পঞ্চায়েত নির্বাচন : মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠারই লড়াই

নিরাপদ সরদার

উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় ৬ টি ব্লক সুন্দরবনের মধ্যে । সন্দেশখালি ১ এবং সন্দেশখালি ২ নং ব্লক তার মধ্যে পড়ে। এই দুটি ব্লক নিয়ে সন্দেশখালি বিধানসভা কেন্দ্র। ২ টি ব্লকে ১৬ টি গ্রাম পঞ্চায়েত। দুটি থানা। একটি থানা ন্যাজাট,আর একটি সন্দেশখালি থানা। ১৩ নদী  ও ৯ টি দ্বীপ। বেশিরভাগ তপশিলী জাতি ও তপশিলী উপজাতি মানুষের বাস। অনেকটা এলাকা জুড়ে নোনা জলের ফিসারী ও অসংখ্য ইটভাটা। আয়ের উৎস চাষ,মাছ,খাল বিল, পুকুর সামান্য পশুপালন ও নদী এক মাত্র ভরসা।

২০১৬ র বিধানসভা নির্বাচন, ১৬ টি অঞ্চলেই আক্রমন, ভয় ভীতি ও সন্ত্রাস করার চেষ্টা করে তৃণমূল। বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। ভোটের দিন ৮২ টি বুথ দখল করে, এই বুথগুলিতে ৯৫ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছে তৃণমূল। এতদ সত্তেও বামফ্রন্ট ভোট পায় ২৩ শতাংশ। জয়লাভ করে তৃণমূলের সুকুমার মাহাতো। শুরু হয় অত্যাচার, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুট, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, টানা ১৫ দিন চলেছে এই অসহনীয় অত্যাচার। বহু মানুষ ঘরছাড়া। আজও অনেক মানুষ বাড়ি ফিরতে পারেনি। অনেকে বাইরেই পাকাপাকি ঠিকানা করে নিয়েছে। বামফ্রন্টের জেতা পঞ্চায়েতগুলি জোর করে, ভয় দেখিয়ে, খুনের হুমকি দিয়ে দখল করে নেয়। একের পর এক অঞ্চল তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনীর দখলে চলে যায়। প্রকাশ্যে গুলি, বন্দুক ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এলাকায় এলাকায় দাপাদাপিতে জনজীবনে বিরাট প্রভাব পড়ে। মানুষ ভয় ভিতিতে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লে শুরু হলো পঞ্চায়েতের টাকা লুট। কোটি কোটি টাকা লুট। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ফুলে ফেঁপে ওঠে। আরো শক্তিশালী করে গড়ে তোলে লুট এবং সন্ত্রাসের বাহিনী।

২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সন্দেশ খালি থেকে সিপিআই(এম) জয়লাভ করে। ২০১৩ পঞ্চায়েত নির্বাচন বামফ্রন্ট ৭ টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করে। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ১৮ শতাংশ ভোট পায়। এই নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস অসংখ্য বুথ দখল করে ব্যাপক রিগিং চালায়। ২০১৫ সাল থেকে বামফ্রন্টের মিটিং মিছিলে তৃণমূলের উপর আক্রমণ বাড়তে থাকে। বিধায়কের উপর একাধিকবার হামলা ও আক্রমনের ঘটনা ঘটে। খুলনাতে মিছিলের উপর হামলা, বিধায়ককে লক্ষ্য করে গুলি, ১৮ জন নারী পুরুষ বোমার আঘাতে আক্রান্ত। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে চাপ বাড়াতে থাকে। পুলিশ-প্রশাসনও সরাসরি তৃণমূলের হয়ে কাজ করতে থাকে।

২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রহশনে পরিনত হয়েছিল। সন্দেশখালিতে কোনও স্তরে কোনও প্রার্থীই বিরোধীরা দিতে পারেনি।বিডিও অফিস ছিল তৃণমূলের সশস্ত্র বাহিনীর দখলে আর নমিনেশনর টেবিল ছিল তৃণমূলের নেতাকর্মীদের দখলে। এসডিও অফিসেও নমিনেশন জমা দিতে পারেনি কেউ, সেটিও উন্নয়ন বাহিনীর দখলে রাখা হয়েছিল। বামপন্থীরা নমিনেশন দিতে চেষ্টা করেছিল এই অপরাধে ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছে। রাস্তায় মেরে ফেলে রেখেছে, হাসপাতালে আনার সাহস পায় নি কেউ। ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচন। সন্দেশখালির মানুষকে পুতুলের মত ব্যবহার করেছে তৃণমূল। সমস্ত বুথের ভোট লুট করেছে, পুলিশের সামনেই। তারা নির্বাক দর্শক হিসাবে সক্রিয় ছিল।

২০২৩ এর পঞ্চায়েত নির্বাচন। এই নির্বাচনের মানে কি? সরকার চায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে। তাহলে ভোট কেন? সন্দেশখালির কোন স্তরেই বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেনি। দ্বীপ এলাকায় সমস্ত রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ। ফেরীঘাট বন্ধ। কোনও লোক নদী পেরিয়ে বিডিও অফিস যেতে পারেনি। ঘাটে ঘাটে তৃণমূলের সশস্ত্র বাহিনীর টহলদারী। সন্ত্রাস ও আক্রমন, মানুষকে ভীত সন্ত্রস্ত করেছে। এতদসত্ত্বেও সিপিআই(এম) ছয়টির মধ্যে চারটি জেলা পরিষদের আসনে প্রার্থী দিয়েছে। কিন্তু প্রচার করার অধিকার নেই। মানুষের উপর প্রচন্ড ভাবে আক্রমন ও সন্ত্রাস নামানো হয়েছে। এলাকাবাসীকে তৃণমূলের বশংবদ হতে বাধ্য করা হচ্ছে। কথা না মানলেই ঘরবাড়ি ভাঙচুর, মারধর, অত্যাচার চলবে- ঘরছাড়া অবধি হতে হবে।

শারিরীক- মানসিক নির্যাতন, বাড়িতে হামলা, পরিবারের উপরে আক্রমণ, শেষ পর্যন্ত ঘরছাড়া হতে হয়েছে অনেককেই।

সন্দেশখালিতে ভোটের কোন পরিবেশই নেই। মানুষ ভোট দিতে পারবেনা। সমস্ত বুথ এলাকা জুড়েই সন্ত্রাসের প্রকোপ।

মানুষকে এখনও অবধি ঘর থেকে বেরোতে দেওয়া হয়নি, তৃণমূলের পরিকল্পনাই এমন। সব বুথই স্পর্শকাতর। দলদাসের প্রতীক মেরুদন্ডহীন নির্বাচন কমিশনকে বলে কোনও লাভ নেই।

এখন মানুষের প্রশ্ন - জনগনের দ্বারা নির্বাচিত হন, জনপ্রতিনিধি। জনগনের ভোট না নিয়ে বিনা ভোটে কি করে জনপ্রতিনিধি হবেন!

সরকারে যারা থাকবে বা ক্ষমতায় যারা থাকবে তারা যাকে ঠিক করে দেবে সেই কি জনপ্রতিনিধি হবে? তাহলে তো ভোটের দরকার নেই। ভোট না হলে মানুষ কি ভাবে তার গনতন্ত্র প্রয়োগ করবে? গনতন্ত্র প্রয়োগের কোন ব্যবস্থাই যদি না থাকে তবে সে কেমন গণতন্ত্র!

সন্দেশখালির মানুষের গনতান্ত্রিক অধিকার নেই? বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীদের বোর্ড গঠনের কোন অধিকার থাকে কিভাবে? তাই লড়াই করেই মানুষকে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়, হবে। আমরা সেই লড়াইতেই শরিক।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন