আভাস রায়চৌধুরী
আমরা পশ্চিমবঙ্গের চেহারাটা দেখতে পারি। স্বাধীনতার সময় শিল্পে অগ্রসরমান একটি রাজ্য ধারাবাহিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনার ফলে ক্রমশ পিছিয়ে গেছে। ১৯৯৪’এ রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার নয়া উদারনীতির মধ্যে ফাঁকফোকর গুলোকে খুঁজে নিয়ে নতুন করে রাজ্যে শিল্প বিনিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। ২০০১ পরবর্তী সময়ে যা অনেকখানি অগ্রগতি ঘটেছিল। শিল্পে বিনিয়োগে একেবারে পিছনের দিকে চলে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশ সামনের দিকে উঠে এসেছিল। ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমবঙ্গে বুনিয়াদি ও ভারী শিল্পের অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে অথবা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের দ্বারা অধীগ্রহন করা হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধনে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলি কে রক্ষার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯১থেকে নয়া উদারবাদী নীতির বেপরোয়া প্রয়োগের ফলে পশ্চিমবঙ্গের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলি বিপদের মধ্যে পড়েছে। এমনকি ২০১৪ পরবর্তীকালে অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে হিন্দুস্তান কেবলস কারখানা উঠে গেছে। ২০০২এ উঠে গেছে কন্যাপুর সাইকেল কারখানা। দুর্গাপুর মিশ্র ইস্পাত কারখানাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র জারি রয়েছে। ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই এখনও পর্যন্ত এই কারখানা টিকে আছে। পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিতে বিপন্ন ডিভিসি, বার্নস, ডিএসপি, ব্রিজ এন্ড রূফ। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করার পরিকল্পনায় এখন অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতেও নিয়ে এসেছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পনা করতে চলেছে ইস্টার্ন গোল্ড ফিল্ড লিমিটেড ও ভারত কোকিং কোল লিমিটেড কোম্পানি দুটিকে কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড থেকে বের করে দিতে। এর ফলে খুব তাড়াতাড়ি বিপন্ন হয়ে পড়বে ই সি এল এবং বি সি সি এল এবং কর্মরত লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মচারী। এ প্রসঙ্গেই আমরা স্মরণ করতে পারি ই সি এল কে রক্ষা করতে বামফ্রন্ট সরকার অতীতে আড়াইশো কোটি টাকা সেস ছেড়ে দিয়েছিল।
ক্রমশ চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভের অস্তিত্ব বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে ভারত সরকার। পরিকল্পিতভাবে বারানসি এবং গুজরাটে বেসরকারি লোকোমোটিভ কে তুলে ধরতে গিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সি এল ডব্লু কে বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। গুজরাটে যে প্রযুক্তি দিয়ে ৯৫০০ হর্স পাওয়ার ইঞ্জিন তৈরি করা হবে, তা নির্মাণে সি এল ডব্লু সক্ষম। করা অতীতে নয়া উদারনীতির প্রথম দিকে সুইডেনের লোকোমোটিভ কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জয়ী হয়েছিল চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ।
অন্য বিষয়ের মতই নয়া উদারবাদি জামানায় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম। দুর্গাপুর প্রজেক্ট লিমিটেড, দুর্গাপুর কেমিক্যালস লিমিটেড, বেঙ্গল কেমিক্যাল সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নেতিবাচক মনোভাবে তা স্পষ্ট।
রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলির বিলগ্নীকরণ থেকে সংগৃহীত অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পগুলিতে অর্থ যোগাতে সাহায্য করবে বলে কেন্দ্রীয় সরকার বলছে। আসলে এটা একটা অজুহাত। নয়া উদারবাদী পর্বে কর্পোরেটগুলিকে বিপুল পরিমাণ কর ছাড় এবং ব্যাংক ঋণ মুকুব করা হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেট গুলির কাছ থেকে প্রাপ্য ১০ লক্ষ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ মুকুব করে দিয়েছে। অথচ এই অর্থ সরকারের ন্যায্য পাওনা এবং তা জনগণের কাজে ব্যবহারযোগ্য। পুঁজিবাদী বিকাশের এই কাজটি আজকের কেন্দ্রীয় সরকার করবে না। কারণ পৃথিবীব্যাপী ধান্দার ধনতন্ত্রের সর্বব্যাপী লুণ্ঠনের মধ্যেই ভারতের নয়া উদারবাদ কাজ করছে। এখানে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছালেও কর্পোরেটের মুনাফায় কোনো ঘাটতি নেই। শিল্প, কৃষি বা পরিষেবা প্রতিটি ক্ষেত্রেই কর্পোরেটের সর্বোচ্চ মুনাফার স্বার্থে দায়বদ্ধ আরএসএস/বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার। এই সূত্রেই বর্তমানে 'কর্পোরেট হিন্দুত্ব' ভারতীয় আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিতে একটি পরিচিত শব্দবন্ধ। এটি হলো শ্রমজীবী মানুষের উপর ফ্যাসিস্তধর্মী আক্রমণ সংগঠিত করার মতাদর্শগত ও প্রয়োগগত হাতিয়ার। ভারতের এই কর্পোরেট হিন্দুত্বের শাসনে লুণ্ঠনের পথে মুনাফা সর্বোচ্চকরনের সাম্প্রতিক একটি নমুনা পেশ করা যেতে পারে। সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা জানিয়েছে গত ছয় বছর আগে ভারতীয় বিলিওনিওরদের মুনাফার ২৯ শতাংশ আসতো ক্রোনি ক্ষেত্র থেকে, বর্তমানে যা ৪৩ শতাংশে পৌঁছে গেছে। বলাবাহুল্য এই হার ক্রমবর্ধমান। এর থেকে সহজে বোঝা যায় ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রগুলি কে দুর্বল ও ধ্বংস করা, অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ লঘু করা, উৎপাদনের ক্ষেত্রকে বিকশিত না করেও কেবলমাত্র আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে মুনাফার সর্বোচ্চকরন ভারতকে কোন বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে।
ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র কে দুর্বল করা মানে যে বুনিয়াদি নীতির ভিত্তিতে স্বাধীন আধুনিক ভারত নির্মাণ শুরু হয়েছিল তাকে বিপন্ন করা। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তব যে রাজনৈতিক শক্তির স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ন্যূনতম সংযোগ নেই যাদের চিন্তার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের কোন অনুভূতি নেই তারাই আজ রাষ্ট্র কাঠামোর শীর্ষ থেকে জনসমাজের প্রায় সর্বত্র অনুপ্রবেশ করেছে, আধিপত্য বিস্তার করেছে। বহুত্ববাদী ভারতবর্ষে ভারতীয় রেল, ব্যাংক-বিমা, পোস্ট, টেলিকম কিংবা প্রায় সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলির শুধুমাত্র অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছিল বা আছে তাই নয়, বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক ভারতের সংহতি ও ঐক্যের পক্ষে প্রয়োজনীয়। সীমাবদ্ধতা নিয়েও ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান গুলি ও রাষ্ট্র পরিচালিত অর্থনীতি, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে বহুত্ববাদী ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনীতি। আজকের ধান্দার ধনতন্ত্রের স্বার্থে এই রাজনৈতিক-অর্থনীতির উপর কর্পোরেট হিন্দুত্বের নামে ফ্যাসিস্তধর্মী আক্রমণ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান রক্ষার সংগ্রাম আজ বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক আধুনিক ভারত নির্মাণকে জারি রাখার সংগ্রামের অংশ।