শেয়ার করুন
প্যান্ডেমিকের প্রতিরোধে - সৃজন ভট্টাচার্য
রবিবার ১২ এপ্রিল ২০২০
করোনা। সামান্য একটা ভাইরাসই এখন থমকে দিয়েছে মানবসভ্যতাকে। সংবাদমাধ্যম প্যান্ডেমিকের নিকটতম বাংলা অনুবাদ বার করেছে, অতিমারী। অতিমারী যাতে মহামারীর চেহারা না নেয়, তার জন্য চিন্তিত আমি আপনি সবাই। লকডাউনে অভ্যস্ত নই কেউই, অথচ স্বেচ্ছাবন্দি থাকাটাই এই মুহূর্তের সবথেকে জরুরি কাজ। এস এফ আই'এর অবশ্য পুরোটা ঘরে থাকার ফুরসৎ নেই - মানুষ যাতে ঘরে বেঁচেবর্তে থাকেন, আমরা সেজন্য রাস্তায়। হ্যাঁ, চিকিৎসকদের পরামর্শ, প্রশাসনের নির্দেশ, সবটা মেনেই।
যখন প্রথম করোনা নিয়ে প্রাথমিক আশঙ্কা তৈরি হতে থাকে, আমরা বিভিন্ন জেলার এস এফ আই ইউনিট'গুলিকে খবর দিয়ে কতগুলো সাধারণ কথাই বলেছিলাম। কমরেডদের সাবধানে থাকতে বলা, বড় জমায়েত এড়িয়ে যাওয়া, ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার ইত্যাদি। লিফলেট বানিয়ে বিলি করা হয় রাজ্যজুড়ে, আমাদের মেডিক্যাল সেকশনকে বলা হয় বাড়তি ভূমিকা নিতে। তখনও লকডাউন ঘোষিত হয়নি।
মূলত স্যানিটাইজার এবং সাথে মাস্ক, সময়ের সাথে প্রয়োজন বাড়ে দুয়েরই। সরকার পারছে না সর্বত্র, আমরা কি ঘরে বসে থাকব? কমরেডরা নেমে পড়ল স্যানিটাইজর বানাতে। অধিকাংশ এলাকাতেই যৌথভাবে কাজ করতে এগিয়ে এলেন যুব আন্দোলনের কমরেডরাও। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে, ছাত্রযুব আন্দোলনের কর্মীরা নিজেরাই মাস্ক এবং স্যানিটাইজর বানিয়ে বিলি করছে এলাকার মানুষের মধ্যে, গত ক'দিনে এটা মোটামুটি পরিচিত দৃশ্য হয়ে উঠেছে। লকডাউন ঘোষণা হতে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই গোটা সংগঠন যেন বলে উঠল, আমরা পাশে আছি মানুষের।
প্রায় সমস্ত জেলার অভিজ্ঞতা৷ মানুষ হঠাৎ অসুবিধায় পড়ে গিয়েছেন ব্যাপক। আমাদের দেশে লকডাউন 'এনজয়' করার বিলাসিতা দেখাতেউ পারেন এমন মানুষ কতই আর? ফোন আসছে নিরন্তর। অন্য রাজ্যে কেউ আটকে পড়েছেন, যোগাযোগ করতে হবে, কমরেডরা আছে। বয়স হয়েছে, বাজার করা দায়, চাল ডাল তেল পৌঁছে দেওয়া, কমরেডরা আছে। ঋতুচক্রের সময়, স্যানিটারি ন্যাপকিন চাই, বেরনো যাচ্ছে না, কমরেডরা আছে। খাবার ফুরিয়ে গিয়েছে, টাকাপয়সা শেষের পথে, অভুক্ত যাতে না থাকেন কেউ, কমরেডরা আছে। ওষুধপথ্য তো বটেই, রক্তও যদি লাগে কারও, কমরেডরা আছে। রাজ্যজুড়ে রক্তের সঙ্কট, তার মধ্যেই, প্রশাসনের অসহযোগিতা সত্ত্বেও, কমরেড সুদীপ্ত গুপ্ত'র শহীদদিবসকে কেন্দ্র করে হাজার ইউনিট রক্ত দিল এস এফ আই কর্মীরা।
দু'একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। কলকাতা থেকে আলিপুরদুয়ার নিয়ে যেতে হবে অসুস্থ ব্যক্তিকে, গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না কোনোমতে, এমনকী প্রশাসনও সুরাহা করতে পারছে না। দু'দিন অক্লান্ত প্রচেষ্টার পর এস এফ আই কর্মীরা জোগাড় করে দিলেন গাড়ি, সাবধানে বাড়ি ফিরে গেলেন ওই অসুস্থ ব্যক্তি। আর এক জায়গায় দেখলাম, লকডাউনের জন্য অন্তঃসত্ত্বাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন আমাদের কর্মীরা, পরে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, মা ও সদ্যোজাত শিশু দুজনেই সুস্থ রয়েছেন। মুখে হাসি ফুটতে না ফুটতে ফোন এল, লকডাউনের ফলে লোক পাওয়া যাচ্ছিল না - মরদেহের শেষকার্যে হাত লাগাতে ছুটে গিয়েছে বাম ছাত্রযুব কর্মীরা।
শুধু রাস্তায় নেমে ত্রাণকার্যে হাত লাগানোই নয়, এস এফ আই আছে বইখাতা'র সমস্যাতেও। লকডাউন ঘোষণা হতেই বোঝা গেল, একধাক্কায় লেখাপড়া পিছিয়ে যাবে অনেকটাই। সিবিসিএস'এর সময়ে - সিলেবাস বাকি পড়ে যাওয়ার ঝক্কি অনেক। তাই, লেখাপড়া খানিক এগিয়ে রাখার জন্যেই আমরা অনুরোধ করেছিলাম বিশিষ্ট অধ্যাপকদের, যদি তাঁরা অনলাইনেই ক্লাস করাতে সম্মত হন। তাঁদের সম্মতিতে শুরু হলো অনলাইন আলোচনা - পোশাকি নাম 'কোয়ারেন্টাইন ক্লাসরুম'। সরকারের কাছে অনলাইন ক্লাস নেওয়ার দাবি সর্বাগ্রে জানালাম আমরাই, এখন ধীরে ধীরে যে পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে সরকার। তবে এখনো দরিদ্র প্রান্তিক অংশের কাছে পৌঁছনো বাকি, যে ছাত্রের বাড়িতে অন্তত একটাও স্মার্টফোন নেই, তারই কাছে লেখাপড়ার উপাদান পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে বাড়তি ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন, এটাও বলেছি আমরা। দাবি থাকছে মিড ডে মিল প্রকল্পের আওতাভুক্ত প্রতিটি ছাত্রের বাড়িতে রোজ খাবার পৌঁছে দেওয়ার, দাবি থাকছে স্কুল-কলেজে লকডাউন পিরিয়ডের ফি'টুকু মকুবেরও। গবেষকদের স্টাইপেন্ডের সমস্যা নিয়েও সোচ্চার হয়েছি আমরা। দেশের বা রাজ্যের ভিতরে ঘর থেকে দূরে আটকে পড়া ছাত্রদের জন্যও বাড়তি ভূমিকা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে এস এফ আই।
<,br>
এই সময়টা বিজ্ঞানমনস্কতার।
এই সঙ্কটকে যারা গোমূত্র খাইয়ে আর যজ্ঞ করে পার করাতে চাইছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে 'লকডাউন কমিকস'। গানে গল্পে আড্ডায় আমরা বার্তা দিচ্ছি যৌথতার, সৌভ্রাতৃত্বের।উ করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করেও বামপন্থীদের সম্বন্ধে কুৎসা ছড়ানোর কাজ অব্যাহত রেখেছে আরএসএস। আমরা বলছি, সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এখন লড়তে হবে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করার জন্য। ডিস্ট্যান্সিং হোক ফিজিক্যাল, কাছাকাছি আসুক আমাদের মন।
এখনো অনেক জায়গায় নামা যায়নি। যতদূর নামলে শান্তিতে ঘুমানো যেত রাতে, তার ধারেপাশেও যাওয়া যায়নি এখনো। বাকি অনেক পাড়া, অনেক অঞ্চল, অনেক গ্রাম। সঙ্কট বাড়ছে, চাহিদাও বাড়ছে রোজ৷ এই সময়টা কর্তব্যপালনের, এবং রাজ্যজুড়ে বাম ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা যে কাজ করছেন, তা নিঃসন্দেহে কুর্নিশযোগ্য। আমরা সেলাম জানাতে তেমন সকল কমরেডকে, যারা কোনো না কোনো ভাবে এই কঠিন কঠিনতর হতে থাকা পরিস্থিতিটাকে বাকিদের জন্য একটু সহজ করে তোলার চেষ্টা করছেন৷ আমরা গর্বিত, আমাদের সহযোদ্ধাদের জন্য।
এখনো বেশকিছু দিন এই অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে চলতে হবে সকলকে। সাবধানে থাকবেন সকলে। প্রশাসনের সাথে সহযোগিতা করতে হবে আমাদের সবাইকে। কোথাও কোনো অসুবিধা হলে, আমাদের যে কাউকে জানাতে পারেন। আমরা আছি, এটুকুই বলার আপনাকে।