PE 2

পঞ্চায়েত নির্বাচন ও আমাদের কাজ (২য় পর্ব)

গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জী

কোথাও কোথাও বিজেপিকে সাথে নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করে তৃণমুলকে হারানোর মানসিকতা তৈরি করার কূটকৌশল তৈরি করছে আরএসএস, তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমকে নিয়ে। সাধারণ মানুষের সামান্য অংশের মধ্যেও এর প্রভাব দেখা দিলে তার বিরুদ্ধে আমাদের মতাদর্শগত ভাবেই লড়তে হবে।

বিজেপি সহ যে কোন মৌলবাদী শক্তির চরিত্র বিচারে সামান্য দূর্বলতাও চরম বিপর্যয়ের সামনে গনতান্ত্রিক আন্দোলনকে ঠেলে দেবে। এই প্রবনতা দেখা দিলে তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই লড়তে হবে। সমাজের স্বার্থেই এই মতাদর্শের লড়াই জরুরী।

জাতীয় ঐক্য বিনাশকারী শক্তি আর এস এস নিয়ন্ত্রিত সংঘ পরিবার নানা ভাবে পশ্চিমবঙ্গে তাদের সংগঠনের বিস্তার ঘটাচ্ছে। এদের সব সংগঠনের খবর আমজনতার কাছে এবং গনতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী সমর্থকদের কাছেও নেই। সংঘ পরিবারের যে সব গনসংগঠন আছে তার মধ্যে একটি হল বিজেপি । লক্ষ্য করলে নিশ্চয়ই দেখা যাবে বিজেপির কোন শাখা সংগঠন নেই, সব শাখা সংগঠনই সব আর এস এস এর।

সারাদেশে আর এস এস এর যা শাখা সংগঠন গড়ে উঠেছে তার গড় বৃদ্ধি অন্য সব রাজ্যের তুলনায় আমাদের রাজ্যে সব থেকে বেশী। গত ১২ মার্চ থেকে ১৪ ,মার্চ হরিয়ানার পানিপথে আয়োজিত আর এস এস এর সভার  বার্ষিক রিপোর্টে আর এস এস এর বার্ষিক রিপোর্ট যা জনসমক্ষে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ এর মার্চের তুলনায় ২০২৩ মার্চে এই রাজ্যে আর এস এস এর শাখার সংখ্যা বেড়েছে ৫৮৩ টি। গত ৩ বছরে এই রাজ্যে মোট শাখা ছিল ২৯১৯ টি, ২০২৩ মার্চে তা বেড়ে হয়েছে ৩৫০২ টি। সারা দেশে আর এস এস এর যা শাখা সংগঠন গড়ে উঠেছে, তাদের মধ্যে  গড় বৃদ্ধি আমাদের রাজ্যে সব থেকে বেশী।

জঙ্গল মহলে শাখা ছিল ৮৭০ টি, ২০২৩ মার্চে ১১৯৩ টি হয়েছে। উত্তরবঙ্গে শাখা বেড়েছে ১৭৪ টি। দক্ষিনবঙ্গে বেড়েছে ৮৬ টি।

(সুত্র: বর্তমান রিপোর্ট, ১৮ মার্চ ২০২৩)

আরএসএস-র শাখার বৃদ্ধি এবং পশ্চিমবঙ্গ সাম্প্রদায়িক বাতবরণ সৃষ্টির দায় কোন মতেই তৃণমুল দল অস্বীকার করতে পারেনা। তৃণমূল দলের নরম সাম্প্রদায়িক মনোভাব আমাদের রাজ্যে আর আস এস এর আঁতুর ঘরে পরিনত হয়েছে। বামফ্রন্ট সময় কালে আর এস এস এবং বিজেপির এত বাড়বাড়ন্ত কখনোই সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

আমাদের পার্টি কর্মসূচির ৫.৭ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে - "… সাম্প্রদায়িক ও ফাসিস্ট ধাঁচের আরএসএস পরিচালিত জোটের শক্তি বৃদ্ধি ও কেন্দ্রে তাদের ক্ষমতা দখলের ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তির বিপদ গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহ, প্রশাসন, শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রচার মাধ্যমের সাম্প্রদায়িকীকরণের পরিকল্পিত প্রয়াস চলছে। সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার শক্তি বৃদ্ধি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়িকতার শক্তিকেও জোরদার করবে এবং জাতীয় ঐক্য বিপন্ন হবে। বিজেপি এবং তাদের সাম্প্রদায়িক মঞ্চের প্রতি বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণীর  কোনো কোনো অংশের সমর্থন, দেশের গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে গুরুতর বিপদের আশঙ্কা তৈরি করেছে। "কাজেই আর এস এস এবং বিজেপি'র বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই আমাদের সংগ্রামের ঐতিহাসিক দায়িত্ব। আর এস এস ও বিজেপি'কে ভারতের আর পাঁচটা রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে এক ক'রে না দেখা এবং এদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের নির্দেশের কথা আমাদের পার্টি সমর্থক, কর্মী, দরদিদের প্রতিটি পদক্ষেপে স্মরণে রাখা অতি প্রয়োজনীয় দায়িত্ব।

আমাদের রাজ্যে তৃণমুল দলটি মুখে গনতন্ত্রের কথা বললেও, আরএসএস-র সর্বাত্মক মতাদর্শিক কর্মসূচী রুপায়ণেই ব্যস্ত।

তৃনমুলের কার্যক্রমের সাথে আরএসএস-র ভাবাদর্শের অনেক মিল যে দেখা যাচ্ছে তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

নির্বাচন কমিশনে তৃনমুলের রেজিস্ট্রেশন এবং প্রতীক, বিজেপি এবং আর এস এস এর সাহায্য ছাড়া হত না।

মনে করে দেখুন এই দল গঠনের আগে মমতা ব্যানার্জি আর এস এস এর সদর দপ্তরের গিয়েছিলেন।ওদের সাহায্য চেয়েছিলেন। আর এস এস মা দূর্গার সাথে মমতা ব্যানার্জী তুলনা করেছিল। তার পর তৃণমূলের জন্ম।

এমন কি আমেরিকার বিদেশ সচিবও তৃনমুল দলের জন্মের আগে মমতা ব্যানার্জির সাথে, কাক শিল্পীর আতিথ্যে একান্তে গোপন বৈঠক করে গিয়েছিলেন, তা আমরা অনেকেই জানি। এর থেকে একটা কথাই প্রতিষ্ঠিত হয় যে, তৃনমুলের কার্যক্রমের সাথে  আর এস এস এর ভাবাদর্শের অনেক মিল। এই দলটি সর্বৈব ভাবে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং ধর্মীয় ফ্যাসিস্ত শক্তির মদতে পরিচালিত। স্বভাবতই সামাজিক বৈষম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তৃণমুল এবং আর এস এস পরিচালিত বিজেপি উভয়েই দেশের মধ্যে শ্রেনী সংগ্রামের বিকাশের ক্ষেত্রে শ্রমজীবীদের স্বার্থের প্রতি মারাত্মক বিপদ হিসাবে দেখা দিয়েছে।

বিজেপি আরএসএস সামাজিক বৈষম্যের সৃষ্টির জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করছে। তৃনমুল দলও সামাজিক বৈষম্যকে বৃদ্ধি করে চলেছে। এটাই ওদের মতাদর্শ।

কাজেই আরএসএস-বিজেপির মতাদর্শগত আক্রমন এবং সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, আমাদেরও মতাদর্শগত ভাবেই লড়তে হবে। না হলে শ্রেনী সংগ্রাম এবং মেহনতীদের মধ্যে শ্রেণী ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দুস্তর বাধা অতিক্রম করা খুবই কঠিন কাজ।

সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তীব্র করার দায়িত্ব কমিউনিস্টদের। সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, শ্রেণী সংগ্রামের এক অন্যতম পর্যায়। সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে দিল্লীর বিজেপির সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃণমুল সরকার কেউই কারো থেকে কম যায় না।

১১ বছর আগের সেনসাস অনুসারে ভারতে ১৪ কোটি কৃষি শ্রমিক এখন সব থেকে বড় অর্থনৈতিক শ্রেনী হিসাবে দেখা দিয়েছে। কৃষি শ্রমিকের ২০২২ অক্টোবরের হিসাব অনুসারে পুরুষদের ক্ষেত্রে গড় বেতন ছিল ৩৬৪ টাকা সেখানে মহিলাদের ছিল ২৭১ টাকা - বিপুল বৈষম্য। পুরুষদের ক্ষেত্রে গড় মাসে ১১০০০ টাকা আর মহিলাদের ৮০০০ টাকা মাত্র! পুরুষদের বেড়েছে ১৭% মহিলাদের মাত্র ১২%, যা মুল্যবৃদ্ধির সূচকে কার্যত আয় কমেছে। পুরুষদের মাত্র ২০৪ থেকে ২০৭, সেক্ষেত্রে মহিলাদের কমেছে ১৬০ টাকা থেকে ১৫২ টাকা।

মনরেগা ভারতের মানুষের ক্ষেত্রে একটা লাইফ লাইন। সেখানে ১৯-২০ সালে কাজ করতেন ৭.৮৮ কোটি। আর শেষ পাওয়া তথ্য অনুসারে কোভিডের আগে সেখানে ৮.১৯ কোটি নাগরিক কাজ করছেন। ২০২২ সালে এই কাজে গ্রামীন মানুষ গড় বেতন বাবদ বেতন পেয়েছেন মাত্র ২১৮ টাকা। ২০২১ এ ছিল ২০৯ টাকা,তার আগের ২০২০ সালে ছিল ২০১ টাকা। এই সময়ের আর্থিক সূচকে অর্থাৎ ২০২২ এর বেতনকে মুদ্রাস্ফীতির দিক থেকে দেখতে গেলে কার্যত আসল বেতন হল ১২২ টাকা! অর্থাৎ প্রায় ১০০ টাকা কমে গেল ২০২২সালে!

(সুত্র: PD13-20 Feb Subodh Varma)

২০২২ এর ক্ষুধা সূচকে ১২১ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭ তম। মানব উন্নয়ন সূচক অনুসারে ভারতের স্থান ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে এখন ভারতের স্থান ১২২-এ।

(সুত্র গনশক্তি ৭ এপ্রিল, ২০২২)

বিভিন্ন সরকারী সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২০২১ কৃষকদের আয় কমেছে বার্ষিক ১.৫% হারে। ১৩ কোটি মানুষ বাস করেন বস্তিতে। ১৯.৪% মানুষের কোনও শৌচাগার নেই। বিশ্বে অপুষ্টিতে আক্রান্ত জন সংখ্যার ২৫% বাস করেন ভারতে। ধনী দারিদ্রের মধ্যে বৈষম্য দারুন ভাবে বাড়ছে। 'অক্সফ্যাম' এর সারভাইভ্যাল দি রিচেস্ট রিপোর্ট অনুসারে দেশের সব চেয়ে ধনী ১% মোট সম্পদের ৪১% মালিক। আর নীচের ৫০% র হাতে মোট সম্পদের মাত্র ৩% আছে। ভারতের সর্বাধিক ধনী  ১০০ জনের মোট সম্পদের পরিমাণ ৫৪.২২ লক্ষ কোটি।সবচেয়ে ধনী ১০ জনের হাতে মোট সম্পদের পরিমাণ ২৭.৫২ লক্ষ কোটি! এই বছর ২২-২৩ আদানির একার সম্পদ বেড়েছে ৪৬% মোদির বদন্যাতায়। আদানী বিশ্বের ধনীদের মধ্যে তৃতীয় হয়েছিলেন, যদিও হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের পর আদানী সাম্রাজ্য আজ বিপর্যস্ত। করফাঁকি, নিজেদের ভুয়ো কোম্পানি খাড়া করে কৃত্রিমভাবে শেয়ার মুল্যবৃদ্ধি করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং বিমাসংস্থা কে কাজে লাগিয়েছে। আদানীদের সম্পদের যোগান দিতে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক-বিমা সংস্থা ক্ষতির মুখে।

দি ইকোনোমিস্ট এর তথ্য অনুসারে ২০১৬ থেকে ২০ এর মধ্যে আদানির সম্পদ বেড়েছে ৭৫০%।  এই সময়ে আম্বানীদের বেড়েছে ৩৫০%। আবার ভারত সরকার তার সম্পদ পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেবার জন্য ন্যাশনাল পাইপ লাইন পলিসি নিয়েছে। অন্য দিকে দেশে দারিদ্র সীমার নিচে  গরীব মানুষের সংখ্যা ২২ কোটি ৮৯ লক্ষ। যা বিশ্বে সর্বাধিক। ধনীদের তুলনায় গরীবের করের বোঝা অনেক বেশী। সামাজিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও সরকারের চরম অবহেলা। ২০১০  সালে দেশে প্রতি ১০হাজার জন  মানুষ পিছু হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা ছিল ৯, সেখানে ২০২০ সালে তা কমে হয়েছে ৫ টি। সেখানে বাংলাদেশ ৮.৭ টি, কেনিয়া ১৪ ও চিলিতে ২১টি। হাসপাতালে শয্যার হিসাবে ভারতের স্থান ১৬৭ টি দেশের মধ্যে ১৫৫ তম। রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি মুল্য কমেছে ৭৫%, সারে ২২%। আয়করের ওপর সার চার্জ কমানোর ফলে অতি ধনীদের সর্বোচ্চ করের হার  ৪৩% থেকে কমে হয়েছে ৩৯ %। কৃষক আন্দোলনের চাপে তিনটি কৃষি বিল প্রত্যাহার হলেও খাদ্যে ভর্তুকি কমেছে ৯০ হাজার কোটি টাকা।

ফ্রন্ট লাইনের তথ্য অনুসারে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, আমেরিকার জি ডি পি ২৫.০৩, চীনের ১৮.৩২ ট্রিলিয়ন ডলার। সেখানে ভারতের জি ডিপি মাত্র ৩.৪৬ ট্রিলায়ন ডলার। (সুত্র দেশহিতৈষী ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২)

যে দু নম্বর বড় লোক তার এক দিনের আয় প্রায় ২২০০ কোটি টাকা।

দারিদ্র হ্রাসের লড়াই সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রেই দেখুন ১৯৭৭-র আগে শহর-গ্রাম মিলিয়ে গড়ে ৬০ শতাংশের উপর মানুষ এ রাজ্যে দারিদ্রসীমার নীচে ছিলেন। ২০০৪-০৫ সালেই তা ২০.৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুসারে, দারিদ্র্য কমার হারে দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। কেরালার পরই ছিল পশ্চিমবঙ্গের স্থান। বামফ্রন্ট সময়কালে  রাজ্যে গরীব মানুষের সংখ্যা ছিল ২০% থেকে ২৫% এর মধ্যে ।১৯৭৭ এ বামফ্রন্ট যখন সরকারে আসে তখন রাজ্যে গরীব মানুষের সংখ্যা ছিল ৭৩ % বাকী ২০% মধ্যবিত্ত আর ১% রও কম তথাকথিত ধনী। (সুত্র: দেশহিতৈষী ১৭ ফেব্রুয়ারি)

রঙ্গরাজন কমিটির মত অনুসারে ৪৭ টাকা ভোগ্যপণ্যের জন্য ব্যয় করার ক্ষমতা হ'লো গ্রাম বাংলার অনুমোদিত স্বীকৃত দরিদ্র রেখা। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে তৃণমূল সরকারের আমলে গ্রাম বাংলার মাত্র ২০.৮৩ শতাংশ পরিবার রঙ্গরাজন কমিটি স্বীকৃত দারিদ্ররেখার উপরে বসবাস করেন। বাকি ৭৯.১৭% মানুষ যাঁদের দৈনিক ৪৭টাকার বেশি খরচ করার সামর্থ্য নেই। এই হল পশ্চিমবঙ্গের তৃনমুলী আমলে গ্রাম বাংলার উন্নয়নের চালচিত্র।

রাজ্যে মানুষের আয়ের পথ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। রাজ্য সরকার অস্বীকার করলেও রিজার্ভ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত শতকের নয় দশকে রাজ্যে আয় বৃদ্ধির বার্ষিক হার যেখানে ছিল ৬.০৯ শতাংশ, বামফ্রন্টের শেষ পাঁচ বছরে সামান্য কমে ৫.৭৬ শতাংশ হলেও, তৃণমূলের প্রথম সাত বছরে তা মারাত্মক কমে দাঁড়িয়েছে ৪.৯২ শতাংশ। (সুত্র সম্পাদকীয় মার্কসবাদী পথ: নভেম্বর ২০২২)

এখন  দরিদ্রতম রাজ্যের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান ১২ নম্বরে। দেশের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ রয়েছেন বিহারে । দ্বিতীয় ঝাড়খন্ড তৃতীয় উত্তর প্রদেশ । চারে মধ্যপ্রদেশ। সবচেয়ে কম কেরালায়। বিহারে দরিদ্রের হার ৫১.৯১% আর সেখানে পশ্চিমবঙ্গে ২১.৪৩%। পশ্চিমবঙ্গের তিন ভাগের এক ভাগ পরিবারই অপুষ্টির শিকার - ৩৩.৬ %। এখনো ৬১.৬%  পরিবার রান্নার গ্যাসের বদলে কাঠ বা কয়লা ব্যবহার করেন। ১০০টি পরিবারের  মধ্যে ৪৭টি পরিবারের নেই পাকা বাড়ি। নিকাশির সুযোগ থেকে বঞ্চিত ৩২%।আর এই সমস্ত মাপকাঠিতে  ২১.৪% মানুষকে বঞ্চিত বলে চিহ্নিত করেছেন নীতি আয়োগ। নীতি আয়োগ এর সূচক অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার প্রায় অর্ধেক ৪৯.৬৯ শতাংশ মানুষই দরিদ্র। তারপর রয়েছে উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। সবচেয়ে কম কলকাতায় ২.৮%।

(সূত্র সম্পাদকীয় মার্কসবাদী পথ: নভেম্বর ২০২২)

আমাদের রাজ্যে গরীব খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে ৭১% গরীব ধর্মীয় সংখ্যালঘু অংশের মানুষ।

রাজ্য বা দেশের উন্নয়নে বড় শিল্পে দরকার, এটা না হলে আরও কর্মসংস্থান হবে না, রাজ্যের উন্নতি হবে না।

কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯১ সালে নয়া উদারনীতি ঘোষণার পর সার্বিকভাবে পরিস্থিতি বিচার করে বামফ্রন্ট সরকার নতুন পরিকল্পনা তৈরি করে। ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরের ২৩ সেপ্টেম্বর রাজ্য সরকারের ‘শিল্পায়ন সংক্রান্ত নীতি বিবৃতি’ ঘোষিত হয়। ১৯৯১ থেকে ২০০৮-এর মধ্যবর্তী সময়ে শিল্প বিনিয়োগের পরিমাণের প্রশ্নে এই রাজ্য উঠে আসে দেশের মধ্যে তিন নম্বর স্থানে। বিনিয়োগ  আসে পেট্রোকেমিক্যালস, তথ্য প্রযুক্তি, লৌহ ও ইস্পাত, ম্যানুফ্যাকচারিং, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো মতো ক্ষেত্রগুলিতে। ২০০৫ সালে রাজ্যে বিনিয়োগ এসেছিল ২৫১৫.৫৮ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০৭২.২৬ কোটি টাকা। ২০০৮ সালে মন্দার বছরেও  ৪৪৩৪.৫০  কোটি টাকা। ২০১০ সালে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছিল ১৫হাজার ৫২ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা। রাজ্যে শিল্প ও বিদ্যুতের পরিকাঠামো গড়ে উঠল। সবশেষে সিঙ্গুর, পানাগড়, কাটোয়া, শালবনির ঘটনা আপনারা জানেন।

বামফ্রন্ট রাজ্যে  শিল্পপুঁজি গড়তে চেষ্টা করেছিল। যাতে কাজ হবে অনুসারী শিল্প হবে।  ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ পুঁজির বিকাশে দেশে ১০/১১ নম্বরে ছিলা। এখন এ রাজ্যে যা চলছে তা লুঠেরা পুঁজি। লুঠেরা পুঁজি এবং শিল্প পুঁজির মধ্যে বিরাট পার্থক্য। বামফ্রন্ট আমলে নুতন নুতন শিল্প কারখানা এবং উৎপাদনের উপায় বৃদ্ধির ফলে মানুষের হাতে অর্থ এসেছিল ফলে ছোট ছোট শহর গঞ্জ তৈরী হল, ছোট মাঝারি শিল্প গড়ে উঠল। যাকে এম এস এম ই বলা হয়। অনেক কর্ম সংস্থান হল। ২০১০ এ পশ্চিমবঙ্গ এই কর্ম সংস্থানে প্রথম ছিল। তারপর ছিল গুজরাত। বিভিন্ন রাজ্য থেকে কর্মসংস্থানের জন্য মানুষ জন এ রাজ্যে আসা শুরু করেছিলেন। কাজের সন্ধানে রাজ্য ছেড়ে যাওয়া মানুষের স্রোত কমেছিল। তৃনমুলের সময়ে কাজের সন্ধানে রাজ্য ছেড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা আবার  বৃদ্ধির দিকে। অথচ  বামফ্রন্ট সময়কালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাইরের রাজ্যে কাজ করতে যেতেন, তবে যা যেতেন তার থেকে বেশী এখানে কাজ করতে আসতেন। ১৯৯১ সালের জনসংখ্যার হিসাবে এই রাজ্যে সেই সময় জনসংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৮০ লক্ষ ৭৭ হাজার ৯৬৫ জন। পরবর্তী এক দশকে ( ১৯৯১-২০০০)  অন্য রাজ্য থেকে ৭ লক্ষ ২৪ হাজার ৫২৪ জনের অভিবাসন হয় এই রাজ্যে। বিদেশ থেকে এক দশকে এই রাজ্যে অভিবাসন হয় ২ লক্ষ ৫৯ হাজার ২০৪ জনের। ঐ দশকে এই রাজ্য থেকে চলে যান ৭ লক্ষ ৩০ হাজার ২২৬ জন।  হিসেব করে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে ঐ দশকে নিট অভিবাসন হয়েছে রাজ্য ছেড়ে যত মানুষ চলে গেছেন তার চেয়েও বেশি মানুষ এসেছেন এই রাজ্যে বসবাস করতে। এই সংখ্যাটি হল ২ লক্ষ ৫৩ হাজার ৫০২ জন।

(সুত্র মার্কসবাদী পথ: নভেম্বর ২০২২)

২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ছবিটা বদলে গেছে। এই দশকে এই রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে অভিবাসন করতে আসা মানুষের সংখ্যা ছিল ৭ লক্ষ ২৯ হাজার৭০২ জন। অন্য দেশ থেকে এই রাজ্যে অভিবাসন হয় ১ লক্ষ ৮৩ হাজার ৩১০ জনের। মোট  এই দশকে এই রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্যের পাড়ি দেন ১০ লক্ষ ১১ হাজার ৩৪০ জন। হিসেবে দেখা যাচ্ছে এ রাজ্যে নীট  অভিবাসন এই দশকে ছিল ঋণাত্মক - ৯৮ হাজার ৩২৮ জন। রাজ্যটি অন্য রাজ্য থেকে বেশি মানুষকে টেনে নেবার ক্ষমতা হারাচ্ছিল। এই রাজ্য থেকে বেশি মানুষ চলে যাচ্ছিল অন্য রাজ্যে। (সুত্র  মার্কসবাদী পথ: নভেম্বর ২০২২ ) তার কারন পশ্চিমবঙ্গে তখন শুরু হয়েছিল কেবলই ধ্বংসের রাজনীতি।

এই প্রবণতা এখন আরো তীব্র হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বেশি বেশি করে মানুষ এ রাজ্য ত্যাগ করছে তৃণমূলের শাসনকালে। এই সংখ্যা ১১ লক্ষ ৭ হাজার ৬৮ জনেরও বেশী!

এই শ্রমিকের নানা সামাজিক সুরক্ষার জন্য আমাদের দেশে যে inter state migrant workers act 1979 লাগু আছে এই রাজ্য সরকার সে বিষয়ে কোন সদর্থক ভুমিকা পালন করেনি। আর মমতা ব্যানার্জীর পরিবারের আয় আদানীর থেকে কম হলেও বিশাল। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইকে শ্রেনী সংগ্রামে পরিনত করতে হবে। সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম থেকে শ্রেনী সংগ্রামকে আলাদা করা যায় না। এটাই মতাদর্শগত সংগ্রাম। এই মতাদর্শের সংগ্রাম আমাদের চালাতে হবে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন