"অপারেশন ১৩৬" - শমীক লাহিড়ী

বিষ বিষ এর শেষ দিন
(৩১ শে ডিসেম্বর, ২০২০)


"অপারেশন ১৩৬"

২৬শে মার্চ, ২০১৮। অদ্ভুত এক 'গোপন তদন্ত রিপোর্ট' জনসমক্ষে আনলেন পুষ্প শর্মা। পেশায় তিনি গোয়েন্দা বা সরকারি তোতাপাখি কোনো তদন্ত সংস্থার অফিসার নন, সাংবাদিক।

পুষ্প শর্মা (সাংবাদিক)


তাঁর রিপোর্টে কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল? দেশের ২৭টি বৃহৎ সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।

কি ছিল অভিযোগ? এরা অর্থের বিনিময়ে সাম্প্রদায়িক গোলোযোগ বাঁধাতে এবং সাম্প্রদায়িক প্রচার করতে রাজি হয়েছিল।

কত অর্থ এদের দাবী ছিল? ৭০মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৫০০কোটি টাকা।

কারা অভিযুক্ত? মোট ২৭টি সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠী যাদের মধ্যে অন্যতম Times of India, Hindusthan Times, India Today, Zee media, , New Indian Express, Dainik Bhaskar, Bharat Samchar, Big FM radio, TV5 সহ অনেকগুলো বড় বড় সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠী।

নারদ স্ট্রিং অপারেশনে মূল অভিযুক্তরা


প্রমাণ কিছু ছিল কি? এইসব সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠীর বড় কর্তাদের বিরুদ্ধে কিছু ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর, দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করে দৈনিক ভাস্কর পত্রিকা। এর ফলে দিল্লি হাইকোর্ট বাকি অংশ প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বাকি ভিডিওগুলো এর ফলে অপ্রকাশিতই রয়ে যায়। পার্ট ১-এ ১৭ টি সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠীর নাম প্রকাশ করা হয়। পার্ট ২ এর সামান্য অংশ প্রকাশিত হওয়ার পর আদালতের নিষেধাজ্ঞায় বাকি অংশ প্রকাশ্যে আর আসে নি। এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও অভিযুক্তরা একথা বলতে পারেনি যে, প্রকাশিত ভিডিওগুলো জাল।

পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরদার


পুষ্প শর্মা কাদের হয়ে কাজ করেছিলেন? তহেলকা। পাঠকদের কাছে এই নামটা নিশ্চয়ই অপরিচিত নয়। এরাই নারদ স্টিং অপারেশন চালিয়েছিল। এদের প্রকাশিত ভিডিওতেই গোটা দেশ তৃণমূলী মন্ত্রী, সাংসদ, নেতাদের ঘুষ খেতে দেখেছিল। ২০১৪ সালে তোলা ভিডিওগুলো ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এর আগে বাজপেয়ী জমানার প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রয়াত জর্জ ফার্ণান্ডেজ ও বিজেপি সভাপতি বঙ্গারু লক্ষ্মণের ঘুষ খাওয়ার ভিডিও প্রকাশ এরাই করেছিল - এটাও অজানা নয়।

উপরের ছবিটি বাজপেয়ী জামানায়, বিজেপি সভাপতি বঙ্গারু লক্ষ্মণ ও নীচে প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রয়াত জর্জ ফার্ণান্ডেজ


কিন্তু ৪ বছর কেটে যাওয়ার পরেও নারদ কান্ডের খলনায়কদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নরেন্দ্র মোদির তোতাপাখি সিবিআই গ্রহণ করেনি। এদের জেলে ঢোকানোর পরিবর্তে এখন বিজেপি নিজেদের দলে এদের ঢুকিয়ে নিচ্ছে। আবার বাংলা সংবাদমাধ্যম এইসব খলনায়কদের নায়ক বানাচ্ছে। কিসের বিনিময়ে? বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে কারোর?

যাইহোক মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক।

২০১০ সালের জুলাই মাসে প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া একটা রিপোর্ট প্রকাশ করে। পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা ও কালিমেকোলান এস রেড্ডি এই ২ জন ছিলেন এই তদন্ত দলের সদস্য। ৭৭ পাতার এই রিপোর্টে তাঁরা সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দিয়ে উল্লেখ করেন, Paid News বা অর্থের বিনিময়ে সংবাদ পরিবেশন করে প্রায় সব বৃহৎ সংবাদমাধ্যমই। যদিও অনেকেই অভিযোগ করেন যে, এই রিপোর্টের সাথে ৭১ পাতার একটি সংযোজনী দিয়েছিল ঐ কমিটি, যেটা বিভিন্ন বৃহৎ সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের চাপে আর প্রকাশ করা হয়নি।

Press Freedom Index
Press Freedom Index এ ভারতের স্থান ১৪২তম।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে কিন্তু এর মালিকদের স্বাধীনতা নয়। এর অর্থ - স্বাধীনভাবে সাংবাদিকরা মত প্রকাশ করতে পারেন কি? পাঠক বা দর্শকদের সত্য জানার অধিকার থাকছে কি? এদের কাছে খবর গোপন রাখা হচ্ছে না তো?

শুধু রাষ্ট্রের আক্রমণের মধ্যেই আজ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ হচ্ছে তা নয়, এটা তো ক্রমশ তীব্র হচ্ছেই বিজেপি-র মতো ফ্যাসিস্ট পার্টির শাসনে। রাষ্ট্রের পেশীশক্তির সাথে যুক্ত হয়েছে কর্পোরেটের অর্থশক্তি। মানুষের সত্য সংবাদ জানার অধিকারই কেড়ে নিয়েছে এরা।

অপরাধের চূড়ায় বসে থাকা কর্পোরেট কর্তাদের বা তাদের প্রতিনিধি রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে কোনও খবর জানতে দেওয়া হয়না পাঠক বা দর্শকদের। বরং প্রকাশ্যে ঘুষ নেওয়া খলনায়কদের অবলীলায় নায়ক বানায় কর্পোরেট বা তাদের প্রতিনিধি রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থে চলা সংবাদমাধ্যম।রাজনীতি -অর্থনীতি- সমাজের অপরাধীদের জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রচেষ্টায় এদের গলা বা হাত বিন্দুমাত্র কাঁপেনা। সমাজকে কলুষিত করার দায়ে আজ এরা অভিযুক্ত।

চোর দেশের বা কিছু লোকের সম্পদ চুরি করে, ডাকাত ব্যাঙ্কের বা কিছু মানুষের অর্থ লুঠ করে, খুনী আর একজনের প্রাণ কেড়ে নেয়। এরা সবাই অপরাধী। আর যারা এদের প্রকৃত পরিচয় আড়াল করে এদের সাধুবেশে মানুষের সামনে প্রতিষ্ঠিত করে, তাদের অপরাধ কিন্তু অন্যান্য অপরাধীদের চাইতে বহুগুণ বেশী

তৃণমূল-বিজেপি এই দুই দলের প্রবল প্রচারে বাজারি সংবাদমাধ্যম ডুবিয়ে দিতে চাইছে মানুষের লড়াইয়ের কন্ঠস্বর। এই দুই দলের মধ্যেই মানুষের ভোটের পছন্দকে আটকে রাখতে পারলে লুঠেরাদেরই পোয়াবারো। আজ যে তৃণমূলের হয়ে লুঠছে, এই দল ডুবলে কাল বিজেপির হয়ে লুঠবে। আর লুঠের অংশের ভাগ পাবে এই সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠীগুলো। তাই লুঠেরা দলগুলো আর তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের হাতেই কেবল ক্ষমতা সীমিত থাকুক - এটাই এই সংবাদমাধ্যমের একমাত্র বাসনা।



এই লুঠেরাদের মুখোশ টেনে খুলতে হবে গণতন্ত্রের স্বার্থেই। গণতন্ত্রের ৪র্থ স্তম্ভকে ভেঙে ফেলছে এরাই। উঁই পোকার মত ধীরে ধীরে ঘুন ধরিয়ে দিতে চাইছে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে।

গণতন্ত্র বিরোধী এই শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই না হলে, দুর্নীতিগ্রস্থ বা ফ্যাসিস্ট শক্তি কারোর বিরুদ্ধের লড়াইকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।

তাই শুভবুদ্ধি সম্পন্ন গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক সব মানুষের, সাংবাদিক সহ, এগিয়ে আসতে হবে গণতন্ত্র-দেশ-মানুষের অধিকার-সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে।




শেয়ার করুন

উত্তর দিন