রবীন্দ্রনাথ - ঝঞ্ঝারাতের আলোকদিশারী - সুব্রত দাশগুপ্ত

২৫ শে বৈশাখ ১৪১৯,(মঙ্গলবার)

আলোচনা শুরু করা যাক কবি বিষ্ণু দে ' র কবিতার অংশ উদ্ধৃত করে --
' তুমি কি কেবলই স্মৃতি , শুধু এক উপলক্ষ্য কবি ?
হরেক উৎসবে হই হই
মঞ্চে মঞ্চে কেবলই কি ছবি ?
তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ
আর বাইশে শ্রাবণ ?"

না , রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ নন | একথা ঠিক যে এই দুটি দিন তাঁকে নিয়ে আমাদের মগ্নতা অনেক বেশি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমাদের সারা বছরের , সারা জীবনের ভালোবাসার ধন , জীবনবোধের অনির্বান দীপশিখা |
জীবনযন্ত্রণায় , আনন্দের মূর্ছনায় , ভালোবাসা - আবেগ - অস্থিরতায় , প্রতিবাদে - বিক্ষোভে - বিদ্রোহে আমাদের হৃদয়ে তাঁর নিত্য উপস্থিতি , মননে তাঁর দীপ্ত অধিষ্ঠান | এবং এসব কেবলমাত্র কথার কথা নয় , " পঁচিশে বৈশাখ"-এ অবলুসী ভাবনা নয় |
বহু ভাষা , বহু ধর্ম , বহু সংস্কৃতির এই মহান দেশের যুগ যুগ সঞ্চিত ও লালিত বহুত্ববাদী ধারণাকে যারা ভেঙে তছনছ করতে চায় , তারাই যখন বহু মানুষের চিন্তার জগৎকে প্রভাবিত করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্টিত হন , সেই তমসাঘন , হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতেও আমাদের হৃদয়ে শ্রাবণের বারিধারার মতো , আশাবাদের সঞ্চার ঘটে কবির উদাত্ত নির্ঘোষে - ' যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া
মহা-আশংকা জপিছে মৌন মন্তরে
দিক-দিগন্ত অবগুন্ঠনে ঢাকা
তবু বিহঙ্গ , ওরে বিহঙ্গ মোর
এখনই অন্ধ , বন্ধ কোরোনা পাখা |''
কিংবা যখন জীবন- জীবিকার দাবিতে রাস্তার লড়াইয়ে সামিল হওয়া বাধাবন্ধনহীন, নতুন যৌবনের দূত , একরোখা ছেলেমেয়েগুলোর দিকে নির্মমভাবে ধেয়ে আসে রাষ্ট্রের জলকামান বা দমবন্ধকরা টিয়ার গ্যাস , সেই রণক্ষেত্রে বুক চিতিয়ে লড়ে যাওয়া , হাতে হাত রাখা একদল তরুণ - তরুণীর কণ্ঠে প্রকাশিত হন রবীন্দ্রনাথ --
' সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান
সংকটের কল্পনাতে হোয়োনা ম্রিয়মান |
মুক্ত করো ভয় ,
আপনা মাঝে শক্তি ধরো , নিজেরে করো জয় |''
এই রবীন্দ্রনাথ শুধু আমাদের অভয়দাতাই নন , আমাদের সংগ্রামী জীবনের প্রেরণা |

মুক্ত করো ভয়

কমিউনিস্টদের নিয়ে 'রবীন্দ্র- বিরোধিতা' র এক মিথ্যা আখ্যান নানা সময়ে , নানা বিভঙ্গে পরিকল্পিতভাবে পরিবেশিত হয় | ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতা ভবানী সেন কর্তৃক রবীন্দ্রনাথকে 'বুর্জোয়া কবি' বলে চিহ্নিত করা এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি۔ কর্তৃক এই চিহ্নিতকরণের স্পষ্ট বিরোধিতা করে বিবৃতি প্রদানের ঘটনা , কোনো কোনো তরফে বিকৃতভাবে পরিবেশিত হয়ে আসছে | এবং এই কর্মের পান্ডারা ইচ্ছাকৃতভাবেই , শুধু ভবানী সেনকে উদ্ধৃত করেন কিন্তু পার্টির বক্তব্যকে উহ্য রাখেন | তাদের এই অর্ধসত্য প্রচারের আড়ালে রয়েছে তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী মানসিকতা | রবীন্দ্রনাথকে কমিউনিস্টরা কিভাবে দেখেন সে সম্পর্কে প্রজ্ঞাবান কমিউনিস্ট নেতা ও বিদগ্ধ পন্ডিত হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য - " বাংলাদেশের মার্ক্সবাদীরা রবীন্দ্রনাথকে পরম শ্রদ্ধার চক্ষে দেখে থাকেন বলেই তাঁকে নিয়ে অলস আলোচনা ও মূল্যহীন স্তুতিবাক্য পরিহার করার সচেতন চেষ্টা চলেছে | আমাদের এই চেষ্টার বহুস্থলে ত্রুটি থেকে গেছে , মাঝে মাঝে মূল্যায়নে নিদারুন ভ্রান্তিও যে ঘটেনি তা বলা যায়না | কিন্তু যথার্থ শ্রদ্ধার অভাব কখনো হয়নি |" ( রবীন্দ্রনাথ ও ভারতবোধ ) |
এ দেশেরই কোনো কোনো পরিসর থেকে রবীন্দ্রনাথকে কেবলমাত্র 'কবি' হিসেবে চিহ্নিত করার একটি সযত্ন প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় | একি শুধুমাত্র তাঁর ভুবনজোড়া ব্যাপ্তিকে সংকীর্ণতার ঘেরাটোপে বন্দি রাখার প্রচেষ্টা নাকি কবিতার বাইরের অন্য রবীন্দ্রনাথকে জানমানস থেকে আড়াল করার ধূর্ত চেষ্টা ?


আসলে রবীন্দ্রনাথ তো শুধুমাত্র একজন কবি নন _ তিনি একজন দার্শনিক , একজন সমাজবীক্ষক | যেমন মানবজীবনের যে কোনো অবস্থা ও ভাবধারায় তাঁর কবিতা ও গানের সমুজ্জ্বল উপস্থিতি , তেমনি সমাজজীবনের প্রায় প্রত্যেকটি বিষয়ে তাঁর লেখনী চিন্তাশীল মানুষের চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে |ব্যাপ্তি ও বিস্তারের দিক থেকে এই প্রতিভা সত্যই বিস্ময়কর |অসংখ্য প্রবন্ধ, গল্প, নাটক , উপীনয়াসের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে আর্থ-সামাজিক , রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিষয়সমূহের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব এবং উপসংহারে প্রকাশিত হয়েছে এক শাশ্বত সত্য |তাই শুধু কবি হিসেবেই নয় , প্রাবন্ধিক - গল্পকার - নাটককার - ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী , আমাদের জীবনসংগীতের গীতিকার - সুরকার - গায়ক |

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রথিতযশা মানুষ বিভিন্ন বিশেষণ ব্যবহার করেছেন | তাঁর সত্তরতম জন্মদিবস উদ্যাপিন উপলক্ষ্য, কলকাতায় আয়োজিত সংবর্ধনাসভায় রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব পরিষদ - এর পক্ষে সভাপতি আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু কর্তৃক প্রদত্ত অভিনন্দনবার্তায় রবীন্দ্রনাথকে 'সার্ব্বভৌম কবি' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ( ১১ পৌষ , ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ ) | সম্ভবতঃ এই শব্দবন্ধটি সংক্ষিপ্ততম পরিসরে তাঁর চরাচরব্যাপ্ত প্রতিভাকে ব্যক্ত করতে পেরেছে | কিন্তু তিনি নিজে নিজেকে কিভাবে দেখেছেন ? তারও এক প্রামাণ্য চিত্র পাওয়া যায় , সত্তরতম জন্মজয়ন্তীতে ছাত্রছাত্রী- উৎসব - পরিষদের সংবর্ধনার প্রত্যুত্তরে তাঁর বক্তব্যে --
' অনেকদিন থেকেই লিখে আসচি , জীবনের নানা পর্বে , নানা অবস্থায় | শুরু করেচি জানছে বয়সে - তখনো নিজেকে বুঝিনি | তাই আমার লেখার মধ্যে বাহুল্য , বর্জনীয় জিনিস ভুরি ভুরি আছে টাতে সন্দেহ নেই | এ সমস্ত আবর্জনা বাদ দিয়ে বাকি যা থাকে আশা করি তার মধ্যে এই ঘিসনাত ষ্পষ্ট যে - আমি ভালোবেসেছি এই জগৎকে | আমি প্রণাম করেচি মহৎকে , আমি কামনা করেচি মানুষের সত্য মহামানবের মধ্যে যিনি সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট: |আমি আবাল্য অভ্যস্ত ঐকান্তিক সাহিত্যসাধনার গণ্ডিকে অতিক্রম۔ করে একদা সেই মহামানবের উদ্দেশে যথাসাধ্য আমার কর্মের অর্ঘ্য , আমার ত্যাগের নৈবেদ্য আহরণ করেচি --তাতে বাইরের থেকে যদি বাধা পেয়ে থাকি অন্তরের থেকে পেয়েচি প্রসাদ | আমি এসেচি এই ধরণীর মহাতীর্থে -- এখানে সর্ব্বদেশ ও সর্ব্বকালের ইতিহাসের মহাকেন্দ্রে আছেন নরদেবতা -- তাঁরই বেদীমূলে নিভৃতে বসে আমার অহংকার , আমার ভেদবুদ্ধি ক্ষালন করার দুঃসাধ্য চেষ্টায় আজও প্রবৃত্ত আছি |"
এই জীবনদর্শন এবং নিজের সৃষ্টিতে তার যথার্থ প্রতিফলনই রবীন্দ্রনাথকে আধুনিক ভারতের শ্রেষ্ঠ মনীষার সম্মানে ভূষিত করেছে |

শুনি যেন সুন্দরের গান
দেখি যেন একনিষ্ঠ দীর্ঘায়ুর প্রগতির এক ছবি


আজ তাঁর ১৬৩তম জন্মদিবস | দেশের বুকে ঘনায়মান অন্ধকার আর রাজ্যজুড়ে অশুভ শক্তির উন্মত্ত পদচারণা | এর বিরুদ্ধে এখন প্রতিটি দিনই সংগ্রামের দিন | এই সংগ্রামে বিজয় অর্জনের ক্ষেত্র
রচনায়ও রবীন্দ্রনাথ আমাদের উদ্বুদ্ধ করবেন , প্রাণিত করবেন |
শুরু করেছিলাম বিষ্ণু দে' র কবিতা দিয়ে , শেষ করছি সেই কবিতারই শেষ অংশ উদ্ধৃত করে ---
" তোমার আকাশ দাও , কবি , দাও
দীর্ঘ আসি বছরের ---
আমাদের ক্ষীয়মাণ মানসে ছড়াও
সূর্যোদয় , সূর্যাস্তের আশি বছরের আলো ۔۔۔۔

শুনি যেন সুন্দরের গান
দেখি যেন একনিষ্ঠ দীর্ঘায়ুর প্রগতির এক ছবি ,
সুন্দরের গান, যেন শুনি , গাই
দশটার, পাঁচটার উদ্ভ্রান্ত ট্রাফিকে ,
বস্তিতে বাসায় আর বাংলার নয়া কলোনিতে
জীবিকার জীবনের ভাঙা ধ্বসা ভিতে --
বোম্বাই সিনেমা আর মার্কিনী মাইকে অসুস্থ বৈভবে
মরা ক্ষেতে কারখানায় পিঁড়ি যেন জীবনের
সংগ্রামশান্তির ষ্পষ্ট উপন্যাস ۔۔۔۔ "
ভেদবুদ্ধিকে পরাজিত করে, মানুষের সম্মান আর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়েই চলমান থাকুক নতুন মানবসমাজ গঠনের পথে আমাদের সম্মিলিত অবিরাম যাত্রা |


শেয়ার করুন

উত্তর দিন