পার্থ মুখার্জী
'আমার জীবনের যাত্রাপথে জ্ঞানকে আমি পার হওয়ার জন্য নৌকার মতো ব্যবহার করেছি মাথায় বোঝার মত বয়ে বয়ে ঘুরে বেড়ানোর কাজ নয়। "
১৮৯৩ সালের আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মহা পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। একনিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক এক মহা পন্ডিত হিসাবে সারা বিশ্বে যথেষ্ট মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠার অধিকারী হয়েছিলেন। মহা পন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন "জ্ঞানেরও কোন খিদে আছে, বিস্তৃত জগতকে দেখার কোন খিদে আছে, শিক্ষিত পরিশীলিত সমাজে থাকারও কোন খিদে আছে যা পেটের খিদের থেকে হাজারো গুণ বেশি প্রবল এবং সর্বদা অতৃপ্ত"। তিনি বারে বারে তার নিজের পরিবার ছেড়ে কোন না কোন অনিশ্চিত অভিযানে বেরিয়ে যেতেন। আর যতবারই তিনি বেরিয়ে যেতেন তার পিতা কোন না কোন ভাবে তাকে ঘরে ফিরিয়ে আনতেন বিভিন্নভাবে লোভ দেখাতেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি তার পুত্রের বিবাহ দিয়েছিলেন ।কিন্তু সে বিবাহকে কোনদিনও তিনি স্বীকার করেননি ।রাহুল সংকীর্তন কে এই কথা বলে তার পিতা বোঝানোর চেষ্টা করতেন' আমি তোমার সারা জীবনের জন্য ভরণপোষণ ও ও সাফ জামা কাপড় পরার ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু তার বাবা রাহুলকে একথা বোঝাতে পারেননি। এখানেই আছে জ্ঞানপিপাসা। বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে তিনি বহির্বিশ্ব সম্পর্কে একটা জগত খুঁজতেন, আর সেই জগতের মধ্যে তিনি খুঁজে বেড়াতেন কোন কিছু একটা স্বপ্ন যা ছিল তার স্পষ্ট কল্পনা।
আধ্যাত্ম্য পাঠ সম্বন্ধে রাহুলের একটি অলৌকিক ধারণা ছিল। ঈশ্বরকে পাবেন এই আশায় বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। নিষ্ঠার সঙ্গে এত কিছু করার পরও যখন অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটলো না, তখন তিনি উপলব্ধি করলেন আধ্যাত্মবাদ নয় জ্ঞান ই কাম্য। এই সময় উত্তর বিহারের বর্ষা মঠের এক মহন্ত একজন নব্য অল্প বয়স্ক ব্রহ্মচারীর খোঁজ করছিলেন। যাকে তিনি ঠিকমতো তৈরি করে নিতে পারবেন। রাহুল সুযোগটি গ্রহণ করলেন। এর ফলে বাড়িতে এবং বাবার কাছ থেকে দূরে থাকার কথা ভাবলেন এবং সংস্কৃত ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে পড়াশোনা সুযোগের কথা ভেবে নিলেন। তিনি একসময় তিরুপতির কাছে তিরুনিশির মঠে মহন্তরূপে ছিলেন। এই সময় ধর্মের প্রতি তার সরল বিশ্বাস আস্তে আস্তে ঘুচে যায় নিজেকে গড়ে তোলেন এক যুক্তিবাদী নাস্তিক হিসাবে। ধর্মীয় আচার-আচরণ থেকে তিনি সরে এসে দর্শনের প্রতি বা জ্ঞানের প্রতি তার আগ্রহকে আরও বৃদ্ধি করতে থাকেন।
তখন ১৯১৭ সাল ।দুনিয়া কাঁপানো ১০ দিনের কারণে টালমাটাল অবস্থা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তার প্রভাব ছিল রাহুলের মনে। সামাজিক পরিবর্তন কি ধর্মের দ্বারা সম্ভব? নাকি একেবারে পুরনো বদ্ধমূল ধারণার উপরে আঘাত হেনে রক্তের বিনিময়ে সামন্ততন্ত্র আর বুর্জোয়া শক্তিকে ধ্বংস করা যায়। বহু বছর পরে যখন তিনি প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়নের পা রাখলেন তিনি ডাইরিতে লিখেছিলেন" যদিও আমি আরো দশ বছর পরোক্ষভাবে আর্য সমাজের প্রভাবে ছিলাম এবং পরবর্তী এবং পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবিত হলাম কিন্তু আমি কোন পথে হাঁটবো তাহলে ১৯১৭ সালের শেষ কয়েকটা মাসেই তা ঠিক হয়ে গিয়েছিল ।যখন তিনি খবর পেলেন ,যে রাশিয়ার রাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের পতন হয়েছে এবং তার জায়গায় কায়েম হয়েছে গরীবের শাসন। শুধু এইটুকু সম্বল করেই পরের বছর তিনি 'বাইসবী সদী, র কাঠামো লিখে ফেলেছিলেন। যদিও সেটা বইয়ে পরিবর্তিত হতে পাঁচ থেকে ছয় বছর লেগেছিল।
রাহুল কিভাবে কমিউনিজমের দিকে ছুটলেন? সে বিষয়ে কিছু কিছু কথা আলোচিত হওয়া দরকার। বুদ্ধ ও কার্ল মার্ক্স এর দর্শন চর্চা এবং জীবনচর্চার মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার বছরের ব্যবধান সত্বেও দুটি জীবন দর্শনের মধ্যে রাহুলের দৃষ্টিতে যে সাদৃশ্য সূত্রগুলি ধরা পড়েছিল, বস্তুত সে কারণেই তিনি বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন অনুসরণ করতে গিয়ে একসময় মার্কসবাদকে পুরোপুরি গ্রহণ করেন ।তথাপি বুদ্ধের প্রতি তার আনুগত্য বজায় রেখেই না সেইসব সাদৃশ্য সূত্রগুলি ধরা পড়েছিল তার মধ্যে প্রধান দিকগুলি প্রয়াত কমরেড অনিল বিশ্বাস তার নির্দিষ্ট লেখনীতে রেখেছিলেন। কমরেড অনিল বিশ্বাস তার লেখনিতে দেখিয়েছিলেন বৌদ্ধ দর্শনের চারটি মহান সত্যের মধ্যে মার্কসবাদ এর প্রতিবিম্ব লক্ষণীয় হয়েছিল রাহুলের কাছে। ( এক) বুদ্ধ দুঃখের অস্তিত্ব দেখেছিলেন। (দুই ) সেই দুঃখের উৎস সন্ধান করেছিলেন (তিন) দুঃখের নিরোধের কথা ভেবেছিলেন (চার) দুঃখ নিবৃত্তি কথা সন্ধান করেছিলেন। রাহুলের মতে মার্কসবাদীরাও কি অনুরূপ চারটি মহান সত্যের বিষয়ে অভিহিত নন ?(এক) পৃথিবীতে দুঃখ আছে (দুই )শোষণের ফলেই দুঃখের উদ্ভব (তিন) শোষণ নির্মূল হলেই এই দুঃখ নির্মূল হবে (চার) কমিউনিজম হল দুঃখ নিবৃত্তি র প্রতিকারের পথ।
এইভাবেই বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের বৈপ্লবিক সূত্র ও তথ্যগুলির রাহুলকে ক্রমশ মার্কসবাদ গ্রহণের উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু একথা সকলেরই জানা রাহুল বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনে তার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাননি। তবেই ধর্ম ও দর্শনকে অবলম্বন ও আত্মস্থ করে তার পক্ষে সহজ হয়েছিল বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ তথা মার্কসবাদ এর উত্তোরনে। এই উত্তরণের অভিজ্ঞতা থেকে রাহুল অনুভব করেছিলেন যে আমরা এমন এক বিজ্ঞানের যুগে বাস করছি কিন্তু ত্বকত্ব শিক্ষিত জনের মধ্যে অনেকেই বৈজ্ঞানিক যুগের পূর্ববর্তী মৃত চিন্তা ভাবনা নিয়ে আছেন। এর একটি কারণ জিজ্ঞাসুদের কাছে তাদের উপযোগী হিন্দি গ্রন্থের অভাব, এই অভাব থেকেই হিন্দিভাষী রাহুল বিজ্ঞান সমাজ বিজ্ঞান দর্শন ও পরিশেষে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ প্রসঙ্গে অসংখ্য রচনা ও গ্রন্থ লিখেছিলেন।
বলা যায় আড়াই হাজার বছর ধরে বস্তুবাদের উপরে যথেচ্ছ গালিগালাজ যা বর্ষিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে বস্তুবাদীরা দারিদ্র্য প্রেরিত অন্যায় অবিচারে প্লাবিত দুনিয়ার মিথ্যা ব্যাখ্যা না করে সেটাকে পরিবর্তন করার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ এমন একটি বড়দর্শন যা দুনিয়ার পরিবর্তন এবং সেই পরিবর্তন কিভাবে ঘটছে তার ব্যাখ্যা করে শুধু তাই নয় এই পরিবর্তন কাজে মানুষকে অংশগ্রহণ করতে হবে এই বিশ্বাসেই রাহুল ছিলেন অটল।