ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু আগেই ঘোষণা করেছিলেন যে চলতি বছরের জুলাই মাসের ১ তারিখেই ওয়েস্ট ব্যাংকের ৩০ শতাংশ জমিকে ইজারায়েলের ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার কাজ মিটিয়ে ফেলা হবে। এখনও অবধি সেই কাজ করা না হলেও নেতানিয়াহু নিজের ঘোষণা অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছেন। এবছর জানুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে পাশে রেখে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প তার কুখ্যাত “শান্তি থেকে সমৃদ্ধির পথে” পরিকল্পনা ঘোষণা করেন যার ফলে এই বেআইনি অন্তর্ভুক্তির কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। এই জঘন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে যাতে জর্ডান উপত্যকার ওয়েস্ট ব্যাংক অঞ্চলে যেখানে যেখানে ইহুদিদের বেআইনি কব্জা রয়েছে সেই সব জায়গাকেই ইজরায়েলে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া যায়। এই পরিকল্পনার ভিত্তিতেই জেরুজালেম কে প্যালেস্তাইনের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে ফিরিয়ে দেবার পূর্বসিদ্ধান্তকে অস্বীকার করা হচ্ছে, সিদ্ধান্ত ছিল জেরুজালেমকে প্যালেস্তাইনের জন্য ছেড়ে দিয়ে প্যেলেস্তাইনের বাইরের কোন জমিকে বদলি হিসাবে ইজরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই অশুভ পরিকল্পনা যদি শেষ অবধি সফল হয় তবে ভবিষ্যতে প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র গঠন হবার সমস্ত সম্ভাবনাকেই অঙ্কুরে বিনাশ করা হবে এবং দুই আলাদা রাষ্ট্র গঠন করে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কফিনে শেষ পেরেক গেঁথে দেওয়ার মতো হবে ।
এই একতরফা অন্তর্ভুক্তি সংক্রান্ত চুক্তির সাথে প্যালেস্তিনিয়রা কোনোভাবেই একমত হন নি। এই চুক্তির প্রধান ব্যক্তি হলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জারেড কুশনার যিনি একজন স্বনামধন্য জায়নবাদী। প্যালেস্তাইনের নেতৃত্ব এই অন্তর্ভুক্তিমূলক চুক্তিকে অস্বীকার করে জানিয়েছেন প্যালেস্তাইনের জনগন কখনো এই চুক্তিতে রাজি হবেন না।
ট্রাম্পই জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে এবং সেখানেই মার্কিন দূতাবাসকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ইজরায়েলি সীমানা সম্প্রসারণের এই নির্লজ্জ পরিকল্পনাকে উস্কে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই নেতানিয়াহু ওয়েস্ট ব্যাংক সংলগ্ন জমিতে জবরদখল করা বিস্তীর্ণ অংশকে ইজরায়েলে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলতে শুরু করেন। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া জমি ইজরায়েলের হবে কিন্তু সেখানে বসবাসকারী প্যালেস্তাইনি অধিবাসিদের সেই জমির উপরে কোন অধিকার থাকবে না। তাদের কোনমতে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকার অধিকার দেওয়া হবে অথবা আদৌ কোন অধিকারই দেওয়া হবে না। এই বিরাট ভূখন্ডের ২৩ শতাংশ জমির উপরে প্যালেস্তাইনের অধিবাসীরা বসবাস করেন জে জমিকে রাষ্ট্র নিজের ইচ্ছা মতো অন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেবে। এভাবে চললে ইজরায়েল আগামীদিনে একটি সম্পূর্ন জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবে।
অন্তর্ভুক্তির এই পরিকল্পনা আন্তর্জাতিকভাবে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে, ধিক্কৃত হয়েছে। একে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছে রাষ্ট্রসংঘ। রাষ্ট্রসংঘের প্রধান ঘোষণা করেছেন ঘোষিত এই অন্তর্ভুক্তি হবে আন্তর্জাতিক আইনের একটি স্পষ্ট উল্লঙ্ঘন, এক বেআইনি দুষ্কর্ম। জার্মানি, ইউনাইটেড কিংডম, ফ্রান্স সবকটি প্রধান ইউরোপীয় দেশ ওয়েস্ট ব্যাংকের অন্তর্ভুক্তি সংক্রান্ত এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে। রাশিয়া এবং চীনও একই সুরে এর বিরোধিতায় সরব হয়েছে।
চোখে পড়ার মতো ঘটনা হল আগামিদিনে রাষ্ট্রসংঘের অস্থায়ী সদস্য হবার সম্ভাবনা সত্বেও এই প্রসঙ্গে ব্যাতিক্রমী অবস্থান নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে উল্লিখিত অন্তর্ভুক্তির কোন বিরোধিতা করা হয় নি। বরং কিছুটা বিপ্রতীপ অবস্থান নিয়ে জানুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে ট্রাম্প যখন তার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন তখন সেই প্রসঙ্গে ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র বলেন “আমরা সব পক্ষের কাছেই আবেদন জানাচ্ছি যাতে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত সাম্প্রতিক পরিকল্পনা সহ সব ক্ষেত্রেই একে অপরের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, এবং দুই রাষ্ট্র সম্পর্কিত সমাধানকে বাস্তব রুপ দেন”।
আত্মবিসর্জনের এই পরিকল্পনায় প্যালেস্তাইনকে একমত হতে পরামর্শ দেওয়ার মধ্যে দিয়েই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে ভারতের বৈদেশিক নীতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে। বর্তমান শাসকের আমলে ভারতের বিদেশনীতির একমাত্র সারকথা হল যেকোনো আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় অবস্থান নেবার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষি হওয়া।
নেতানিয়াহু এখনও অবধি ঘোষিত এই পরিকল্পনায় বেশিদূর এগোন নি তার পিছনে হয়ত তার নিজের দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতিই কারণ। নেতানিয়াহু যে সরকারের প্রধান সেই সরকারে আরেকটি প্রধান পক্ষের নেতা হলেন বেনি গান্টজ। দুই দলের মধ্যেকার চুক্তি অনুযায়ী সরকার পরিচালনার কাজে অর্ধেক সময়ের প্রধানমন্ত্রী হবেন গান্টজ। বর্তমানে উপপ্রধানমন্ত্রী গান্টজ জানিয়ে দিয়েছেন অন্তর্ভুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ জুলাই মাসের ১ তারিখে করা সঠিক হবে না কারণ এখন গোটা দেশকেই অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। অন্য আরেকটি কারণ সম্ভবত এই যে নেতানিয়াহু আগামিদিনে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। নিজের যাবতীয় রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরনের জন্য নেতানিয়াহুকে ট্রাম্পের উপরে নির্ভর করতেই হবে, অথচ সাম্প্রতিক কালে আমেরিকায় নির্বাচনের রেটিং স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি পদের জন্য নির্বাচিত হবার ক্ষেত্রে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছেন। হয়ত সেই জন্যেই নেতানিয়াহু ইদানিং কিছুটা সাবধানী অবস্থান নিয়েছেন।
যদিও এখনও এই অন্তর্ভুক্তির কাজ শুরু হয়নি, পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে তাতে আগামিদিনে ঐ এলাকাগুলিতে প্যালিস্তিনিয়দের নিজেদের জমি এবং সম্পত্তি থেকে ক্রমশ উচ্ছেদ করা হবে। কৃষকদের জমি কেড়ে নিয়ে চুক্তির নামে সেই জমিতে পাকা সড়ক বানানো হবে। বড় বড় জমি ইজরায়েলের সেনার সাহায্যে কেড়ে নেওয়া হবে, ইতিমধ্যেই সেই উদ্দেশ্যে সেখানকার বিশাল বিশাল অলিভ গাছগুলীকে কেটে ফেলা শুরু হয়েছে। অতিমারি এবং লকডাউনের পরিস্থিতিকে ঢাল হিসাবে ব্যাবহার করে এভাবেই উচ্ছেদ এবং জবরদখলের কাজ শুরু হয়েছে।
বহু আরব দেশই এখন আমেরিকার সাথে হাত মিলিয়েছে, তারা প্যালেস্তাইনের প্রসঙ্গে আমেরিকার সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলছে। প্যালেস্তাইনকে কোনোরকম কার্যকর সমর্থন দিতে তারা অক্ষম। এই ভয়ংকর সময়ে দুনিয়াজূড়ে একমাত্র সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তিগুলিই প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানিয়ে একে অন্যের হাতে হাত মিলিয়েছে, তার পাশে দাঁড়িয়েছে। ভারতেও সমস্ত গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির উচিত একসাথে মোদী সরকারের কাছে দাবী জানানো যাতে সরকার প্যালেস্তাইন প্রসঙ্গে নিজেদের মার্কিন-ইজরায়েলপন্থী অবস্থান বদল করতে বাধ্য হয়।
পিপলস ডেমোক্রেসি'তে প্রকাশিত
শেয়ার করুন