রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে স্মরণে রেখে

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

মার্কসবাদ জিজ্ঞাসার বিষয় সন্দেহ নেই- আবার ঐ বিষয়েই যার বাংলা লেখা সহজ কথায় অনেকের অনেক জিজ্ঞাসার উত্তর দেয় সেই মানুষটি চলে গেলেন।

আজ সকাল ৮টা বেজে ৫০ মিনিটে ফুসফুসের কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বিশিষ্ট বাঙালী মনীষা রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। দর্শন শাস্ত্র’কে যারা কেতাবি বুলির বাইরে টেনে এনে আমাদের চেতনার সামনে ফেলে দেন, প্রমান করেন না জেনে কিংবা না বুঝেই আমরাও প্রত্যেকেই কোনও না কোনও দার্শনিক অবস্থানেই নিজেদের বোধ লালন করি – যেমনটা মার্কস বলেছিলেন যে প্রত্যেক মানুষই দার্শনিক, কেউ উৎকৃষ্ট কেউ হয়ত নিকৃষ্ট।

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন, পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট হন। ঐ বিষয়েই কলকাতার আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন, রিডার হয়েছেন। মেধার দুনিয়ায় তার পরিচিতি যদিও আরও বিস্তৃত- ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশনের এমিরিটাস ফেলো ছিলেন, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ ফিলজফিক্যাল রিসার্চের ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্বও সামলেছেন।

আমাদের দেশে যারা প্রাচীন চার্বাক দর্শনবোধ হতে শুরু করে বৈদিক ধারণাসমূহ পেরিয়ে বৌদ্ধ, জৈন মতবাদ অবধি এসে মার্কসীয় সাম্যবাদে উপনীত হন, অন্যদের উপলব্ধিতে সেই ধারাবাহিকতা গেঁথে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন অধ্যাপক ভট্টাচার্য ছিলেন তাদেরই অন্যতম।   

দর্শন বিষয়ে লেখালেখির জন্যই প্রধানত তার পরিচয়, তবু সেইসব রচনায় তার অসামান্য সাহিত্যগুণের উল্লেখ বিনা আলোচনা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। এমনই দুয়েকটি উদাহরণ আমাদের মনে রাখাই উচিত-

‘আমাদের বাড়িশুদ্ধ সবাই পাগল।

কথাটা আমাদের অক্ষর দিদিকে একবার বলেছিলুম। তিনি এমন করে তাকালেন যেন পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় সত্যি আর হয় না। খানিক পরে খুব শান্তভাবে শুধু জিগেস করলেন, 'হোম টাস্ক হয়েছে?' আমি আর কী বলব। মনে মনে বুঝে নিলুম, উনিও পাগল। নইলে ঐ কথার পিঠে কেউ এমন প্রশ্ন করে?

অথচ আমি একটুও বাড়িয়ে বলি নি। আমাদের বাড়িশুদ্ধ সব্বাই। পাগল। ধর আমার জেঠু। নিজের দুই ছেলের কী নাম রেখেছেন, জান? কিঞ্চিৎ আর অধিক। কিঞ্চিৎ সেন আর অধিক সেন। ডাকনাম: হেলে আর দুলে। অনেকেই জানতে চায় এমন নাম দেওয়া কেন। জেঠু বলেন, একদিকে কিঞ্চিৎ, অন্যদিকে নিক—এতে সবদিক ঠিক থাকে। আর, "হেলে ধরতে পারে না, গোখরো ধরতে যায়' এই প্রবাদটা নাকি ছোটোবেলা থেকেই ওঁর খুব ভালো লাগত। তাই বড়ছেলের নাম দিয়েছিলেন হেলে। ছোটোছেলের নামটাও গোখরো রাখতে চেয়েছিলেন, জেঠিমার প্রবল আপত্তিতে সেটা আর হয়ে ওঠে নি। তাই জোড় মেলানোর জন্যে নাম রাখলেন দুলে। জেঠুর খুব দুঃখে ছোটোবেলায় নাকি গোখরো বলে ডাকলে দুলেদা কোনো আপত্তি করত না, কিন্তু একটু বড় হওয়ার পরে ঐ নাম শুনলেই ফোঁস করে উঠত। ঠিক গোখরোর মতোই। তবু কেন গোখরো নামটা মা-ছেলে কারুরই পছন্দ হলো না সেটা উনি কিছুতেই ভেবে পান না’...

কিংবা

‘অনেক দিন ধরেই কথা হচ্ছে দুজনের মধ্যে। একজনের বয়েস পঁচিশ-তিরিশ। নাম, ধরা যাক, প্রশ্নময় ইতস্তত। ছোটো করে বলা হবে: প্র:। দ্বিতীয় জনের বয়েস পঞ্চাশের ধারেকাছে। নাম? অভিজ্ঞ উত্তরীয়, ছোটো করে, উ:।

কথা শুরু হয়েছিল হঠাৎই। দুজনের মধ্যে আগে তেমন আলাপ ছিল না, শুধু পরিচয়টুকুই ছিল। তবে কথায় শুধু কথা বাড়ে না, চেনা জানাও বাড়ে। প্র: আর উ: গোড়ায় যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, সেখান থেকে আরও ঘনিষ্ঠ হন।’

অনেকেই জানেন, আবার অনেকেই জানেন না ছোটদের জন্যও তিনি কলম ধরেছিলেন। সেই কাজে ‘অংশু মিত্র’ ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প সেই কলমেই লেখা হয়। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি তার লেখা ‘চার্বাক চর্চা’ বইটির প্রকাশক। এছাড়াও তার বহু লেখা বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে আমাদের হাতে এসেছে, তারই কিছু হল - ব্রাহ্মণ-রোমান ক্যাথলিক বিসংবাদ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত: ইতিহাসবোধ ও রাষ্ট্রচিন্তা, বের্টল্ট ব্রেশ্ট: প্রয়োগের নন্দনতত্ত্ব, দর্শন পড়ার ভূমিকা, বাঙলা ভাষার ভূত-ভবিষ্যৎ, বাঙালির নতুন আত্মপরিচয়: সমাজসংস্কার থেকে স্বাধীনতা, ওরে বর্ণচোরা ঠাকুর এল ইত্যাদি বিতর্ক, কামারের এক ঘা, ক্লাসিক কেন চিরায়ত, মননের মূর্তি, বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ, পরশুরাম গল্পকার, পরশুরামের চরিত্রশালা, পরশুরাম বিবিধ, রবীন্দ্রনাথের তিন সঙ্গী, বিভূতিভূষণ ও কথাসাহিত্যে বাস্তববাদ, বস্তুবাদ জিজ্ঞাসা, ন্যারেটলজি: ছোটোগল্প: ছোটোদের গল্প, ভারতবিদ্যা ও মার্কসবাদ, মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব, প্রবন্ধসংগ্রহ, Grounds for Hope, Studies on the Carvaka/Lokayata।

একাধিক বিষয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেছেন- ইংরেজি, বাংলা দুই ভাষাতেই। তার মনীষার ব্যাস ছিল একদিকে ভারতে জ্যামিতির শিকড়সন্ধান থেকে আজকের প্রজন্মের জন্য মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা অবধি। এমন মানুষের অস্তিত্ব নিজের দেশে বাম আন্দোলনের বাইরে মানায় না, সেই যোগসূত্র তার ছিল- জীবনের শেষদিন অবধি।

এই একটি লেখায় রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের জীবনের সবটা তুলে ধরা যাবে না। আমরা চেষ্টা করব দ্রুত তার সম্পর্কে লিখতে পারেন এমন মানুষের কলমেই তাকে স্মরণ করতে। আপাতত এই প্রতিবেদন এক ভারতীয় মেধাকে স্মরণ করতে চাইছে- যে মেধা ভারতীয় হওয়ার সাথেই আন্তর্জাতিকতায় সঞ্জাত ছিল, সেই আন্তর্জাতিকতা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতা, ক্যাপিটালিস্ট দখলদারী মনোভাবের যা ঠিক বিপরীত।

ওয়েবডেস্কের পক্ষে- সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন