরণ। তাঁর লেখা দ্য ফোর্থ ডায়মেনশন অফ সিনেমা গোটা বিশ্বের চলচ্চিত্র পরিচালকদের কাছেই বিশেষ ভাবে সমাদৃত। পরবর্তী যুগে বিলি ওয়াইল্ডার, চার্লি চ্যাপলিন, অ্যালফ্রেড হিচকক, দ্য সিকা, রোজেলিনি, ভিসকন্তি, ফেদরিকো ফেলিনি প্রমুখ অসংখ্য চিত্র পরিচালকদের ছবিতে আইজেনস্টাইনের নির্মাণশৈলীর ছাপ পড়েছে। ভারতের চলচ্চিত্র নির্মাণেও এর প্রভাব বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা গিয়েছে।

ম্যাক্সিম গোর্কি’র বিখ্যাত উপন্যাস মাদার -কে চলচ্চিত্রের রূপ দিয়েছিলেন পুদোভকিন। ১৯০৫ -এর বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে গোর্কি এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন। পুদোভকিনের আরেকটি অবিস্মরণীয় ছবি দ্য এন্ড অফ  সেন্ট পিটাসবার্গ মুক্তি পেয়েছিল ১৯২৮ -এ। কাজের খোঁজে গ্রাম থেকে শহরে আসা এক কৃষক পরিবারের সন্তানের বিপ্লবী হয়ে ওঠার চিত্র। এই ছবিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার সাধারণ মানুষের দুর্দশার চিত্রের পাশাপাশি বলশেভিক বিপ্লবের প্রেক্ষাপট এবং তার পরবর্তী গৃহযুদ্ধে বিপ্লবকে রক্ষা করার সংগ্রাম তিনি তুলে ধরেছিলেন। তাঁর বাকি ছবিগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য,  ভিক্টরি (১৯৩৮), মিনিন অ্যান্ড পোজারস্কি (১৯৩৯) এবং সুভরভ (১৯৪১)।

নভেম্বর বিপ্লবের একশত পাঁচ বছর অতিক্রান্ত। সোভিয়েত সাবেক হয়ে গিয়েছে তাও তিন দশক পেরিয়ে। নভেম্বর বিপ্লব’কে রক্ষা করা যায়নি। সমাজতন্ত্র নির্মাণের দুর্নিবার অভিযান সাময়িক ভাবে ব্যাহত। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ফের সেখানে চূড়ান্ত বৈষম্যের রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তুলেছে। মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের প্রয়োগ কৌশলের ত্রুটি ও মতাদর্শগত বিচ্যুতির পাশাপাশি, সমাজতন্ত্রকে বিনাসের আভ্যন্তরীন এবং  বহির্দেশীয় বৃহৎ ধনতান্ত্রিক শিবিরের যুগপৎ ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা না করতে পারাও বিপর্যয়ের অন্যতম কারন। তবু মেহনতি মানুষের আশা-আকাঙ্খা, অধিকারবোধ, মুক্তির আশ্বাস বরাবরের জন্য প্রজ্জ্বলিত করেছে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা।

‘ধনগরিমার ইতরতা অবসানে’ সুদীর্ঘ সংগ্রামের লক্ষ্যে অবিচল উন্নত সংস্কৃতির প্রথম জাগরণ ঘটিয়েছে নভেম্বর বিপ্লব-ই।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন