ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র পলিটব্যুরো নিম্নলিখিত বিবৃতি দিয়েছেঃ
কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৩-২৪ এমন এক সময়ে পেশ হয়েছে যখন ভারতের অর্থনীতি অতিমারীর কারণে গতি হারিয়ে ফেলেছে, ২ অতিমারী বছরে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতিমারী পরবর্তীতে অর্থনীতি চাঙ্গা হতে গিয়ে বিশ্ব-অর্থনীতির গতিহীনতার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যে বিশ্ব-অর্থনীতি সম্ভবত এক মন্দার দিকে এগোচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, গৃহস্থের চাহিদা পূরণের মত কেন্দ্রীয় বিষয়গুলি এই বাজেটে উল্লেখ হওয়া উচিৎ ছিল।
এই বাজেট এহেন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, রাজস্ব ঘাটতি সমস্যা মোকাবিলা করতে সরকার ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছে, যদিও সরকার ধনীদের আরও বেশী রাজস্ব ছাড় দিয়েছে। এমন সময় এই বাজেট পেশ হচ্ছে যখন অক্সফ্যাম রিপোর্ট বলছে দেশের ধনীতম ১ শতাংশ মানুষ শেষ দুবছরে উৎপন্ন হওয়া সমগ্র সম্পদের ৪০.৫ শতাংশ কুক্ষিগত করে রেখেছে। এটি এমন একটি দ্বিচারী বাজেট যা অর্থনৈতিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
২০২২-২৩’র আনুমানিক ব্যয়ের তুলনায় ২০২৩-২৪ এর মোট সরকারি ব্যয়ের বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ যখন একই সময়ে নগন্য জিডিপি বৃদ্ধি (মুদ্রাস্ফীতির সাথে) আনুমানিক ১০.৫ শতাংশ। এইভাবে, জিডিপির শতাংশ হিসাবে সরকারী ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। যদি সুদ পরিশোধের কথা বাদ দেওয়া হয় তাহলে এই ব্যয় গত বছরের তুলনায় মাত্র ৫.৪ শতাংশ বেশি। দেশীয় বাজারে মুদ্রাস্ফীতির হার ৪ শতাংশ এবং প্রায় ১ শতাংশ জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধরে নিয়ে হিসাব করা হলে, এই তথাকথিত "জন-কেন্দ্রিক" বাজেট আমাদের জনসংখ্যার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবিকাকে আরও বেশী আক্রমণ করে।
যখন বেকারত্বের হার ঐতিহাসিক উচ্চতায়, তখন বাজেটে রেগায় বরাদ্দ ৩৩ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হল। খাদ্যে ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া হল ৯০,০০০ কোটি টাকা, সারের বরাদ্দ থেকে কমানো হল ৫০,০০০ কোটি টাকা, পেট্রোলিয়াম ভর্তুকি কমানো হল ৬,৯০০ কোটি টাকা।
অতিমারীতে ধ্বসে যাওয়ার উপক্রম হওয়ার পরেও, গত বছর স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দের ৯২৫৫ কোটি টাকা ব্যয় করতে পারে নি সরকার, একইভাবে, শিক্ষা বাজেটে ৪২৯৭ কোটি টাকা ব্যয় করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আই সি ডি এস কর্মচারীদের বেতন এমনিতেই যথেষ্ট কম, সেই খাতে কোনো বাড়তি বরাদ্দ নেই। লিঙ্গ সাম্যের প্রশ্নে বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ। দেশে এস সি ও এস টি জনগোষ্ঠী ভুক্ত রয়েছেন যথাক্রমে ১৬ শতাংশ ও ৮.৬ শতাংশ অথচ এদের জন্য বরাদ্দের অংশ মাত্র ৩.৫ ও ২.৭ শতাংশ। কৃষকদের রোজগার দ্বিগুণ হবে বলে বড় বড় কথা বলে এখন দেখা যাচ্ছে পি এম কিষান ফান্ডে বরাদ্দ ৬৮০০০ কোটি থেকে কমে ৬০০০০ কোটি হয়েছে।
সরকার দাবি করছেন কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে তারা যথেষ্ট পরিমাণে মূলধনের ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই দাবিতে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। ২০২২-২৩ এর হিসাবকে ধরলে দেখা যাবে পাবলিক এক্সপেন্ডিচার বা জনস্বার্থে খরচ সমেত ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার বা মোট বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৯.৬ শতাংশ। অথচ জিডিপি র স্বাভাবিক হার ১৫.৬ শতাংশ। সরকারের দাবি সম্পর্কে সন্দেহ অমূলক নয় এই কারণেই।
প্রত্যক্ষ কর আদায়ে আয়ের ঊর্ধ সীমা ৫ থেকে ৭ লক্ষ করে দেওয়ায় বেতনভুক জনতার একটি অংশ কিছুটা রিলিফ পাবেন ঠিকই, কিন্তু এই সময়েই মূল্যবৃদ্ধির হার যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে অচিরেই এই সুবিধাটুকু ও ততটা কার্যকরী হবে না, যা প্রচার করা হচ্ছে। একই সময়ে সামাজিক খাত সমূহে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যার ফলে জনসাধারণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ প্রতিনিয়ত জরুরী এমন অনেক পরিষেবা পেতে অনেক বেশি খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিষয়টি আয় ও প্রকৃত আয়ের নিরিখে বিচার করলেই বোঝা যাবে।
এই বাজেটেও অর্থের বন্টন প্রসঙ্গে কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কটিকে আরও সংকুচিত করা হল। আদায়কৃত অর্থে (কর সহ অন্যান্য খাতে সরকারের আয় বাবদ) রাজ্যগুলির ন্যায্য দাবী খারিজ করে কেন্দ্রের অধিকারকে বাড়িয়ে দেওয়া চলছেই। ঋণ পেতে নতুন শর্ত প্রযোজ্য হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে যত বরাদ্দ ছিল তার সাথে চলতি সময়ের মূল্যবৃদ্ধির হার (৮.৪%) কে ধরলে দেখা যাবে ২০২২-২৩ এ রাজ্যের জন্য বরাদ্দ আদৌ বৃদ্ধি পায়নি।
অর্থবর্ষে ধনীদের (কর্পোরেট) জন্য কর আদায়ে আরও ছাড় দেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর ঘোষনা অনুযায়ী এমন ছাড়ে সরকারের রেভিনিউ লস (ক্ষতি) প্রায় ৩৫০০০ কোটি টাকার।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে জনসাধারণকে প্রকৃত অর্থে রিলিফ দিতে এবং দেশীয় বাজারে চাহিদার ঘাটতি মোকাবিলা করতে বাজেট ঘোষনায় যা যা উল্লেখ করতে হত সেগুলি হল:
১) কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে কার্যকরী রূপে পরিকাঠামো খাতে বরাদ্দের (ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার) বৃদ্ধি।
২) বর্ধিত বেতন ক্রম সহ এম এন রেগার পরিসর আরও বাড়িয়ে দেওয়া।
৩) বিনামূল্যে ৫কেজি খাদ্য শস্যের সাথেই আরও ৫ কেজি শস্য সরকারি ভর্তুকির আওতায় এনে বিলি করা।
৪) সম্পত্তি কর সহ পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য সম্পদের উপরে কর চাপানো।
৫) খাদ্য, ওষুধ সহ নিত্য প্রয়োজনীয় সকল জরুরী পণ্যকে জি এস টি র আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া।
সিপিআই(এম) এই বাজেটের জনবিরোধী এবং দ্বিচারী অবস্থানের বিরুদ্ধে ২২ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ পর্যন্ত দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচী সংগঠিত করবে এবং উপরোক্ত দাবিগুলি বাস্তবায়িত করার দাবী জানাবে৷ জনগণের জীবন-জীবিকা রক্ষায় ব্রতী সকল অংশের মানুষের এই প্রতিবাদে অংশ নেওয়া উচিত।