পিঁয়াজ কেন ১০০টাকা? - শমীক লাহিড়ী

ওয়েবডেস্কের প্রতিবেদন :
৪ঠা নভেম্বর, ২০২০:


পিঁয়াজের ঝাঁঝে নয়, দামে এখন চোখে জল। কয়েক সপ্তাহ আগেও পিঁয়াজ ২০টাকা/কেজি বিক্রি হয়েছে। হঠাৎ ১ মাসে ৪/৫ গুণ দাম বাড়লো কেন?

সরকার বলছে কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্রে অতিবৃষ্টির জন্য পিঁয়াজ উৎপাদন কম, তাই এত দাম। সত্যি কি তাই?

গত ২০শে সেপ্টেম্বর গায়ের জোরে, মার্শাল ডেকে বিরোধীদের সংসদের বাইরে বের করে দিয়ে ২টি নতুন কৃষি সংক্রান্ত আইন এবং ৬৫ বছরের পুরনো ১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন পালটে দিল বিজেপি সরকার। নতুন এই আইনে পিঁয়াজ আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নয়। যত ইচ্ছে মজুত করো আর ইচ্ছেমতো কালোবাজারি করো। সব মোদিজির দয়ায় এখন আইনসিদ্ধ। ফড়ে দালালদের স্বর্গরাজ্য।

২০ শে সেপ্টেম্বর নতুন আইন পাশ হ'ল আর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই পিঁয়াজের দাম চড়তে শুরু করলো - এটা কি নেহাৎই কাকতালীয়? নাকি রাজনৈতিক প্রভুর ইশারায় উৎসাহিত ফড়ে দালালদের অবাধ লুটের সোৎসাহে যাত্রাশুরু!

পিঁয়াজের দাম ফড়ে দালালদের হাতের ছোঁয়ায় আকাশচুম্বি হওয়ার পর, কেন্দ্রীয় সরকার এখন অধ্যাদেশ জারি করেছে - খুচরো ব্যবসায়ী ২ টন আর হোলসেল ব্যবসায়ীরা ২৫ টন পর্যন্ত মজুত করতে পারবে। লুটেরাদের জন্য অবাধ লুটের আইন পাশ করিয়ে আর কি এদের বশে আনা যায়!? তাই হোল সেল ব্যবসায়ীরাও লুটের 'আইনি অধিকার' রক্ষার জন্য এখন ধর্মঘটে নেমে পড়েছে।

দেশের পিঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করে মূলত মহারাষ্ট্রের নাসিকের ১৫টা মান্ডি। এর মধ্যে লাসালগাঁও কৃষি মান্ডি এশিয়ার সবচাইতে বড় পিঁয়াজ বাজার। এখানে কেনা বেচা সব বন্ধ করে রেখেছে হোলসেল ব্যবসায়ীরা। দাবি - ইচ্ছামত মজুত করতে দিতে হবে। প্রতিদিন ১.৫লক্ষ ক্যুইন্টাল পিঁয়াজ কেনা বেচা হয় এখানে। দেশে মোট ১৬৫ লক্ষ টন পিঁয়াজের চাহিদার ১/৩ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে লাসালগাঁও সহ এই ১৫টা মান্ডি। এদের ধর্মঘটে ফলে বাজারে যোগানের হাল আরও খারাপ হয়েছে। আরও আকাল বেড়েছে পিঁয়াজের।

এখন এসেনসিয়াল সার্ভিসেস মেইনটেইনেন্স আইন ব্যবহার করে দেশের মানুষকে এই লুটের হাত থেকে বাঁচানোর কোনো উদ্যোগ নেই বিজেপির। কারণ এই সব ফড়ে দালালদের অধিকাংশই বিজেপি ঘনিষ্ঠ। এদের জন্যই সাংসদদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সংসদের বাইরে বের করে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন পাল্টেছেন মোদি।

এটা ঠিক দেরীতে বৃষ্টি এবং কোথাও দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টিতে পিঁয়াজ চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এটাই কি একমাত্র এবং মূল কারণ পিঁয়াজের এই আকাশছোঁয়া দামের?

পৃথিবীর মোট পিঁয়াজ উৎপাদনের ১৯% ভারতবর্ষে উৎপাদিত হয়। চীনের পর আমরা পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম পিঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশ। পৃথিবীর যত জমিতে পিঁয়াজ চাষ হয় তার ২৭% জমিই আমাদের দেশে। কিন্তু আমাদের দেশে একর প্রতি উৎপাদনের ৪গুণ হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এর মূল কারণ উন্নত চাষের উপকরণ ব্যবহারই শুধু নয়, সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার যথাযথ পরিকল্পনা এর অন্যতম একটা কারণ।

Indian Council for Agriculture Research (ICAR) এর সমীক্ষা অনুযায়ী আমাদের দেশে উৎপাদনের ৩০-৪০% ফসল নষ্ট হয়ে যায় সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায়। স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরেও দেশের মোট পিঁয়াজ উৎপাদনের মাত্র২% সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে।

এর ফল কি? সবারই নিশ্চয়ই খেয়াল আছে, ২০১৮ সালে নাসিকের পিঁয়াজ চাষিরা কেজি প্রতি মাত্র ১ টাকা দাম পাওয়ায়, পিঁয়াজ রাস্তায় ফেলে জাতীয় সড়ক অবরোধ করেছিল। অথচ সে-বছরই পিঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ বলেছিলেন - আমি তো পিঁয়াজ খাই না।

ফলে পিঁয়াজের দাম চাষি বাড়ায় না বা পিঁয়াজের দাম বাড়লে চাষির লাভ হয় না। দাম বাড়লে বিপদে পড়ে খুচরো বাজারের ক্রেতা। একই কথা প্রযোজ্য অন্যান্য সব্জি বা ফসলের ক্ষেত্রেও।

বাজার যদি ফড়ে দালালদের থেকে মুক্ত করা না যায়, আর যথাযথ সংরক্ষণের সরকার নিয়ন্ত্রিত পরিকাঠামো গড়ে তোলা না যায়, তাহলে এই ফাটকা বাজারের হাত থেকে সাধারণ ক্রেতার মুক্তি নেই। অথচ এদের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার জন্যই অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন পালটে অবাধ মজুতদারি ও কালোবাজারিকে আইনসম্মত করলো বিজেপি সরকার। কেন?

একইভাবে আমাদের রাজ্য সরকার ২০১৪ ও ২০১৭ সালে আইন পাশ করে বাজারে প্রবেশের অধিকার লাইসেন্স ফাটকা কারবারিদের হাতে তুলে দিয়েছে। এখন তাদের নিয়ন্ত্রণেই বাংলার পুরো বাজার। এই জন্যই চাষির থেকে ৬/৬.৫০টাকা/কেজি দরে আলু কিনে, হিমঘরে মজুত করে, বাজারে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে, তারপর ৩৫-৪০টাকা/কেজি বিক্রি করছে এই রাজ্যের লাইসেন্সধারী ফাটকা কারবারিরা।

আপনি যে রাজনৈতিক দলের সমর্থক হ'ন না কেন আলু, পিঁয়াজ, চাল, ডালের দাম বাড়লে, বাড়তি দাম আপনাকেও দিতে হচ্ছে। জয় শ্রীরাম বললেও যা দাম, জয় দিদি বললেও একই দাম। কোনও রাজনীতিতে না থাকলেও একই দাম।

এই অস্বাভাবিক দাম বাড়ার জন্য কে দায়ী? এই ফড়ে-দালালদের জাত কি? ধর্ম কি? ভাষা কি? সব ধর্ম-ভাষা-জাতের লোকই আছে এই ফড়ে দালালদের মধ্যে। এখানে হিন্দু ফড়ে দালাল, হিন্দু সাধারণ ক্রেতার রক্ত চুষছে। মুসলমান ফড়ে দালালরা কি মুসলমানদের ছাড় দিচ্ছে? এদের জাত-ধর্ম একটাই। এরা লুটেরা।

ঠিক করুন আপনি কি করবেন। পেটে গামছা বেঁধে জয়দিদি বলে ২০টাকার দিশি পাউচ খেয়ে নেশায় বুঁদ হবেন? জয় সিয়া রাম বলে পেটে গামছা বেঁধে ঘুরবেন?

আর একটা রাস্তা আছে। হিন্দু-মুসলমান-খ্রীস্টান-শিখ-বৌদ্ধ-জৈন-নাস্তিক যাই হোন কেন, ঐক্যবদ্ধভাবে ফড়ে দালালদের হাতে রাজ্য-দেশ তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই। রাস্তাটা লম্বা- কষ্টকর। দিশি মদের মতো চট করে নেশা তুলে সব ভুলে বুঁদ হওয়ার সুযোগ নেই। অথবা জয় সিয়া রাম ধ্বনির উত্তাল উন্মাদনায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও খিদে ভুলে থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু ফড়ে-দালালদের রাজনৈতিক প্রভুদের হঠাতে পারলে, এই লড়াইয়ে জিততে পারা যাবে। জিততে পারলে প্রতিদিন আপনার পরিবারের সবার মুখে অন্তত ভাত-ডাল- পিঁয়াজ মাখানো আলুসিদ্ধ তুলে দিতে পারবেন।

এই লড়াইটাই বামেরা লড়ছে। ফড়ে-দালাল অধ্যুষিত এই কালোবাজারিদের পাশ কাটিয়ে ৬০ টাকায় পিঁয়াজ, ২৫ টাকায় আলু বিক্রি করছে শ্রমজীবীদের বাজারে, অথবা ২০ টাকায় তুলে দিচ্ছে দুপুরের খাবার। যে কাজ সরকারের করার কথা, সেটাই করছে বিরোধী বামশক্তি।

আর বিজেপি-তৃণমূল মদ আর সাম্প্রদায়িকতার নেশায় আপনাকে বুঁদ করে রেখে, হাওয়া দিচ্ছে কালোবাজারিদের।

কি করবেন? কোন দিক বেছে নেবেন আপনি?


শেয়ার করুন

উত্তর দিন