ওরা কাজ করে, দেশে দেশান্তরে



শমীক লাহিড়ী

১মে ,২০২০ শুক্রবার: তখন সন্ধ্যা ৮ টা বেজে গেছে। সূর্য্য ডুবেছে, কিন্তু শেষ আলোর ছটায় তখন শিকাগো শহরের নীল আকাশের রঙ পাল্টে লাল হয়ে যাচ্ছে। আলো আঁধারির মাঝে হিমেল হাওয়ায় সারি সারি কালো মাথা দাঁড়িয়ে। This image has an empty alt attribute একটা গাড়ির উপরে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছেন জর্জ এঞ্জেলস। পেটানো চেহারা কিন্তু আজ খানিকটা ক্লান্ত লাগছে তাঁকে। সূর্য্য তাঁর পেছনে ডুবেছে, আলো- আঁধারিতে তাই মুখটা অস্পষ্ট। কিন্তু এই কন্ঠ্যস্বরকে খুব ভালো চেনে শিকাগোর এই মানুষগুলো। খানিকটা দূরেই ম্যাককরমিক রিপার কারখানার গেটে একটা জটলা। ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে ১লা মে থেকে শুরু হয়েছিল ধর্মঘট আমেরিকা জুড়ে। তারই সমর্থনে চলছিল এই সভা। This image has an empty alt attribute হঠাৎই পুলিশ এল ঘোড়া ছুটিয়ে। সভা বন্ধ করার হুকুম জারি হল। এঞ্জেলস নেমে এলেন। পুলিশকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন - সভা তো শান্তিপূর্ণ ভাবেই চলছে, কি অসুবিধা এতে? ততক্ষণে আর এক শ্রমিক নেতা এ্যালবার্ট পারসনস গাড়ির উপরে উঠে বক্তৃতা শুরু করছেন। কিন্তু পুলিশের হুকুম - বন্ধ করতেই হবে সভা। এরই মাঝে রিপার কারখানার গেটের মুখে পুলিশের হামলা শুরু হল। গুলিও চললো। এরই মাঝে হঠাৎই বোমা বিস্ফোরণ। কেউ পুলিশের দিকে বোমা ছুঁড়েছে। শুরু হয়ে গেল নির্বিচার গুলি বর্ষণ। চলল লাঠি। নিরস্ত্র অসহায় শ্রমিকরা প্রাণ বাঁচাতে ছুটলো। গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়লো অনেকে। ঘোড়ার পায়ের তলায় পিষ্ট, লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত মানুষ। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে, আর ভীড় থেকে শুধুই গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে। নিজের দপ্তরে ফিরে গিয়েই এঞ্জেলস লিখে ফেললেন এই অত্যাচার বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রচার পত্র।সকালের সূর্য্য ওঠার আগেই আবার কারখানার গেটগুলোতে জটলা, ভীড়। একজন কালো একটা ঘোড়ায় চেপে ভীড়গুলোতে ছড়িয়ে দিয়ে গেল সেই প্রচারপত্র - 'লড়াই থামবে না, গড়ে তোল প্রতিরোধ'। শুরু হল রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র - সেই কুখ্যাত হে মার্কেট ট্রায়াল। একে একে ৮ জন শ্রমিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা হ'ল। অগাস্ট স্পাইস, এ্যডল্ফ ফিশার, এ্যলবার্ট পারসনস, জর্জ এঞ্জেলস, ল্যুই লিঙগ, স্যামুয়েল ফিলডেন, মাইকেল সোয়াব, অস্কার নীব - এই ৮ জনের বিরুদ্ধে ডিনামাইট বোমা ছুঁড়ে পুলিশ কর্তাসহ মোট ৮ জন পুলিশকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। ২৭শে মে পুলিশ এই ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে এই অভিযোগ এনে। বিচারের জন্য মোট ৯৮১ জনের ইনটারভিউ নেওয়া হয়, জ্যুরি বোর্ড গঠনের জন্য এবং আশ্চর্যজনকভাবে যারা হে মার্কেট ঘটনায় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মত পোষণ করেন, কেবলমাত্র তাদেরই বোর্ডে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং এটা ঘোষণা করেই করা হয়। একইভাবে সদ্য উত্থিত পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত খবরের কাগজগুলোতেও প্রবলভাবে শ্রমিক বিরোধী লেখা প্রকাশিত হতে থাকে, যার বেশিরভাগই ছিল মনগড়া। বিচার শুরু হল ২১শে জুন এবং শেষ হল ১১ ই আগষ্ট। স্বাভাবিকভাবেই এই ৮ জনকেই দোষী সাব্যস্ত করা হল এবং ৭জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হল। ১১ই নভেম্বর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হল। স্পাইস, ফিশার, এঞ্জেলস, পারসনসকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হল। ল্যুই লিঙগ আত্মহত্যা করেন আগের রাতে। মাইকেল সোয়াবকে ১০ই নভেম্বরই ফাঁসি দেওয়া হয় এবং নীবকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অভিযুক্তদের আইনজীবীরা প্রশ্ন তুলেছিলেন একসাথে ৭ জন মিলে একটা বোমা কিভাবে ছুঁড়তে পারে? এরা যে বোমা ছুঁড়েছিলেন, তার প্রমাণ কি? পুলিশ অন্য একজনকে গ্রেপ্তার করেছিলো বোমা ছোঁড়ার অভিযোগে, তাঁকে আবার ছেড়েও দেওয়া হ'ল কেন? ৭ জন পুলিশ গুলিতে নিহত এবং সাক্ষ্যে সবাই বলেছে গুলি শুধু পুলিশই চালিয়ে ছিল আত্মরক্ষার্তে। তাহলে আত্মরক্ষার নামে ৭ জন পুলিশকে কি পুলিশই গুলি করেছিল? এমন অনেক প্রশ্নের জবাব না দিয়েই, বিচিত্র এই বিচারে অভিযোগ করা হ'ল যে এরা বোমা ছোঁড়েনি ঠিকই, কিন্তু এরা বিশৃঙখলা তৈরী করার জন্যই ওখানে বোমা ছোঁড়ার সুযোগ পেয়েছিল আততায়ী। আর এদের মধ্যে একজনের বাসস্থানের ডেরা থেকে নাকি একটা ডিনামাইট বোমা পাওয়া যায়, যেটা নাকি হুবহু ৪ই মে ছোঁড়া বোমার মতো। শুধু বোমা ছোঁড়াই নয়, আসলে বিশৃঙখলা তৈরী করে সরকার ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল এই অভিযুক্তরা। জ্যুরি বোর্ডের প্রধান গ্যারি বলেন - জ্যুরি বোর্ডের সবাই যদি সন্দেহাতীতভাবে মনে করেন অভিযুক্তরা দোষী, তাহলে তারা দোষী। যুক্তি-প্রমাণ-স্বাক্ষ্য এইসব বিচার্য নয়, জ্যুরিদের বিশ্বাসবোধই বিচারের ভিত্তি। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক কোনও রায়ের সাথে মিল পাচ্ছেন, পাঠক?  এই বিচার প্রক্রিয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে, এই অন্যায় বন্ধ করার দাবী উঠেছিল সেই সময়ে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকেই। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক উইলিয়াম ভিল হ'লওয়েলস, অস্কার ওয়াইল্ড, বার্ণার্ড শ', ফ্রেডরিক এঙ্গেলস প্রমুখ ব্যাক্তিরা প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এই সাজানো অন্যায় বিচারপ্রক্রিয়ার। পরবর্তীতে ১৮৯৩ সালে ২৬ শে জুন খোদ ইলিয়নয় প্রদেশের গভর্নর জন অল্টগেড হে মার্কেট ট্রায়ালকে অভিযুক্ত করে বলেন - ঐ মানসিক বিকারগ্রস্ত এবং পক্ষপাতদুষ্ট বিচারকরা একবারের জন্যও খুঁজে দেখলেন না, কে বোমা ছুঁড়েছিল এবং বোমা ছোঁড়ার সাথে অভিযুক্তদের যোগাযোগের কোনও সম্পর্ক প্রমাণিত নয়। রায় ঘোষণার পরেরদিন প্রবল উচ্ছাস ব্যক্ত করেছিল সেই দেশের পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত সব মার্কিন সংবাদ মাধ্যম। বলা হয়েছিল এইবার জব্দ হবে শ্রমিকরা, বন্ধ হবে নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলা। আসলে উচ্ছ্বাস ছিল এই ভেবে যে ৮ঘন্টা কাজের দাবীসহ শ্রমিকদের অন্যান্য দাবীর লড়াই শেষ হয়ে যাবে। ইচ্ছেমতো শ্রমিকদের খাটানো যাবে, ছাঁটাই করা যাবে - এই ভাবনায় আবিষ্ট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম সেদিনও মানুষের মনকে প্রভাবিত করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছিল। ফাঁসির আগে অগাস্ট স্পাইস বলেছিলেন - আজ তোমরা আমাদের কন্ঠ্য রুদ্ধ করছো, কিন্তু সেইদিন আসবেই যখন আমাদের কথার চাইতেও অনেক বেশী জোরালো হয়ে উঠবে আমাদের নিস্তব্ধতা। এই সৈনিকদের সমাধিফলকে লেখা আছে স্পাইসের এই অমোঘ বাণী। ১৩১ বছর পরে। পৃথিবীর আর এক প্রান্তে আর একটা ঘটনার বিচার হ'ল। ২০১৭ সাল। ১১ই আগষ্ট। হরিয়ানার এক আদালত মারুতি-সুজুকি কারখানার ১৩ জন ইউনিয়ন নেতাকে সেখানকার ম্যানেজারকে খুন করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এই ১৩ জনের মধ্যে ১২ জনই ঐ কোম্পানীর শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকর্তা। আরও ১৮ জন শ্রমিককে বিশৃঙখলা, আগুন লাগানো ইত্যাদি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করলো। এই কোম্পানির শ্রমিকরা দাবী করেছিলো - শ্রমিক ইউনিয়নের স্বীকৃতি, স্থায়ী শ্রমিকের পরিবর্তে অত্যন্ত কম মজুরির চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। শ্রমিকদের সাথে আলোচনায় বসতে হবে। না, কোনটাতেই রাজি হয়নি মালিক-ম্যানেজমেন্ট। চুপ করে কাজ করো, না হয় ছাঁটাই। ১৮ ই জুলাই,২০১২। কারখানায় আগুন লাগলো, একজন ম্যানেজারের দুঃখজনক মৃত্যু হ'ল। তৎকালীন হরিয়ানা রাজ্য সরকার কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথমে ৯১জন জন এবং পরে আরো ৫৭জন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করলো। ৫ বছর ধরে মামলা চলাকালীন কাউকে জামিন পর্যন্ত দেওয়া হ'লনা। ১০ই মার্চ, ২০১৭ আদালত ৩১ জন শ্রমিককে বিভিন্ন অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করলো এবং ১১৭ জনকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করলো। ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৪ জনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং বাকিদের ৪ বছরের কারাদণ্ড দিল আদালত। যে প্রশ্ন উঠলো এই মামলাকে ঘিরে- ১১৭ জন যাদের আদালত নিঃশর্ত মুক্তি দিল, তারা কেন বিনা দোষে ৫ বছর জেলে থাকলো? কেন ৫ বছরে মামলা চলাকালীন কাউকে জামিন দিলনা আদালত? কোম্পানি ৯১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল। বাকি ৫৭ জন শ্রমিককে কার অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তার কোনও উল্লেখ হরিয়ানা পুলিশের পক্ষ থেকে কোথাও করা হয় নি। বিচার প্রক্রিয়ায় কাদের সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ করা হ'ল? ৪ জন লেবার কনট্রাক্টর। একটা অদ্ভুত জিনিস দেখা গেল এই ৪ জনের সাক্ষ্যদান পর্বে। বীরেন্দ্র যাদব নামে লেবার কন্ট্রাক্টর সাক্ষ্য দিল যে ২৫ জনকে ভাঙচুর করতে ও আগুন লাগাতে দেখেছিল তাদের প্রত্যেকের নামের আদ্যক্ষর ইংরেজি A থেকে G এর মধ্যে, ইয়াদ রাম তাঁর সাক্ষ্যে যে ২৫ জনকে চিহ্নিত করে তাদের প্রত্যকের নামের আদ্যক্ষর ইংরেজি H থেকে P এর মধ্যে, আকাশ নামে আর এক সাক্ষী যে ২৬ জনের নাম নেয় তাদের প্রত্যেকের আদ্যক্ষর ইংরেজি P থেকে S এবং আর এক সাক্ষী রাকেশ যে ১৩ জনের নাম নেয় তাদের নামের আদ্যক্ষর ইংরেজি S থেকে Y এর মধ্যে ছিল। ঠিক যে ক্রমিক ধরে সুজুকি কোম্পানি ৯১ জন শ্রমিকের নামে অভিযোগ জানিয়েছিল, ক্রমান্বয়ে সেই ক্রমিক ধরেই ৪ জন সাক্ষী বলে তারা এই ৯১ জনকে ভাঙচুর ও আগুন লাগাতে দেখেছে। This image has an empty alt attribute সূত্রঃ হিন্দুস্তান টাইমস মার্চ১৭, ২০১৭ পাঠক কোনও মিল পাচ্ছেন এই দুটো মামলায়! তফাৎ ১৩১ বছর। দূরত্ব ১২০৩১ কিলোমিটার। This image has an empty alt attribute Hindusran Times.. তেলেঙ্গানার লঙ্কা ক্ষেতে কাজ করতো ১২ বছরের জামলা মাকদম। হঠাৎ সব বন্ধ - ট্রেন বাস সব। এর নাম নাকি লকডাউন। মানুষকে বাঁচানোর জন্যই নাকি সব বন্ধ। এখন কি করবে সে? এদিকে কাজ বন্ধ, তাই মজুরিও বন্ধ। খাবে কি? নিরুপায় জামলা রওনা দিল ছোট্ট ছোট্ট পায়ে বাড়ির দিকে। কত দূরে বাড়ি সে জানে না। ৪দিন, ৪ রাত হেঁটেই চললো জামলা বড়দের সাথে। জানতো না আর মাত্র ১৪ কিলোমিটার পেরোলেই তার বাড়ি। সেখানেই তার মায়ের আঁচল পাতা ঘর। হলো না বাড়ি যাওয়া। ১৪ কিলোমিটার আগে ১২ বছরের জামলার দেহটা লুটিয়ে পড়লো। This image has an empty alt attribute ছয় জনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছবু মন্ডল। গুরগাঁওতে কাজ করে। বাড়িতে অর্থ পাঠালে বাড়ির ৬ জনের পেট চলে। লোক বাঁচাতে সব বন্ধ হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর এক ভাষনে মাত্র ৪ঘন্টার নোটিশে। বিহারের পরিযায়ী শ্রমিক, ৩৫ বছরের ছবু রঙের কাজ হারিয়ে, আড়াই হাজার টাকায় তার মোবাইল ফোন বিক্রি করে দেয়। এই টাকা স্ত্রীর হাতে তুলে দেয় অনাহারক্লিষ্ট পরিবারের খাবারের জন্য। কাজ আর না পাওয়ার আশঙ্কায় কপর্দকহীন ছবু আত্মহত্যা করে। আনুমানিক এমন ১০কোটি জামলা-ছবু যাদের পোশাকি নাম পরিযায়ী শ্রমিক, এখন দেশের রাস্তায় ঘাটে বসে আছে। কে মরছে, কে বেঁচে আছে কোনও হিসাব নেই। ১৪ কোটি শ্রমিকের কাজ গেছে,, আশঙ্কা ৪০ কোটি নাকি কাজ হারাবে। কি হবে? রাষ্ট্রের কাছে এরা ততক্ষণই মূল্যবান, যতক্ষণ এরা মুখ বুজে উদ্বৃত্ত শ্রমের মূল্য পুঁজির মালিকদের হাতে তুলে দেবে। যেদিন মুখ খুলবে সেদিনই হে মার্কেট বা সুজুকি মামলার মতো সাজানো মামলায় এদের সাজা হবে। যেদিন এদের শ্রম অপ্রয়োজনীয় মনে হবে, সেদিন জামিলা বা ছবু'র মতো লাশ রাস্তায় পড়ে থাকবে - সে রাস্তা নিউইয়র্কের 99th street এর হার্লেমই হোক বা দক্ষিণ ইতালির মেজ্জোগিয়ারনোই হোক। This image has an empty alt attribute রাস্তা ঘাট শুনশান। কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তাগুলোয় পিন পড়লেও আওয়াজ পাওয়া যায় এখন। প্রাণের ভয়ে মুখে মুখোশ এঁটে দরজায় তালা বন্ধ করে বসে আছে কলকাতার ফ্ল্যাটবাসী পৃথিবীর বাকি শহরগুলোর মতোই। তার মাঝেই রাস্তায় মোটর বাইকের আওয়াজ। বেজে উঠছে কলিং বেল। দেড় ইঞ্চি দরজা ফাঁক করে ৯ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা ডান্ডার ডগায় হোম ডেলিভারির খাবার প্যাকেট ঝুলিয়ে তারপর ভেতরে নিয়ে, ভালো করে স্যানিটাইসারে বেল-গ্রীল পরিস্কার করে খেতে বসছে শহরগুলোর ৭/১০ তলার অনেক বাসিন্দা। বাইক চালিয়ে আবার ছুট দিয়েছে ডেলিভারি বয়। পেটে নিয়ে খিদে, পিঠে নিয়ে খাবার - ১২/১৪ ঘন্টা রাস্তায় ঘুরেও ৩০০ টাকা আয় নেই। মনে পড়ছে ১৯৪৭ সালে সুকান্ত ভট্টাচার্য্য-র লেখা ছাড়পত্র গ্রন্থের রাণার কবিতার সেই পঙক্তি - পিঠেতে আছে যে টাকার বোঝা, তবু সে টাকা যে যাবে না ছোঁয়া। সেই রাণার আজও ছুটছে ক্ষুধায় ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে। This image has an empty alt attribute মিল পাচ্ছেন? স্পাইস, এঞ্জেলস, রানার, জামলা, ছবু, ডেলিভারি বয়। শুধু ফ্রেম গুলো সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায়। চেহারা একই। মিলছে না - সেই হে মার্কেট বিচার, হরিয়ানার সুজুকি মামলার বিচার? মিলছে না হার্লেম পয়েন্ট বা জাতীয় সড়কের ধারে পড়ে থাকা লাশের মুখ আর মুখোশের পেছনে লুকিয়ে রাখা শাসকের মুখগুলো? স্পাইস-এঞ্জেলেসরা বলেছিলেন শুধু ৮ঘন্টা লড়াইয়ের দাবীর মধ্যেই শ্রমিকদের আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। প্রয়োজন যারা এই অমানবিক ব্যবস্থা কায়েম করেছে, তাদের উচ্ছেদ করা। একমাত্র এর মধ্যে দিয়েই কেবল ৮ ঘন্টা কাজের দাবীই নয়, শ্রমিকদের জীবনের যাবতীয় দুর্দশার নিরসন করা সম্ভব। This image has an empty alt attribute সে লড়াই দীর্ঘস্থায়ী। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে, এক এক করে দাবী ছিনিয়ে নিতে হয়। ছিনিয়ে আনা দাবীগুলো যাতে রক্ষা করা যায় তার লড়াই লড়তে হয়। This image has an empty alt attribute এই লড়াইতে স্পাইস, ফিশার, এঞ্জেলস, সুজুকির শ্রমিক নেতা, জামলা বা ছবুরা সাময়িকভাবে হারলেও, লড়াই থেমে যায় না। একটা হার আর এক একটা লড়াইয়ের ভিত্তিভূমি তৈরী করে। স্পার্টাকাসও সেই লড়াইতে জিততে পারে নি। কিন্তু যারা স্পার্টাকাসকে হারিয়েছিল, তারাও দাস সমাজব্যবস্থা হাজারো অত্যাচারেও টিকিয়ে রাখতে পারেনি। ভেঙেছে, ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এটাই কালের নিয়ম, ইতিহাস-সমাজ-অর্থনীতি এই নিয়মেই চলে। চাইলেও ইতিহাসের চাকা কেউ উল্টো পথে ঘোরাতে পারে না। হয়ত কিছু সময়ের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে পারে।  এই অবশ্যম্ভাবী নিয়মকে ভরসা করেই বোধহয় রবি ঠাকুর বলেছিলেন - বিধির বাঁধন কাটবি তোরা কি এমন শক্তিমান ? This image has an empty alt attribute
শেয়ার করুন

উত্তর দিন