পঞ্চায়েত আর মহাজনের গল্প - চন্দন দাস...

১৬ অক্টোবর ২০২২, রবিবার

ষষ্ঠ পর্ব

কাকদ্বীপের গল্প। ১৯৮২-৮৩-র গল্প।
গল্প — কিন্তু সত্যি।
কাকদ্বীপে প্রতাপাদিত্য নগর নামে একটি পঞ্চায়েত আছে। তখনও ছিল। সেই পঞ্চায়েতের সদস্যরা একটি পরিকল্পনা করে। ১০০জন মহিলাকে ছান্দি জাল তৈরির জন্য ৫৬হাজার টাকার ব্যবস্থা করে দেয় পঞ্চায়েত। জাল তৈরি করবেন মহিলারা। বিক্রি করবেন নিজেদের ঠিক করা দামে। মহাজনের মাতব্বরি চলবে না। কারন — টাকা মহাজনের থেকে নিচ্ছেন না।
মহাজনরা জাল প্রতি মজুরি দিত ৮টাকা। কিন্তু পঞ্চায়েত মজুরি দেওয়া শুরু করল ১৭টাকা — দ্বিগুণের বেশি। মহাজন দেখল ঘোর বিপদ। তারা মজুরি বাড়িয়ে করল ১২টাকা। মহাজনরা মহিলাদের থেকে জাল নিয়ে তা বিক্রি করত ৪৫ টাকায়। চাহিদার মরশুমে তা ৭০ টাকাতেও পৌঁছোত। কিন্তু পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সেই জাল বিক্রি শুরু হল অনেক কম টাকায়। ফলে মৎসজীবীরাও খুশি। তাঁরাও সেই জালই কিনতে শুরু করলেন।
পঞ্চায়েতের এই প্রকল্পটি এতটাই জনপ্রিয় হল ওই এলাকায় যে, কিছুদিনের মধ্যেই ৭০০ মহিলা ওই প্রকল্পে যুক্ত হলেন। ৬ মাসে প্রথম ১০০জন মহিলার লাভ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২০ হাজার টাকা।


এ’ তো শুধু একটি বর্ণনা। এমন অনেক ঘটনা পঞ্চায়েত ঘটাচ্ছিল গ্রামে, যাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মহাজন-জোতদারদের কর্তৃত্ব ভাঙছিল। অর্থনীতির গতি বাড়ছিল। বাজার বাড়ছিল। গ্রামীণ সমাজ বদলাতে শুরু করেছিল। ‘অপারেশন বর্গা’ নিয়ে কলকাতার একটি সংস্থা সমীক্ষা চালিয়েছিল ১৯৮২-তে। তার একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সেই রিপোর্টে দেখা যায়, ৪০% বর্গাদার উৎপাদন বৃদ্ধি করতে এবং ৬০% বর্গাদার আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছিলেন ওই সময়ে। গ্রামীণ মহাজন তখনও ছিল। কিন্তু বর্গাদাররা মহাজনের সঙ্গে সুদ নিয়ে দর কষাকাষি করছিলেন। এবং ২০% বর্গাদার মহাজনের ঋণ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে গেছিলেন।


আসলে পঞ্চায়েত গ্রামীণ সমাজে গরিব, মধ্যবিত্তের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলছিল। সাহস তৈরি হচ্ছিল ঘরে ঘরে। একটি ঘটনা বলা যাক। সিপিআই(এম) নেতা, কমরেড মহবুব জাহেদির একটি অভিজ্ঞতা। তিনি লিখছেন,‘‘আদিবাসী পাড়ার দুধবাগানে প্রাথমিক স্কুলের ভিত কাটার কাজ কাজ করছিল শ্যাম মাঝি। কোদাল চালাতে চালাতেই শ্যাম মাঝি বললেন,‘এই স্কুলটাকে আমার কচি বৌয়ের কচি হাত দিয়ে এমন লেপিয়ে দেওয়া করাবো যে, বুঝতে পারবে সবাই এই স্কুল আমাদের।’’
পঞ্চায়েত স্কুল বানিয়েছে গণউদ্যোগে। পঞ্চায়েত সমাজে ‘আমরা’ বোধ প্রতিষ্ঠা করেছে। এমন অনেক ঘটনা পঞ্চায়েতের ইতিহাস তৈরি করেছে। তত্বকে বাস্তবে প্রমাণিত করেছে। কারন — বামফ্রন্ট ছিল।
আর কী হয়েছে গ্রামে?
‘জমি বিলি দেখিয়েই সিপিএম অনেক দিন চালিয়ে গেছিল।’ সুব্রত মুখার্জি বারবার এই কথা বলতেন। মমতা-শাসনে মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর ঘরে অনেকবার মুখোমুখি কথা বলেছি। তখন বারবার তাঁর মুখে এটি শুনেছি।
এমন কথা অনেক বামফ্রন্ট বিরোধীর মুখেই শোনা গেছে। বহুবার। এমন একটা ধারনাও সমাজে গড়িয়ে দেওয়ার কাজ সংবাদপত্রগুলিও করেছে।


যদি প্রশ্ন করা হয় শস্য বীমা রাজ্যে কবে চালু হয়েছে? বলতে পারবেন না অনেকেই। রাজ্য সরকারের তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গে শস্য বীমা প্রথম চালু হয় ১৯৭৯-৮০ আর্থিক বছরে। প্রথমে শুধু আমন ধানকে এর আওতায় আনা হয়েছিল। পরের বছর আউশ, আমন, বোরো এবং আলু এই বীমার আওতায় আসে। কৃষকের ক্ষতিপূরণের ৭৫% সাধারন বীমা কর্পোরেশন এবং ২৫% টাকা রাজ্য সরকার দিত।
কৃষি পেনশন? চালু হয় ১৯৮০-৮১-তে। ক’জন জানি?
খেতমজুর, বর্গাদার এবং অনধিক ৩ বিঘা জমির মালিক কৃষককে মাসে ৬০ টাকা পেনশন দেওয়া শুরু হয় প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনের দু’ বছর পর থেকে।
ক্ষুদ্র সেচে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল বামফ্রন্ট। ১৯৭৮-৭৯ আর্থিক বছরেই তা শুরু হয়। ছোট ছোট বাঁধ, খাল খনন কিংবা সংস্কার, স্লুইজ তৈরির মত কাজে আগে ৫০% টাকা কৃষকদের দিতে হত। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে তার পুরোটাই সরকার দেওয়া শুরু করে। ফলে কৃষকের ভার অনেকটা লাঘব হয়।
পঞ্চায়েত তৈরি হওয়ার পর বর্গাদাররা কিভাবে সুরক্ষিত হলেন?

১৯৭৭-র আগে রাজ্যে নথিভুক্ত বর্গাদার ছিলেন ২লক্ষ ৫০ হাজার। পঞ্চায়েতের সহযোগিতায় বর্গাদার নথিভুক্তি শুরু হয় ১৯৭৮-র আগস্ট থেকে। ১৯৮২-র ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজ্যে নথিভুক্ত বর্গাদারের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ লক্ষ ৬ হাজার। বর্গাদার এবং খেতমজুরদের বাস্তুজমি দেওয়ার কাজ শুরু হয় প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে। ১৯৮২-র ১ জানুয়ারির আগে এতে উপকৃত হন ১লক্ষ ৪৭ হাজার কৃষিজীবী। তাঁদের মধ্যে তফসিলি জাতির ছিলেন ৬১ হাজার। আর আদিবাসী ছিলেন ২৮হাজার ৭০০-র বেশি।

ক্রমশ

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক চন্দন দাস এর এই প্রবন্ধটি ১২ টি পর্বে প্রকাশিত হবে। পাঠকদের কাছে আবেদন প্রতিবেদনটি পড়ুন ও শেয়ার করুন


শেয়ার করুন

উত্তর দিন