মতাদর্শের আধিপত্য, শ্রমিকশ্রেণির আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই- সিআইটিইউ'র প্রতিষ্ঠা দিবসে

সুদীপ ও সুনন্দ

৫৪ বছর আগে স্থিতাবস্থা, শ্রেণি সহযোগিতা এবং সুবিধাবাদের কালো মেঘের মধ্যে বিপ্লবী দৃঢ়তার এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো গড়ে উঠেছিল সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন বা সংক্ষেপে সিটু।  CITU-র প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে সংগঠনের প্রথম সভাপতি কমরেড বি টি রণদিভে তাঁর সমাপনী বক্তব্যে দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন ‘আমরা, বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণি, আমরা, বিশ্বের মেহনতি, আমরা, বিশ্বের সাধারণ মানুষ, আমরা বিজয়ের পথে এগিয়ে চলেছি;  এই যুগ আমাদের, এই যুগ সাধারণ মানুষের এবং শ্রমিক শ্রেণির...সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের শেষবিচার লেখা হয়ে গেছে, তোমরা মৃত সমাজ, অদূর ভবিষ্যতে নিঃশেষ হয়ে যেতে বাধ্য। আর শ্রমিক শ্রেণিই তোমাদের কবর দেবে।’

আজ ৩০ শে মে ২০২৪, আমাদের ৫৫তম প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপন । নিঃসন্দেহে আজকের দিন আমাদের গৌরবময় যাত্রার কথা মনে করানোর দিন । পাশাপাশি আজ আমরা এক আত্ম-পর্যবেক্ষণের মুখোমুখিও বটে- কোথায় এসে দাঁড়ালাম এই বছরগুলোতে, আমাদের সাংবিধানিক লক্ষ্যে, শোষণহীন সমাজ নির্মাণের প্রকল্পে আমরা কতটা এগোতে পারলাম?

একথা সত্যি যে এই ৫৪ বছরে, বিশ্বের ইতিহাস ও রাজনৈতিক বাস্তবতা আমূলভাবে বদলে গেছে। সোভিয়েতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটেছে এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশে নব্য উদারবাদী আধিপত্যের বাড়বাড়ন্ত আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক মননে থাবা বসিয়েছে।

কিন্তু বস্তুগত পরিবর্তনের সাথে সাথে যে বিষয়ীগত পরিবর্তন ঘটেছে সেটা নিয়েই আজ আমাদের বিশেষ করে ভাবনাচিন্তা করতে হবে। যে মতাদর্শটি সিটুকে অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রগুলির থেকে আলাদা করে তা হল সমাজ বদলের আদর্শ। এই আদর্শই সিটুর জন্মের কারণ এবং আজ পর্যন্ত এর পৃথক অস্তিত্বকে ধরে রেখেছে । নিঃসন্দেহে আমাদের শ্রেণি শত্রুদের নিরলস ও নিরন্তর আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়েও তাই আজ সিটু সমাজ বদলের রাজনীতির প্রতি অবিচল রয়েছে।

এটা নিঃসন্দেহে সত্যি যে পুঁজিবাদের ‘আর কোনও বিকল্প না থাকা’র (TINA) ঝড়ের মধ্যে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর জন্য আমরা জানকবুল লড়াই করেছি । কিন্তু আমরা এটাও বস্তুনিষ্ঠ ভাবে মূল্যায়ন করি যে ভারতের শ্রমিক শ্রেণি এখনও শ্রেণিমুক্তির স্বপ্নকে, শোষণহীন সমাজের স্বপ্নকে তাঁদের দৈনন্দিন সংগ্রামের চালিকাশক্তি হিসেবে দেখার থেকে বহু ক্রোশ পিছিয়ে রয়েছে। একমাত্র এই স্বপ্নই পুঁজিবাদের বহুমাত্রিক মতাদর্শের আক্রমণে নিরুৎসাহিত হয়ে থাকা শ্রমিক শ্রেণিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে, ঘুমিয়ে থাকা দৈত্যকে জাগিয়ে তুলতে পারে, শোষিত ও নিপীড়িত অন্যান্য সমস্ত শ্রেণি ও অংশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করতে পারে এবং সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর করতে পারে। মনে রাখতে হবে, এটাই শ্রমিকশ্রেণির ঐতিহাসিক দায়িত্ব।

শাসক শ্রেণির দ্বারা মতাদর্শগত আক্রমণের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো আমাদের সংগঠকদের পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণির বৃহত্তর অংশের মধ্যে তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব সম্পর্কে অবিশ্বাস, নিরুৎসাহ, অসন্তোষ এবং হতাশা সৃষ্টি করা। এটি আমাদের নিরস্ত্র করে দেওয়ার এক ষড়যন্ত্র যাতে আমরা আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব এবং শক্তিকে সবচেয়ে উন্নত এবং বিপ্লবী শ্রেণি হিসেবে দেখতে না পারি। এই আক্রমণকে মোকাবিলা না করতে পারলে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ কোনোভাবেই তার চারপাশের পুঞ্জীভূত হতাশার পরিমন্ডলকে কাটিয়ে উঠতে পারবেনা। বিদ্যমান সামাজিক অবক্ষয় ও রক্ষণশীলতার বিপরীতে শ্রমিক শ্রেণির হাতিয়ার কেবল একটা রেডিক্যাল মতাদর্শ যা কিনা এক নতুন সমাজের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দিশা দেখায়।

শ্রেণি এবং এর ভূমিকা: শাসক শ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এজেন্ট, সংশোধনবাদী ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এবং রাজনৈতিক দালালদের মাধ্যমে হানা মতাদর্শগত আক্রমণের প্রধান উপাদান হল আমাদের অস্তিত্বের প্রধাণ ভিত্তি, আমাদের "শ্রেণির" ধারণাকেই ঘেঁটে দেওয়া। তারা ব্যক্তিদের একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসাবে শ্রেণির সুনির্দিষ্ট এবং বস্তুনিষ্ঠ উপস্থিতি অস্বীকার করে । এই বুদ্ধিজীবীরা মানতে চায় না যে উৎপাদনের উপকরণের ওপর নিয়ন্ত্রণের অধিকারের ভিত্তিতে এবং উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের স্বতন্ত্র অবস্থানের সাথে প্রতিটি গ্রুপের কিছু সাধারণ স্বার্থ তৈরি হয়; যেমনটি আমরা জানি, এক শ্রেণি অন্য শ্রেণির যুযুধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে, উদাহরণস্বরূপ শ্রমিক বনাম পুঁজিপতি, সামন্তপ্রভু বনাম কৃষক ইত্যাদি।

বরং তারা প্রস্তাব করে যে শ্রেণি আসলে একটি প্রক্রিয়া যা চারটি প্রক্রিয়ার বিবিধ সমন্বয় ছাড়া আর কিছুই নয় যেখানে উদ্বৃত্তের উৎপাদন, আহরণ, বণ্টন ও ভোগ নির্ধারিত হয়। সহজভাবে বলতে গেলে, শ্রেণি মানুষের একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী নয়, বরং উৎপাদন প্রক্রিয়ার একটি অস্থায়ী শ্রেণিবিভাগ।

এই আপেক্ষিক এবং অনির্দিষ্ট শ্রেণিবিভাগের ফল হলো উদ্বৃত্ত বরাদ্দের প্রক্রিয়া থেকে সরাসরি উৎপাদকদের বর্জন-অন্তর্ভুক্তির উপর নির্ভর করে এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া শোষণমূলক বা অ-শোষণমূলক হয়ে যেতে পারে। এইভাবে, একজন পুরুষ শ্রমিক কারখানায় শোষিত হতে পারে, আবার সে হয়তো তার স্ত্রী বা পরিবারের সন্তানদের শোষণ করে। একজন কারখানার মালিক এক পরিস্থিতিতে শোষক এবং অন্য পরিস্থিতিতে শোষিত হতে পারে।

এই তত্ত্বায়নের ব্যবহারিক সমস্যা হল, শ্রেণি যদি একটি অস্থায়ী ধারণা হয়, তবে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে ধারাবাহিক শ্রেণি সংগ্রাম আর ইতিহাসের চালিকা শক্তি হতে পারে না! আসলে এই সমস্যাটির জন্ম হচ্ছে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক দ্বন্দ্বের মধ্যে মাত্রাকে আলাদা করতে না পারার ব্যর্থতা থেকে, সকল দ্বন্দ্বকে এক মানদণ্ডে নিয়ে হাজির করার ভুল প্রবৃত্তি থেকে।

এই উদ্ভট তত্ত্বের সুদূরপ্রসারী বাস্তব ও ব্যবহারিক প্রভাব হল শ্রেণিগুলির স্থায়ী, সুনির্দিষ্ট গঠনকে অস্বীকার করা, তাদের মধ্যে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করা, শ্রেণি সংগ্রামের নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ভূমিকাকে এবং বিশেষ করে সামাজিক রূপান্তরে শ্রমিকশ্রেণির দায়িত্বকে অস্বীকার করা। রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক পরিপ্রেক্ষিতে, এই তত্ত্ব স্থায়ী শ্রেণি সংগঠনের প্রয়োজনের পরিসমাপ্তি ঘটায়। একটি বিপ্লবী ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের জন্য, মালিক শ্রেণির বিরোধিতা করে আশু দাবি আদায়ের লড়াইয়ের ময়দান হলো সেই স্কুল যেখান থেকে শ্রমিক শ্রেণি সমাজের সমস্ত শোষিত শ্রেণি ও নিপীড়িত অংশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক পরিপক্কতা অর্জন করে। শ্রমিকশ্রেণির সুপ্রিমেসির জন্য তাত্ত্বিক সংগ্রাম, শ্রেণির ধারণাকে রক্ষা করার সংগ্রামও সেই বৃহত্তর সংগ্রামের অংশ । নিঃসন্দেহে শ্রমিক শ্রেণির জন্মই হয়েছে একটি শ্রেণি হিসাবে গঠিত হতে এবং তার ঐতিহাসিক কাজগুলি সম্পন্ন করতে।

শ্রেণি না পরিচিতি: দ্বিতীয় আক্রমণের ধারাটি হলো শ্রেণিভিত্তিক শোষণের গুরুত্ব ও প্রাথমিকতাকে লঘু করার একটা সচেতন প্রচেষ্টা এবং জাতি, লিঙ্গ বা বর্ণের মতো অ-শ্রেণি পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে ঘটে চলা নিপীড়নের সাথে একে এক করে দেখা বা হয়তো গুরুত্বের বিচারে আরও নামিয়ে ফেলা । এটি নিছক শ্রেণিবিন্যাস বা গুরুত্ব আরোপের বিষয় নয়, এটি আসলে শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক ভূমিকার সামগ্রিক দায়িত্ব, পরিধি এবং ব্যাপ্তিকে সংকুচিত করে ফেলার চক্রান্ত।

আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে পিতৃতন্ত্র থেকে বর্ণবাদ, সমস্ত পিছিয়ে থাকা সামাজিক অনুশীলনগুলি প্রকৃতপক্ষে আধিপত্যবাদী সামাজিক-রাষ্ট্রীয় যন্ত্রগুলির মাধ্যমে শাসকদের বিনা মূল্যে বা সস্তা শ্রম প্রদান ও শোষণের শাসনকে মান্যতা দেয়। নিঃসন্দেহে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোরালো সংগ্রামের মাধ্যমেই শ্রমিক শ্রেণি তার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে এবং সামন্তবাদী-পুঁজিবাদী নিপীড়ক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ফ্রন্টও গড়ে তুলতে পারবে। মানব সভ্যতাকে শোষণের কবল থেকে মুক্ত করে বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত একটি ন্যায্য সমাজই কেবলমাত্র মানুষের দ্বারা মানুষের বিবিধ নিপীড়নকে দূর করতে পারে। আর সেখানেই ট্রেড ইউনিয়নের ভূমিকা হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ।

পেটি উৎপাদকদের গ্লোবাল সাউথের বিপ্লবী শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করার ভ্রান্ত ধারণা

ভারতে ক্ষুদ্র উৎপাদক বা ছোট চাষীদের সংখ্যা বিপুল। এর একটি প্রধান কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে প্রাক-পুঁজিবাদী বা অ- পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের অস্তিত্ব এখানে এখনও রয়ে গেছে। যদিও একথা সবাই স্বীকার করে যে কৃষিতে পুঁজির অনুপ্রবেশ ক্রমশ বাড়ছে এবং সামন্ত জমিদাররা ক্রমশ পুঁজিবাদী জমিদারে রূপান্তরিত হচ্ছে ।

এদেশের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ক্ষুদ্র উৎপাদক এবং একচেটিয়া পুঁজিবাদের মধ্যে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকে সামনে নিয়ে এসেছে। এটি থেকে এক পেটি বুর্জোয়া ফর্মুলেশনের জন্ম হয় যে পেটি-উৎপাদনের বিরাট সংখ্যায় বেড়ে ওঠা আসলে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের গ্লোবাল সাউথ মডেল । স্বাভাবিক ভাবেই এই ধারণা সামাজিক রূপান্তরের চালিকা শক্তি হিসাবে শ্রমিক শ্রেণি এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলির ভূমিকাকে খর্ব করে।

এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি এই সত্যটি মিস করে যে ক্ষুদ্র উৎপাদনের একটি বড় অংশ একচেটিয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত গ্লোবাল ভ্যাল্যু চেইনের পার্ট হিসেবেই কাজ করছে । ক্ষুদ্র উৎপাদকদের পণ্যের দামও বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে একচেটিয়াদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় । এক জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের উদ্বৃত্তও পৌঁছে যায় বড় পুঁজিপতির কাছে। তাই, প্রতিরোধের একটি স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া হওয়া তো দূরে থাক, ক্ষুদ্র উৎপাদন একচেটিয়া পুঁজিবাদের একটি অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবেই কাজ করে আজকের দুনিয়ায়। যদিও তীব্র সংকটের মুহূর্তে একচেটিয়া পুঁজিবাদের দ্বারা আদিম সঞ্চয়ন, জোরপূর্বক অসহনীয় আত্ম-শোষণে বাধ্য করা বা জবর দখলের মাধ্যমে সঞ্চয়নের সময়ে ক্ষুদ্র উৎপাদকরা একচেটিয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সরাসরি ভূমিকা গ্রহণ করে, তার উদাহরণ হলো কৃষক আন্দোলন।

দ্বিতীয়ত, ক্ষুদ্র-উৎপাদকরা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর অত্যন্ত পেটি ও আন্তঃপ্রতিযোগিতামূলক প্রকৃতির কারণে এদের নিজে থেকে সংগঠিত হওয়া কঠিন। আর তাই, ক্ষুদ্র উৎপাদকদের স্বার্থ রক্ষা এবং সামন্ততন্ত্র-একচেটিয়া বিরোধী সংগ্রামে বিজয়ের প্রক্রিয়া একটি দীর্ঘ লড়াই-এর অংশ, এবং এর জন্য প্রয়োজন এই লড়াইয়ে শ্রমিক শ্রেণির অংশগ্রহণ, সংহতি ও নেতৃত্ব। আর একারণেই এই ভুল তত্ত্বের অবসান জরুরি।

প্রতীকী পদক্ষেপ এড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আসল সংগ্রামে নামুন

শ্রমিক শ্রেণিকে কেবল তার কারখানা, স্থানীয় এলাকা বা অর্থনৈতিক দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সংস্কারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং উল্টোদিকে আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স পুঁজির দ্বারা শ্রমিক শ্রেণিকে ক্রমাগত এক নেটওয়ার্কে জুড়ে ফেলার বাস্তবতার মধ্যে আজকের দিনে এক বিরাট ফারাক তৈরি হয়েছে।

গ্লোবাল প্রোডাকশন নেটওয়ার্কের ক্রমবর্ধমান খণ্ডিতকরণ এবং বিস্তারের ফলে, গ্লোবাল সাউথ আসলে মধ্যবর্তী উৎপাদন বা সংযোজনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, যেখানে উল্টোদিকে ব্র্যান্ড মূল্য নির্ধারণ নিয়ন্ত্রণ করে গ্লোবাল নর্থের কোম্পানিগুলি। আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজি গ্লোবাল সাউথের সব দেশকে অমানবিক শ্রম নীতি প্রয়োগ করতে বাধ্য করে, যাতে শ্রমশক্তির মূল্য আরও কমিয়ে আনা যায়, ক্ষুদ্র উৎপাদন ধ্বংস করা যায় এবং গ্লোবাল নর্থে উদ্বৃত্ত মূল্য চালান সর্বাধিক করা যায়। ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই গ্লোবাল সাউথ ও নর্থের দেশগুলির মধ্যে শ্রমশক্তির মূল্যের বিরাট তফাৎ রয়ে গেছে। নবউদারবাদী বিশ্বায়নের সময়কালে এই পার্থক্য কমে নি একটুও, কারণ পুঁজি আরও বেশি শোষণমূলক এবং গতিশীল হয়ে উঠেছে; কিন্তু শ্রমশক্তি জাতীয় সীমানার মধ্যে স্থানীয় রয়ে গেছে।

একই সাথে, এটি গ্লোবাল নর্থকে শিল্পহীনতা এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মেট্রোপলিটান পুঁজি তার শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষকে শান্ত করতে কিছু সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তবে, সংকট আরও গভীর হওয়ার সাথে সাথে, এই সামাজিক নিরাপত্তাগুলিও কমানো শুরু হয়েছে এবং পরিস্থিতি ক্রমাগত বিস্ফোরণমুখী হয়ে উঠছে। পুঁজির গতিশীলতার ফলে সংকটের কেন্দ্র এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে, একই সাথে পুঁজিবাদ রক্ষার শেষ উপায় হিসাবে বর্বর নয়া-ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ।

এমন পরিস্থিতিতে, বিপ্লবী শ্রেণি ভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের দায়িত্ব হলো সংকটকে যুদ্ধরাজনীতির মাধ্যমে পার করার প্রতিটি সাম্রাজ্যবাদী চেষ্টার বিরূদ্ধে গড়ে ওঠা সকল লড়াইয়ে জানকবুল সংহতি দেখানো । আর্থিক নিষেধাজ্ঞা, সামরিক আগ্রাসন বা সরাসরি যুদ্ধ যাই হোক না কেন – সাম্রাজ্যবাদের সব হরকতের বিরূদ্ধে লড়াই করতে হবে, তাকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। অবশ্যই জীবন্ত শ্রমই একমাত্র বাস্তব শক্তি যা এই লড়াই পরিচালনা করতে সক্ষম। অবশ্যই এই সংকট সমাধানের একমাত্র আদর্শ হলো আন্তর্জাতিকতা এবং সমাজ বদলের আদর্শ।

আজকের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হলো একটি রূপান্তরমূলক রাজনীতির সুতোয় জাতীয় সীমানার মধ্যে আটকে পড়া বিবিধ শ্রমকে একসাথে গাঁথার চেষ্টা করা । আমাদের সংগঠিত করতে হবে গ্লোবাল ভ্যালু চেইনের বিভিন্ন অংশে আটকে থাকা উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ের বিবিধ পণ্য ও কোম্পানি ভিত্তিক শ্রমিকদের; গড়ে তুলতে হবে আরও দৃঢ় আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর চেতনার সাথে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন - বিশ্বকে সংকটাপন্ন পুঁজিবাদের মারণ থাবা থেকে বাঁচানোর প্রত্যয় নিয়ে ।

পুনর্বন্টন না বিপ্লব

আজকের এই সন্ধিক্ষণে যখন দীর্ঘ পুঁজিবাদী সঙ্কট ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও দুর্দশার দিকে গোটা সমাজকে নিয়ে যাচ্ছে, তখন পুনর্বন্টন পুঁজিবাদের মধ্যেই একটি জনপ্রিয় সংস্কারবাদী স্লোগান হিসাবে দেখা দিয়েছে, যাতে সিস্টেম-বিরোধী রাগ-ক্ষোভকে দানা বাঁধার আগেই কিছুটা ঠান্ডা করা যায়।

সম্পদের পুনর্বন্টন মূলত সেই সংস্কারবাদী ধারণাকে নির্দেশ করে যা মনে করে যে উচ্চতর আয়, সম্পদ বা উত্তরাধিকার কর আরোপ করে এবং সংগৃহীত অর্থ জনকল্যাণ ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পগুলিতে ব্যয় করে পুঁজিবাদের মধ্যেই অসমতা কমানো সম্ভব। এমন দৃষ্টিভঙ্গি ইচ্ছা করে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সেই সত্যকে যে আসলে অসমতার মূল কারণ হলো উৎপাদনের উপায়গুলির একচেটিয়া হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া, প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মধ্যেও তারতম্য এবং অভূতপূর্ব মাত্রার পুঁজি সঞ্চয়ন।

প্রতিটি পুঁজি সঞ্চয়নের চক্রের সাথে সাথে, উৎপাদনের প্রযুক্তিগত অংশ বৃদ্ধি পায় এবং মুনাফার হার কমে যায়। পুঁজি তার মুনাফা বজায় রাখতে চায় শোষণ বৃদ্ধি, কাজ ছাঁটাই এবং শ্রমের রিজার্ভ আর্মি বাড়ানোর মাধ্যমে। এটি আবার উৎপাদিত পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে দেয় এবং উৎপাদিত পণ্য রিয়ালাইজেসনের সংকটের দিকে নিয়ে যায়, যার ফলে মুনাফার হার আরও কমে যায়।

এই সমস্যার সমাধানের জন্য, পুঁজিবাদ রিশেসন তৈরি করে; ফলস্বরূপ রিটার্ন আরও কমতে থাকে, বিনিয়োগ ধীর হয়, সঞ্চয় থামে, প্রযুক্তিগত উন্নতির হার সাময়িক ভাবে কমে, উৎপাদনে শ্রমের অংশ বাড়তে থাকে এবং অবশেষে মুনাফার হার স্থির হয়ে যায়। তবে, এর পুরো ধাক্কাটাই গিয়ে পরে শ্রমিকশ্রেণি ও সাধারণ জনগণের ওপর।

কিন্তু অদ্ভুতভাবে, ২০০৮ সাল থেকে দীর্ঘ সংকটের মাঝে এবং এমনকি মহামারীর সময়েও, সঞ্চয়ের হার কমেনি। এটা সিস্টেমে একটি গুরুতর ফল্টলাইন তৈরি করেছে, আসলে যা সংকটের সিস্টেমিক চরিত্রকে প্রকাশ করছে। এর সমাধানে, সংস্কারবাদী অর্থনীতিবিদরা ধন এবং আয় পুনর্বন্টনের পরামর্শ দিচ্ছেন যাতে সঞ্চয়নের অনিয়ন্ত্রিত গতিকে আংশিকভাবে নিষ্ক্রিয় করা যায়।

এখন ব্যাপার হলো, গ্লোবাল নর্থের দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গ্লোবাল সাউথ থেকে উদ্বৃত্ত স্থানান্তরের সুবিধা ভোগ করে, যে সুবিধা গ্লোবাল সাউথের একটি দেশের পুঁজিপতির কাছে কিছুটা হলেও কম রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে, একচেটিয়া পুঁজির দ্বারা পরিচালিত একটি রাষ্ট্রের পক্ষে একচেটিয়া পুঁজির ওপরেই কর বৃদ্ধি করে মুনাফার হার কমিয়ে দেওয়া আসলেই একটি স্ববিরোধী ধারণা । এই কাজ করার অর্থ একচেটিয়া পুঁজির ক্ষমতার মূল ভিত্তিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা যা চালু রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়।

আর তা সত্ত্বেও, সাময়িক পুনর্বণ্টন উপরের ১০% এবং নিচের ৫০% এর মধ্যে বৈষম্য কিছু সময়ের জন্য করলেও করলেও, পুঁজির কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া শীর্ষ ১০%-এর পুঁজিকে ১%-এর হাতে, শীর্ষ ১%-কে ০.১%-এর হাতে এবং এভাবে ক্রমবর্ধমান হারে কেন্দ্রীভূত করবে। ফলস্বরূপ, পুনর্বণ্টন আরও একচেটিয়াকরণের দিকে নিয়ে যাবে। অন্যদিকে, এটি আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজির নির্দেশ বিরোধী আপাত এক পরিস্থিতি তৈরি করবে; এবং এর ফলে পুঁজির পলায়ন ঘটার সম্ভাবনা থাকবে।

কাজে কাজেই, একটি সংস্কারবাদী স্লোগান হিসেবেও পুনর্বণ্টন আমাদের স্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয় যে এই পচনশীল ব্যবস্থাতে টুকটাক পরিবর্তন বা বা কোনো কৌশল প্রয়োগ করে কোনো প্রকৃত রিলিফ দেওয়াও আজকের দিনে আর সম্ভব নয়। সংকট এত তীব্র এবং গভীর যে এমনকি সংস্কারবাদী স্লোগানও আদপেই বিপ্লবী উৎখাতের পরম প্রয়োজনীয়তার দিকে আমাদের নিয়ে যাবে। অন্তর্বর্তী সময়ে ধনীদের ওপর কর বৃদ্ধির দাবি জনগণকে সংঘবদ্ধ ও শিক্ষিত করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু এই ব্যাপারে আমাদের মনে কোনো ভুল ধারণা না থাকাই শ্রেয় । শ্রমিক শ্রেণিকে মূল পরিবর্তনের দিকে দৃঢ় পরিকল্পনা ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লড়াকু আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে হবে।

২১ শতকের প্রলেতারিয়েত কে?

নব্য-মার্ক্সবাদী এবং বিভিন্ন ধরনের সংস্কারবাদীরা শিল্প প্রলেতারিয়েতের অস্তিত্বকে, ( যা শ্রমিক শ্রেণির অগ্রবর্তী অংশ হিসাবে বিবেচিত) অস্বীকার করে। তারা শ্রমিক ইউনিয়নগুলিকে পুরনো ধ্যান ধারণায় বন্দী হিসাবে অভিযুক্ত করে এবং অসংগঠিত, স্বনিযুক্ত, প্ল্যাটফর্ম কর্মী, গৃহকর্মী বা প্রকল্প কর্মীদের মতো শ্রমিক শ্রেণীর নতুন রূপগুলিতে যথাযথ মনোযোগ না দেওয়ার জন্য সমালোচনা করে।

কিন্তু বাস্তবতা আমাদের কী বলে? আজ, সমস্ত কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়নগুলির প্রায় ৯০% সদস্যপদ অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে আসে। স্পষ্টতই, তারা সবচেয়ে দীণ অবস্থার শ্রমিক, অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ন্যূনতম জীবিকা নির্বাহের স্তরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। অবশ্যই তারা সংখ্যায় ব্যাপক, প্রকৃতিতে মরিয়া এবং রাজনৈতিক ডিসকোর্স নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে কাজ করতে সক্ষম।

তবে, একটি বিপ্লবী শ্রমিক ইউনিয়নের জন্য শুধুমাত্র শ্রমিক শ্রেণির একটি নির্দিষ্ট অংশের অসহায়তা, দুর্দশা বা সংখ্যার বিশালতা অগ্রাধিকারের মানদণ্ড হতে পারে না। প্রায়োরিটি ক্ষেত্র নির্ধারিত হয় পুঁজি  এবং রাষ্ট্রের শাসনকে সরাসরি মোকাবিলা করার ক্ষমতা, একে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করার ক্ষমতা দিয়ে। এই কারণেই বিদ্যুৎ, কয়লা, পেট্রোলিয়াম, পরিবহন, প্রতিরক্ষা, ফিনান্সের মতো ক্ষেত্রগুলিকে স্ট্রাটেজিক সেক্টর হিসেবে দেখা হয়। এ কারণেই আধুনিক উৎপাদন/পরিষেবা শিল্প যেখানে বিশাল পুঁজির বিনিয়োগ হচ্ছে, অভূতপূর্ব প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং তার অনুসারে শ্রমপ্রক্রিয়ার পুনর্গঠন হচ্ছে, তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এই ক্ষেত্রগুলি ক্রমাগত নিজেদের পুনর্গঠিত করছে যাতে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের শ্রম-সময়ের প্রিশিসনের সাথে উদ্বৃত্ত-উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়, যাতে প্রতি ইউনিট শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য উত্তোলন তীব্রতর হয়। উৎপাদনের যন্ত্রপাতির আধুনিকীকরণ এবং শ্রমশক্তির ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিতি হলো আধুনিক উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্রে পুঁজির দ্বন্দ্বের স্বাভাবিক গতি।

চুক্তিভিত্তিক কাজ, ক্যাজুয়াল কাজ, প্রশিক্ষণার্থী, শিক্ষানবিস এবং অন্যান্য সকল ধরনের অনিয়মিত শ্রম সম্পর্কের আরোপ এবং মজুরি ভাগের ক্রমাগত হ্রাস হলো এই সময়ে পুঁজির চক্রান্তের অংশ, যা আসলে শ্রমের লড়াই করার ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য তৈরি। স্ট্রাটেজিক এবং আধুনিক উৎপাদন/পরিষেবা ক্ষেত্রের এই বিভিন্ন ধরনের অনিয়মিত শ্রমিকরাই আসলে আধুনিক ভারতের সবচেয়ে অগ্রসর এবং সম্ভাবনাময় প্রলেতারিয়েত শ্রেণি গঠন করে, যারা সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা এবং হাতিয়ার দ্বারা সজ্জিত।

আজকে একদিকে যেমন যুবসমাজ শ্রমিকশ্রেণিরও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়ে উঠেছে, সাথে সাথে তারা এমন একটি শক্তি যা পুঁজির বিরূদ্ধে সংগ্রামকে প্রকৃতপক্ষে নেতৃত্ব দিতে পারে এবং অন্যান্য শোষিত অংশের শ্রমজীবী মানুষকে উদ্দীপ্ত ও সংগঠিত করতে পারে। বিপ্লবী মনোভাবকে নিরস্ত্র করার স্পষ্ট বা প্রচ্ছন্ন সকল চক্রান্তকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আধুনিক প্রলেতারিয়েতের এই কৌশলগত এবং গণ চরিত্রকে নির্দিষ্ট ভাবে পরিষ্কার করার ওপরে জোর দেওয়া আজ সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।

ভবিষ্যতের পথ ইতিহাস থেকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে!

তাহলে, ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণির জন্য বাস্তব কাজের কী ধরনের রিওরিয়েন্টেশন সংকটকে বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনের চেতনায় পরিণত করতে পারে? অবশ্যই, এই প্রশ্নের উত্তর একটি বাক্যে দেওয়া সম্ভব নয়; তবে চলুন ১৯০৫ সালের ঝড়ো দিনগুলিতে রাশিয়ান শ্রমিক শ্রেণির ইতিহাসে ফিরে যাই এবং কাজের এক সুনির্দিষ্ট পথের দিকে আমাদের সম্মিলিত কল্পনাকে জাগিয়ে তুলি ।

১৯০৫ সালের জানুয়ারিতে নিষ্ঠুর জারতন্ত্রের রাশিয়ায়, সেন্ট পিটার্সবার্গে ১ লক্ষ কারখানার শ্রমিকরা ব্যাপক আন্দোলনের মাধ্যমে ভাল কাজের পরিবেশ, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং একটি গণপরিষদ গঠনের দাবিতে ধর্মঘটে গিয়েছিল। জারের সৈন্যরা ধর্মঘটরত শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায় । ফলস্বরূপ অন্তত ১২২টি শহর এলাকার দশ লক্ষেরও বেশি মানুষের অংশগ্রহণে দুই মাসব্যাপী ধর্মঘটের তরঙ্গ তৈরি হয়। সেপ্টেম্বর মাসে, মুদ্রণকর্মী, টাইপসেটার এবং অন্যান্য শ্রমিক বিভাগের কর্মীরা ধর্মঘট শুরু করে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে, রেল শ্রমিকরা একটি জাতীয় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় যা জার প্রশাসনের কঠোর দমনপীড়নের মুখে পড়ে।

রাশিয়ান শ্রমিকরা এই সংকটময় মুহূর্তে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছিল যা পরবর্তী বছরগুলিতে মানব সভ্যতার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। ১০ অক্টোবর থেকে, সেন্ট পিটার্সবার্গের কারখানার শ্রমিকরা ধর্মঘটরত শ্রমিকদের সাধারণ সভা আয়োজন করে শহরের কেন্দ্রে এক জায়গায় প্রতিনিধিদল পাঠানো শুরু করে, যাতে পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা করা যায়। ১৩ অক্টোবর, তারা একটি গণপরিষদ গঠনের দাবিতে রাজনৈতিক সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় এবং সমস্ত কারখানাকে প্রতিনিধি পাঠাতে বলে। কারখানার স্তরে ধর্মঘট কমিটি গঠন করে কারখানায় প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করা হয়। তিন দিনের মধ্যে, ৯৬টি কারখানার ২২৬ জন প্রতিনিধি ওই সভায় উপস্থিত হয়। ১৭ অক্টোবর, এই দলটি 'শ্রমিক ডেপুটিদের সোভিয়েত' নাম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, ২২ সদস্যের একটি অস্থায়ী কমিটি নির্বাচিত করে এবং তাদের নিজস্ব সংবাদপত্র প্রকাশ শুরু করে।

সোভিয়েত শ্রমিকদের সাধারণ ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের কেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং দ্রুত শ্রমিকদের নিজের পার্লামেন্টে পরিণত হয়। এটি ছিল নিচ থেকে সরাসরি গণতন্ত্র চর্চার ধারণা নিয়ে গঠিত প্রথম ধরনের বিপ্লবী কেন্দ্র। ১৯০৫ সালের সেন্ট পিটার্সবার্গ-সোভিয়েত রাশিয়া জুড়ে কারখানার শ্রমিক, কৃষক এবং সৈন্যদের সোভিয়েত গঠনের পথ তৈরি করে এবং ১৯১৭ সালের বিপ্লবে 'সমস্ত ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে'– এই চূড়ান্ত স্লোগানের রূপ নেয়।

বিশ্ব বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের এই গৌরবময় অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়। প্রথমত, সংগ্রামের সংকটময় মুহূর্তে কারখানার শ্রমিকদের সরাসরি গণতন্ত্র চর্চা অভূতপূর্ব আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল এবং রাশিয়ার সমস্ত শ্রমিক জনগোষ্ঠী, এমনকি কৃষক ও সৈন্যদের মধ্যেও অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক থেকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংগ্রামকে উন্নীত করা, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন তোলা এবং ধারাবাহিক শিল্প ধর্মঘটের পরে সমস্ত শ্রমিক অংশকে যুক্ত করে সাধারণ ধর্মঘটের অস্ত্র ব্যবহার করা, প্রলেতারিয়েতকে সমস্ত শ্রমজীবী জনগণের নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামোকে অস্বীকার করা এবং বিপ্লবী সংকট পরিপক্ক না হলেও প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বে একটি বিকল্প গণতান্ত্রিক কাঠামো গঠনের প্রক্রিয়ার বীজ বপন করা।

আজকের দিনে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী কল্পনা এবং সমস্ত শ্রমজীবী জনগণকে নেতৃত্ব দেওয়ার স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিই ভারতীয় সমাজের অচলাবস্থাকে নাড়া দিতে পারে। যে কোনও বিপ্লবী রূপান্তরের শ্রেণিগত প্রস্তুতির উপর নির্ভর করে তার সম্ভাবনা। এমনকি ১৯১৬ সালের রাশিয়াও ১৯১৭ সালের আসন্ন বিপ্লবের কোনো পূর্বানুমান করতে পারেনি! সিআইটিইউ-এর ৫৫তম প্রতিষ্ঠা দিবসে আমরা সমস্ত শ্রমিকশ্রেণির শত্রু মতাদর্শ, প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বকে বাতিল করার সকল অপচেষ্টার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত-রাজনৈতিক সংগ্রাম শুরু করার অঙ্গীকার করি। শ্রমিক শ্রেণি অবশ্যই বিজয়ী হবে যদি তা সামাজিক রূপান্তরের মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয় – আমাদের কাজ হল আগামী দিনে আমাদের শ্রেণির আধিপত্য স্থাপন, শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব, একটি সুন্দর আগামীর ভবিষ্যতের দিকে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম পরিচালনা করা ।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন